– এই যে মিস্টার খ্যাতুস! উঠেন! ম্যালা বেজে গেছে!
– উম?
– উঠেন! চোখ খুলেন! না হলে কিন্তু চোখের পাতায় ফেভিকল মেরে দিবো!
মিটমিট করে চোখ খুললো নুর! হাতড়ে হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা হাতে নিলো। একটা বাটনে টিপ দিলো, মোবাইলের আলোতেই যেন নুরের চোখ ঝলসে গেলো এই অন্ধকারে! কিছু একটা দেখে মোবাইলটা বুকের উপর রেখে বললো,
– সামিয়া!
– জী মি. খ্যাতুস!
– আমার মনে হয় এখনো সুর্য লেপের তলা থেকে বের হয় নি,
– হ্যা হয় নি তো!
– তো আমায় কেন লেপের তলা থেকে বের করার মত নির্দয় আচরন দেখাচ্ছো?
– ওই ওই ওই….
– কি কি?
– কাল কি কথা দিছিলা?
– কথা দিছি? কালকে?
– ওরে আমার ভুলোমনা খ্যাতুস টা রে! কাল বলছিলা আমার সাথে নামাজ পরা শুরু করবে!
– ওহ হো! তাই তো গো…
– উঠো উঠো…
– আজকে না পরলে হয় না?
– আজকে শুয়ে না থাকলে চলে না??
নুরের কিছুই করার থাকেনা! সামিয়া ওকে সব সময় শাষন করে। এটা ভালোবাসার শাষন, কোন অন্যায় শাষন নয়। নুর ও প্রচন্ড উপভোগ করে এটা। বিয়েও করেছে বেশিদিন হয় নি। খাঁটি এরেঞ্জ ম্যারেজ যাকে বলা হয়। একটু একটু করে যতই সামিয়াকে দেখছে বুঝছে, ততই তার প্রেমে পরে যাচ্ছে নুর। নুর কে সামিয়া খ্যাতুস বলে ডাকে তার নামের জন্য নয়! বরং এই নামটা সামিয়ার অনেক প্রিয়। কিন্তু নুর ছেলেটা কেমন জানি ভুলোমনা আর হাবাগোবা টাইপের! এমন ছেলেদের শাষন করেও মজা আছে। সেই রোমান্টিক শাষন টাই করে সামিয়া!
– মি. খ্যাতুস!
– জী মিসেস খ্যাতুস!
– ওই আমারে খ্যাতুস বলবা না! আমি তোমার মত ভুলোমনা না!
– আমি খ্যাতুস, এবং তুমি আমার বউ! তাহলে তুমি মিসেস খ্যাতুস ই তো হচ্ছো!
– নাহ! আমাকে ওই নামে ডাকবা না। এখন একটু এদিকে আসো!
– হুম ..কি রান্না হচ্ছে শুনি?
– এই তো ডিম ভাজি!
– হুম! এই বাটিতে এই কিম্ভুতকিমাকার, ষড়ভুজ, ত্রিভুজ ওই তো একটা চতুর্ভুজ ও আছে দেখছি…এই বস্তু গুলা কি গো? ম্যাথম্যাটিকাল এক্সপেরিমেন্ট করছো নাকি?
– ওওও….ওগুলা তো রুটি (লজ্জিত স্বরে নিচু গলায় বলে সামিয়া)
– রুটি? হাহাহাহাহাহা (ঘর কাঁপিয়ে হাসে নুর)
– এই একদম হাসবা না বলে দিলাম। আজীবন তো মায়ের হাতের গোলাকার একঘেয়ে আকৃতির রুটি খেয়ে এসেছো, এখন থেকে বিশিষ্ট আনাড়ি রন্ধনশিল্পী সামিয়ার বানানো ম্যাথম্যাটিকাল রুটি খাবা!
– হাহাহা….
– হাসবানা! এখন এদিকে এসে হেল্প করো!
– হুম! ডিম ভাজি করছো তো!
– আমি বুঝতেছিনা এটাতে কয় চিমটি লবন দিবো! যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে তো খেতে পারবা না!
– সামান্য একটু দাও!
– না! আমার ভয় লাগছে! বেশি পরে যাবে হয়তো!
– তাহলে দাও! আমিই লবন দিচ্ছি!
– আচ্ছা এক কাজ করি। ডিমে লবন না হয় নাই দিলাম। তুমি খাওয়ার সময় রুটিতে লবন মেখে খাইয়ো!
– এএ…রন্ধন শিল্পী সামিয়ার কি এটা উদ্ভাবিত নতুন খাওয়ার স্টাইল নাকি?
– হ্যা! এটা নিউ স্টাইল। তোমার মত খ্যাতুস কে এভাবেই আমি স্টাইলিশ বানাবো!
– হেহেহে! আচ্ছা মিসেস খ্যাতুস!
– এই! আবার আমারে ওই নামে ডাকলা?
আজ অফিস থেকে দুপুরে তারাতারি আসতে হয়েছে নুর কে! কারন সামিয়ার হুকুম তাই! তাকে নাকি সামিয়া আজ তার হাতের স্পেশাল রান্না খাওয়াবে! খাবার টেবিলে বসলো নুর। একে একে সামিয়া তরকারির বাটি আনতে লাগলো। সব শেষে ভাতের বাটি আনলো! নুর খাবার দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতেছে না। ঝোলের তরকারি হলুদে হলুদময়! বেগুনের চপ পুড়ে নিগ্রো হয়ে গেছে, পটল ভাজি তে পটল গুলা সাদা সাদাই রয়ে গেছে, ডালের ভেতর তেজপাতা আর ভাত একদম ল্যাকট! নিশ্চিত পানি বেশি দিয়ে ফেলেছিল সে। কিন্তু নুর অন্য যাই হোক এরকম ভাত একদমই খেতে পারে না! নুর এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর ওদিকে সামিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার এমন মুখ দেখে মায়াই লাগলো নুরের। সে অন্যরকম এক ভাব নিয়ে বললো,
– সামিয়া! জলদি খাবার বেড়ে দাও! প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে!
– তুমি হাত ধুয়ে নাও! আমি প্লেটে বেড়ে দিচ্ছি! (সামিয়া আগ্রহী একটা ভাব নিয়ে বলে)
নুরের এই ভাত খেতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও খাচ্ছে। তার পাশে সামিয়া বসে নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে নুরের খাওয়া দেখছে। হয়তো বাঙালী মেয়েদের এখানেই তৃপ্তি যে নিজের হাতের রান্না স্বামী কে আয়েশ করে খেতে দেখবে। নুর আরেকটু ভাত নেয়, তরকারি নেয়, পটল ভাজি নেয়, এক চামচ ডালও নেয় আর ওদিকে সামিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়! নুর ঠিক বুঝছে না এই খাবারের প্রশংসা করা ঠিক হবে কিনা! কারন সামিয়া নিজেও জানে এটা কেমন রান্না হয়েছে। প্রশংসা না করে চুপ থাকাও মুশকিল! আর তো দুর্নাম করার প্রশ্নই আসেনা! সে একরকম উভয় সংকটে পরেছে! রাতের বেলা,
– সামিয়া দেখো তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি!
– কই কি এনেছো?
– প্যাকেট খুলেই দেখো না!!
সামিয়া বাক্সটা খুলতে শুরু করে। নুর উত্তেজিত হয়ে পরে মনে মনে। নিশ্চিত সামিয়া অনেক খুশি হবে!
সামিয়া বাক্সটা খুলে জিনিসটা বের করে। কিছুক্ষন জিনিসটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর “তুমি একটু ওয়েট করো আমি আসছি” বলে ভেতরের ঘরে এলোমেলো হয়ে হাটা দেয় সে।
নুর বুঝেনা সামিয়া ঠিক খুশি হলো নাকি রাগ করলো। কারন সে রাইস কুকার এনেছে সামিয়ার জন্য। ইলেক্ট্রিসিটির সাহায্যে এটাতেই সুন্দর ভাত রান্না করা যায়। সে ভাবছে এতে অন্তত সামিয়ার একটু কষ্ট লাঘব হবে। আর সেও এই পানি বেশি হওয়া ভাত খেতে পারেনা। সে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। দেখে সামিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটু পর পর সামিয়ার দেহটা কেঁপে উঠছে! সে কি কাঁদছে?? নুর সামনে গিয়ে দেখে সামিয়ার চোখে জল! সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। ফিসফিস করে বলে,
– সামিয়া! সরি! আমি ঠিক বুঝিনাই!
– তুমি জানো! এই বিয়েটা আমাকে হুট করেই দেয়া হয়েছে?
নুর সামিয়ার কথা শুনে কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। এরকম ভাবে তো সে আগে কথা বলেনি!
– ইয়ে! না তো!
– আমি বাবা-মার আদরের মেয়ে ছিলাম। কখনো একটা কাজ নিজ হাতে করিনি। তাই কিছু শিখতেও পারিনি। (সামিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে)
– ইয়ে সামিয়া! আমি সরি…
– প্রত্যেক বাঙালী মেয়েরই স্বপ্ন থাকে তার স্বামীকে তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখা, নিজের রান্নার প্রশংসা শুনা! এই বিয়েটা হুট করে না হলে আমি আম্মুর কাছ থেকে রান্নাটা শিখে নিতে পারতাম। কিন্তু পারিনি!
– তুমি তো খারাপ রান্না করো না!
– মিথ্যা বলবানা নুর! তোমার খাবার সময় আমি তোমাকে দেখেছি। মুখে সন্তুষ্টির ভাব আনো যাতে আমি রাগ না করি কিন্তু মনে মনে ঠিকই খাবার গিলতে পারো না। আমি তোমায় পড়তে পারি নুর।
– ইয়ে….
– বিয়ের পরের কয়টা দিন লুকিয়ে লুকিয়ে রান্না করার বই পড়েছি। লজ্জায় তোমার কাজের খালার কাছে বলতে পারিনি আমাকে রান্না শিখাতে। তুমি জানো যে কাজের খালা অসুস্থ! কিন্তু না! আমি তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় করেছি শুধু নিজ হাতের রান্না তোমায় খাওয়াবো বলে!!
– আচ্ছা বাদ দাও না এসব!
– ভাবছিলাম এভাবেই হয়তো রান্নাটা শিখে যাবো। কিন্তু তুমি আজ আমাকে রাইস কুকার দিলে ভাত রান্না ঠিকমতো করার জন্য। এভাবে আমার অপারগতা টা দেখিয়ে দিলে? তুমি আমাকে মুখে বলতে পারতা! কাজের খালাটা কে আবার আসতে বলতাম!
– আসলে ভাবছিলাম এটা হলে তোমার কাজ টা আরও সহজ হয়ে যেত। কষ্ট কম হতো। নুর অপরাধীর মত দাড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কত বড় না জানি অপরাধ করে ফেলেছে! এবার নুরকে দেখেই সামিয়ার মায়া লাগছে!
– এই তুমি এভাবে ঘামছো কেন শীতের ভেতর?
– কই? না তো! ইয়ে….
সামিয়া এবার নুরের কাছে যায়। বাঙালী বউদের মত নুরের মুখের ঘাম আচল দিয়ে মুছে দেয়। নুর অবাক চোখে সামিয়ার দিকে তাকায়। সামিয়া আস্তে আস্তে বলে,
– তুমি এত খ্যাতুস কেন গো? আমার মন বুঝোনা!! হুট করে সতীন ঘরে আনলা!
– সতীন?? আর হুম, এখন থেকে বুঝবো! বুঝতেই হবে আমাকে!
– সতীন ই তো। রাইস কুকারটা। আমার কাজের ভাগ নিতে চায়। যে প্রশংসা টা আমি ভাল ভাত রান্না করে পাবো সেটা এই রাইস কুকার দিয়ে রান্না করলে কি পেতাম?
– ওহ! তাই তো! সতীন টাকে কালই বিদেয় করবো!
– আর আমাকেও মিসেস খ্যাতুস বলেই ডাকবা বুঝছো। যেহেতু রান্না পারিনা আর তোমার মুখ থেকে এটা শুনতে খুব ভাল লাগে। আমি তো মেকি রাগ দেখাই যাতে এই ডাকটা বার বার শুনতে পাই! কিন্তু তুমি এত খ্যাতুসের খ্যাতুস যে তাও বুঝো না!
– কি করবো বলো? আমি যে আজন্ম মি. খ্যাতুস! হাহাহা!
– আমার হাতে পরেছো না? আমিই তোমাকে খ্যাতুস থেকে স্মার্টুস বানাবো!
– তা তো বুঝতেই পারছি!
– একটা কথা বলি লজ্জার মাথা খেয়ে?
– লজ্জার মাথা কেন? পারলে পুরাটা খেয়েই বলো!
– আমরা দশটা বাবু নিবো কেমন?
– ও বাবা! এত কেন?
– আমার ইচ্ছা তাই!
– এত বাচ্চা নিয়ে কি করবা?
-কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলবো! তোমার কোন প্রবলেম?
– হাহাহাহা! না কোন প্রবলেম নাই, হাহাহাহা….
আরও কিছু কথা ওদের ভেতর হয়। কিছুটা মুখে, কিছুটা মনে বাকি টুকু চোখে চোখে!