আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে ছিলো,মৌলবি টাইপের,মেয়েটার মাঝে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব ছিলো,যেটা আমার খুব বিরক্ত লাগতো। অনার্স লাইফটা যেখানে আমরা সব ফ্রেন্ডরা এনজয় করে কাটাচ্ছি ওই মেয়েটাকে দেখতাম তখন চুপচাপ বসে থাকতো সামনে একটা বই নিয়ে।ক্লাসে স্যার আসতে দেরি হলে যেখানে হৈ-হুল্লোড় করে আমরা ছেলেমেয়ে সবাই মিলে আড্ডা দিতে ব্যস্ত ছিলাম সেখানে মেয়েটাকে দেখতাম মোবাইল নিয়ে বসে থাকতো।
মেয়েটাকে কেনো জানি আমার প্রথম থেকেই বিরক্তিকর লাগতো।হাতে পায়ে মোজা পরে,নেকাব লাগিয়ে মেয়েটা ক্লাস করতো,কখনো নেকাব খুলতো না ক্লাসে ইভেন কমনরুমে ও মেয়েদের সামনে নেকাব খুলতো না। আমার কাছে মেয়েটাকে ওভার স্মার্ট মনে হতো বা মাঝে মাঝে মনে হতো যে আটেনশান সিকার। মেয়েটার সাথে আমার কিসের এতো দ্বন্দ্ব ছিলো আমি জানি না। আমাদের হাফ ইয়ার্লি এক্সামের পর সেদিন ক্লাসে রাজিব স্যার জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের এখানে রোল ৬০৪ কার?
মেয়েটা উঠে দাড়ালো।
স্যারঃ তোমার নাম কি?
মেয়েটাঃ আয়েশা বিনতে আশরাফ।
স্যারঃ আমি কাল রাতে তোমাদের ইকোনমিকস খাতা দেখেছি,সবগুলো খাতার চাইতে তোমার খাতার প্রেজেন্টেশন আমার অনেক ভালো লেগেছে।তোমার লেখা ও অনেক সুন্দর যাকে বলে মুক্তার মতো অক্ষর, তুমি কি জানো সেটা??
আয়েশাঃ জ্বী স্যার,আমি স্কুল লাইফ থেকেই শুনে আসছি কথা টা।
স্যারঃ তুমি সবার চাইতে বেশী মার্কস পেয়েছো,তোমার খাতা আমি আজকে আমার সব ক্লাসে দেখিয়েছি স্টুডেন্ট দের,যাতে ফাইনাল এক্সামে সবাই তোমার মতো করে খাতা প্রেজেন্ট করে,আমরা স্যাররা খাতার সব লিখা পড়ি না,খাতার প্রেজেন্টেশনটা আগে দেখি,সেটা দেখেই স্টুডেন্ট দের মূল্যায়ন করা হয়। স্যার যখন আয়েশার খাতা সবাইকে দেখাচ্ছে আমার কেনো জানি হিংসা হচ্ছে,আমার মনে হচ্ছিলো এই মেয়ে না থাকলে স্যার আমার খাতায় সবাইকে দেখাতো আমার লিখাও তো অনেক সুন্দর। আয়েশার উপর আমার রাগ দিন দিন বাড়তেছে,ওরে একটা শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করতেছে।যদিও মেয়েটা জানে না আমি যে ওরে এতো অপছন্দ করি। মেয়েটা ক্লাসে কারো সাথেই খুব একটা কথা বলে না।
সেদিন ক্লাসের পরে শপিং মলে যাই ৩টা ফ্রেন্ড মিলে,আমি যাই একটা ড্রেস নিতে,আয়েশাও যায় দোকানে বোরকা নিতে।দোকানি ছেলেটা অনেকগুলো ড্রেস বের করে,আয়েশার জন্য বোরকা বের করে। দোকানী দের ট্রিকস হচ্ছে মানুষকে পাম্প দেয়া আমাকে একটা ড্রেস দেখিয়ে বললো ম্যাডাম,এই ড্রেসটা নেন,বিশ্বাস করেন আপনাকে হট লাগবে এটাতে,প্রাইস ও রিজনেবল,আমি জানি এই কথা ওনারা সবাইকে বলে,তবু আমি খুশি হয়ে উঠছিলাম শুনে,মনে হচ্ছে সত্যি আমাকে অনেক সুন্দর লাগবে।খুশিতে গদগদ হয়ে গেলাম আমি শুনে,ঠিক করলাম এটাই নিবো। জ্বী ভাইয়া,তাইলে প্যাক করে দেন ড্রেসটা।
আয়েশাকে বোরকা দিয়ে বললো আপু,এই যে নেন। আমি অবাক হলাম,লোকটা আমাকে ম্যাডাম বললো আর ওরে আপু,কাকে বেশি সম্মান দিলো?? হাফ ইয়ার্লি রেজাল্টে আয়েশা ১ম হলো, আর আমি ২য়। আমার চাইতে ৪৭ মার্কের ব্যবধানে ও ১ম হলো। রাগে আমার মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে। আমাকে ওর মতো হতেই হবে নিজের মধ্যে একটা জেদ চেপে যায়।কেনো যেনো রাগে ওরে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে ফেলি।আয়েশা আমার সব কথা চুপচাপ শুনে যায়,কিছুই বলে না। ওর মৌনতা আমার আরো রাগ বাড়ায়।
আমিঃ এরকম বোরকা,হাতে পায়ে মোজা সবাই লাগাতে পারে, এতে করে নিজেকে সস্তা প্রমাণ করা ছাড়া আর কিছুই হয় না,জানো তুমি সেটা??? তোমার তো এসব লোক দেখানো।
আয়েশাঃ তুমি পারবে ১০ দিন এরকম করে আসতে আমার মতো?? এই প্রথম আয়েশা জবাব দিলো আমার কথার।
আমিঃ ১০০ বার পারবো,এটা কোনো বিষয় হলো!!
আয়েশাঃ ঠিক আছে,চ্যালেঞ্জ ১০ দিনের। যদি তুমি জিতো তাইলে আমি কখনো তোমার চাইতে বেশি মার্কস পাওয়ার চেষ্টা করবো না। তোমার ১ম পজিশন কেড়ে নিবো না।
আমিঃ ঠিক আছে।
পরেরদিন সকালে বোরকা,নেকাব,হাতে পায়ে মোজা পরে বাসা থেকে বের হলাম,প্রতিদিনের মতো বাসে খুব ভীড় ছিলো, কিন্তু তারপরেও দেখলাম যে একটা লোক সীট থেকে উঠে আমাকে বসার জায়গা করে দিলো,যেখানে অন্যসব দিনে আমাকে দাড়িয়ে মানুষের সাথে ঠেলাঠেলি করে যেতে হয়। অথচ আজ এভাবে কেউ সীট ছেড়ে দিলো যা আমার জীবনের প্রথম।
স্টেশন থেকে ভার্সিটি ২ মিনিটের পথ,মোড়ের দোকানে কতোগুলো ছেলে বসে বসে সব সময় গান গাইতো মেয়েদের দেখলে,কার ফিগার কেমন সেটা নিয়ে নানান মন্তব্য করতো,তাই লজ্জায় মাথা নিচু করে ক্লাসে যেতে হতো,কিন্তু আজকে তেমন কিছু হলো না।ছেলেগুলো আজকে আমাকে একটা কথা ও বললো না।আমার কেনো জানি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হতে লাগলো।
১০ দিন খুব দ্রুতই কেটে গেলো,কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এটাই যে,আমাকে এই ১০ দিনে একবার ও বাসে দাড়িয়ে থাকতে হয় নি।দোকানে কেউ আমাকে বলে নি এই পোশাকে আমাকে হট লাগবে,পাড়ার ছেলেগুলো আমার পিছন পিছন সিটি বাজায় নি,আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করেছি,কুরআন পড়তে শুরু করেছি। পর্দা করার গুরুত্ব,ফজীলত নানতে পেরেছি।পর্দা মেয়েদেরকে করে তোলে সম্মানিতা । আল্লাহ তায়া’লা বলেন,”‘(হে নারীগণ!) তোমরা আপন গৃহে অবস্থান করো এবং জাহেলিয়াতের যুগের মতো সাজসজ্জা সহকারে অবাধে চলাফেরা করো না।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৩৩) ১০ দিন পরে ও আমি বোরকায় নিজেকে আবৃত করে ক্লাসে গেলাম,আয়েশার পাশে গিয়ে বসলাম।
আয়েশাঃ তুমি জিতে গেছো।
আমিঃ না তুমি জিতে গেছো আয়েশা।আমি বুঝতে পেরেছি পর্দাতেই নারীর সৌন্দর্য। আমি বুঝতে পেরেছি হিংসা মানুষকে বিপথগামী করে,বন্ধুত্ব মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। তুমি আমাকে মাফ করে দিও,আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমাকে তোমার বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিবে?
আয়েশাঃ আলহামদুলিল্লাহ,অবশ্যই তুমি আমার বন্ধু।এখন থেকে আমরা একসাথে ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলতে একে অপরকে সাহায্য করবো।