মাইয়াডা দেখছোস? পাক্কা ভুচকি। লগে যে চার পাঁচটা পোলা আছে। ওইগুলি ভার্সিটিতে পড়ে। সবাই মিল্লা ভাড়া কইরা নিয়া আহে। রাস্তায় খাড়াইয়া সারা দিন দুধ মুধ হাতায়। এরপর সন্ধ্যা হইলে ফ্ল্যাটে লইয়া কাম কইরা ছাইড়া দেয়।’ সোহেল এমন বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো কথাগুলো বললো; যেনো মনে হচ্ছে সোহেল কোন মুদি দোকানদার না- সে একজন টকশো বুদ্ধিজীবী। আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম,’ তোর কাছে সিগারেট চেয়েছি। কারো ক্যারেকটার সার্টিফিকেট চাই নাই।’ সোহেল সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললো,’ কথা মনে হয় গায়ে লাগলো তোর। ‘
‘ আরে ভাই সিগারেট দে।’
সিগারেট জ্বালিয়ে আমি আবার মোড়ের দিকে তাকালাম। দু’টো বাইক রাখা। একটাতে মেয়ে বসে আছে। আর তার পাশে চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাসছে; তারা কথা বলছে। বাস! এটুকুই। আমি পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। সিগারেট শেষ করে বাসার কেচিগেটে তালা দিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি। এমন সময় শুনতে পেলাম,’ এক্সকিউজ মি।’ কেচি গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটা। আমি বললাম,’ জ্বী।’
‘ আমার কাছে চাবি নেই। আপনি একটু খুলে দিবেন তালাটা?’
‘ কয় তালায় থাকেন?’
‘ তিন তালার উত্তর পাশে। গতকালই শিফট হয়েছি।’
আমি গিয়ে কেচি গেটের তালাটা খুলে দিলাম। মেয়েটা ভেতরে প্রবেশ করে ধন্যবাদ জানালো। এরপর নিজে থেকেই বললো,’ আপনি কয়তালায় থাকেন?’
‘ তিন তলায় দক্ষিণ পাশে।’
‘ ও পাশে তো বাড়িওয়ালী ভদ্রমহিলা আর উনার পরিবার থাকে।’
‘ জ্বী। আমি সেই পরিবারের সদস্য।’
‘ আপনি উনার বড় ছেলে শুভ?’
‘ জ্বী।’
‘ আমি মিলি। আন্টি বলেছিলেন গেটের চাবির ব্যাপারে আপনাকে যেনো বলি। ‘
‘ ঠিক আছে। আমি চাবি এরেঞ্জ করে দিবো।’ মিলি চলে যাচ্ছিলো। আমি আবার ডাক দিলাম, ‘ শুনুন।’
‘ জ্বী।’
‘ আপনার সাথে মোড়ে কিছু ছেলেকে দেখলাম।’
‘ ওহ। ওরা আমার ফ্রেন্ড। একচুয়ালি বাবা দেশের বাইরে থাকেন। ভাই নেই কোন আমার। তাই বাসা শিফট করার জন্য হেল্প করছিলো।’
‘ এরপর আসলে বাসায় এনে বসাবেন। ছাদে আড্ডা দেবেন। মহল্লা সিকিউর না।’
মিলি ভয় পেয়ে গেলো। আমি সাথে সাথে বললাম,’ আপনার জন্য সিকিউর। ছেলেগুলোর জন্য না। কিছু ছেলেপেলে আছে মহল্লায়। ওরা কোন মেয়ের সাথে ছেলেকে দেখলে হ্যারেজ করে মজা পায়।’ মিলি আর কিছু বললো না। সিড়ি দিয়ে উঠে চলে গেলো। ল্যাপটপে মুভি দেখছিলাম। এমন সময় মা’র সাথে একজন ভদ্রমহিলা আসলেন। মা আমাকে ডেকে বললেন,’ শুভ। উনারা ওই পাশের ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। তুই একটু ডিশওয়ালাকে বলে দেতো ওদের বাসায় লাইন দিয়ে যেতে।’
আমি সাথে সাথে কল দিয়ে মুখলেস চাচাকে বললাম। মুখলেস চাচা হলো এই মহল্লার ডিশ কোম্পানির ম্যানেজার।পেশা ডিশের লাইন দেয়া। আর নেশা গার্মেন্টসে চাকরি করা মেয়েদের পটিয়ে বিয়ে করা। এ পর্যন্ত সাতটা বিয়ে করে ফেলেছেন। সন্ধ্যায় এসে মুখলেস চাচা ডিশের লাইন দিয়ে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম। মুখলেস চাচার উপর কোন ভরসা নেই। ঘটনা ওখানেই শেষ নয়। ডিশের লাইন দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়েই মুখলেস চাচা কল দিলো।
‘ হ্যালো চাচা। বলো।’
‘ কিরে? কি ভাড়া দিছোস? মা আর মেয়ে দুইটাই তো মাল। শরীর ভাড়া দেয় নাকি।’
‘ বালের প্যাচাল পাইরো না তো। ফোন রাখো।’ আমি কল কেটে দিলাম। রাতে রিয়াদের কল। বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলাম।
‘ হ্যালো শুভ।’
‘ বল।’
‘ তোগো বাসায় নাকি জোস একটা মাল ভাড়া আইছে।’
‘ ঘুমামু। ফোন রাখ।’
আবার কল কেটে দিলাম। রিয়াদ আমার বন্ধু। বন্ধু বললে ভুল হবে বাল্যবন্ধু। একজন মেয়েকে বশে আনার জন্য ওর কাছে সবকিছু আছে। ফর্সা স্ক্রিন, সিক্স প্যাক, প্রাইভেট কার, বাইক, ক্রেডিট কার্ড, স্মার্টনেস ইত্যাদি। এক কথায়- হি ইজ পার্ফেক্ট। হি ইজ বেস্ট। আর মহল্লার যে কোন মেয়ের বাসায় সে অবলীলায় যেতে পারে। কারণ ওর ব্রডব্যান্ড এর বিজনেস। সেই ব্রডব্যান্ড এর লাইনের ছলনায় পরদিন মিলিদের বাসায় হাজির। খুব সুন্দর করে মিলিকে বললো,’ শুভ বললো আপনাদের বাসায় ব্রডব্যান্ড এর লাইন দিয়ে যেতে।’ আমার সামনে এতোবড় মিথ্যে বলার পরও আমি কিছু বলতে পারলাম না। শতহোক বন্ধু মানুষ।
এরপর থেকে প্রায়শই নেটের লাইনের প্রবলেমের অজুহাতে রিয়াদ মিলিদের ফ্ল্যাটে আসতো। আমাদের ছাদে বসে আড্ডা দিতো। আমি মিলিকে সাবধান করতে চাচ্ছিলাম কেন যেনো। কিন্তু কিসের জন্য সাবধান করবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে দু’মাস চলে গেলো। একদিন সন্ধ্যে সবে অফিস থেকে ফিরেছি। ফ্ল্যাটে ধুকে দেখি মিলির মা বসে আছেন। আমাকে দেখেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ বাবা! আমার মেয়েটা ভার্সিটি থেকে ফিরে নি। নাম্বারও বন্ধ পাচ্ছি।’
‘ আপনি ওর ভার্সিটির ফ্রেন্ডের ডিটেলসগুলো আমার ছোট ভাই আদিয়ানকে দিন। বাকীটা আমি দেখছি।’ রুমে এসে মোবাইল বের করে রিয়াদকে কল দিলাম।
‘ বন্ধু বল।’
‘ তুই কই রিয়াদ?’
‘ আমি তো বিক্রমপুর আসছিলাম। ‘
‘ মিলি কই?’
‘ জানি না তো।’
‘ এখন সাড়ে সাতটা বাজে। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত সময় দিলাম। এর মাঝে মেয়েটাকে সহীহ সালামতে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যা।’
‘ আরে ভাই আমি বিক্রমপুর। মিলিকে কই পাবো?’
‘ এর আগে একদিন শরীফ চাচার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না- সেদিন তুই বিক্রমপুর ছিলি। চার নাম্বার লাইনের নিরাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না- সেদিন তুই বিক্রমপুর ছিলি। আরে মাদারচোদ” আমার কপালে কি বোকাচোদা লিখা আছে? সাড়ে এগারোটার মধ্যে মিলিকে না দিয়ে গিলে আমি কিন্তু পুলিশ নিয়ে তোর বাসায় যাবো। তোর বাবা কিন্তু হার্টের রোগী। মনে রাখিস। ‘ আমি ফ্রেশ হয়ে ছাদে চলে এলাম। কতোক্ষণ ছাদে আছি মনে নেই। তবে ঘড়ির কাটায় সময় বারোটার আশেপাশে। এমন সময় মিলি আসলো ছাদে।
‘ হাই!’ অনেকক্ষণ কেঁদেছে মনে হয়। গলার স্বর ভেঙে গেছে। আমি বললাম,’ হ্যালো।’
‘ থ্যাংকস। ‘
‘ ওয়েলকাম।’
‘ আপনি আমাকে সাবধান করেন নি কেন?’
‘ আপনি তখন অন্ধ ছিলেন।’
‘ মানে?’
‘ আমি একজন আর আট দশজন সাধারণ মানুষের মতো দেখতে। রিয়াদ তার উল্টোটা। আমি যদি ওর ব্যাপারে কিছু বলতাম আপনি কি বিশ্বাস করতেন?’
মিলি কিছু বললো না। কিছুক্ষন নিরবতা। এরপর নিরবতা ভেঙে নিজেই বললো,’ সাপোস আমার কিছু হয়ে যেতো। তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন?’
‘ সর্বোত্তম আর সর্বশ্রেষ্ঠ এর মাঝে পার্থক্য কি জানেন? ‘
‘ নাহ।’
‘ সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেব করা হয়- রূপ, গুণ, অর্থ, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি দিয়ে। তবে সর্বোত্তম হিসেব করা যায় না। এরা আফসোসের মতো হয়। চুপিসারে সাধারণের মন জয় করে যায়। যেমন ধরুন মাশরাফি। তার চেয়ে অনেক ভালো বোলার আছে বাংলাদেশে। মুস্তাফিজ, রুবেল, সাইফুদ্দিন। ইত্যাদি। কিন্তু মাশরাফি যেভাবে মন জয় করেছে ; যতোটা ভালবাসা পেয়েছে বাকীরা কি তা পেরেছে বা পেয়েছে? মুস্তাফিজ, রুবেল, সাইফুদ্দিনকে আপনি স্ট্যাটিসটিকস দিয়ে প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু মাশরাফিকে স্ট্যাটিসটিকস দিয়ে প্রকাশ করতে গেলে ভুল করবেন। ‘
মিলি হেসে ফেললো। বললো,’ একটা সিরিয়াস বিষয়ে ছিলাম। সেখান থেকে ক্রিকেটে নিয়ে গেলেন। আচ্ছা! একটা জিনিস বলুন তো আপনি আমাকে এভোয়েড করতেন কেন? আপনার ফ্রেন্ড আপনার রেফারেন্সে এসে আমার তো সর্বনাশই করতে চেয়েছিলো। সেই বেনিফিটটা আপনিও পারতেন।’
আমি সিগারেট ধরলাম। খুব ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম,’ আপনার বয়স কতো বিশ কি একুশ? আরো চল্লিশ বছর পর যখন আপনি ষাট পেরোবেন। তখন কোমড়ের ব্যথায় রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আপনি বলতে পারবেন- আপনার যৌবন সুধা পান করার জন্য যখন হাজারো পুরুষ প্রেমিক সাঁজছিলো; তখন কেউ একজন ছিলো। যে ওই প্রেমিকদের ভীড়ে ছিলো না। যে ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে পুরুষত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।’ মিলি কিছু বলতে চাচ্ছিলো। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,’ স্যরি আমার যেতে হবে। সকালে অফিস আছে।’ আমি চলে আসি ছাদ থেকে। জানি না মিলি কতোক্ষণ ছাদে বসে ছিলো।