মিতুর কল৷ আমার মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো৷ আমি জানি ফোন ধরলেই, মিতু আমাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়বে৷
ঐদিকে ছোট বোন মিথিলা আধ ঘন্টা পর পর বেহুশ হচ্ছে৷ এই নিয়ে আব্বার প্রচুর টেনশন৷ আমি রুম বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছি৷ মিনিট পাঁচেক আগে মিথিলার রুমে একবার উখি মেরে এসেছি৷ আব্বার সাথে চোখাচোখি হল একবার৷ এদিকে আম্মা আমার জন্য যত্ন করে বিরিয়ানী বানাচ্ছে৷ বিরিয়ানীর সুগন্ধে অনেকটা সুস্থতা বোধ করছি আমি৷ সাথে মিতু যতবার কল দিচ্ছে৷ ঠিক ততবার আমার ভেতরে একটু ভালো লাগা কাজ করছে৷
মিথিলার বেহুশ হওয়া নিয়ে আমি কিংবা আম্মা একটুও চিন্তিত নয়৷ এটা কিছুদিন পর পরই হয়ে থাকে৷ যখনই তার টাকার দরকার পরে৷ কিংবা পরীক্ষার রেজাল্টে ডাব্বা মেরে বসে৷ তখনই উনার এই বেহুশ রোগ হয়ে যায়৷ আব্বা শাসন করার বদলে উল্টো আদর যত্ন করে থাকেন৷ এবারের বেহুশ হওয়াতে একটু ভিন্নতা আছে৷ বেহুশ হওয়ার আগে আগে বোনটা আমার চিৎকার দিয়ে উঠছে৷ যদিও আমি এই বুদ্ধিটাও ধরে ফেলেছি৷ ঘটনাটা সপ্তাহখানেক আগের৷ মিতুর সাথে আমার তুমুলভাবে ঝগড়া হলো একটা৷ আমার মতো কেয়ারলেস প্রেমিক মিতু আর সহ্য করতে পারছেনা৷ ঝগড়া শেষে হনহন করে বাড়ির পথ ধরেছিল মেয়েটা৷
কয়েকটা রাত আমি ভালোভাবে ঘুমোতে পারবো বলে মনে মনে খুশি হয়েছি বটে৷ তবুও প্রেমিক হিসেবে একটা ফর্মালিটি রয়ে যায়৷ সেই হিসেবে আমি সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করলাম৷ যদিও আমার অভ্যাস নেই একদমই৷ তবুও আমার সিগিরেট খেতেই হবে৷ মিতুকে বোঝাতে হবে বিরহের আগুনে পুড়ছে আমার ভেতরটা৷ প্রথম সিগারেট ধরাতেই কাশাকাশিতে নাজেহাল অবস্থা৷ পরক্ষণে মনে পরলো, এতো কষ্ট করে সিগারেট খাওয়ার অর্থ নেই৷
আমি বরং মিতুর ছোট ভাইয়ের কোচিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবো৷ দু’একটা মাটি কাঁপানো কাশি দিবো৷ তারপর মিতুর চশমা দেয়া হ্যাবলা ভাইটা মিতুকে গিয়ে বলবে হয়তো, আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি মিতুর জন্য৷”
পরিকল্পণা মোতাবেক শালাবাবুর কোচিংয়ের সামনে সিগারেট টানলাম৷ ভয়ংকর রকমের দু’একটা কাশি দিলাম৷
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে মিথিলার মুখোমুখি হলাম একবার৷ তার মুখে রহস্যময়ী হাসি৷ এমন হাসি সে যত্রতত্র দেয় না৷ আমাকে বাঁশ দেয়ার কোনো ফন্দি পেলেই মূলত পূর্বসংকেত হিসেবে হাসিটা দিয়ে থাকে৷ তবুও আমি মাথায় নিলাম না৷ সন্ধ্যা পেরোতেই আব্বার রুমে ডাক৷ তারপর দরজাটা বন্ধ হলো৷ নতুন বানানো বিছিনার ঝাড়ুটা আমার পিঠের উপরেই চিন্নবিচ্ছিন্ন হলো৷ প্রথমে লাল তারপর কালো দাগ পরে গেল৷ আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেলাম৷ আম্মা সারারাত শুশ্রুষা করলো আমার৷ আমার রাগ লাগছে খুব৷ সকালে ঘুম ভাঙতেই আমি দোটানা নয় তিনটানায় পরে গেলাম৷ ছোটবোনের উপর রাগবো, নাকি মিতুর ভাই অথবা মিতু!”
টানা ছ’দিন বিছানার সাথে লেপ্টে ছিলাম৷ আম্মা একদম ১বছরের বাচ্চার মতো যত্ন করেছে৷ আব্বা আর ছুটকির সাথে আমি আর আম্মা কথা বলছিনা আপাতত৷ রান্নাটাও আলাদা চলছে৷ আম্মা কখনো বিরিয়ানী বানাচ্ছেন আবার কখনো ফুচকা কিংবা চটপটি৷ আর বিরোধী দলে কখনো তরকারীতে লবণ বেশি কিংবা পোড়া ভাত গিলতে হচ্ছে৷
শালাবাবুর কোচিংয়ের সামনে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ৷ খানিক বাদে রাজপুত্র বেরিয়ে আসলেন৷ আমি কাছে ডেকে কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কাজটা ঠিক হল শালাবাবু?
-কোন কাজটা?
-এই যে আমার সিগারেট টানার ছবিটা তোমার বোনকে না দিয়ে আমার বোনকে দিলে কেন?” শালাবাবু এবার লজ্জারাঙা মুখ নিয়ে বলল,
-আসলে..
-আসলে কী?
-আমার ভালো লাগে আপনার বোন কে!”
এহেন কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হলো হুট করে৷ ভাবলাম মাথায় তুলে আছাড় মারলে কেমন হয়! পরক্ষণেই শালাবাবুর ছোট খাটো টাইপের হস্তির সমান শরীরটার দিকে নজর গেল৷ তারপর মনে পরলো ছুটকির কথা! না ও তো আমার বোন না৷” মেজাজটা ঠান্ডা রাখলাম৷ শালাবাবুর কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
-তারপর?
-সেই হিসেবেতো আমার দায়িত্ব আছে একটা তাই না?
-হু৷
-তাই সরলমনে ছবিটা দিয়েছি৷”
যদিও শালাবাবুর দুইগাল লাল করে দেয়া উচিত এই মূহূর্তে৷ আমি আরেকবার রাগ সামাল দিলাম৷ চড়ের বদলে জড়িয়ে ধরলাম ছেলেটাকে৷ তারপর বললাম,
-আমার বোনকে পেতে গেলে পরীক্ষা দেয়া লাগবে!
-আমি সব করতে রাজি আছি!”
কনফিডেন্স দেখে ভড়কে গেলাম৷ আমার মনে পরলো শালাবাবু সাঁতার জানেনা! প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো মনের ভেতর৷ এক ঢিলে তিন পাখি মেরে বসবো আমি৷ মনের ভেতর শিকারি শিকারি ভাব চলে এসেছে৷”
শালাবাবুকে পুকুরে নামিয়ে দিলাম৷ মিনিট দশেক নাহু নাহু করে নেমেছিল পানিতে৷ বেচারির পেটটা একটু নাদুসনুদুস ছিল৷ পানি গিলে অবস্থা আরো বেগতিক হয়েছে৷ মরে গেলে আবার ফেসে যাবো৷ নাক মুখ লাল হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে৷ নিজ দায়িত্বে বাসায় পোঁছে দিয়ে এসেছি৷ মিতুর সাথে আমার দেখা হলো সেই সুযোগে একবার৷ ভাবলাম আমাকে দেখে হয়তো কেঁদে দিবে৷ আমার ভাবনায় পানি ঢেলে উল্টো ভেংচি কাটলো৷ নিজের ভাইয়ের তাকিয়ে আকাশ থেকে পরলো৷ রাগি দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে৷ আমার মেজাজটা আরেকটু খারাপ হলো৷ শালাবাবুর কানে ফিসফিস করে বললাম, সত্য বললে খবর আছে বুঝলি! যত পারবি আমার নামে গুণ গাইবি বুঝেছো?” জবাবে শালাবাবু মাথা নাড়লো৷”
প্রতিশোধের পর্ব শেষ করে বুক ফুলিয়ে বাসায় ফিরছিলাম৷ মাঝপথে আব্বার সাথে দেখা হলো৷ মূহূর্তেই অসুস্থশিল্পী আনোয়ার হোসেন স্যারের মতো ভং ধরে ফেললাম৷ আম্মার হাতের যত্ন করা রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টেরই পাইনি৷ ঘুম ভাঙার পর থেকে মিথিলার বেহুশ নাটকের পর্ব দেখেই চলেছি৷ ঐদিকে ফোনটা বেজে চলেছে৷ বারবার ভেসে উঠছে মিতুর নামটা৷ আর আমার মুখে ফুটে উঠছে পৈশাচিক হাসি৷ হুট করে মিতুর কল আসা বন্ধ হলো৷ ভেসে উঠলো শালাবাবু নামে সেইভ করা নাম্বারটা৷ এবার ফোনটা তুললাম৷ শালাবাবু ওপাশ থেকে মিনমিন করে বলল,
-ভাই আমি কী পাশ করেছি?
-যদি বলি না!
-আমার বোনকে পেতে গেলেও পরীক্ষা দেয়া লাগবে!” আমার গলাটা আটকে গেল৷ আমি জানি এগুলো মিতুর কাজ৷ এই নাদুসনুদুস ছেলেটা এসব করতে পারেনা কিছুতেই৷ আমি এবার হো হো করে হেসে দিয়ে বললাম,
-ধুর বোকা ছেলে৷ শালা-দুলাভাইয়ের মশকারা বুঝোনা তুমি!” খানিক বাদে ছুটকি এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো৷ এখন ভাই-বোন বসে আইসক্রিম খাচ্ছি৷ একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছি৷ আব্বাকেও খুশি দেখাচ্ছে৷ এতোদিন লবণ বেশি তরকারি আর পোড়া ভাত খেয়ে মানুষটা শুকিয়ে গিয়েছে৷ ঐদিকে মিতু তার ভাইয়ের সেবা শুশ্রুষা করে চলেছে৷ আমাকে বলেছে, দেখা হলে দেখে নিবে৷”