অপূর্ণ ইচ্ছা

অপূর্ণ ইচ্ছা

অফিস শেষে হুড়োহুড়ি করে বাসে চড়ে সিটে বসে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত দেহটা এলিয়ে দিলাম। খালি পড়ে রইল আমার পাশের সিটটা। বাস ছাড়ার শেষ মূহুর্তে উঠলেন এক বৃদ্ধ। ইতিউতি করে খুঁজে দেখলেন কোন খালি সিট আছে কি না, অবশেষে আমার পাশে বসে পড়লেন। সাথে সাথেই আতরের সুতীব্র মিষ্টি একটা সুবাস এসে নাকে ধাক্কা দিল। আমি যেন কিছুক্ষণের জন্য বিমোহিত হয়ে গেলাম। আড়চোখে লক্ষ্য করতে লাগলাম পাশে বসা বৃদ্ধটিকে। গায়ে শুভ্র সাদা উজ্জ্বল পাঞ্জাবী, মুখে লম্বা দাঁড়ি।

এমনকি সেই দাঁড়িগুলোও ধবধবে সাদা। বৃদ্ধের গায়ের চামড়াও ফর্সা। মনে হচ্ছে যেন তার গায়ের থেকে আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কোলে মিষ্টির প্যাকেট রেখে যত্ন করে তা ধরে রেখেছেন। আমি ইতস্ততভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। নির্বিকার ভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাস কণ্ডাক্টর আমার কাছে এসে ভাড়া চাইলো। পকেট থেকে চিকন মানিব্যাগটা বের করে তার হাতে বিশটাকা গুঁজে দিলাম। কন্ডাক্টর আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল কিন্তু বৃদ্ধের কাছ থেকে কোন টাকা নিল না! আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন, “বাবা, এই কন্ডাক্টর আমাকে চিনে। প্রায়ই এ বাসে আসা যাওয়া হয়। তাই এই বুড়ো মানুষটার কাছ থেকে ভাড়া নিতে চায় না।”
আমি শুধু চাপাস্বরে বললাম, “অও আচ্ছা।”

– তোমার নাম কী বাবা?
– আমার নাম পলাশ।
– ও। তুমি দেখতে অনেকটাই আমার ছেলের মতো।
মৃদু হেসে বললাম, “নাম কী আপনার ছেলের?”
– ওর নাম শিমুল। ইঞ্জিনিয়ার। বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকে। মাঝে মাঝে আসে আমার সাথে দেখা করতে।
– আপনি আপনার ছেলের সাথে থাকেন না?
– না বাবা। “শান্তিনীড়” বৃদ্ধাশ্রমে থাকছি প্রায় দুই বছর হলো।

আজ একবছর পর আমার ছেলে আসবে বৃদ্ধাশ্রমে আমার সাথে দেখা করার জন্য। ওর জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ছেলেটা মিষ্টি ভীষণ পছন্দ করে। বৃদ্ধের চোখ ছলছল করছে। তার চোখে একইসাথে খুশির ও দুঃখের পানি ঢেউ খেলছে৷ সেই চোখের দিকে আমি আর তাকাতে পারলাম না৷ চোখ সরিয়ে নিলাম। বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলেন, “তোমার চাচী বেঁচে থাকলে খুব ভালো হতো। একা একা বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে ভালো লাগে না। সে থাকলে দুজনে গল্প করে সময় কাটিয়ে দিতে পারতাম। আমাকে রেখে তিন বছর আগেই পাড়ি জমালো ওইপাড়ে। আর আমাকে একা রেখে গেল এই ভাগাড়ে।”

আমি তাঁর কথার কোন উত্তর দিতে পারলাম না। কিছু কিছু কথার হয়তো কোন উত্তর হয় না। সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে ঝিমুনি এসে গেছে বুঝতেই পারলাম না। বাস থামতেই ঝাঁকুনি খেয়ে তন্দ্রা ছুটে গেল। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি বৃদ্ধ নেই। বাস থেকে নেমে গেলেন নাকি? আমি কন্ডাক্টরকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার পাশের বুড়ো চাচাটা কি বাস থেকে নেমে গেছেন?” ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “আপনার পাশে আবার কহন বুড়ালোক বইলো? আমি তো দেখলাম না।”

– আরেহ আমার এই পাশেই সাদা পাঞ্জাবী পরে এক বুড়ো বসেছিলেন।
– বুইড়া বইলে আমি ট্যাকা নেওয়ার সময় তারে দেখমু না?
– তুমি তো তার থেকে কোন টাকাই নাওনি!
– হেডাই তো। না দেখলে ট্যাকা নিমু কেমনে?

এমন সময় পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কি ভাই কি সমস্যা?” কন্ডাক্টর ছেলেটা বিরক্তকণ্ঠে বলল, “আর কইয়েন না ভাই। হে কইতাছে তার পাশে নাকি বুড়ালোক বসছিল। আপনেরা দেখছেন কোন সাদা পাঞ্জাবী পরা বুড়া চাচারে?” পিছনের লোকটা বলল, “উনার পাশে কোন বুড়ালোক বসে নাই। অযথাই তর্ক করতেছে। আমার তো ধারণা উনার মাথায় সমস্যা আছে৷ পুরা সময় খেয়াল করলাম এই ছেলে শুধু পাশে তাকায় আর বিড়বিড় করে। মাথায় সমস্যা না থাকলে কেউ একলা একলা বিড়বিড় করে?” আমি এবার রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাসের সবাই বলছে আমার পাশে কোন বৃদ্ধ বসেননি এমনকি আমি নাকি একা একাই পাশে তাকিয়ে বকবক করেছি। অথচ আমি তো বৃদ্ধকে নিজে চোখে দেখেছি! তাহলে সবই কি আমার ভুল? ক্লান্ত মস্তিষ্কের কল্পনা?

বাসায় ফিরে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। বাস থেমেছিল মোহনপুরে। আর মোহনপুর থেকে একটু এগিয়ে গেলেই শান্তিনীড় বৃদ্ধাশ্রম। এমনও তো হতে পারে বৃদ্ধ সেখানেই নেমে গেছে সবার অগোচরে৷ কেউ লক্ষ্য করেনি। তাই বলে কি একজনও লক্ষ্য করবে না? মাথায় হাজারো জল্পনাকল্পনা নিয়ে ঘুমুতে গেলাম৷ সিদ্ধান্ত নিলাম কাল সকালেই যাবো মোহনপুরের শান্তিনীড়ে। ওখানে গিয়ে বুড়োর সাথে কথা বললেই সব সমাধান হয়ে যাবে। সারারাত ঠিকমতো ঘুম এলো না৷ এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালে শান্তিনীড় বৃদ্ধাশ্রমে এসে পৌঁছালাম। কত বৃদ্ধ বসে আছে। এদের মধ্যে কত মিল। একজন আরেকজনের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। কিছু বৃদ্ধ বসে দাবা, লুডু খেলছে। কেউ গল্পের বই, কুরআন পড়ছে। যেখান তাদের আপন বলতে কেউ নেই, সেখানে তারা সব পরকে পরম মমতায় আপন করে নিয়েছে। আমাকে দেখতেই এক বৃদ্ধ বলে উঠলেন, “বাবা, তুমি শিমুল নাকি?” আমি তার পাশে বসতে বসতে বললাম, “আপনি শিমুলকে চিনেন চাচা?”

– হ্যাঁ, কেন তুমি শিমুল নও?
– না আমি পলাশ।
– ওহ, তুমি দেখতে অনেকটাই শিমুলের মতো। ওকে যখন শেষবার দেখেছিলাম তখনও দেখতে ঠিক তোমার মতোই দেখাচ্ছিল।
– শিমুলকে শেষবার কবে দেখেছেন?
– যেদিন ওর বাবা মারা গেল।

বাবা মারা গেল! কথাটা যেন সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার মধ্যে আঘাত হানলো। আমাকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে বাবা?” আমি তাকে ধীরে ধীরে কাল রাতে বাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললাম৷ সব শুনে চাচা এবার বলতে লাগলেন, “কাল ছিল ২৩ শে সেপ্টেম্বর। আর ঘটনাটাও ঠিক আজ থেকে তিনবছর আগের ২৩শে সেপ্টেম্বরের কথা। শিমুলের বাবার নাম ছিল আমজাদ হোসেন। এই বৃদ্ধাশ্রমে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল ও। দুইবছর ধরে ওর ছেলে ওকে রেখে যায় এখানে। এর মাঝে সে আর একবারও আসেনি তার বাবার সাথে দেখা করতে। খোঁজ খবরও তেমন রাখতো না। মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতো। আমজাদ মাঝে মাঝে চোখের পানি ফেলতো আর আশায় থাকতো কবে তার ছেলে তাকে দেখতে আসবে। একদিন বিকেলবেলা শিমুল ফোন করে জানালো ও ওর বাবাকে দেখতে আসবে আজ রাতে। বুড়োর আর আনন্দ ধরে না। বেরিয়ে গেল মিষ্টি কিনতে, তার ছেলে মিষ্টি পছন্দ করে কি না!

মিষ্টি কিনে রাতের বেলা যে বাসে আমজাদ ফিরছিল সে বাস এক্সিডেন্ট করলো। আমজাদ ফিরে তো এলো, কিন্তু লাশ হয়ে! তার অধম ছেলে বাবাকে আর জীবিত দেখতে পেলো না। দেখলো বাবার রক্তাক্ত শরীর। যেই বাবাকে বেঁচে থাকতে অযত্নে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, সেই বাবাকে বাঁচাতে সে মরিয়া হয়ে হাসপাতালে দৌড়ালো। কিন্তু তার বাবা আর তাকে বুকে টেনে নিল না। তার আগেই চলে গেল ওপাড়ে। মৃত বাবাকে ধরে ছেলের সে কি কান্না! আহা!

এরপর তিনটা বছর কেটে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তোমার মতো আরো দুটি ছেলে এসে আমজাদের খোঁজ করেছে। তোমাদের তিনজনের চেহারাই শিমুলের সাথে অনেকটা মিলে যায়। ওরাও তোমার মতোই দাবি করেছে যে তারাও আমজাদকে একই দিনে একই বাসে দেখেছে সাদা পাঞ্জাবী পরে হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বসে থাকতে।”
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তার মুখে চেয়ে রইলাম। সেই বৃদ্ধের অতৃপ্ত আত্মা এখনও তার ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে। হয়তো আমার মাঝেই খুঁজে বেরিয়েছেন তার ছেলের ছায়া।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত