নির্মম সত্য

নির্মম সত্য

এক আত্মীয়ের বিয়েতে চেয়ারে বসে বসে ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রোল করছিলাম।এক মা তার বাচ্চা ছেলেকে আমার দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই দেখো বাবা,ভুত।আরেকবার কান্না করলে কপ করে নিয়ে গিয়ে তোমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে।ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে কান্না বন্ধ করে দিল।

আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।তারপর আবার নিউজফিডের দিকে মন দিলাম। আমার এসিডে ঝলসে যাওয়া মুখটার দিকে যে তাকায় সে-ই ভয় পেয়ে যায়।প্রথম প্রথম যখন কেউ তাকায়,তার বমি-টমি হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার দিকে থাকালে ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের মায়ের কাছে চলে যায়।তবু আমি তাদের কাছে গিয়ে কোলে নিয়ে আদর করার চেষ্টা করি।অপরিচত মায়েরা আমায় দেখিয়ে ভয় দেখায় আর পরিচিতরা সরাসরি নিষেধ করে দেয়।যাতে আমি ওদের ছেলে-মেয়েদের পাশে না যায়।কারণ অনেক সময় পিচ্চিরা আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে দেয়।

অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা সেটা?আগে আমার চেহেরাটা কতো সুন্দর ছিলো।যেজন আমার দিখে তাকাত সেই প্রেমে পড়ে যেত।আগে কতো সুন্দরী ছিলাম,যে-কেউ বলতো কত মায়াবী চোহেরা তোমার।এখন সেটা আর কেউ বলেনা,যে দেখে তার ভাবখানা এমন, যেন গোবর মাখা মুখ আমার। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা দিয়েছি কয়েকমাস হলো।মায়াবী চেহেরাটার প্রেমে পড়ছে ভার্সিটির অনেকে।সরাসরি এসে নম্বর চাই।আইডি খোজে।ভালোবাসার কথা বলে।এসব আমার ভালো লাগতোনা মোটেও।বিয়ের প্রস্তাব ও পাই অনেক।

আমার ইচ্ছে, যে আমার প্রেমে পড়বে সে নব্বই দশকের প্রেমিকের মতো হোক।যে ভালোবাসার কথা বলতে বলতে ছয়মাস এক বছর কাটিয়ে দিবে।পেয়েছিলাম সে রকম একজন। যে প্রায় প্রতিদিন আমার জন্য ফুল,চকলেট কিংবা আইসক্রিম এবং হাতে একটা কাগজ নিয়ে রোজ দূর থেকে আমাকে ফলো করতো।কিন্তু কোনদিন সে কাছে আসতে পারেনি।আমি আমার বাসার গেইটে ঢুকে গেলে তারপর ধ্যাত বলে জিনিসগুলো পেলে দিয়ে চলে যেতো।ও যাওয়ার পর আমি জিনিসগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তারপর বাসায় যেতাম।

ভালো লাগতো তার ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো কুড়িয়ে রাত জেগে সেখানে ভালোবাসা খুজতে। ছেলেটার নাম ঠিকানাও যেমন জানিনা তার পেশা কি সেটাও অজনা।তবে ছেলেটা ছবি আঁকতে ভালোবাসে তা বুঝতে পেরেছিলাম।সে রোজ আমার ছবি আঁকত। ছেলেটা অন্যদের মতো না,একদম সাদামাটা সভাবের।ওকে ভালো লেগেছিল আমার।আমি যে জিনিসগুলো কুড়িয়ে নেতাম আরেকজন খেয়াল করতো তা রোজ।সে আমাদের গলির মজনু দা।যে দুইবছর ধরে আমাকে প্রপোজ করেছিল।আমাকে দেখলে অশ্লীল ভঙ্গিতে তাকাতো।আমি যদি কারো সাথে প্রেমে জড়াই তবে খুব খারাপ হবে বলে হুমকি দিতো।এসবের তোয়াক্কা করতামনা আমি।

নাম অজানা ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলাম।সে একদিন আমার পিছু পিছু না আসলে ভালোই লাগতোনা।ও আমার পিছনে পিছনে আসলে অন্য রকম একটা ভালোলাগা কাজ করতো।যে ভালোলাগা আরো দীর্ঘস্থায়ী করতে রিকশা বা বাসে করে বাসায় না ফিরে ত্রিশ মিনিটের রাস্তা হেটে আমি বাড়ি ফিরতাম।মনেমনে খুব চাইতাম সে আমার সাথে কথা বলুক,ভুল করে হলেও একবার কথা বলুক।বাকিটা আমি সামলিয়ে নেব। কিন্তু কথা বলা পাত্র সে নয়।ত্রিশ মিনিটের পথ রোজ একা হেটে বাড়িতে এসেছি।কিন্তু কেউই কারো সাথে কথা বলেনি।

রোজ এভাবে চলছিল দুজনের দিন কাল।ভালোবাসা দূর থেকে।বর্তমান হলেও আজকালকার প্রেমে পড়ার মতো না।এক বছর ধরে ভালোবেসে আসছি কিন্তু কেউ কাউকে ছুয়েও দেখেনি।সে ছুঁয়েছে আমার মন,আর আমি তার আকা আমার ছবি। ছেলেটা আমার প্রতিটা ছবিতে মাথায় তার প্রিয় বেলি ফুল গুঁজে দিতেন।তাই আমিও বেলি ফুল গুঁজে ভার্সিটিতে যেতাম। তার দেওয়া ফুলগুলো মাথায় গুঁজে দিয়ে বুঝাচ্ছিলাম ভালোবাসি।বলতে পারো তোমার কথাগুলো নির্ধিদ্বায়।আমি প্রস্তুত তোমার কথা শুনতে।

কিন্তু কে বুঝে কার ভাবের কথা।সে রাজি হয়না কথা বলতে।তাই ধৈর্যের বাধ ভেঙে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম নিজ থেকে কথা বলব। বলবো তাকে,যদি ভালোবাসো তবে পাশাপাশি এসে হাটো।একদিন তাই করলাম।এই যুগে এমন ছেলে আমি প্রথম দেখলাম,আমি যখন তার মুখামুখি দাঁড়ালাম তার পা কাঁপছিল খুব।কপালের ঘাম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাতে থাকা কাঠগোলাপ আর কাগজটা পড়ে গেলো।আমি তা তুলতে মাথা নিচু করলাম।মজনু দা কিছু সঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কোথেকে এসে হাজির। সেও কিছু চকলেট রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলল,আমিও তিন বছর ধরে ভালোবাসি,তা-ই আমার গুলো আগে তুলবি।ভয় পেয়ে তাঁর গুলো তুলে দিয়ে বললাম, ভাই আপনাকে আমি ভাই হিসেবে মানি।আর ওঁকে আমি দেড় বছর ধরে ভালোবাসি। মজনু দা অশ্লীল একটা কথা বলে বলল,এই ব্যাটার কি এমন আছে যা আমার নাই।তোর নাম কিরে মিয়া?

–ছেলেটা নম্র ভাবে বলল,আসিফ মাহমুদ। এখন আমার এলাকা ছেড়ে যাবি,আর কোনদিন যেন না দেখি তোরে।দেখলে কিন্তু উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আসিফের ভয় কোথায় চলে গেলো। বছর ধরে দেখা ছেলেটার হাবভাব একদম বদলে গেলো।সে কথা-কাটাকাটি শুরু করে দিলো।বলল,যতদিন আমার প্রয়াসী এই গলিতে থাকবে ততোদিন রোজ আমি আসব যাব।

মজনু দা আমাকে বলল,তুই ছেমরির অনেক অহংকার বুঝি।সুন্দর চেহেরার অহংকার করিস তাইনা?লোভ দেখিয়ে ব্যাটা মানুষকে তোর পিছন পিছন ঘুরাস তাইনা?দেখ এবার কেমন লাগে বলে একটা বোতলের ঢাকনা খুলে আমার মুখে ছুড়ে মারলো।আসিফ আমার মুখে হাত দিয়েছিল এইটুকু মনে ছিলো শুধু।তারপর বার্ন ইউনিটে তারপর সার্জারী করা হলেও শেষ রক্ষা হয়নি আমার।হাসপাতালে এসিডে পোড়া চেহেরাটা প্রথম যেদিন আমিও আয়নায় দেখেছিলাম, ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলাম।বমি-টমি করে সেকি অবস্থা হয়েছিলো।শুধু চোখ দুটো ছাড়া পুরো মুখ ঝলসে গেলো।আগের চেহারার কোন অস্তিত্ব নাই, কি হওয়ার কথা ছিল আর কি হয়ে গেলো।আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি শুরু করে দিল,মেয়েটার জীবনটাতো শেষ করে দিল রে।কে করবে তোকে বিয়ে?কে নিবে তোর দেখবালের দায়িত্ব।

এই কথা বললে মনের ভিতর থেকে বলে উঠতো, আসিফ মাহমুদ।আসিফ মাহমুদ। কিন্তু আসিফ মাহমুদের দেখাও নাই।আমিও বারান্দায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।কারো জন্য শাড়িও পড়ে মাথায় বেলি ফুল গুঁজে দিয়ে রাস্তায় বের হয়না। আসিফ মাহমুদ কোথায় হারিয়ে গেলেন।মনে মনে বললাম,আজকাল মানুষ চেহেরা দেখে ভালোবাসে।আমার ভালোবাসাও চেহেরার সৌন্দর্যের কাছে হেরে গেলো।সুন্দর চেহেরা হারালাম তো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার হারালাম।পাড়াপড়শির ফুঁড়াফুঁড়িতে বাবা বাসা চেঞ্জ করলেন।মজনু দা এসিড ছুড়েছিল নাকি আমার দোষে।আরো কত কি বলছে লোকজন।

আজকাল আমার অন্ধকারকে অনেক প্রিয় লাগে।প্রায় প্রতিদিন পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে বেলকনিতে গিয়ে রাস্তা দেখি,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে রাস্তার আলো দেখি আর ব্যস্ত মানুষগুলোর আনাগোনা দেখি।মানুষগুলোর মধ্যে কতো অপরাধী লুকিয়ে আছে।তারা প্রত্যেকে কারো না কারোর কাছে ভয়ংকর অপরাধী,যাদের দেখলে ঘেন্নায় শরীর ছিন ছিন করে। অথচ অপরিচিতদের কাছে তাদের চেহেরাটা কতো নিস্পাপ । একদিন প্রতিদিনের মতো বেলকনিতে দাড়িয়ে অতীত ভাবছিলাম। ছোট বোন এসে বলল, আপু তোর সাথে এক ডাক্তার দেখা করতে এসেছে।নাম নাকি আসিফ মাহমুদ। হার্টবিটটা একদম হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলো।ছোট বোন এটা কি বলল।ওকে আবার প্রশ্ন করলাম,কি বললি তুই।বোন হেঁসে চলে গেলো। সত্যি কি এসেছে আসিফ মাহমুদ!

আমার দুচোখের জল টপটপ মাটিতে গড়িয়ে পড়লো।মনে মনে বললাম,আমার পুড়ে যাওয়া চেহেরাটা দেখলে তুই এখন পালাবি।তুই যে চেহেরা দেখে আমাকে ভালোবেসেছিস সেই চেহেরা সেদিন তোর সামনে আমি তা হারিয়েছি।যা তুই কেন সয়ং আমার নিজেরও পছন্দের না। আয় ব্যাটা দেখে চিরতরে চলে যা আমার জীবন থেকে। আসিফ সত্যি এসেছে বাসায়। বাবা-মা বেশ অবাক হয়ে বললেন,ডাক্তার সাহেব আপনি আসলেন আমাদের বাসায়?আপনার হাতের কি অবস্থা।সেদিন আপনি না হলে আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে দিয়েছিলাম।আপনি যেভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আমার মেয়ের জন্য।তো আপনার বাবা-মা কেমন আছে? উনারাও অনেক ভালো মানুষ। আমি বেশ অবাক হলাম,আসিফের বাবা-মাকেউ চিনলো করে। আসিফ বলল,উনারা আমায় রোজ বিরক্ত করে চলেছেন,আপনাদের বাসায় আসতে চায়।

আমি আগাগোড়া কিছু বুঝলামনা। বাবা আমাকে দেখে বললেন,মা,এই ডাক্তার সাহেব তোর জন্য কতো ত্যাগ স্বীকার করেছে।তোকে বাঁচাতে গিয়ে তার ডানহাত ঝলসে গেলো।সে কথা ভুলে তোর জন্য হাসপাতালের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করল।তোকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে তারপর তোর ফোন থেকে আমাদের ফোন করেছিল।তোর খবর রাখত রোজ। আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে রইল।আমি পোড়া মুখটা ডেকে একপাশে দাড়িয়ে ছিলাম।বাবা বলল,ও তোকে বিয়ে করতে চায়। বাবা বলেটা কি!সে শুধু খোজ নিয়েছে ,আমার পোড়া চেহেরাটা দেখেছে সে? বাবাকে বললাম আলাদা কথা বলতে চাই।বাবা চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল,কি বলবে তা জানি,তুমি অচেতন অবস্থায় আমি প্রায় গিয়েছি তোমার কাছে। তোমার চেহারার রঙ হয়তো পুড়ে ফেললো তারা,কিন্তু তোমার মায়াটা তারা পুড়তে পারেনি।তুমি নামক মানুষটাকে আমার খুব প্রয়োজন। সেদিন কি বলব বুঝতে না পেরে চেহেরার কথা ভুলে মানুষটার হাতটা কাছে টেনে নিয়ে বললাম, আমার জন্য শুধু শুধু আপনার হাতটা কেন পোড়ালেন।দেখতে খুব বিশ্রি লাগে বমি আসতে চাই। সে বুঝেছিল আমার মনের অবস্থা,বলল চোখের জল ফেললে যে।যদি রোজ এই জল মোছার অধিকার দাও আগে।তারপর নাহয় সব প্রশ্নের উত্তর হাতড়িয়ে নিয়ো।

শত অপরাধীর মাঝে একটা ভালোমানুষ কে আমি খোজে পেলাম। বিয়ের দিন ঘটা করে মেকাপ করে দিয়েছিলেন।যেন পোড়া চেহেরাটা দেখা না যায়।শেষবার সেদিন শুনেছিলাম মাশাল্লাহ বউ দেখি অনেক সুন্দর।আসিফ তোর কপাল কতো ভালোরে বাবা।আসিফ উনাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। পরের দিন থেকে শুরু হলো মানুষের সেসব অবহেলা আর কথা,দেখতে ভূতের মতো লাগে এটা কি বউ আনলি,তুইতো বড় ডাক্তার ভালো ঘরের কোন সুন্দরী মেয়েকে পেয়ে যেতি।কেন যে কোন অঘটন ঘটানো মেয়েকে নিয়ে আসলি।

প্রতিটার উত্তর আসিফ দিতে পারেনা তবে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, এসব আমি কেয়ার করিনা বুঝলে,তুমি আমার সাথে একই পথে চলবে সেটাই আমার কেয়ার এন্ড লাভ। সেদিন থেকে আমিও “আই ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে চলতে শুরু করলাম।ঘরের কোণ ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি।কেউ আমার চেহেরা দেখলে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে,কেউ বমি করে।কতোজন কত কিছু বলে,কিন্তু এসবে আমি কর্নপাত করিনা।সবার কাছে আমি খুব অপ্রিয় হতে পারি।

তবে একজন আছে যার কাছে আমার চেহেরাটা না দেখলে দিন যায়না।পোড়া কপালে চুমু না খেলে সময়টা ভালো যায়না।হাত ধরে না হাঁটলে ভালো লাগেনা আর আমিওএকটা নির্মম সত্য নিয়ে আমি এগিয়ে চলছি,সবার কাছে অপ্রিয় গোবর মাখা ভূত হয়ে পরিচিত মানুষটারও তাকে ভালোবাসে এমন একজন খুব প্রিয় থাকে। শতজন দরকার না-ই আমার,একজন থাকুক যে আমার সত্যটা জানার পরো আমার ভরসায় তার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে কোন দ্বিধাবোধ করবেনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত