নীল ডায়রী

নীল ডায়রী

আমি রিয়েল স্টেট এবং ইমপোর্ট এক্সপোর্ট এর ব্যবসা করি। ব্যবসা সূত্রে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে নতুন বাসা কিনেছি একটা। শুনেছি বাসাটি কোন রেলওয়ে কর্মকর্তার ছিল। পারিবারিক অসুস্থতা ও নানা সমস্যার কারণে ব্যাংকে অনেক ঋণ করে ফেলেন। অনেকদিন ঋণ শোধ করতে না পারায় বাড়িটি ব্যাংকের বাজেয়াপ্ত হয়। এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঐ পরিবারকে উচ্ছেদ করে। এর থেকে বেশি কিছু শুনিনি। শোনার প্রয়োজনও মনে করিনি। কেননা বাসা কেনাবেচা করতে গিয়ে এমন অনেক গল্প আমার জানা হয়ে গেছে।

আর বাসাটা দেখে আমার ভাল লাগাতে ব্যাংকের কাছে থেকে কিনে ফেলি। বাহির থেকে খুব সাদামাঠা হলেও বাসার ভেতরের শৌখিন কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হই। দেওয়ালের রং ক্ষয়ে গেছে কোথাও কোথাও। রুমের মধ্যে কিছু পুরোণো বই-খাতা ছড়িয়ে রয়েছে। একটা রুমের জানালা খুলার সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা মারে মুখে। পাশেই বেলকুনি। ঘর থেকে বেরিয়ে বেলকুনিতে বসলাম। নিচে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। বিশাল আকারের এক পুকুর। হরেক রকমের পাখি উড়াউড়ি করছে পুকুরের আশপাশ। বেলকুনির এক পাশে দোলনা,অন্যপাশে কয়েকটা পুরোণো ফুলের টপ। ফুলের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে।

বাসাটা দেখেই মনে হলো নিশ্চয় কোনো শৌখিন ব্যক্তি স্বাদ করে তৈরি করেছিলেন বাসাটা। দোলনাটার কাছে যেতেই একটা ধূলোমাখা ডায়রীতে চোখ পড়লো। ডায়রীটা তুলে ঝাড়া দিলাম। কয়েকটা পাতা ভেতর থেকে খসে পড়লো। অযত্নে থাকায় ধূলোতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডায়রীটা। বেলকুনিতে বসেই পাতাগুলো সাজিয়ে ডায়রীটা পড়তে শুরু করলাম- “আমার স্বপ্ন বিলাস” আমাদের ছোট সংসার। আমি এবং আমার প্রিয় স্ত্রী প্রিয়া। মা-বাবা গ্রামে থাকেন। আমি একটা কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টিভ এ কর্মরত। যৎ সামান্য বেতন পাই মাশাআল্লাহ্ আমাদের সংসারে অভাব অনটন সে ভাবে ফুটে উঠেনা। মা-বাবার জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাই তাতেই অনেক দুআ করে আমাদের জন্য। সব সময় বউমার খোঁজ খবর রাখে কখন কি খেলাম না খেলাম সব।

আর আমার স্ত্রী প্রিয়ার চাহিদাগুলোও সামাণ্য। যা পূরণ করতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয়না। এই ধরেন বছরে দুই থেকে তিনটা বোরকা আর বাসায় পড়ার জন্য দুই সেট থ্রি-পিচ। একে অপরের স্যাক্রিফাইজে দাম্পত্যজীবন মোটেও মন্দ যাচ্ছে না। বরং এক কথায় আলহামদুলিল্লাহ্ বলতে দ্বিধা থাকেনা। ছুটির দিনগুলোতে দুজন মিলেই প্রিয় কোনো খাবার রান্না করি।

গোসল শেষ করে একসঙ্গে খেতে বসি। একটা প্লেটেই খাবার নিয়ে প্রিয়া আমাকে খাইয়ে দেয়, আমি প্রিয়াকে। দুপুরের পর প্রিয়ার চুলগুলো চিরুনি আচড়ে দিয়ে বেণী গেঁথে দেই। স্বামী-স্ত্রীর গল্প আর খুনসুটিতে সময়গুলো মধুময় হয়ে ওঠে। ছুটির দিনের বিকেলগুলোতে বাইরে ঘুরতে বের হই। পুরো বিকেলটা রোমাঞ্চকর সময় পার করে সন্ধ্যা নামার পূর্বে বাড়িতে ফিরে আসি। মাগরিবের আযান হয়। মাগরিবের নামাজের জন্য প্রিয়া টুপিটা হাতে দেয়। আমি মসজিদের দিকে রওনা হই। ধূলোবালির শহরের ফাঁকে আকাশটা হালকা দেখা যায়। কয়েক টুকরো মেঘও উড়ে যায় পশ্চিমের আকাশে। এমন সময় আমার মন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে “সুবাহানআল্লাহী ওয়া বিহামদিহী সুবাহানআল্লাহিল আযিম।”

একদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি আমার স্ত্রী প্রিয়া আমার কোর্টটা খুলে রাখে টেবিলে। তারপর টাইয়ের বাঁধনটা খুলতে খুলতে মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে ” আ প নি বা বা হতে চলেছেন মি-স্টার পাগল জামাই।” আমি নিজেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ভুলে গেয়িছিলাম তাৎক্ষণিক। আমি আবার প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করি “কি বললে?” প্রিয়া আবার একই কথা বলে। আমি জানিনা অন্যকারও বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন। খুশিতে আমার চোখে জল চলে আসে। কোলে তুলে নেই প্রিয়াকে। নাকের সাথে নাক ঘষে বলি “সুবাহানআল্লাহ্।” প্রিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলি “এখানে থাকো উঠবেনা।” আমি দ্রুত ডিম মামলেট করে নিয়ে আসি।

প্রিয়া বিছানা থেকে উঠতে যায়। আমি দ্রুত সাহায্য করি তাকে। আমার কাণ্ড দেখে প্রিয়া বলে “পাগল জমাই এক্ষুণি এতো যত্ন না নিলেও চলবে।” আমার তাৎক্ষণিক প্রশ্ন “কে বলেছে যত্ন নিতে হবেনা? আমার লক্ষী বউটা আমার বাবা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করবে ইনশাআল্লাহ্ আর আমি যত্ন নিবো না, তা হয়না।” আচ্ছা হা করো খাইয়ে দেই। খাওয়ানো শেষ করে বলি “আরেকটা সুখবর আছে তোমার জন্য পাগলী বউ।” প্রিয়া চোখেমুখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। পকেট থেকে একটা খাম বের করে বলি “কয়েক মাস আগে যে ভাইভা দিয়েছিলাম বাংলাদেশ রেলওয়েতে, এটা আমার জয়নিং লেটার।”

প্রিয়া বিছানা থেকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না সেদিনের। আমি জানিনা কোনো পুরুষ নিজের স্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে কখনো কান্না করেছে কি না। তবে সে সময় আমার চোখের পাতা ভিজে গাল বেয়ে জল পড়েছিল অনেক। প্রিয়াকে সামনে বসিয়ে বলি “জানো প্রথম পোষ্টিং কোথায়? তোমার শহর চট্টগ্রামে। তারপরেই শুরু হয় প্রিয়ার নানা প্রশ্ন। “কোথায় উঠবো ওখানে? বাসা ভাড়া নিবে না কি কোয়ার্টার পাবে?” আরও অনেক প্রশ্ন। আমি বলি “সামনে মাসের ১ তারিখ থেকে জয়েন করতে বলেছে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় থাকা যায়।”

এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে দুজনে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মার্কেটে সারাদিনের ক্লান্তিতে আজ আর চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেনা। চোখে এখন নতুন স্বপ্ন, নতুন স্বপ্ন মানুষকে ঘুমোতে দেয়না ইচ্ছেমত ভাবায়। আর এই ভাবনার জগতটা যখন স্বপ্ন হাতের মুঠোয় থাকা অবস্থায় হয় তখন আর কোনো শূণ্যতাই থাকে না, মাশাআল্লাহ্ সব দিকে পূর্ণতা। স্বামী-স্ত্রী গল্প করতে করতে কে কখন যেনো ঘুমিয়ে যাই টেরই পাইনা। ফযরের আযানের ধ্বণিতে ঘুম ভাঙ্গে। প্রিয়াকে ডেকে তুলি নামাজের জন্য। আমি মসজিদের দিকে যাই।

আমার কর্মরত কোম্পানিতে বিষয়টা জানাই। কাজের দায়িত্ব্য আর সততায় সব স্যারদের প্রিয় মুখ আমি। তাঁরা আমার নতুন কর্মে সুযোগ পাওয়ার কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। সবাই অভিনন্দন জানায় এবং শুভ কামনা করে। সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বিদায় নেই সবার কাছে থেকে। পৃথিবীতে আমরা কোথাও চিরস্থায়ী নই,আবার কোনো কিছুই আমাদের চিরস্থায়ী নয়। ২৮ তারিখ আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। “তূর্ণা এক্সপ্রেস” ট্রেন ছাড়লো রাত ১১.১০ মিনিটে। রাতের আকাশ চাঁদের জ্যোছনায় স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে চারদিক।

জানালার পাশ দিয়ে শহরের কিছু অংশ দেখে কল্পনা করা যায় ব্যস্ততম শহরটা এখনো অব্দি ঘুমাইনি। কত বিচিত্র এই শহর যার একদিকে টাকার খেলা অন্যদিকে অনাহারীর আর্তনাদ। কেউ কারও খোঁজ রাখেনা। অনাহারী শিশুদের নিয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনের সাথে কাজ করে বুঝেছি সামাণ্য খাবারের জন্যেও এই শহরে শত শত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। তাও এই শহরের প্রতি একটা মায়া জন্ম নিয়েছে। আর আজ যখন শহর ছেড়ে যাচ্ছি তখন বুঝতে পারছি মাঝে মাঝে মায়া ত্যাগ করতে হয়। নিজের জন্য, নয়তো অন্যকারও জন্য। তবু ভালোবাসার কমতি যেনো না থাকে ঐ মায়ার প্রতি।

-একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পুকুরটার দিকে তাকালাম। সূর্যটা পুকুরের বিপরীত পাশের ভবনগুলোর উপরে। তার মানে এখনো অনেকটা বেলা আছে। বেলা শেষ হওয়ার আগেই ডায়রীটা পড়ে শেষ করা যাবে মনে হয়।
পরের পাতা উল্টালাম —

প্রিয়াও আমার মত ডায়রী লিখতে ভালোবাসে। কখনো ওর ডায়রীটা পড়া হয়নি। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে পড়ে দেখি পাগলীটা আমাকে নিয়ে কিছু লিখে কি না?পরক্ষণে ভাবি থাক না জমানো গল্পগুলো। বুড়ো বয়সে না হয় একে অপরকে ডায়রী পড়ে শুনাবো আর হাসবো। কল্পনাগুলো কতই না সুন্দর। এমন সুন্দর জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে মন থেকে ধন্যবাদ। প্রিয়া নিজের ডায়রীটা ব্যাগে রেখে খাওয়ার জন্য বিস্কুট দেয়। দুইটা বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে নেই। ছোট বেলার একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো “ট্রেন চলছে ট্রেন চলছে, ট্রেনের বাড়ি কই ?” পাশ থেকে প্রিয়া শুনতে পেয়ে বলল “ট্রেনের বাড়ি সব স্টেশনে।” দুজনে হেসে উঠি। এ হাসি ট্রেনের শব্দের সাথে মিলিয়ে যায়।

সকাল সকাল ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌছাল। সঙ্গে আনা লাগেজগুলো উপকারী মানুষগুলোর মধ্যে একজন এসে নামিয়ে দিলো(কুলিদের উপকারী মানুষ বলি)। ভাড়া ঠিক করে নিলাম। ভাড়া ঠিক না করলে পরে আবার ঝামেলা করে। উপকারী মানুষটাকে ভাড়ার থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিলাম। লোকটা দ্রুত আমার পা সালাম করতে যায় “আল্লাহ্ আপনার ভাল করবে স্যার” বলে। ‘এই ভাই কি করছেন?’ বলে আমি হাত ধরে ফেলি। ‘সালাম স্যার।’ সালাম দিয়েই লোকটা চলে গেলো। আমি ভেবে অবাক হলাম যে মাত্র পঞ্চাশ টাকাতে মানুষ মানুষের প্রতি এতো ভক্তি করে! আজব কেউ তো কোটি টাকাতেও সন্তুষ্ট নয়।

আসলে বুঝতে পারলাম আত্ম সন্তুষ্টিটা নিজ নিজ মনের ব্যপার। প্রথম অবস্থায় শ্বশুড় বাড়িতেই উঠলাম। কয়েক দিনের মধ্যে বাসা ভাড়া করে নতুন বাসায় উঠে পড়লাম। এখন সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন। নতুন বাসায় উঠে শুক্র,শনিবার সব গুঁছিয়ে নিলাম। প্রিয়াকে কোনো কাজ করতে দেইনি। সকালে রান্না করে প্রিয়াকে খাইয়ে অফিসে যাই, অফিসের কাছেই বাসা নেওয়ায় দুপুরে দুজনে একসাথে খেতাম। আবার সন্ধ্যায় ফিরে রান্না করতাম দুজন মিলে।

পরে প্রিয়ার যত্ন নেওয়ার কথা ভেবে শ্বাশুড়ী আম্মুকে ভাড়া বাসায় নিয়ে আসি। তারপরও শ্বাশুড়ী আম্মু মাঝে মাঝে আমাকে মশকরা করে বলে “আব্বু তুমি যে পরিমাণ যত্ন নিচ্ছো তাতে তো আমি না থাকলেও সমস্যা ছিল না।”
আমি মুচকি হেসে বলি “তারপরও আম্মু মেয়ে মানুষ তো, আমি তো আর সব কিছু বুঝবো না।” সেদিন এই কথা বলার পর মা ও মেয়ের চোখে মুখে যে চমক দেখেছিলাম তা বর্ণনার শব্দমালা আমার ছোট স্মৃতিশক্তির মস্তিষ্কে নেই। “যত্নে মিলে রত্ন” আর আমার যত্নে মিলেছিল অকৃত্রিম স্নেহ ভালোবাসা।

আমাদের অনাগত সন্তান পৃথিবীতে আসার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রিয়া মাঝে মধ্যে বলে যে “আমাদের ছেলে হবে, আমি বলি না মেয়ে হবে। ” এ নিয়ে দুজনের মাঝে খুনসুটি বেশ চলে। অবশেষে আমাকেই হার মেনে নিতে হয়। তবুও কিউরিসিটি থেকে প্রিয়া আমার কোলে মাথা রেখে বলে “চলোনা আলট্রাসেনো করে দেখি ছেলে হবে না কি মেয়ে?” আমি প্রতিবারের মত বলি “আল্লাহ্ যেদিন পৃথিবীতে পাঠাবেন সেদিনই দেখবো নাহয়।” আমি বুঝতে পারি এ নিয়ে প্রিয়া মন খারাপ করে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে মন ভাল করার চেষ্টা করি। এমন সময় শ্বাশুড়ী আম্মুর চোখে চোখ পড়ে।

চোখে চোখ পড়ায় দ্রুত সরে যান আম্মু। আমি শ্বাশুড়ী আম্মুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে তা স্পষ্ট দেখতে পাই। জানিনা মেয়ের সুখে সুখের জল, না কি অন্য কোনো পূরোণো স্মৃতির ঘনাঘটা। আর যাইহোক চোখের জলটা সুখের হলেই আলহামদুলিল্লাহ্। সময় ঘনিয়ে আসায় গ্রামে বাবা-মা কে আবার খবর দেই। কয়েকদিন পরই বাবা-মা চলে আসে। বউমার জন্য কয়েক রকমের আচার,বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার এবং ছোট বাবুর জন্য নেংটি,কেথা,জামা আরও কতো কি নিয়ে এসেছে তার ইয়াত্তা নেই। পারলে বউমাকে যেনো মাথায় তুলে রাখে।

আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবার সামনে বললাম “এখন তো দাদা-দাদি,নানি সব হাজির আমি কি আমার যত্ন নেওয়া ছেড়ে দিবো?” আমার আম্মু দ্রুতই বলল “তোমার আর প্রয়োজন হবেনা আমরা দুই বেহাইন মিলেই আমাদের মেয়ে নাতী/নাতনী যাইহোক সামলাবো।” প্রশান্তির হাসি দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম আর যাই বলুক আমার প্রিয়ার যত্ন আমিই নিবো। ডায়রীটা এখনো অনেকটা বাকি। প্রচণ্ড চা খেতে ইচ্ছে করছে এখন। ডায়রীটা শেষ না করে বাইরে যেতেও ইচ্ছে করছে না । ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে পানি খেলাম। উঠে বেলকুনিতে একটু হাঁটিহাঁটি করে বসে আবার ডায়রীটা পড়া শুরু করলাম।

আলহামদুলিল্লাহ্ সবকিছু মাড়িয়ে আমাদের সোনামণি পৃথিবীতে আসছে আজ। যখন শুনেছিলাম আমি বাবা হব,আর যখন শুনলাম আমি বাবা হয়েছি। দুটোর অনুভূতি একদম আলাদা রকম। এসব অনুভূতির বর্ণনা হয়না। পৃথিবীর সকল বাবাদের মধ্যেই থাকে সুপ্ত অবস্থায়। মেয়ে হয়েছে আমার। এই খুশিতে আমি পুরো ক্লিনিকের কর্মচারী,ডাক্তার/ডাক্তারণী, রোগী ও সাথে আসা সবাইকে মিষ্টিমুখ করাই। প্রিয়ার কপালে চুমু এঁকে দেই সাথে মেয়েরও। দাদা-দাদি, নানিরসহ যে কি আনন্দ। যেনো তারা আজ পৃথিবীতে চাঁদ হাতে পেয়েছেন। আমার মেয়ের নানু ও মামারা বাহির দেশে থাকেন। যে কারণে তাঁদের অনুপস্থিতি।

যাহোক দাদা-দাদি ও নানি মিলে তাদের অনুপস্থিতি পূর্ণ করেছে। মেয়ের কি নাম রাখবো এ নিয়ে অনেক চিন্তার পর। নাম ঠিক হয় আমার পছন্দেই। আদিবা নাম রাখি মেয়ের। নামটা প্রিয়ারও অনেক পছন্দ হয়। প্রিয়া আর এখন আমাকে পাগল জামাই বলে ডাকেনা। এখন আদিবার আব্বু বলে ডাকে। আমার অনেক ভাল লাগে বিষটা। আমদের সোনামণি আদিবা পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে আমাদের স্বপ্নগুলোও ভিন্নরূপ ধারণ করে। আদিবাকে ঘিরেই সব। ইচ্ছা,স্বপ্ন সব যেনো সোনামণি কেন্দ্রিক হয়।

আমার কোম্পানির চাকুরি করা সময়ের কিছু সঞ্চয় এবং বর্তমান মিলিয়ে আদিবার ছয় বছর বয়সে হজ্জ্ব যাই। আদিবা,আমি আর প্রিয়া। সেখান থেকে ফিরে চট্টগ্রাম রেলওয়ের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের সাহায্যের জন্য একটা স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন চালু করি। সুবিধা বঞ্চিতদের খাদ্য,শিক্ষা এবং সফল ভাবে কর্মমুখী করতে কাজ শুরু করি। এতে আমার স্ত্রী প্রিয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সহযোগীতা করে। ধীরে ধীরে স্টেশনের পরিবেশটায় পরিবর্তন হতে থাকে। প্রশাসনিক ভাবেই স্টেশন এলাকা থেকে নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনকারীদের বিতাড়িত করে। যা আমার স্বপ্ন পূরণে বেশ সহযোগিতা করে।

আদিবার বয়স যখন দশ বছর তখন একদিন ওর আম্মু আদিবাকে জিজ্ঞেস করলো “আম্মু তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো তোমার আব্বুকে না কি আম্মুকে?” আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে উত্তর দেয় “তোমাকে আম্মু। আব্বুকেও অনেক ভালোবাসি। ” আমাদের ছোট সংসারের ভালোবাসাটা কাকতালীয় ভাবে চাক্রীক। আমি সব থেকে ভালোবাসি আমার মেয়ে আদিবাকে,আদিবা ওর আম্মুকে আর ওর আম্মু আমাকে। যদিও পরিবারের ভালোবাসা পরিমাপ করা যায়না তারপরও উপলব্ধি করা যায়।

সময়গুলো ভালোই চলছিল। আদিবাও স্কুল শেষ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে স্টেশনে কাজ করতো। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রত্যাবশ্যিত শিশুদের খাওনো হতো। এর বেশির ভাগ অর্থ সহযোগিতা আসতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে এবং এলাকার বিত্ত্ববান সৎ মানুষদের হতে। ছুটির দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আসতো সংগঠনে। অনেকে সংগঠনের স্থায়ী সদস্য হয়। বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে সংগঠনকে। তাদের মধ্যে সব থেকে কর্মঠ ছিল আরিফ,শিশির,সাদিক,রুবেলসহ আরও অনেকে।

অনেক দিন ধরে টাকা জমিয়ে অল্প কিছু জায়গা কিনি। এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বপ্নের মত সাদামাঠা একটা বাড়ি দেই। মাসিক বেতন থেকে কিছু করে টাকা দিয়ে ঋণের টাকা পরিষদ করছিলাম। ভালোই চলছিল জীবন।
মেয়ে আদিবা এসএসসি শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়। ক্লাশের সময় কিছুটা কমে। তাই সংগঠনে অনেক সময় দিতে শুরু করে। আর আমারও বিষয়টা ভাল লাগছিলো। কারণ একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাজ করে যতোটা ভাল মানুষ আর মানবিক হওয়া যায় আর কোনো ভাবে তা হওয়া যায়না। কোনোভাবেই না। সংগঠনের হয়ে যারা কাজ করতেছিল তাঁরা একে অপরের সাথে সবাই অনেক আন্তরিক। সবাইকে আমার অনেক পছন্দ।

ইদানিং প্রিয়ার শ্বাসকষ্টটা বেড়ে গেছে। কেমন মনমরা থাকে সব সময়। আমার সাথেও তেমন একটা কথা বলেনা।
আজ রাতে খাবার টেবিলে আদিবার বিয়ের কথা তুলে প্রিয়া। ছেলে না কি বিদেশে থাকে ব্যবসা করে। আমাদের বাড়ির পাশেই বাসা। আদিবা খাওয়া বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে রুমে যায়। বুঝতে পারি মেয়ে বিয়েতে রাজি না। প্রিয়া আবার বলতে শুরু করে “ওর নানির অনেক পছন্দ আর ওর মামারও।” পরে জানতে পারি আদিবা সাদিককে পছন্দ করে। ছেলে হিসেবে সাদিক অনেক ভদ্র। চট্টগ্রাম ভেটেনারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩য় বর্ষে পড়ে। সাদিকের বাড়ি সিলেট শহরে। আমি সাদিকের সাথে কথা বলি এ ব্যপারে।

এবং বুঝিয়ে বলি যে বাবা পড়ালেখাটা ভাল করে শেষ করো। শুনেছি ছেলেটা আদিবাকে বিয়ে করার জন্য এখন থেকেই একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে। এদিকে আদিবার নানা নানিরা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আদিবার আম্মু আদিবাকে অনেক বুঝায়।” চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে সম্ভব না। একটাই মেয়ে আবার নানা-নানি,মামা আন্টিরা আমাকে অনেক কথা শুনাবে। আমি বেশিদিন বাঁচবোনা এভাবে।” আদিবা কিছু বলেনা। আদিবার আম্মুর অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় মেয়েটা নিজেই অসোহায় হয়ে পড়ে। মনে অনেক রাগ,অভিমান জমিয়ে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিয়েতে রাজি হয়।

আজ আদিবার বিয়ে হলো। সাদিক বেশ কয়েকবার আমাকে ফোন করেছিল ফোন ধরিনি। অনেকগুলো টেক্সও করেছে পড়িনি একটাও। মেয়েকে বিদায় দিয়ে বেলকুনিতে বসে ভাবছি “আমি কি এসব ঠিক করছি?” বিবেক বারবার নিজেকে স্বার্থপর বলে গালি দিচ্ছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটনে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য উঠেছে। রোদের আভা চোখে পড়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে । ফযর নামাজটা মিস গেছে। চোখ ঘষতে ঘষতে ফোনটা রিসিপ করলাম। কান্না জড়িত কণ্ঠে ফোনের ওপাশ থেকে ” আংকেল সাদিক আর বেঁচে নেই। স্টেশনের পাশেই পড়ে আছে ওর লাশ। ” ইন্নালিল্লাহ্……

আমার জ্ঞান ফিরলে দেখি হাসপাতালের বেডে। আমার পা দু’টো কাজ করছেনা। ডাক্তার বলেছে রেস্ট নিতে। পাশেই আমার মেয়েটা দাড়িয়ে ছিল। ও কাঁদছিল। জানিনা কাউকে হারিয়ে কাঁদছিল না কি আমার অসুস্থতার জন্য।
১৫ দিন পর ডাক্তার রিলিজ দিলো। আমার পা দু’টো কাজ করেনা অথ্যাৎ প্যারালাইজড। বাসায় নিয়ে আসা হলো আমাকে। আমার এ অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী প্রিয়া ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়লো। প্রথম প্রথম এভাবেই অফিস করতাম। অনেক সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। পরে দরখাস্ত দিয়ে রিটায়ার নিই। রিটায়ার এর অর্থ দিয়ে প্রিয়ার চিকিৎসা শুরু করি। জমানো টাকা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

এদিকে জামাই বিদেশে পাড়ি জমায়। আদিবা আমাদের সাথে থাকতে শুরু করে। মেয়েটার মুখে আজকাল হাসি দেখিনা। আদিবাই একমাত্র আমাদের যত্ন নিতে শুরু করে। আত্মীয়রা যারা অনেক কথা বলতো তারা দূরে সরতে থাকে। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর! বেশ কয়েক বছর যায়। আয়হীন জীবনে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ করে দেওয়া বাড়িটা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। পেনশনের টাকায় এই শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো।

আজ দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ফোন আসে আদিবার শ্বশুর বাড়ি থেকে। আদিবার জামাই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই! কলিজাটা ফেটে আওয়াজ আসে। খবরটা শুনে সাথে সাথে আদিবার আম্মু স্টোক করে। হাসপাতাল নিয়ে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে! আজ ডায়রীটা লিখতে লিখতে কয়েকটা পাতা ভিজে গেছে চোখের জলে। ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছে। সামাণ্য কিছু ভুলে সবকিছু উলোট-পালোট হয়ে যায়। কতগুলো সাজানো পরিবারে অমানিশা নেমে আছে। বেঁচে থাকার শক্তি হ্রাস পাচ্ছে দিনদিন।

আদিবার শ্বশুর বাড়ি থেকেও কেউ খোঁজ নেয়না মেয়েটার। আবার আজ সকালে ব্যাংক থেকে লোক এসেছিল। বলে গেছে ঋণ অনেক হয়ে গেছে। যদি ছয় মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করিরি তবে বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। আমার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে কলিজায় আঘাত করছে। আমার খুব করে মনে হচ্ছে “আমাদের সন্তানেরা যেটা চায়, সেটা যদি মন্দ না হয় আর দেওয়ার মত ক্ষমতা থাকে তবে আমাদের সেটা দেওয়া উচিৎ। কেননা পূর্বের কোনো কিছু ফিরে আসেনা আর বর্তমানকেও সব সময় মানিয়ে নেওয়া যায়না। ”

কয়েকদিন ধরে কোর্ট থেকে লোক আসতেছে বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। বাইরের দেওয়ালে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে না কি “এই সম্পত্তি এক্সিম ব্যাংকের আওয়তাভুক্ত।” এই বাসাটা ছেড়ে যাওয়ার আগের রাতে কোনো ভাবে ঘুম ধরছিল না,তারপরও কখন যেনো হালকা ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ কিসের শব্দে যেনো ঘুম ভেঙ্গে যায়। সারারাত আর ঘুম ধরেনা। আমার মনে পড়ে আমার স্ত্রী প্রিয়ার ডায়রীটার কথা। ডায়রীটা পশ্চিমের ঘরটাতে আছে। খুব পড়তে ইচ্ছে করছে আজ। মেয়েটা মনে হয় ঘুমোচ্ছে। থাক সকাল হলে চেয়ে নেবো ডায়রীটা।

সকাল হওয়ার সাথে সাথে আদিবা আমাকে বেলকুনিতে দোলনায় বসিয়ে রেখে যায়। আর বলে যায় “আব্বু আজকেই আমরা চলে যাব গ্রামে।” আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালিতে। সেখানে পুরাতন বাড়িতেই থাকবো এখন থেকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে স্বপ্নের এই বাড়িটা ছাড়তে। তবু কি আর করার এটা ধরে রাখার শক্তি বা অধিকার কোনোটাই আমার নেই। চোখ জোড়া পুকুরের দিকে গেলো। পুকুরটা সকাল সকাল শান্ত থাকে। দু একটা ভোরের পাখি উড়ে যায় নীড়ে। কয়েকটা সাদা বক আবার খাবারের সন্ধানে এসে পুকুরের ঘাটে ঘাটে বসে। আদিবা খাবার নিয়ে এলো। আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল এই বাড়ির কোনো জিনিসপত্র আমাদের সঙ্গে নিবো না। আমি চুপচাপ থাকি। বাকশক্তিও অবরুদ্ধ হয়ে আসছিল আমার।

নীল ডায়রীটাতে আর কোনো কিছু লেখা নেই। আমার চোখজোড়া ভিজে শার্টসহ চবচব হয় গেছে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ দু’টো মুছে নিলাম। আর মনে হলো নিয়তি মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়! এই ডায়রীটার শুরুতে লেখা ছিল “আমার স্বপ্ন বিলাস।” আর অধিকার না থাকা সত্ত্বেও আমি লিখে দেই ” আপনার স্বপ্ন বিনাশ।” একটু পরে আমার এই ঘটনার প্রিয়ার ডায়রীটার কথা মনে পড়লো। দ্রুত পশ্চিমের ঘরটার দিকে ছুটে গেলাম! (যদি সুযোগ হয় প্রিয়ার ডায়রীটার কথা লিখবো কখনো)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত