ক্যাম্পাসের প্রথম দিন, ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, এরমধ্যে সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটা ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে সোমালির। রীতিমতো রাগী চেহারা নিয়ে তাকায় তার দিকে, কিছু বলতে গিয়েও বলে না, রাগে গজগজ করতে করতে উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। ছেলেটা তেমন কিছু মনে করে না, হতেই পারে তাড়াতাড়ি চলতে গেলে। ক্যাম্পাসে আসলে সিনিয়ররা জুনিয়রদের নিয়ে বসে, আর সোমালিদের ব্যাচ যেহেতু নতুন তাই তাদের ডাক পড়ে। লাঞ্চ ব্রেকে একটা ক্লাসরুমে সবাই বসে আছে সিনিয়রদের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পরে নেতা টাইপের কিছু সিনিয়র ভাই-আপুরা আসে। এপর্যন্ত ঠিক ছিলো, কিছুক্ষণ পর সেই ছেলে প্রবেশ করে যার সাথে সোমালির ধাক্কা লাগে সকালে।
সোমালি যেন জিহবায় কামড় খায়, তবে কি এ সিনিয়র? তবে তো অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে সে। সব ভাই আপুরা নিজেদের পরিচয় আর ব্যাচ বলে জুনিয়রদের সাথে পরিচিত হয়। জুনিয়রেরা এক এক করে তাদের পরিচয় দেয়। সোমালি ছেলেটার পরিচয় পায়, নাম রাফসান, তার দুই ব্যাচ উপরে। নাহ, ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত মন শান্ত হচ্ছে না সোমালির। বিকেলে ক্লাস শেষের পর অনেকক্ষন অপেক্ষা করে সোমালি, পরে দেখে রাফসান বাসে উঠার জন্য বাসের দিকে যাচ্ছে। এতদূর থেকে ডাক দেয়া ঠিক হবে না, আবার যেতে যেতে সে চলে যাবে, কিন্তু ক্ষমা তো চাইতেই হবে। সেদিন আর ক্ষমা চাওয়া হয় না। পরের দিন এসে দেখে ক্লাস না থাকায় রাফসান আসে নি, মনের মধ্যে খুতখুতে ভাব থেকেই যায় তারপরের দিন রাফসানের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে সোমালির ক্লাস মিস হয়।
– ভাইয়া
– জ্বি, আমাকে বলছো?
– মানে শুরুর দিনে আপনার সাথে ধাক্কা লেগেছিলো মনে আছে?
– হবে হয়তো!
– তার জন্য সরি!
– ওহ ব্যাপার না! আমি কিছু মনে করি নি!
– ধন্যবাদ ভাইয়া!
– হুম।
রাফসান তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলো। সোমালি কিছুটা অবাক হয় এমন ভাব দেখে। সিনিয়র মানুষ, হতেই পারে ভাব বেশি। এর মধ্যে সোমালিদের রিসিপশনের দিন ঠিক হয়, সোমালি বেশ কিছু বন্ধুও বানিয়ে ফেলেছে। রিসিপশনে কে কি করবে ভাবতে থাকে, পরে জানা যায় সিনিয়রেরা যা বলবে তাৎক্ষণিক সেটা করতে হবে। সবাই কিছুটা চিন্তিত ও ভয়ে থাকে। সবাই টুকটাক গান কবিতা নাচ চর্চা করে। সোমালি গান পারে, নাচ তেমন পারে না। তাও যাই হোক, নানা ভাবনা চিন্তায় দিন পার হলো।
রিসিপশনের দিন সবাই এলো। সোমালি পড়েছিলো ময়ুরকন্ঠী রঙের শাড়ি, বেশ সুন্দর লাগছে। রাফসান পড়েছে কালচে জিন্স আর নীলাভ টিশার্ট। জুনিয়রদের লটারির মাধ্যমে বিবেচনা করা হবে কে কি করবে। কারো ভাগ্যে পড়েছে নাচ, কারো গান, কারো কবিতা বা কৌতুক। কারো ভাগ্যে পড়েছে সিনিয়রদের প্রপোজ করা, তবে কাকে প্রপোজ করবে সেটা নিজের ইচ্ছা। সোমালি চেয়েছিলো তার ভাগ্যে এটা পড়ুক, কিন্তু না, তার বান্ধবী রক্সির ভাগ্যে পড়ে এটা, আর কাকতালীয় ভাবে রক্সি রাফসানকেই প্রপোজ করে। সোমালির ভাগ্যে পড়ে অন্য এক সিনিয়রের সাথে গান গাইতে হবে। সোমালির রাগে কষ্টে কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছিলো। ও বুঝতে পারছিলো হয়তো ও রাফসানকে পছন্দ করে। ওদিকে রক্সির প্রপোজটা সিরিয়াস ভাবে নিয়ে সবাই মজা করতে থাকে। সবাই বলে এবার রাফসানের গলায় ঘন্টা বাঁধা হলো।
অনুষ্ঠানের পর থেকে সোমালি মন মরা হয়ে থাকে। একদিন ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে দেখে ভার্সিটির কনফেশন পেজে ওর নামে কনফেশন এসেছে। পোস্ট পড়ে সোমালি মজা পেলেও ভাবতে থাকে কে লিখলো। কমেন্ট করে ” আপনি কে ভাইয়া? ” সেখানে দেখে রাফসান কমেন্ট করেছে, ” চালিয়ে যাও ভাই! ” সোমালি ভাবে তবে কি রাফসান জানে এ কে? এসব ভাবা বাদ দিয়ে সোমালি রাফসানকে কিছু লিখবে, তাই সুন্দর করে লিখতে বসে কনফেশন পেজের ইনবক্সে দেয়। যথারীতি সেটা পোস্ট হয়।
লেখা ছিলো, প্রিয় রাফসান, আপনাকে শুরুর দিন থেকেই ভয় ভয় লাগতো, এরপর মায়া জন্মায়। জানিনা কবে আপনার হাসির মোহে পড়ে গেছি। রিসিপশনের দিন আপনাকে একটা মেয়ে প্রপোজ করে, আমার সেটা আমার মোটেও ভালো লাগে নি। আচ্ছা আপনি কি সত্যিই তার সাথে রিলেশনশিপ গেছেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কমেন্ট করে জানিয়ে দেবেন প্লিজ। ” রাফসানের বন্ধুরা সেখানে মজা করতে থাকে। কেউ বলে ” দোস্ত ভাবি পাইছি, ট্রিট দেও “, কেউ বলে, ” এই মেয়েকে খুঁজে বের করতে হবে “, আবার কেউ বলে, ” রাফসানের কি ভাগ্য যে কনফেশন এসেছে। সেখানে রক্সির কমেন্ট ছিলো জ্বালাময়ী, ” দেখেছেন, আমি প্রপোজ করেছি বলেই কত মেয়ের চোখে পড়েছেন, আমাকে ট্রিট দেন স্পেশাল।
এটা দেখার পর রাগে সোমালির শরীর জ্বলতে থাকে। ইতিমধ্যেই সোমালি এক সিনিয়র আপুকে পটিয়ে ফেলেছে। তার থেকেই খবর পেয়েছে রাফসান কারো সাথে রিলেশনে নেই। সোমালি অনেক খুশি হয় এটা শুনে, তবে ভাবে আর দেরি করলে হবে না, মনের কথা জানাতে হবেই। এরমধ্যে পরিক্ষা চলে আসে, পরিক্ষার আগে পনেরো দিন বন্ধ, সোমালির সে কি কষ্ট, পনেরো দিন তাকে দেখতে পারবে না। তবুও নিজেকে স্বান্তনা দেয়, কিভাবে প্রপোজ করবে ভাবে, কি লিখবে ভাবে। প্ল্যান করে, খাতা নিবে তার কাছ থেকে, তা ফেরত দেয়ার সময় লাভ লেটার দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তবে কাজ করতে হয় পরিক্ষার মধ্যেই, তবে খাতা পায় নি, নোট চাইতে গিয়ে বই পায় রাফসানের কাছ থেকে। প্রথম পরিক্ষার দিন বই নেয়, দ্বিতীয় পরিক্ষার দিন বই ফেরত দেয়।
– পরে দিলেও হতো, পরিক্ষার মধ্যে এত ব্যস্ততা ছিলো না।
– তারপরেও ভাইয়া, আমি আবার কখন ভুলে যাই তারজন্য দিয়ে দিলাম।
– ওহ আচ্ছা, পরিক্ষা কেমন হয়েছে?
– একটা হলো কেবল!
– আমার দুইটা হয়েছে, আজ তিন নম্বর
(কথা বলতে বলতে রাফসানের হাত থেকে বই পড়ে যায়, আর চিঠি বেরিয়ে আসে। সোমালি এটা দেখেই দৌড় দেয়। রাফসান চিঠিটা নিয়ে খুলে দেখে, তারপর সোমালির যাবার পথে তাকিয়ে মুচকি হাসে।) পরের পরিক্ষাগুলোতে রাফসানের মুখোমুখি হয় নি সোমালি, রাফসান সেভাবে গায়ে লাগায় নি। পরিক্ষার পর আবার বন্ধ পনেরো দিন। এর মধ্যে রাফসান নিজে থেকে সোমালিকে ফেসবুকে মেসেজ দেয়।
– কি ব্যাপার, সেদিন ওভাবে দৌড় দিলে ক্যান?
– কই? ওহ এমনি! দেরি হয়ে যাচ্ছিলো!
– আমাকে ভূগোল পড়াও?
– এ মা, আমি না আপনার জুনিয়র? আপনাকে কিভাবে পড়াবো?
– এই যে পড়ালে! চিঠি দিলে!
– পড়েছেন?
– পড়লামই তো!
– এখন বলেন
– কি বলবো?
– চিঠিতে কিছু লিখছিলাম, তার উত্তর দেন!
– এভাবে দেয়া যাবে না
– কিভাবে দেবেন?
– কাল বা পরশু ফ্রি আছো?
– পরশু ফ্রি আছি
– বিকেল চারটায় রঙ্গন চত্ত্বরে আসতে পারবে?
– হুম, পারবো
– আচ্ছা এসো, সেখানেই বলবো!
– আচ্ছা
অজানা চিন্তায় সোমালির যেন দিন রাত কিছুই কাটছে না। কি হবে ভেবেই অস্থির। রাফসান কি রাজি হবে না কি রিজেক্ট করবে! রিজেক্ট করলে এভাবে ডাকবে ক্যান? তাইলে কি অপমান করবে? র্যাগ দিবে। অনেক ভয়, অনেক উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করে সোমালি। নির্দিষ্ট দিনে সোমালি খুব সুন্দর করে সেজে যায় রঙ্গন চত্ত্বরে। গিয়ে অনেক খুঁজে দেখে রাফসান একটা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে বসে আছে। সোমালির যেন কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। রাফসান ওকে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়,
– আরে সোমালি যে, কি খবর? এদিক এসো?
– হুম, আপনার কি খবর?
– ভালই, তা এখানে কি মনে করে?
– (সোমালির যেন রাফসানকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে, এই কি সেই রাফসান যার সাথে চ্যাটে কথা হয়েছিলো। তবে কি প্ল্যান করে এসব করা হচ্ছে)
– কি হলো চুপ যে?
– এ কে রাফা? (পাশের মেয়েটা বলে)
– আরে আমার জুনিয়র, সোমালি!
– হায় সোমালি, আমি রাফসানের স্ত্রী।
– (সোমালি যেন আকাশ থেকে পড়ে) ওহ, হায় ভাবি! এমনি ঘুরতে আসছিলাম।
– একা এসেছো? বয়ফ্রেন্ড আসে নি?
– নাহ নেই। (সোমালি চোখের জল লুকাতে গিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে) সোমালি চলে যাবার পর রাফসান পাশের মেয়েটাকে বলে,
– বেশিই হয়ে গেলো, এভাবে বলা ঠিক হয় নি
– কিভাবে বলতাম?
– জিএফ বললেও হতো!
– বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে কেমন লাগে এটাই দেখলাম আর কি!
– বসো, ওরে ডেকে আনি! ( রাফসান সোমালিকে ডাকতে যায়)
– আরে সোমালি দাঁড়াও
– (সোমালি কথা না শুনে চোখ মুছতে মুছতে হাঁটতে থাকে)
– আরে দাঁড়াও
– ছাড়ুন হাত, এভাবে অপমান না করলেও পারতেন।
– আরে কান্না করতেছো কেন?
– সরেন, আমি যাই।
– আরে আগে আসো আমার সাথে। (রাফসান হাত ধরে সোমালিকে সেই মেয়ের কাছে নিয়ে যায়)
– এ হচ্ছে ফারিয়া, আমার কাজিন
– হায়, সরি বেশি মজা করে ফেলেছি! রাফার কাছে তোমার কথা শুনেছি, আজ বললো দেখা করতে আসবে৷ তাই একটু মজা করতে আসলাম।
– না আপু, ঠিক আছে।
– নে রাফা, এবার প্রপোজ কর!
– আমি কেন করবো? সে করবে!
– আরে গাধা সে তো চিঠি দিয়েছে, তুই একসেপ্ট কর।
– ওহ তাই তো!
– কই সেই ফুলের তোড়া কই রাখছিস রাফা।
(বেঞ্চের পিছন থেকে ফুলের তোড়া বের করে সোমালিকে দিয়ে প্রপোজ একসেপ্ট করে রাফসান। রাফসানের কাজিন ফারিয়া ওদের বিদায় বলে চলে যায় নিজের গন্তব্যে)
– এভাবে কাঁদালেন ক্যান?
– তোমাকে সব রূপে দেখেছি কিন্তু কান্না রূপে দেখিনি, তাই দেখতে ইচ্ছে হলো।
– মজা পাইছেন? আমাকে কষ্ট দিয়ে?
– হুম খুব!
– একটা মাইর দেবো
– আমি তোমার সিনিয়র কিন্তু।
– তাতে কি? কষ্ট দিছেন তো।
– আচ্ছা সরি, চলো ফুচকা চটপটি খাই
– আচ্ছা চলেন। অতঃপর শুরু হলো আরেকটি ক্যাম্পাসিয়ান কাছে আসার গল্প।