উচ্চ জীবন: ৪. পিতৃ-মাতৃভক্তি

উচ্চ জীবন: ৪. পিতৃ-মাতৃভক্তি

৪. পিতৃ-মাতৃভক্তি

হযরত মুহম্মদ বলেছেন–মায়ের পায়ের তলে স্বর্গ। তিনি আবার বলেছেন–মা-বাপের চেয়ে খোদাই তোমার বেশি আপন।

পিতামাতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তবে সেখানে না করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পিতৃ মাতৃভক্তি। মায়ের ভিতর যে সত্য মা রয়েছেন তাকেই মেনে নিতে হবে।

উড়িষ্যায় একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মানুষ না খেতে পেরে মরছিল। প্রথমে টাকা খরচ করে চাল পাওয়া যেতো, শেষে চালেরও অভাব হল। মানুষ পথে বের হল কিন্তু সবারই যে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। কে কাকে অন্ন দেবে? এরপর মানুষ গাছের পাতা খাওয়া আরম্ভ করল। শেষে তাও ফুরিয়ে গেল। সে দেশে একটা উড়িয়া পরিবার ছিল। দুটি ছেলে আর পত্নী। বাপ তাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন কোন দিকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে এলো না। যা কিছু ছিল সব বিক্রয় করে ফেলা হল, তবুও ক্ষুধা নিবৃত্তি হল না। মানুষ যা-তা খেয়ে জ্বর, কলেরায় মরে যেতে লাগল। শেষে দেশে কিছুই রইল না, কেবল রইল উত্তপ্ত বালি আর রৌদ্র। একদিন ছোট ছেলেটি ভিক্ষার জন্য বের হয়ে সেও আর ফিরে এলো না। মা ক্ষুধা ও ব্যাধির যন্ত্রণায় বিছানায় পড়লেন। তিনি প্রথমে দুই-তিন দিনে সামান্য কিছু মুখে দিতেন, এখন তাও দেন না। দুর্বল অস্থিসার শরীরে কাঁদবার শক্তিও ছিল না। বড় ছেলে ভিক্ষা করে যে দুই মুঠা পায় তাই এনে মাকে খাওয়ায়। সে নিজে কোনো দিন খায়, কোনো দিন খায় না। মায়ের জন্যে অশ্রুতে তার চোখ ভেসে যায়। মা না খেতে চাইলে সে অনুনয় করে তাকে খাওয়ায়। মা না খেলে কাঁদতে থাকে। ছেলেটির নাম সনাতন।

এইভাবে দুই-চার দিন গেল। একদিন সনাতন ভিক্ষায় বের হল। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিল আর মায়ের কথা ভাবছিল। সে ভাবছিল এতদিন মাকে বাঁচাতে পেরেছি। আজ আর পারবো না, মা নিশ্চয়ই মরে যাবে, খোদা একমুঠা চালের যোগাড় তুমি করে দাও। মা আমার পথ চেয়ে আছে। পিতা কোথায় চলে গেছেন, ভাইও ভিক্ষায় বের হয়ে আর ফিরে এলো না।

সেদিন সনাতনের চরণ জড়িয়ে আসছে। তবুও হাঁটছিল। এক ব্রাহ্মণের বাড়ির দুয়ারে এসে সে ভিক্ষা চাইল। ব্রাহ্মণ বড় দয়ালু, কিন্তু তা হলে কী হয়? তার ঘরেও বেশি কিছু ছিল না। বালকের শীর্ণ চেহারা দেখে বললেন, বাবা আমরা যা বেঁধেছি তারই এক মুঠো তোমায় দিচ্ছি, কিন্তু এত অল্প অন্নতে তোমার কী হবে? সনাতন বলল–আমায় তাই দিন, তাই আমি নিয়ে যাব। ব্রাহ্মণ সনাতনকে বসতে বলে বাড়ির ভেতর থেকে কিছু ভাত এনে জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় বসে খাবে?

সনাতন বলে–আমি খাব না, সঙ্গে নিয়ে যাবো। ব্রাহ্মণ বললেন–সে কি? এত অল্প ভাত কোথায় নিয়ে যাবে? এখানে বসেই খাও। সনাতন বিনীতভাবে বলল না–মহাশয়, একমুঠো ভাত হলেও আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।

ব্রাহ্মণ বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, বালক বলল–মা আমার তিন দিন না খেয়ে ঘরে পড়ে আছে। মায়ের কথা বলতে যেয়ে সনাতন কেঁদে ফেলো। ব্রাহ্মণ বালকের কথা শুনে নিতান্ত ব্যথিত হলেন। এবার তিনি কিছু বেশি করে ভাত আনতে গেলেন; কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন দুর্বল শরীরে হঠাৎ মানসিক উত্তেজনায় সনাতন মাটিতে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে। শরীরে তার প্রাণ নেই।

সনাতনের অতুলনীয় মাতৃভক্তি চিরকালই মানুষের ভক্তি-অশ্রু আকর্ষণ করবে।

পিতামাতা অনেক সময় ছেলেদের অবাধ্য বলে গালি দিয়ে থাকেন–ছেলে যদি অবাধ্য হয় তবে তার কারণ পিতামাতার জ্ঞানের অভাব। বুদ্ধিহীন সেনাধ্যক্ষ যেমন সৈন্যদেরকে চালনা না করতে পেরে নিজেদেরই অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, পিতামাতাও তেমনি অবাধ্য ছেলের নিন্দা করে নিজেদের হালকামির পরিচয় দেন। মানুষ সব জায়গাতেই মানুষ; অন্যায় রকমে আঘাত পেলেই সে ক্ষেপে উঠবে। কীরূপ ব্যবহার করলে ছেলেরা চরিত্রবান, বিনয়ী ও ভক্তিমান হয়ে উঠে, তা এখানে বলা কঠিন। একদিক হতে কোনো কালে ভক্তির উৎস বয় না। স্নেহ বিচক্ষণ ব্যবহার ও নিরন্তর সন্তানের মঙ্গল কামনা ছেলেমেয়েকে তাদের প্রতি বাধ্য করতে সক্ষম। শিশু ও ছেলে মেয়েরা বিচক্ষণ ঋষি নয়, মুরুব্বীদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, তা তারা জানে না। পিতার জন্যে যদি প্রাণ দিতে হয়, তা তারা চিন্তা ও যুক্তিতর্ক না করে দেবে। শিশু ও যুবকের মনকে যুক্তি দিয়ে বশ করতে যাওয়া বড়ই ভুল। ক্রুদ্ধ হলে ছেলেরা আল্লাহকে অপমান করতে ইতস্তত করে না, সে যে অবোধ।

অতিরিক্ত স্নেহে অনেক সময় পুত্র-কন্যাদের নৈতিক অধঃপতন হয়। লোকে বলে–চোরের পুত্র চোরই হয়ে থাকে। পিতামাতার স্নেহের শক্তি এত বেশি যে, তা ভেবে দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। মানুষকে কঠিনভাবে আঘাত করলেও সে তার পিতা-মাতার সংসার ত্যাগ করতে পারে না। তাই অনেক সময় পিতা ও মাতার রূঢ় ও কঠিন ব্যবহার আশীর্বাদস্বরূপ মানব জীবনের সমূহ কল্যাণ করে থাকে।

পিতা কঠিন আঘাত করেছেন সন্তানকে তা কিন্তু নীরবে মেনে নিতে হবে। অসহ্য হলে দূরে সরে যেতে পার, তার সঙ্গে কলহ বিবাদ করা কাপুরুষতা। বিয়ে হলে পুত্রবধূর সঙ্গে কোনো কোনো স্থলে পিতার মিল হয় না, ফলে পুত্রের সঙ্গেও অনেকটা অপ্রীতিকর সম্বন্ধ এসে জোটে। বহু অপদার্থ মানুষ পিতৃভক্তির ভুল অর্থ বুঝে পিতার মনোরঞ্জনের জন্যে পত্নী ত্যাগ করে। এদের মতো পিতৃদ্রোহী আর নেই। পিতার ভিতর যে সত্য পিতা রয়েছে; তাকেই মানতে হবে। পিতার অসত্যকে বরণ করে অনেক পিতৃভক্ত সন্তান পিতার আদর লাভ করে, এরা সুখে জীবনযাত্রা নির্বাহ করলেও এদের মূল্য খুব কম। পুরুষের নিঃসহায় পত্নীর প্রতিও একটা কর্তব্য রয়েছে।

পিতামাতার অবস্থা যদি শোচনীয় হয়, অন্নাভাবে তারা যদি উপবাসী থাকেন, তা হলে তাদের জন্য সম্পদশালী ব্যক্তির অর্থ প্রয়োজনমত না বলে নিলে কোনো দোষ হয় না। কিন্তু তা যদি না হয় তবে পিতার অর্থ লালসা বা তার অসুখের জীবনযাপনের জন্যে তুমি অধর্ম করে পয়সা উপায় করতে পার কিনা। তাতে তোমার পিতা যদি তোমায় অভিশাপ দেন কোনো ক্ষতি নেই।

মেবারের রাজা মাড়বার রাজকন্যার সঙ্গে ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। যখন কথা হচ্ছিল তখন রাজা রহস্য করে বলেছিলেন–আমার মতো বুড়োর হাতে কেউ মেয়ে দেবে না। এ রহস্যের মাঝে এতটুকু দুর্বলতা ছিল না। পুত্র সে কথা শুনে বললেন–”আমার বাপের সঙ্গেই রাজকন্যার বিয়ে হবে।

পুত্রের কথা শুনে রাজা ছেলেকে ডেকে বললেন–আমি বুড়ো হয়েছি, তোমাকেই এখন সংসারী হয়ে সব ভার নিতে হবে। পাগলের মতো এ কী কথা বলছ?

পুত্র বললেন–আমি এ মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।

রাজা কিছু বিরক্ত হয়ে পুনরায় বললেন–দিন ঠিক হয়ে গিয়েছে। বিয়ে না করলে কী হবে, তা কি তুমি বুঝতে পারছ না।

পুত্র পুনরায় বললেন–আমার দ্বারা এ কাজ অসম্ভব। ক্রমে রাজা ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এদিকে দিনও ঘনিয়ে আসছিল। রাজকন্যার নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হওয়া চাই, নইলে সর্বনাশ হবে। রাজা আর একবার পুত্রকে ডেকে তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। এবার রাজা কঠিনভাবে বললেন–পুত্র তবুও অসঙ্কোচে বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। এবার রাজা আরও কঠিনভাবে বললেন–বেশ আমিই এই বালিকাকে বিয়ে করছি কিন্তু ঠিক জেনো এর গর্ভে যদি কোনো সন্তান হয় তবে সেই সিংহাসনে বসবে। পুত্রকে ভয় দেখিয়ে পথে আনবার জন্যেই রাজা একথা বলেছিলেন। কিন্তু তবুও পুত্র পিতার মতোই কঠিন ভাষায় বললেন–ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, আমি আপনার সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করলাম।

মা মরলে পিতা অনেক সময় দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকে, এতে অনেকে বিরক্ত হয় নতুন মাকে অপমান ও অপ্রস্তুত করতে আনন্দ অনুভব করে। পুত্রের পক্ষে পিতার প্রতি এর বেশি দুর্ব্যবহার আর নাই। নতুন নারীকে ‘মা’ বললে তো কোনো দোষ হয় না–এতে মৃত মায়ের প্রতি অসম্মান দেখান হয় না। এ যে মনে করে তার মন খুবই ছোট। হারানো মার আসন পুরোতে আর একজন নারী যে এলেন, সে জন্যে নিজকে সৌভাগ্যবান মনে কর। মানুষ পথের নারীকে মা বলে আনন্দ অনুভব করে, আর তুমি তোমার পিতার পত্নীকে মা বলতে সঙ্কোচ বোধ কর? নতুন মা ছেলেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এ কথাটা অন্যায়। বর্বর সমাজে শুধু মা বলে নয়, প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি কঠিন ব্যবহার করতে আনন্দ বোধ করে। আপন মৃত মায়ের মতো নতুন মায়ের সহ্য করার ক্ষমতা না থাকতে পারে। সে যদি দৌরাত্ম সহ্য না করতে পেরে শিশুকে একটু মারে, সেজন্যে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তার স্বভাব ও মন নিষ্ঠুর নয়। পর বললেই মানুষ পর হয়ে যায়। তৃষিত পথের কুকুরকে মানুষ গালি দেয়, নিজের স্বামীর পুত্র কন্যাগণকে নারী কেন ভালবাসে না? মানুষ প্রেম হতে জন্মেছে, ভালবাসা তার স্বভাব।

সৎমাকে সৎমা বলে তার মনুষ্যত্বের অবমাননা করো না। মায়ের মৃত্যুর পর পিতার বিবাহে কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। বাপ বুড়ো হয়ে গিয়েছে এ বয়সে তার বিয়ে করা অন্যায় এসমস্ত কথা বলা নিতান্তই অভদ্রতা। বুড়ো মানুষের বালিকার সঙ্গে বিয়ে আমি। সমর্থন করছি না। নতুন মায়ের ছেলে হলে, তার সম্পত্তির অংশ পাবে এই ভয় পোষণ করাও নীচাশয়তা। বাপের সম্পত্তি ভোগ করবার জন্য তোমার এত লালসা কেন? যতদিন নিঃসহায় ছিলে, তৃতদিনই তোমার অপরের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। যে সমস্ত পুত্র পিতার সম্পত্তির লোভে ক্ষুধিত শৃগাল হয়ে বসে থাকে, তারা অপদার্থ। বিশ্বকে মানুষ সর্বস্ব দান। করেছে, তুমি তোমার ভাইকে তোমার নিজের অংশ দিতে কষ্ট বোধ করবে কেন? হোক না যত ইচ্ছা ভাই বোন, তাদের সকলকে নিয়ে ইসলামের সেবায় জীবন উৎসর্গ কর।

মৃত মায়ের সম্পত্তি নিয়ে অনেক পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য হয়। পুত্র পিতার সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করতে কষ্ট বোধ করে না। শিশুকালে যে একবার তোমায় চুমো খেয়েছে তার কাছে তুমি কত ঋণী আর পিতা কলিজার স্নেহ দিয়ে তোমায় পালন করেছেন তাঁর সঙ্গে কি কোনো আড়ি করা যায়? পিতা যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পুত্রকে দূর হয়ে থাকতে বলেন তবে নীরবে তার ইচ্ছামতই কাজ করতে হবে, তার প্রতি ক্রোধ পোষণ করা ঠিক নয়।

অত্যধিক পিতৃভক্তিতে পত্নী ত্যাগ করা কিংবা পত্নীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া মনুষ্যত্ব নয়–পত্নীর দাবি শোধ দিবার জন্যে যদি পিতাকে অসন্তুষ্ট করতে হয়, তবে তা করতে হবে যদি পরীর সম্ভ্রম রাখবার জন্যে জমিদারি ত্যাগ করতে হয় তাতেও তোমার মনুষ্যত্বের অবমাননা হবে না। পিতার খেয়ালের মূলে একটা মানুষ হত্যা করা মানুষেরা। কখনও অনুমোদন করে না।

পিতার মৃত্যুর পর নতুন মায়ের প্রতি কখনও অসদ্ব্যবহার করবে না। এরূপ করা কাপুরুষতা।

সামান্য সামান্য ব্যাপারে পুত্র-কন্যারা পিতা-মাতার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করবে; তা পিতামাতাদেরই শিশু অবস্থায় শেখান কর্তব্য। নইলে এসব তারা কোনো কালে নিজে শিখবে না।

মা যদি অল্প বয়সে বিধবা হন, তবে, তাকে পুনরায় বিয়ে করতে বলা উচিত। এতে কিছুমাত্র অসম্মান বা লজ্জা নেই। হীন ব্যক্তির ঘরে যেয়ে যদি তার কোনো অসম্মান হবার ভয় থাকে তবে সেজন্যে অভিভাবক হয়ে পূর্ব হতেই মাকে সতর্ক করবে; তাই বলে তার স্বামীর মতের উপর হস্তক্ষেপ করো না। যারা এ বিষয়ে কোনো প্রকার ব্যঙ্গোক্তি করে। তারা নিতান্তই ঘৃণিত জীব।

পুত্রকন্যা যেদিন ভূমিষ্ট হয়, সেদিন মনে ভেবো–আজ আল্লাহর বান্দা আমার ঘরে এসেছে; না জানি খোদা তাকে কী উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার জন্য জগতে পাঠিয়েছেন। আমি পিতা নই–আল্লাহর বান্দার সেবক। যে পিতা মাতার পুত্র-কন্যাগণ সম্বন্ধে এরূপ কল্পনা করতে পারেন, তিনি কত বড়, তার পুত্রেরা মহাপুরুষ হবে না কেন? জনক-জননীর জন্য তারা অকুতোভয়ে হাসতে হাসতে তলোয়ারের সামনে যেয়ে দাঁড়াবে।

মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শিশুকে পালন কর–বড় হয়ে তোমার জন্য হৃদয়ের রক্ত দেবে।

মা যদি বিধবা হন, তবে দিনের মধ্যে বসে তার সঙ্গে নানা বিষয়ের গল্প করা চাই। বৌ নিয়ে যদি বিদেশে থাকতে হয় তাহলে মায়ের বিশেষ ইচ্ছা ব্যতীত তাকে একাকিনী বাড়িতে ফেলে রাখবে না। বৃদ্ধ বয়সে নারীর একমাত্র অবলম্বন পুত্র। তাঁর সঙ্গ হতে বঞ্চিত থাকা তার অবলম্বনহীন জীবনে খুবই বেদনার কথা। অনেক মা নিজের সুখের কথা না ভেবে অনবরত পুত্রের মঙ্গল ও সুখের কথা চিন্তা করেন। এই জন্যই মায়ের কথা বেশি ভাবতে হবে।

বিয়ের পর কোনো কোনো পিতা-মাতা মনে করে ছেলে পর হয়ে গিয়েছে–পুত্রবধূর, সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে পুত্রবধূকে নিতান্ত অস্থির করে তোলেন; জীবনের এই অবস্থাটা বড়ই সমস্যাপূর্ণ। নানাফন্দি করে; পিতামাতা ও পত্নী উভয়পক্ষেরই মন রক্ষা করতে হবে। পিতামাতা যতই কোনো অন্যায় কথা বলুন; তাদের বিরুদ্ধে সন্তানের কিছুই বলার নেই। মনের কষ্ট বুকে চেপে রেখে সব নীরবে সহ্য করতে হবে। পিতা মাতার সঙ্গে রোষ-পূর্ণ বাক্য ও উগ্র ব্যবহার করবে না। সন্তানের পক্ষে বড়ই অগৌরবের কথা।

এক রাজা, বেড়াতে বের হয়ে প্রজাদের অবস্থা দেখতেন। প্রজারা নানা উপহার দিয়ে রাজা-রানীকে সম্মান জানাচ্ছিলেন। এক বৃদ্ধ তার সাতটি পুত্র এনে রাজাকে বললেন-হে সত্যের প্রতিনিধি, আমার আর কিছু নেই–দেশ কল্যাণের জন্যে আমার এই সাত পুত্র উপহার দিচ্ছি।

রাজা বৃদ্ধকে বললেন–আপনার এই দানের চেয়ে আর কোনো দান শ্রেষ্ঠ হয় নি। আপনার এই শ্রেষ্ঠ উপহার আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। সত্যের সেবকের কাছে সত্যের সৈনিকই শ্রেষ্ঠ উপহার।

যে পিতা দেশ কল্যাণের জন্য পুত্রগণকে দান করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ পিতা। যাদের এমন পিতা পাবার ভাগ্য হয়েছে জীবন তাদের সার্থক। পিতার মঙ্গল উদ্দেশ্যের মুখে যদি জীবন বলি দেওয়া যায় তবে তার মতো পিতৃভক্তি আর নেই। হযরত ইব্রাহিম যখন বললেন, পুত্র, সত্য তোমাকে আহ্বান করছে। তোমার হৃদয় রক্ত দিয়ে সত্যের মর্যাদা রাখতে হবে। শিশু তখনই বললেন-বাপ, এতেই তো জীবনের সার্থক।

সত্যের জন্যে তোমার যা কিছু আছে সব উৎসর্গ করতে হবে। কারবালার মরুমাঠে তৃষ্ণায় এক এক করে মরতে হবে তথাপি অসত্যকে নমস্কার করতে পার না।

যে পিতা জীবনকে এমন করে সার্থক করে দেবার জন্যে আহ্বান করেন তিনি ধন্য। এস বিশ্বের সকল সন্তান তাঁকে সালাম করি।

পিতাকে ভক্তি করি কেন? তিনি আমার শরীরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সেই জন্যে? মনুষ্যত্বকে অবমাননা করে, তার প্রাণপন চেষ্টায় জীবনকে সুখী করতে পেরেছি, এই জন্যে? আমি তার উপার্জিত অর্থে আরামের পথ নিরাপদ করতে পেরেছি এ জন্যে? না, না, না–সে জন্যে নয়। আমি চাই মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা, আমি চাই মানুষের সত্য জীবনের উদ্ধার, আমি চাই অবিচারের অবসান, আমি চাই দুঃখের অবসান। আমার সাধনাকে আমার পিতা তার স্বরে মনে করিয়ে দিয়েছেন। এ জীবন ব্যর্থ হবার নয়। আঁধার রাতে আমার পিতা আমার পাশে জীবনের মহাসঙ্গীত শুনিয়েছেন; আমি স্পন্দিত প্রাণে তার মুখের দিকে চেয়েছিলাম, তিনি আমার বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ভয় নেই। তুমি শক্তি,–এই আঁধার সাগর পাড়ি দিয়ে তোমাকে আলোকের রাজ্যে দাঁড়াতে হবে–তুমি অনন্ত, বিনাশ তোমার নেই; তুমি বিরাট–তুমি ছিলে তুমি আছ–তুমি থাকবে। আমার দেহ, মন, প্রাণ, রক্ত, সবগুলি তরল হয়ে পিতার চরণ সিক্ত করেছিল।

এমন পিতার বিদ্রোহী সন্তান হয়ে কি আমি নিজেকে হত্যা করতে পারি? তা হলে বিশ্বের সকল গান যে আজ থেমে যাবে আজ আকাশে বাতাসে কেবল ক্রন্দন জেগে উঠবে।

তুমি পিতাকে সন্দেশ রসগোল্লা খাওয়াও, মাতাকে বহুমূল্য পোশাক দাও, আজ্ঞা পালনের জন্যে নত মাথায় তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাক, এই দেখেই আমি তোমাকে পিতৃ মাতৃভক্ত বলতে পারবো না। আমি জিজ্ঞাসা করবো–তোমার স্বভাবে কলঙ্ক আছে কিনা? তুমি চরিত্রবান কিনা? মানুষ তোমার সৎগুণের কথা বলে কিনা? তোমার স্পর্শে এসে নরনারীকে বিপন্ন হতে হয় কিনা? মানব শিশুকে তুমি স্নেহ কর কিনা? যদি কোথাও উত্তর না পাই–আমি বলবো তুমি পিতৃ-মাতৃভক্ত নও–তুমি বিদ্রোহী অভাগা।

দৈনন্দিন জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে পিতামাতার স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি নজর রাখতে হবে–ভুল করে তা যেন কেউ মনে না করে।

এক ভদ্রলোক সবার মাঝে বলেছিলেন, আমি আমার সন্তানকে দেশের কাজে দান করলাম। সন্তানরা বন্ধু বান্ধবের কাছে বলেছিলেন–পিতার ইচ্ছায় আমরা আমাদের জীবন নষ্ট করতে পারি নে। এরা বৃদ্ধ পিতাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন, তারা পিতার সর্বপ্রকার সুখের ব্যবস্থা করে দিতেন, তবু এদের পিতৃভক্ত বলতে আমার সংকোচ হয়। যে পুত্র পিতার জড়দেহের সেবা করেই তৃপ্তি লাভ করে তার ভক্তি নিকৃষ্ট। পিতার সত্য ও আত্মার বাণীতে যে সাড়া দেয়, ভক্তি পথে তার স্থান অনেক উচ্চে। পিতার আত্মার আদর্শকে অবমাননা করে যে তার দেহের সুখ দান করে সে কাপুরুষ; পিতার আশীর্বাদ পাবার উপযুক্ত সে নয়। লোকমুখে অনেক সময় শুনেছি, দরিদ্র পিতা পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুত্র লজ্জা করে বন্ধুবান্ধবদের কাছে তার পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেছেন। পিতা যদি দরিদ্র হন সে জন্য তো লজ্জার কিছু নেই। কার্লাইল সব সময়ই নিজেকে চাষার ছেলে বলে পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করেছেন। এ জগতে বহু মহাপুরুষ জন্মেছেন, তাঁরা খুব দরিদ্রের ছেলে। আত্মশক্তিতে নিজের সাধনায় মানুষ বড় হয়। বাপের দারিদ্র্য তোমাকে ছোট করে না।

তুমি যদি ছোট লোকের ছেলে হতে তাতেও তোমার লজ্জার কোনো কারণ নেই। হীন চরিত্র পিতামাতার স্নেহ অনেক সময় মানুষকে নীচ ও ছোট করে রাখে। কিন্তু তোমার মধ্যে যে তোমার পূর্ব-পুরুষের নীচতা রয়েছে–সেকথা বলবার আগে আমাকে অনেকখানি ভেবে দেখতে হবে। হীন বংশে জন্মেছ বলেই যদি কেউ তোমাকে ছোট মনে করে, আমি তাকে ঘৃণা করি। ছোট লোকের ছেলে ছোট হয় কোনো সময়ে? যখন তার মধ্যে আত্মশুদ্ধির কোনো প্রচেষ্টা না থাকে, বিবেক যেখানে স্নেহের দানে দুর্বল হয়ে পড়ে, যেখানে একটা নিরর্থক দাম্ভিকতা বিদ্যমান থাকে, সেখানে অহঙ্কার নিজের ভুল বোঝবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে আত্মা নির্মল, শুদ্ধি সাধনায় সদাই সজাগ; মনুষ্যত্বের আহ্বান চঞ্চল, সেখানে কি আমি তোমায় ঘৃণা করতে পারি? যে সত্য সাধকের কুৎসা রচনা করে, তাকে দুর্বল করে ফেলতে চায়, তার নামায রোযা বৃথা। খোদার সঙ্গে যে আত্মীয়তা করেছে, হউক সে দাসীর ছেলে, তাকেই শ্রদ্ধা করতে হবে। খবরদার তাকে অসম্মান করো না।

মা-বাপ ছোট হলে তার পরিচয় দিতে কখনও লজ্জা বোধ করো না। যদি কেউ ঘৃণা করে তার সঙ্গে তুমি সম্বন্ধ নষ্ট করে ফেলো। যে বন্ধু তোমার বাপকে স্বীকার করে না, তার সঙ্গে তোমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। বাপের অপমান শুনে তোমার বন্ধুরা প্রকাশ্যে না হোক অন্তরালে হাসতে পারেন, তা হলেও তোমার লজ্জা বোধ করবার দরকার নেই। তুমি যখন। তোমার পাগল বাপের মুরব্বীয়ানা সহ্য করতে পেরেছ, তখন তোমার বন্ধুরা কি দুই মিনিটের জন্য তা পারবে না? সভার মাঝে হোক, গোপনে হোক, পিতামাতার সঙ্গে দেখা হলেই সমাজের রীতি অনুসারে তাকে সম্ভ্রম জানাবে।

বাপের নামের সঙ্গে কোনো উচ্চ উপাধি নেই বলে লজ্জাবোধ করবার দরকার নেই। তাঁর নাম লিখতে অনর্থক একটা মুনশী উপাধি লাগালে তাকে অপমান করা হয়। উপাধি ব্যবহার জিনিসটা নিতান্তই আপত্তিজনক। নামের সঙ্গে যারা আজকাল চৌধুরী, খ ও কাজী উপাধি লাগান, তারা হয়তো বলতে চান আমরা অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। খুব বিস্ময়ের কথা সন্দেহ নেই।

প্রবন্ধ লেখকের বংশকে লোকে জরদার বংশ বলে থাকেন। জরদার অর্থ স্বর্ণ অথবা ধন-সম্পত্তির মালিক। বড়লোক ছাড়া কারো এই উপাধি হয় না। নদীয়া জেলায় এক ব্রাহ্মণের এ উপাধি আছে; সুতরাং এ উপাধি ব্যবহার করতে মনে গর্ব ছাড়া লজ্জা আসে না। কিন্তু বিবেকের কাছে অনুমতি চাইলে সে জিজ্ঞাসা করেছে তোমার অর্থ কই? আর অর্থ যদিই থাকে, তবে তা লোকের কাছে প্রচার করা কী প্রকার ভদ্রতা?

কোন্ সালের টাকা, কে আমাকে দিয়েছে, এর পূর্বে কার বাক্সে ছিল তা আমার জানবার দরকার নেই–আমি শুধু একটিবার তাকে বাজিয়ে দেখব।

সংসার যখন ভারী হয়ে ওঠে, যখন ছেলেপিলে, দাসদাসী, আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভর্তি হয়ে পড়ে, তখন অনেক সময় বুড়ো বাপ-মায়ের বড় অসম্মান হয়।

এক বাড়িতে আমি দেখেছিলাম, পিতার জমিদারি সবাই ভোগ করছে অথচ সকলের খাওয়া শেষ হলে বাইরে অতিথির মতো পিতাকে ভাত দেওয়া হয়। খাবার সময় তাকে পানি দেবার লোকও থাকে না।

ছেলের মাথার চুল পেকেছে বলে কী সে বাপকে ‘বাপ’ বলে ডাকতে লজ্জা বোধ করবে? কে এই নরাধম? আমি তাকে ঘৃণা করি।

পিতা বা বুড়ো মায়ের অনর্থক বকাবকি শুনে যে ধৈর্য হারিয়ে উপহাসের হাসি হাসে, সে অপদার্থ। মানুষ বড় হলে শিশু হয়, শিশুর মতোই তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে হবে।

এক ইংরেজ পরিবারের বুড়ো দাদাকে নিয়ে ছেলেমেয়েরা কৌতুক করতো। বুড়োকে যেন তারা বানর বলেই মনে করতো। বুড়োর নিজের ছেলেও যেন এজন্য বেশ আনন্দ উপভোগ করতেন। বাঙালি পরিবারে বুড়ো দাদাকে নিয়ে যেন কোনো কৌতুক রঙ্গ না হয়।

ক্রুদ্ধ হয়ে বাপকে বাপ’ বলে ডাকতে কখনও লজ্জাবোধ করো না; শিশুকালে কতবার তোমার মা তোমাকে কোলের কাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, অপমানজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে তার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছ। আজ বড় হয়ে ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে সে কথা ভুলে গিয়েছ? জননীর বুকের ক্ষীরধারা এখনও যে তোমার মুখে লেগে রয়েছে। সম্ভব হলে জননীর পাশে শেষ শয্যা গ্রহণ করো তবু মায়ের অঞ্চল ছেড়ো না।

মা-বাপ নিচে বসলে তুমি কখনও উচ্চাসনে বসবে না। উপার্জনক্ষম হয়ে মা-বাপকে রেখে কখনও দধির প্রথম অংশ এবং মাছের মাথা খাবে না, তোমার ছেলেপেলেকেও দেবে না।

বিপন্ন হয়ে, ব্যাধিপীড়িত হয়ে যদি তোমার পিতামাতা বিছানায় মল ত্যাগ করেন, তা হলে নিজ হাতে তা ধুয়ে দেবে। তোমার পত্নী যদি বুদ্ধিমতী হন তা হলে তিনিও তোমার সঙ্গে এসে তোমার পিতামাতার সেবা করবেন।

তুমি এবং তোমার পত্নী ছাড়া পুত্র-কন্যা দিয়ে পিতামাতার সেবা করাবে না। পিতার ধন-সম্পত্তির লোভ বেশি না করে তার সদ্গুণগুলি আয়ত্ত করবার জন্যে তোমার আগ্রহ যেন বেশি হয়। সেইটেই হবে তোমার যথার্থ পিতৃভক্তি।

মহাপুরুষকে ভক্তি কর, কিন্তু তার জীবনকে নিজের জীবনে ফুটিয়ে তোলবার জন্য যদি তোমার কোনো সাধনা না থাকে, তা হলে তোমার ভক্তির কোনো মূল্য নেই। গান্ধী। বা বুদ্ধের মূর্তি পূজা করে কোনো লাভ হবে না, যদি তাদের শিক্ষাকে গ্রহণ না করা হয়।

বহু মানুষ হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর মহাজীবনের গুণকীর্তন করে, কিন্তু তাঁর জীবনের শিক্ষাকে তারা মানে না। এর মানে কি ভক্তি? পতিত মানুষ এইভাবেই মহাপুরুষের জীবনকে ব্যর্থ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবনকেও ব্যর্থ করে।

পিতাকে অন্ধভাবে ভক্তি করেও কোনো লাভ নেই যদি তার চরিত্র মাহাত্ম্যকে তুমি। গ্রহণ না কর। পিতা খুব সম্মানী লোক ছিলেন; তার গুণে ও জ্ঞানে সারা দেশের লোক মুগ্ধ ছিল; তার নামে দোহাই ফিরত এই সমস্ত গল্প করে কাপুরুষতার পরিচয় দিও না। তোমার এই সমস্ত অহঙ্কারের গলাবাজি শুনে মন বিরক্ত হয়ে ওঠে।

পিতা মহাজন ব্যক্তি ছিলেন সে কথা লোক-সমাজে প্রচার করে নিজের পৌরুষতা বাড়াতে চেষ্টা করো না। পিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে তাঁর আত্মার তৃপ্তি সাধনা কর। এই আমরা চাই।

উন্নত জীবনকে অনুসরণ করে কত অপরিচিত পথের মানুষ হৃদয়শক্তি সঞ্চয় করেছেন আর তুমি পুত্র হয়ে পিতার জীবনকে অনুকরণ করতে পারবে না? পিতার চেয়ে জীবন্ত আদর্শ আর তোমার সম্মুখে কে?

অনেক স্থলে দেখা যায়, যাদের মহিমা ও কর্মশক্তিতে জগৎ স্তম্ভিত তাঁদের পুত্রগুলি অপদার্থ। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় কী হতে পারে? জ্ঞানে-গুণে পদমর্যাদায় পিতাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, এই প্রতিজ্ঞা তুমি কর, তোমার এ কল্পনায় তোমার পিতা কত সন্তুষ্ট হবেন, তা বলা যায় না। তুমি তোমার পিতারই প্রতিচ্ছবি।

পিতার অজ্ঞানতার দরুণ বহু মানুষের জীবন বিফল হয়, এও সত্য কিন্তু সে কথা তোলবার অধিকার পুত্রদের নেই। যে অবস্থায়ই হোক না মানুষকে সকল অবস্থার ঘাড়ে চড়ে জীবনের পথ কেটে নিতে হবে। বাধা-বিপত্তি সকল প্রকার অন্তরায়কে সত্য বলে গ্রহণ করে তোমাকে অগ্রসর হতে হবে।

যুবক বয়সে জীবনে একটা বড় বিপদ আসে, সেটা হচ্ছে অহঙ্কার। পল্লীর দীন মা বাপের কুটির ছেড়ে এসে প্রাসাদবাসী বন্ধুদের সঙ্গে মিশে মনের গোপন কোণে অজ্ঞাতসারে একটা অহঙ্কার জাগে। বাড়ি যেয়ে ময়লা কাপড় পরা, দরিদ্র পিতামাতা, ছিন্নবসনা ভাইবোন, পল্লীবাসীদের অশুদ্ধ ভাষা, অনুন্নত জীবন দেখে মনে অহঙ্কারে বলে ওঠে, বড় বিরক্তকর। যখন উচ্চ জ্ঞান ও উচ্চস্তরের লোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে, তখন সাবধান, আপনার জনের সঙ্গে কখনও দাম্ভিক ব্যবহার করো না-বাপ-মায়ের সঙ্গে কখনও উগ্রভাবে কথা বলো না। অসভ্য ভাইবোনদের সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করো না; এতে তোমার মনের দীনতারই পরিচয় পাওয়া যায়।

বিয়ের পরে অনেক সময় পত্নী গর্বের অহঙ্কারে মা-বাপকে ব্যথা দিতে পারেন। গরীবের ছেলে বড় ঘরে বিয়ে করলে পত্নীর মনে এরূপ অহঙ্কার আসা সম্ভব।

গরীবের ছেলের পক্ষে উচ্চঘরে বিয়ে করতে যাওয়া মূর্খতা ও লজ্জাজনক। যারা তোমার পিতামাতাকে এতকাল বংশমর্যাদায় ছোট বলে মনে করে এসেছে, তোমার যদি আত্মমর্যাদা জ্ঞান থাকে, তা হলে সম্মানের আশায় তাদের ছায়া স্পর্শ করো না। বিয়ে করে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করবার মতো অপমান জীবনে আর নেই।

স্বামী যদি বিলক্ষণ টাকা উপায় করেন, অথবা পত্নী যদি অর্থশালিনী হন, তা হলেও তার মনে অহঙ্কার আসতে পারে। সাধারণত নারীর মন অনুন্নত। অনুন্নত মানুষ অর্থ ও ক্ষমতা পেলে তার স্বভাব তো কিছু উগ্র হবেই। পত্নীর ব্যবহারে যদি পিতামাতা কিছু আহত হয়ে থাকেন, তা হলে সাধ্যমত বাপ-মায়ের সন্তোষ বিধান করবে; তাদের যথেষ্ট সম্মান করবে।

এ সম্বন্ধে পত্নীর সঙ্গে কোনো কথা তুলবে না, তাতে বিপরীত ফল হবেই। মাতাপিতার প্রতি তোমার ভক্তি দেখে তোমার পত্নী নিশ্চয়ই লজ্জিতা হবেন। যদি এতেও কোনো ফল না হয় তবে পত্নীকে কৃপার পাত্র বা বুদ্ধিহীনা মনে করে তার কথা সকলকে অগ্রাহ্য করতে হবে। তার সঙ্গে পিতামাতা সম্বন্ধে কোনো কথা উঠলেই নীরব হয়ে যাবে। এই সমস্ত কথা নিয়ে মনকে নিরন্তর শান্তিহীন করে তোলাও ঠিক নয়।

মৃত্যুর পূর্বে পিতা যদি তার সম্পত্তি কোনো শুভকার্যে দান করে যেতে চান, তা হলে কদ্যপি তাকে বাধা দেবে না, বরং সেই সমস্ত কাজে উৎসাহ দেবে। মানুষের অভাব কোনো কালেই পূর্ণ হবে না। পিতা যদি কোনো দান করবার শুভ কল্যাণ পোষণ করেন তবে তাতে বাধা না দেওয়া ঠিক। পুত্র এবং কন্যাদের জন্যে সম্পত্তির কতটুকু রাখা দরকার তা পিতাই ঠিক করে দেবেন। পুত্র-কন্যাকে ভিখারি করে যাওয়া পিতার পক্ষে খুবই কষ্টকর। তবে ছেলেমেয়েদের জন্যে সর্বস্ব না রেখে যদি কিছু সম্পত্তি দীন-দুঃখী বা কোনো সদানুষ্ঠানে দিয়ে যেতে চান, তাতে পুত্রকন্যার মনে আনন্দ হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

পুত্র-কন্যার জন্যে মানুষ কত না পাপ করে। জীবন ভরে রাশি রাশি অর্থ জমিয়ে মানুষ রেখে যাচ্ছে কেবল ছেলেমেয়েদের জন্যে। জাতি যখন মানুষের ছেলেমেয়েদের কথা ভুলে শুধু নিজের ছেলেমেয়েদের কথা বেশি ভাবে, তখন বুঝতে হবে তারা পতিত।

দুটি যুবকের কথা জানি; তারা ঝগড়া করে বাপকে বন্দুক দিয়ে খুন করে ফেলেছিল। পিতার গালি ও দুর্ব্যবহার সহ্য করবার মতো বল যদি বুকে না থাকে, তা হলে বাড়ি ছেড়ে দূর দেশে চলে যাও, সেও ভালো, বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে কাজ নেই। পিতাকে হত্যা করে মহা অন্যায় করো না। জগতে কেউ বাপকে হত্যা করেছে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। সংসারের সমস্ত অর্থ যদি লাভ হয়, তা হলেও এমন কাজ করা যায় না।

আর দুটো যুবককে জানি, তারা বাপের সঙ্গে কথা বলে না। সর্বত্র বাপের কুৎসা বর্ণনা করে। তবুও মানুষের অপবাদ সহ্য করে, চুপ করে থাকাই উপযুক্ত পুত্রের কাজ। বুঝতে নাপেরে পিতা অন্যায় আচরণ করতে পারেন, তাই বলে তুমি পিতার প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করতে পার না। যদি তুমি তাই কর, তাহলে তোমার পিতৃ-ভক্তির পরীক্ষা হবে না। মনুষ্যত্বের জন্য বেদনা সহ্য করলে বড় মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়া হবে।

মা বা মামুদের সম্পত্তি লাভ করে অনেক পুত্র পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। এরূপ বিদ্রোহী হওয়াতে জীবনের গৌরব কতখানি নষ্ট হয় তা ভাষায় কেমন করে প্রকাশ করবো। পিতা নতুন বিয়ে করেছেন তিনি অত্যাচারী হলেও তার নিন্দা পুত্রের মুখে শোভা পায় না। সর্বদা নিজেকেই অপরাধী বলে মানুষের কাছে প্রকাশ করবে। তাতে কোনো দোষ নেই। আর এরই নাম পিতৃভক্তি।

পিতার নব বিবাহিত পত্নীর নিন্দা প্রচার করাও দোষের। বুক ভেঙ্গে যদি বেদনা গুমরে ওঠে, জনহীন আকাশতলে অথবা নির্জন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদ, কিন্তু এই অশ্রুকে ক্ষমা করো না। চিত্তকে ডেকে বলো–ওরে মন, তাঁর সুখেই কি সুখী হতে পার না? কেন এ দুর্বলতা, কেন এ ছেলেমি; যদি মৃত মায়ের কথা মনে হয়, তা হলে মনকে বলো, মন, এ জগতে অনন্ত মানুষ এসেছিল; এখন কোথায় তারা? সকলকেই যেতে হবে, কেন বৃথা এ আখিজল।

কোনো কারণে পিতার কাছ থেকে যদি দূরে থাকতে হয় তা হলে সুযোগ সুবিধা পেলেই পিতার সঙ্গে দেখা করো। নতুন মাকে শ্রদ্ধা জানাতে যেন কোনো ভুল না হয়। বাপ-মায়ের কাছে সকল অহঙ্কার চূর্ণ করে ফেলে দাও। পিতা যদি অজস্র গালি দেন তবে তা শোনবার জন্যেই তার সঙ্গে দেখা করবে। পুত্র হয়ে পিতার কাছ থেকে দূর হয়ে থাকা বিধাতার আঁখিজলের মতোই করুণ ও অন্যায়। পিতার গালি-গালাজে মনে একটা গোপন আনন্দ হয়, কারণ এরই নাম পিতৃভক্তি।

পিতৃভক্তির অর্থ যেন কেউ না বোঝে পিতার ইচ্ছায় নিজের বিবেককে বিসর্জন দেওয়া। বিবেক অনেক সময় আমাদের ভুল পথে নিয়ে গেলেও সর্বদা তাকে অনুসরণ করতে হবে। বিবেকের আদেশ পালন না করে মানুষের আর উপায় নেই। বিবেকের অনুবর্তী হয়ে সাধ্যমতো আমাদেরকে পিতা-মাতার তুষ্টি বিধান করতে হবে।

নিজের চিন্তা ও ভাব পিতার কাছ থেকে গোপন করে রাখা ভুল। অনেক সময় পিতাকে শিশু ভেবে বিনয়ে তাঁর কাছে সত্য ও কল্যাণের কথা জানাতে হবে।

সাবধান! পিতার প্রতি ব্যবহারে নিজেকে কোনো প্রকারের রূঢ় অহঙ্কারী করে তুলো না।

নারী জাতিকে পরের ঘর করতে হয়। বিয়ের পর দিন হতেই সে স্বামীর পরিবারের একজন হয়ে যায়। পিতার কুলের কারো প্রতি তার বিশেষ কোনো কর্তব্য থাকে না। বিয়ের পর পিতামাতার আজ্ঞা পালন করাই তার পক্ষে কঠিন। যে নারী স্বামীর কথা ভুলে পিতামাতার আজ্ঞানুবর্তিনী হয় সে হতভাগিনী। সত্য কথা বলতে, পিতামাতার প্রতি নারী জাতির বিশেষ কোনো কর্তব্য নেই।

নারীর একমাত্র প্রভু স্বামী। স্বামী ছাড়া আর কারো কথা শুনতে নারী বাধ্য নয়।

নারীর নিতান্ত অসহায় বলে তার মনুষ্যত্ব স্ফুরণ হবার কোনো সুযোগ হয় না। সে যা সত্য বলে মনে করে, তা সে করতে সাহস পায় না। সে জীবনে যা বলে ও করে তার নিজের বলা ও নিজের করা নয়। জাতিত্ব, বিবেক ও ভাব, স্বাধীনতা তার কিছু নেই। জীবনের দুরবস্থা ও অসহায় অবস্থার কথা স্মরণ করে সে কার কথা শুনবে, কীভাবে চলবে। কিছুই ঠিক পান না। যাবৎ না সে চিন্তা ও কর্মশক্তির স্বাধীনতা পাচ্ছে, তবে তার কাছে উচ্চজীবনের কথা বলা বৃথা।

পিতামাতার কথা শুনতে নারী বাধ্য নয় বলে ব্যথার সময় সুযোগ পেলে নারী প্রাণ দিয়ে পিতামাতার সাহায্য করবে।

কোনো কোনো স্বামী শ্বশুরকে জব্দ করবার জন্য পত্নীকে বাপের বাড়ি যেতে একদম বন্ধ করে দেন। এরা নিষ্ঠুর।

কোনো নারীর কথা জানি, তিনি যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে পীড়িতা মায়ের সেবা করেছিলেন, তা অতি আশ্চর্য, দুই তিন বৎসর কঠিন পরিশ্রম করেও তিনি মাকে বাঁচাতে পারেন নি। অনেক সময় সারাটি রজনী অনিদ্রায় কাটিয়ে দিতেন।

কারো কারো পিতা বৃদ্ধকালে বহুদিন ধরে রোগ শয্যায় শায়িত থাকেন। বাড়ির সবাই অগোচরে বিরক্তি ভরে বলে থাকেন, এ বিপদ আর সহ্য হয় না। কতকাল আর এ ব্যাধি টানতে হবে।

পিতা সম্বন্ধে এরূপ চিন্তা যেন মনে কখনও স্থান না পায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত