আমার মানিব্যাগটা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না । কোথায় রেখেছি ঠিক মনে পড়ছে না । তাই আমার স্ত্রী শাম্মী কে ডাক দিলাম । সে এসে বলে – এত চেঁচামেচি করছো কেন ? কি হয়েছে , কে মারা গেছে । আমি বললাম – আমার মানিব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না , তুমি কি দেখেছ । সে বলে – তা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন, ভালো করে খুঁজে দেখলেই পারো । আমিতো আর তোমার মতো চোর না সাহেব , মানিব্যাগ চুরি করে নিয়ে যাব যে ।
এই বলে , হাসতে হাসতে বিছানার এক পাশ থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেয় । মানিব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে যায় । আর আমি রাগে ক্ষোভে বিছানায় বসে পড়ি । তখনই ঠিক মনে পড়ে যায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা । পাঁচ বছর আগের কথা — তখন ছিলো রোজা , কয়দিন পরে ঈদ । শাম্মীর সাথে তখন আমার এক বছরের রিলেশন ছিল । তো একদিন শাম্মী বললো – আচ্ছা এবার আমাকে ঈদে শপিং করে দিবে না । আমার পকেট একদম খালি, কিন্তু যদি বলি শপিং করিয়ে দিবো না তাহলে খারাপ দেখায় । তাই বললাম- তোমার কি লাগবে বলো ?
সে বললো – একটা নীল শাড়ি, কিছু নীল চুড়ি, নীল টিপ , নীল রঙের জুতো , কিছু কসমেটিকস ,এই সামান্য জিনিস ।
আমি শুধু বললাম – আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে দিব । দেখছেন তার কারবার , এত কিছু লাগবে বলেও , আবার বলে এই সামান্য । এমনি আমার পকেট একদম খালি নিজের খরচের জন্য টাকা নেই । এবার ঈদে নিজেই শপিং করতে পারব না । তাকে শপিং করিয়ে দিবো কি । মনে মনে ভাবলাম এখন তাকে শপিং করিয়ে দিতে হলে আমাকে চুরি বা ডাকাতি করতে হবে এছাড়া আর কোন উপায় আমি দেখছি না ।
এসব ভাবতে ভাবতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল , একটা রেস্টুরেন্টে দুজনে ইফতার করলাম । ইফতার করে আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম ,তাকে যে কথা দিলাম ঈদের শপিং করিয়ে দিব, এখন আমি টাকা পাবো কোথায় ।
এমন সময় হঠাৎ শাম্মীর মোবাইলটা বেজে উঠলো , তার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা নিয়ে তার আম্মুর সাথে কথা বলে মোবাইলটা তার ব্যাগে আবার রেখে দিল । তার মোবাইলটা দেখে হঠাৎ আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসলো , তার মোবাইলটা চুরি করে ,যদি মোবাইল বিক্রি করে সে টাকা দিয়ে তাকে শপিং করিয়ে দেই তাহলে কেমন হয় । অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম আসলে বিষয়টা মন্দ হয় না । আর মোবাইলটা একদম নতুন নিউ মডেল ভালো দাম পাওয়া যাবে । গত মাসেই তার ভাই সৌদি আরব থেকে তার জন্য পাঠিয়েছে ।
কথায় আছে শুভ কাজে দেরি করতে নেই যেমনি ভাবা তেমনি কাজ । তার সাথে গল্প করার ফাঁকে একসময় তার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা আমি আমার পকেটে নিয়ে নিলাম । এরপর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা ঠিক করে শাম্মী কে তার বাসা পৌছে দিলাম । তারপর মোবাইলটা নিয়ে চলে গেলাম মার্কেটে । আমার কিছু টাকা আর্জেন্ট লাগবে বলে মোবাইলটা একটা দোকানে বিক্রি করে দিলাম । নতুন আর বিদেশি সেট হওয়ার কারনে ভালোই দাম পেলাম । মোবাইলটা বিক্রি করে টাকাগুলো পকেটে নিয়ে মার্কেট থেকে বের হলেই , শাম্মী তার মায়ের নাম্বার থেকে কল দেয় । আমি ফোনটা রিসিভ করলেই । সে বলে – এই আমার মোবাইলটা খুজে পাচ্ছি না , কোথায় রেখেছি ঠিক মনে পড়ছে না, তুমি দেখছিলে । এক মিনিট নীরব থেকে কি উত্তর দিব ভাবলাম।
আমি বললাম – ভালো করে খুঁজে দেখো ভুলে কোথাও রেখেছ হয়তো ।
সে বললো – সব জায়গা খুঁজে দেখেছি পাইনি ,মনে হচ্ছে মোবাইলটা চুরি হয়ে গিয়েছে ।
চোরের বড় গলা কথাই আছে ,আমি একটু রাগ দেখিয়ে বললাম – একটা মোবাইলে ঠিক করে রাখতে পারো না , এত দামী একটা মোবাইল , কোন কিছুর প্রতি দেখি তোমার কেয়ার নেই । এরকম একটা অমনোযোগী আনকেয়ার মেয়ের সাথে আমি কিভাবে সংসার করবো । আর ইচ্ছেমত অনেক বকা সকা শুনিয়ে দিলাম । সে তখন রেগে গিয়ে বলে আমি মোবাইল হারিয়ে ফেলছি সে দুঃখে বাঁচিনা , কোথায় তুমি আমাকে একটু সান্তনা দিবা, তা না করে উল্টা আমাকে আরো বকা দিচ্ছ , আচ্ছা যাও বায় ।
এই বলে ফোন রেখে দেয় ।
পরদিন আমি শাম্মী কে কল দিয়ে , সুন্দর করে বুঝিয়ে বললাম – যে একটা মোবাইল গিয়েছে তাতে কি হয়েছে ,কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই, তোমার ভাইকে বুঝিয়ে বললে দেখবে আর একটা মোবাইল পাঠিয়ে দিবে । এর দুইদিন পরেই তাকে নিয়ে শপিং করতে বের হলাম , শাম্মী যা যা বলছিল আমি তাকে সব কিছু কিনে দিলাম । তারপর নিজের জন্য শপিং করে নিলাম । তারপরও হাতে কিছু টাকা ছিল । সেই টাকা দিয়ে ঈদের ঘুরাফেরার খরচ হয় যায় । তার মোবাইল বিক্রির টাকা দিয়ে ঈদের সম্পূর্ণ খরচ পূর্ণ হয়ে যায় । আমার পকেট থেকে এক টাকাও খরচ হয়নি ।
রোজার ঈদের চার মাস পরেই শাম্মীর সাথে আমার বিয়ে হয় । পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। আমাদের বাসর রাতে । আমি রাত একটা বাজে রুমে ঢুকলাম । রুমে ঢুকে দেখি শাম্মী ঘোমটা দিয়ে বসে আছে । আমি যখনই তার কাছে যেতে চাইলাম । সে ঘোমটা উঠিয়ে বলে , দাঁড়াও আমার কাছে আসবেনা , একদম আসবে না । আমি অবাক হয়ে বললাম – মানে কি ? সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছ কেনো ।
সে বলে – আমি একজন চোরের সাথে সংসার করতে পারবো না , সবাই আমাকে চোরের বউ বলে ডাকবে এটা আমার সহ্য হবে না । আমি আমতা আমতা করে বললাম – কে চোর ? কি বলছো আবোল তাবোল ।
সে বলে – তুমি একটা চোর ,
আমি বললাম – আমি চুরি করতে যাবো কোন দুঃখে ।
সে বললো – আহা তুমি দোয়া তুলসি পাতা । একদম কিছু জানো না তাই না , আমার সামনে সাধু সাজতেছ ,মোবাইল চোর ।
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম – কিসের মোবাইল কি মোবাইল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । সে বললো – এটা তো চোরের অভ্যাস চুরি করে অস্বীকার করা । রোজার ঈদে তুমি আমার মোবাইল চুরি করো নি ? তার এমন কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না । আমি চুপচাপ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম । সে তখন আবার বলল – কি হয়েছে এখন চুপ কেন ।
আমি নিচু গলায় বললাম – হ্যাঁ আসলে আমি মোবাইলটা চুরি করছিলাম । কারন তখন শপিং করার মত টাকা আমার কাছে ছিল না এজন্য ।
সে বলে – শপিং করার টাকা ছিলো না সেটা বললেই পারতে । চুরি করার কি দরকার ছিল ।
আমি বললাম – আসলে আমি ভাবলাম, যদি তোমাকে শপিং করিয়ে না দেই । তাহলে হয়তো তুমি কষ্ট পাবে , তোমার মন খারাপ হবে ।
সে বলে – আচ্ছা এই কথা , যখন তুমি মোবাইল চুরি করিছিলে তখন কি আমার খারাপ লাগেনি আমি কষ্ট পাইনি । কতোদিন বলার পর ভাই মোবাইলটা আমাকে দিয়েছিলো ।
আমি বললাম – আচ্ছা সরি , ভুল হয়ে গেছে । কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না। আমি মোবাইল চুরি করছি, তুমি এই বিষয়টা কখন জানতে পেরেছো ,এর আগে বলনি কেন ।
সে বলে – ঐদিন ঘরে গিয়ে যখন দেখলাম আমার ব্যাগে মোবাইল নেই । অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও পাইনি । তখন আমি তোমাকে কল দিয়েছিলাম । আমি ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে আবার রেস্টুরেন্টে যাবো, হয়তো সেখানে ভুলে রেখে এসেছিলাম । কিন্তু তুমি উল্টো আমাকে অনেক বকা দিয়েছিলে । তাই রাগ করে ফোন রেখে দিয়ে আমি একাই একাই সেই রেস্টুরেন্টে গেলাম ।
সেখানে গিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে বলে তারা কোন মোবাইল পাইনি । পরে বললো – তাদের রেস্টুরেন্টে নাকি সিসি ক্যামেরা আছে । তখন আমি দেখানোর অনুরোধ করলাম । সিসি ক্যামেরায় যখন দেখলাম , তখন দেখি তুমি আমার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা নিয়ে তুমি তোমার পকেটে নিয়েছ । তখন রেস্টুরেন্টে লোকের সামনে আমি যে লজ্জা পেয়েছি তা বলার মত না । আমি অনেক ভেবে চিন্তে বললাম – মোবাইলটা মনে হয় ভুলে আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে গিয়েছে । আচ্ছা আমি তার কাছ থেকে নিয়ে নিবো এই বলে সেখান থেকে চলে আসলাম ।
আমি বললাম – ও তেরি সিসি ক্যামেরা ছিলো আমি খেয়ালী করলাম না ।
সে বলে – সত্যি তোমাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া দরকার । গার্লফ্রেন্ডের মোবাইল বিক্রি করে ,সেই টাকা দিয়ে গার্লফ্রেন্ডকে শপিং করিয়ে দেওয়া । নিজে শপিং করা ঈদের সব খরচ মেটানো ।তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে তা সম্ভব নয় ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম – তুমি যখন সবকিছু আগে থেকে জানতে এর আগে কখনো বলোনি কেন ।
এই বলে – আমি বিছানার কাছে এগুতে চাইলাম ।
সে বলে – খবরদার সামনে আসবে না । এতদিন বলিনি কেন জানো , কারণ আমি এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । তুমি যে চুরি করেছ তার তো শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে ।
আমি বললাম – শাস্তি ? কি শাস্তি ।
সে বলে – আজ থেকে পাঁচ দিন তুুমি আমার কাছে আসতে পারবে না আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না । এটাই হচ্ছে তোমার শাস্তি । তোমার সামনে থাকবো , তোমার আশে পাশে থাকবো । কিন্তু তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না ।যদি কখনো ভুলেও আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করো তাহলে আমি চিৎকার দিয়ে ঘরের সবাইকে এখানে উপস্থিত করব । আমি বললাম – আজকে আমাদের বাসর রাত , এমন পাগলামি করার মানে হয় না ।
সে বলে – আমি মোটেও ফাজলামি করছি না । তুমি আমাকে স্পর্শ করলেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠবো । আমি ভাবলাম এই মেয়ের উপর ভরসা নেই । এই মেয়ে সত্যি সত্যি চিৎকার দিয়ে বসতে পারে ।ঘর ভর্তি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব । ।আর নতুন বউয়ের ঘর থেকে যদি চিৎকার বের হয় তাহলে মানুষ কত কথাই না ভাববে । সে যদি চিৎকার দেয় তাহলে আমার মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে । কি আর করার, পরে তার শর্ত মেনে নিলাম । আমি তাকে বললাম – আচ্ছা ঠিক আছে আমি না হয় খাটের একপাশে ঘুমাবো তুমি একপাশে ।
সে বলে – খাটে নয় তুমি নিচে পড়ে ঘুমাবে , এটা হচ্ছে তোমার শাস্তি । এই বলে খাট থেকে একটা চাদর আর একটা বালিশ নিচে ছুড়ে মারলো । আমি ভদ্র ছেলের মত নিজ থেকে বালিশ চাদরটা নিয়ে নিচে ঘুমিয়ে পড়লাম । পাঁচটা দিন এভাবে কাটালাম । একবার একটু ভেবে দেখেন, যে ভালোবাসার মানুষটাকে এক বছর পর আপন করে পেয়েছি । ২৪ ঘন্টা চোখের সামনে থাকত , আশেপাশে থাকত , এক রুমে ঘুমাতাম অথচ আমি তাকে স্পর্শ করতে পারিনি । সেটা যে কি দুঃখের কি কষ্টের কি যন্ত্রণার সেটা হয়তো আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না । ওই পাঁচ দিন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখ কষ্টের মুহূর্ত ।
তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে এখন পাঁচ বছর। বিয়ের পর থেকেই আমাকে চোর সাহেব বলে ডাকে । এখন আমি দুই সন্তানের বাবা । দুইটা সন্তান আছে আমাদের একটা মেয়ে একটা ছেলে । এই পাঁচ বছরে আমি তাকে চারটা নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছিলাম । তার যে মোবাইল চুরি করছিলাম তার চেয়েও দামি ।কিন্তু তারপরেও সে আমাকে সবসময় চোর সাহেব বলে ডাকে । কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া হলে পাঁচ বছর আগের মোবাইল চুরির খোটা দিবে ।
এই পাঁচ বছর তাকে চারটা মোবাইল দিয়েছি তার কোন নাম নেই ।শুধু এক সময় তার কাছ থেকে একটা মোবাইল চুরি করে নিয়েছিলাম । সেটা সে এখনো মনে রেখেছে ।সব সময় মোবাইল চুরির খোটা দিয়ে যাচ্ছে । আর এই চুরি করার খোটা মনে হয় আমাকে সারাজীবন শুনতে হবে তার কাছ থেকে । মেয়ে মানুষ বড়ই অদ্ভুত । আপনি তার জন্য যত কিছু করেন না কেন সেটা সে মনে রাখবে না । কিন্তু আপনি তার জীবনে কিছু একটা ঘটিয়েছেন সেটা সে আজীবন মনে রাখবে । সেটা সে কখনোই ভুলবে না , আপনাকেও ভুলতে দিবে না ।