আমার মেয়ে নাঈমা আমার সামনে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বসে আছে। রাগে আমার ইচ্ছে করছে এখনই কষে দুচারটে চড় মারি। বহুকষ্টে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আমার পাশে বসে আছে আমার স্ত্রী নূরী। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। মেয়ের এমন আচরণে সেও লজ্জিত। কেননা মায়ের কাজ ঘরের পরিবেশ ঠিক রাখা। সে হয়তো এই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মনে মনে অনুতপ্ত।
অনেকক্ষণ ধরেই রুমটা জুড়ে নীরবতা পালন করছে। নীরবতা ভেঙে নাঈমা বলল, “বাবা ওর নাম রাশেদ। খুব ভালো ছাত্র। প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট বয় হয়ে আসছে। বর্তমানে বুয়েটে পড়ে। বুয়েট থেকে বের হলে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে যাবে।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলল। মনে হলো এতক্ষণ বসে কথাগুলো গুছিয়েছে। নাঈমা এক নজর আমার দিকে আরেক নজর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার বলল, “আমি ওকে খুব ভালোবাসি। রাশেদও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমরা চার বছর ধরে একসাথে চলছি। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব ভালো। প্লিজ বাবা মেনে নাও ওকে।”
নাঈমার কথাগুলো শুনে পরিবেশটা কেমন যেন বদলে গেল। মুহূর্তেই চারপাশটা অতীতে পরিবর্তন হয়ে গেল। বর্তমানে আমার সামনে বসে আছেন জনাব এমদাদ আহমেদ, নূরীর বাবা। তার পাশেই আছেন নূরীর মা সায়রা বেগম। রুমের পাসগে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নূরী। সময়টা তৎকালীন যখন আমার ও নূরীর মাঝে ভালোবাসা চলছিল। কিন্তু গতকাল নূরীর বাবা আমাদের দেখে ফেলেন। তাই আজ আমাকে ঘরে ডেকেছেন।
রাতের নূরী অনেক বুঝিয়েছে যে আমি ওকে খুব ভালোবাসি। সেও আমাকে খুব ভালবাসে। আমরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচবো না। কিন্তু নূরীর বাবার একটাই প্রশ্ন, “ছেলের ভবিষ্যৎ কি?” নূরী আমার অতীতের উজ্জ্বল সময়ের কথা বলেছে। প্রতিটি ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম, তখন বিসিএস ক্যাডার করছিলাম। ভবিষ্যৎ ভালো হবে। কিন্তু নূরীর বাবার পাল্টা জবাব, আজকাল শত শত বিসিএস ক্যাডার রাস্তায় রাস্তায় বেকার ঘুরছে। সেদিন মনে মনে নূরীর বাবাকে অনেক গালি দিয়েছিলাম। পাষাণ, নির্দয়ী সহ আরো অনেক কিছুই বলেছিলাম। মুখে ছিল অনেক মহান বাণী। ভালোবাসা চাইলেই সব পারে, মানুষ ছোট থেকেই বড় হয়, সময় একদিন বদলাবে, টাকা পয়সা দিয়ে সুখ হয় না ব্লা ব্লা ব্লা অনেক জ্ঞানের কথা বলেছিলাম।
নাঈমার ডাকে আমি আবার বর্তমানে ফিরলাম। নাঈমা বলল, “বাবা, হয়তো তুমি আমার বিয়ে কোনো ধনী ছেলের সাথে দিতে পারবে। কিন্তু আমি ওখানে সুখী হবো না। টাকা দিয়ে সুখ পাওয়া যায় না, বাবা। বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা।” চোখের জল নিয়ে নাঈমা উঠে চলে গেল। আমিও রাশেদকে বিদায় করলাম। তারপর নূরীর মুখোমুখি হয়ে বললাম, “আমরা যা করেছি তা ভুল ছিল। সত্যিই বড্ড ভুল ছিল। তোমাকে নিয়ে পালিয়ে আসা উচিত হয়নি। সেদিন বয়ফ্রেন্ড হিসেবে আমার জ্ঞানী কথাগুলো বলতে আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু আজ বাবা হিসেবে সেই কথাগুলো শুনে আমারই খুব খারাপ লাগছে। তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাকে নিয়ে এসে আমি বড্ড ভুল করেছি। পাপ করেছি। উনি উনার স্থানে ঠিক ছিলেন। ভুল আমরাই ছিলাম।
আজ আমি এই ভুলের ভার নিতে পারছি না।” নূরীর চোখে পানি। আমার চোখেও পানি। আমি নিজের চোখের পানি মুছে আরও বলতে লাগলাম, “আজ যদি আমরা রাজি না হই। তবে ওরা পালিয়ে যাবে। আমার এতদিনে কষ্ট করা মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। লোকে আমার মুখে থুথু দিবে। সেদিন এমন অনুভূতি তোমার বাবারও হয়েছিল। আমাদের জন্য তারও মানহীন হয়েছিল। যা কিছুদিন পর আমার হবে। আমি এই অপমান সহ্য করতে পারবো না। কিন্তু কি করব? বাঁধা দিলে হয়তো নাঈমা আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে। আদুরে মেয়ের লাশ আমি নিজ চোখে দেখতে পারবো না।” কথাগুলো বলতে বলতে পাশে থাকা ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে নিজের পেটে গেথে দিলাম। একটা তীব্র চিত্কার বেরিয়ে এলো। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।
“বাপ্পী, বাপ্পী, এই বাপ্পী! কি হয়েছে? চিত্কার করলি কেন?” টিপটিপ করে আমি চোখ খুললাম। চোখ খুলে মাকে দেখতে পেয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। এতগুলো বছর পর মা কোত্থেকে এলেন? আমি তো সবকিছু ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাম। বাবা মা তখন পাশে না থাকায় আমিও আর তাদের সাথে যোগাযোগ করিনি। তবে আজ মা কিভাবে এলেন? এ কি বাবা ও ছোট বোনটাও দেখি এসেছে। ও এখনো ছোট কিভাবে? বাবাও সেই আগেরমত, মাও তো আগেরমত। এ কি আমি তো আমার রুমে। রুমটা একদম আগেরমত। আমি নিজেই আগেরমত।
সবকিছুই তো আগেরমত। তাহলে এতক্ষণ ধরে কী আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? হ্যাঁ তবে স্বপ্নই দেখছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর দুঃস্বপ্ন বলে আমি বাবা মাকে শান্ত করে তাদের রুমে পাঠিয়ে দিলাম। সকাল হতেই নূরীকে জানিয়ে দিলাম তাকে নিয়ে পালানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আগে প্রতিষ্ঠিত হব। তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ে করব। নয়তো বাস্তবতা মেনে যে যার যার পথে হাঁটবো। এতে হয়তো আমরা দুজনে কষ্ট পাব। তবুও আমাদের দুই পরিবার তো সুখে থাকবে। অনেকের কষ্টের চেয়ে দুজনের কষ্টই উত্তম। নূরী হয়তো আমাকে বেঈমান ও প্রতারক ভাববে। কিন্তু এছাড়া কিছু করার নেই। যা এখন বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ঠিক লাগছে। তা এক সময় বাবা হিসেবে ভুল লাগবে। যৌবনে যে কাজগুলো ঠিক লাগে, বয়স্ক হলে সে কাজগুলোই পীড়া দিবে।