৩. জীবনের ব্যবহার
১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ওহিও (Ohio) নদীর ধারে কতকগুলি ইংরেজ অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ কতকগুলি দেশী মানুষ তাদেরকে আক্রমণ করল। চারদিকে বেড়া ছিল, তার ভিতরে এসে আত্মরক্ষার জন্যে তারা প্রস্তুত হলেন। শত্রুর আক্রমণ বাধা দেওয়ার। জন্য বিশেষ আয়োজন ছিল না। দস্যুরা শিগগিরই তাদের বেড়া ভেঙ্গে সব লুট করে নিয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে সকলকেই খুন করে ফেলবে।
যতগুলি ইংরেজ সেখানে ছিলেন-নারী, পুরুষ, শিশু বুড়ো সবাই সেই ঘেরার মাঝে জমা হয়েছিলেন।
বাইরে একটু দূরে একটা ঘরে এক পিপে বারুদ ছিল, কিন্তু কে যাবে সেটাকে আনতে? অসভ্য দস্যুগুলি তীর তুলৈ বসে আছে। সেই ক্ষুদ্র দলটির মুরুব্বী সবাইকে বিপদের কথা বুঝিয়ে বললেন। কয়েকজন যুবক বলল–আমরা বারুদ আনতে যাবো। সংখ্যায় সেখানে মাত্র ষোলজন পুরুষ ছিল!
একটা সতেরো বছরের মেয়ে উঠে বললেন–তোমাদের কারো যাওয়া হবে না। এই ক্ষুদ্র দলের পক্ষে একটা মানুষের জীবনও খুব মূল্যবান। আমি নারী এবং অবিবাহিতা আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমাদের জন্যে জীবন দিতে চাই আমি। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাকে তার সংকল্প ত্যাগ করাতে পারলেন না। সাহসী বালিকা বেড়ার দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে তিনি যখন বারুদের ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন তখন সকলে দারুণ শঙ্কায় তার দিকে চেয়ে রইল। সকলেই মনে করছিল এখনই দস্যুদের তীর এসে তার বুকে পড়বে। খোদা বালিকার মহত্ত্ব ও উচ্চতায়। মুগ্ধ হয়েছিলেন। বালিকা বারুদ কাঁখে করে নির্বিঘ্নে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। সতের বছরের এই বালিকার মনুষ্যত্বের সাহস সেই ছোট দলকে বাঁচিয়েছিল।
যে মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের গৌরব আসন নিয়েছে, তার মধ্যে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ হয়, তার সঙ্গে দেহের সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। মানব-মঙ্গলের জন্যে মানুষ যে ত্যাগ স্বীকার করে, তা শুনলে কান পবিত্র হয়, লেখনী ধন্য হয়। তাদের স্পর্শে এসে জগৎ ধন্য হয়েছে। তাদেরই জয়গান শোনাবার জন্যে আকাশে চাঁদ ওঠে। বিশ্বের সৌন্দর্য। তাদেরই সংবর্ধনার জন্যে নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ঊষার বাতাস তাদেরই পুণ্যমাধুরী বুকে নিয়ে দিকে দিকে ছোটে।
যে জীবন মহত্ত্বের মঙ্গল–আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল না, যেখানে জ্ঞানে মনুষ্যত্বের দীপ্তি শোভা পেলো না–সে জীবনে কাজ কী?
জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করে যদি না তোলা গেল তবে তাকে সুখী করবার জন্যে এত উৎসব আয়োজন কেন? এই ছার নিকৃষ্ট মাংসের স্তূপটাকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। ওতে মূল্যবান পোশাক জড়াবারও কারো কোনো অধিকার নেই।
জীবনে কাজ করতে হবে। কাজহীন জীবন শত পাপের আবাস। কি বাল্যে, কি যুবক বয়সে সকল সময়ে কাজ চাই। যদি পিতার অগাধ অর্থ-সম্পত্তি পেয়ে থাক, যদি হাতখানি মুখে তুলতেও দশজন দাসদাসী হাজির হয়, তা হলেও তোমাকে কাজ করতে হবে, দুঃখ বেদনার অভিশাপ দিয়ে খোদা এ জগতে অন্তহীন কাজের পথ করে দিয়েছেন।
তুমি অর্থশালী, তোমার কোনো কাজ নেই। কত মানুষ নত হয়ে তোমাকে সালাম করে। কত খাবার সামগ্রী তোমার সামনে আসে, কত ভেট-ডালি তোমার মনকে তুষ্ট করে। তোলে, কিন্তু তবুও বলি কাজ নেই এ কথা তুমি কখনও ভেবো না। তোমার মনের দিকে তাকিয়ে দেখ, সে কত অন্ধকারে পড়ে আছে। তুমি মানুষ, তোমাকে জ্ঞান-সাধনা করতে হবে। যে পয়সার জন্যে পুস্তক পাঠ করে, সে অধমের অধম!
শিক্ষিত লোককে এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদেরকে বই ও জ্ঞানালোচনার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রেখে হেসে-খেলে জীবন কাটাতে দেখেছি। এরা ঘি-মাংস খেয়ে থাকে, মানুষ। এদের সম্মান করে থাকে। কী মর্মবেদনা!
তুমি অর্থে বড়? তুমি উচ্চ রাজকর্মচারী? নবাবের কন্যাকে বিয়ে করেছ? পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে মন তোমার ভরে আছে, এতটুকু দুঃখ তোমার নেই। তোমার ঐ হাসি ঐ রহস্য, আলাপের অন্তরালে দেখতে পাচ্ছি তোমার দীনতা, তোমার দারিদ্র্য, তোমার পাতিত্য। তুমি তো বড় নও। যে হৃদয় জ্ঞানের সঙ্গে কোনো যোগ রাখে না, যে মানুষ মনকে মহৎ ও উচ্চ করে তোলার জন্যে কিছুমাত্র ব্যগ্র নয়, সে তো ছোট। সে তার সিংহাসন ছেড়ে নিচে এসে দাঁড়াক।
জীবনকে বড় করবার জন্যে তুমি কঠিন পরিশ্রমের সঙ্গে নানা শাস্ত্রের আলোচনা করতে পার। এ জগতের কিছুই তো তুমি জান না? এ হেন মানব-জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এটা কী সহজ কথা! লক্ষ কোটি বছর পরেও তো এই সাধের জীবনকে ফিরে পাবে না। অতএব কেমন করে তুমি এর অপব্যবহার করতে সাহস পাচ্ছ? আকাশে, তারায়, আলোকে, উদ্ভিদে কত রহস্য গোপন হয়ে রয়েছে–সে রহস্যের সন্ধানে কত জীবন কাটিয়েছেন। তুমি কাজ খুঁজে পাও না–এর অর্থ কী?
যেভাবে ধর্ম পালন করে তুমি আত্মপ্রসাদ লাভ করছো, এটা ধর্ম নয়। মানুষের ব্যথা বেদনা-তার পতিত জীবন দেখে যদি তুমি তোমার মনে কোনো ব্যথা না জাগে, তাহলে তুমি ধর্ম উৎসব কর, আরব দেশে যাও, তোমার বেতন এক সহস্র টাকা হোক–তুমি আসলে ছোট। ধর্মজীবনের সত্য তোমার কাছে ধরা পড়ে নি। অন্তহীন নরনারীকে আত্মা দিয়ে, শরীর দিয়ে সেবা করতে হবে–কেমন করে ভাবো তোমার কাজ নেই।
দেশের লোকের মধ্যে দেখেছি মানুষ জীবনে যতই হীন ও নীচ থাকুক না কেন, মৃত্যুর পর কাউকে দিয়ে কিছু কোরান পড়িয়ে অথবা কিছু দান করে তার মুক্তির পথ পরিষ্কার করে দেওয়ার আয়োজন হয়। বেশি কিছু করলে অর্থ ব্যয় করে মসজিদ তোলা হয়। মানুষগুলি বোঝে না মসজিদে যাবার আগে মানুষকে মাদ্রাসায় কুরানের কালামগুলি মুখস্থ করে নিতে হবে। সবাই মসজিদ তুলতে ব্যস্ত। তারা বোঝে না জগতে যদি বিদ্যালোচনা না থাকে তা হলে আপনা-আপনি মসজিদগুলি ভেঙ্গে পড়বে। পতিত জাতি কখনও তার ধর্মমন্দির খাড়া করে রাখতে পারবে না। আপনা-আপনি খোদার ঘরগুলি ভেঙ্গে মাটিতে মিশে যাবে।
ধর্মমন্দিরের কথা ভাববার আগে আমাদের জ্ঞান-প্রচারের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে উন্নত, জ্ঞানী ও সৎস্বভাব করবার জন্যে যিনি যে প্রচেষ্টা করুন না, তিনি মহৎ, তাঁরই ধর্মজীবন সার্থক হয়, তিনি পুণ্যবান ও বরেণ্য।
চারিদিকে লক্ষ নরনারী পাপে, মূর্খতার অত্যাচারে, মানুষের উপেক্ষায় তিলে তিলে মরে যাচ্ছে, তাদের জন্যে কি তোমার করবার কিছু নেই? বিশ্বকে উদ্ধার না করতে পার, তোমার গ্রামটিকে কি তুমি উচ্চজীবনের ধারণা দিতে পার না? তাদের মধ্যে ধর্ম ও মনুষ্যত্বের বীজ উপ্ত করতে পার না? কত বালক-বালিকা, কত যুবকের জীবন নিরাশায় ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে শক্তি ও বিশ্বাসের আগুন জ্বালাতে পার না? তুমি মানুষ, তুমি ভাব ও ভাষার প্রাণপূর্ণ প্রতিচ্ছবি–ঘরের কোণায় বসে থাকবার জন্য তুমি নও। আজ হাটের মাঝে তোমাকে এসে দাঁড়াতে হবে। কাজ তোমার অফুরন্ত। বৃথা জীবন নষ্ট করে দিচ্ছ কী বলে? মানুষের পাপ ও ব্যথা দেখে তোমার মনে জ্বালা উপস্থিত থোক। শয়তানকে হত্যা করবার জন্যে তোমার মাঝে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ হোক।
জ্ঞানালোচনা করার পক্ষে আমাদের দেশের একটা ভয়ানক বাধা আছে। বিদেশী ভাষায় কোনো উত্তম পুস্তকও মনকে আনন্দ দান করতে অসমর্থ। নিরানন্দের ভিতর দিয়ে কি জগতে কোনো কাজ সিদ্ধ হয়? নিজের ভাষায় সহস্র বই হওয়া চাই। মানুষের ভিতর জ্ঞানস্পৃহার জন্যে একটা পিপাসা হলে বিদেশী ভাষায় তা মিটাবার কোনো সুবিধা হয় না। জ্ঞান অর্জন পথের এই বাধা জাতির পক্ষে কত বড় ক্ষতির কথা তা আমি বলতে পারি না।
হচ্ছে হবে–এই বলে সময়কে যেতে দিলে কোনো কালে কোনো কাজ হবে না। জীবনে হাসি খেলার যে আবশ্যকতা নেই তা বলছি নে। কিন্তু শুধু হাসি খেলা দিয়ে এ সোনার জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়ে লাভ কী? লেখাপড়া শিখে চাকরি করছ। আশা করেছ–জীবন অর্থ উপায়, পান ভোজন আমোদ-উৎসব করেই কাটিয়ে দেবো। জমিদারিতে যথেষ্ট টাকা পাওয়া যায়, সুতরাং সময়কে উড়িয়ে দেওয়ার অধিকার তোমার রয়েছে। অনেক টাকা আছে বলে কি কতগুলি সাগর-জলে ফেলে দেওয়া যায়? সময়ের আর এক নাম অর্থ–তা কী জান? শত রকমে সময়ের কাছ থেকে লাভ আদায় করে নিতে পার। সময়ের সদ্ব্যবহার করলে তোমার আরও উন্নতি হবে; তখন-তখন ফল পেতে না পার কিন্তু ধীরভাবে বিশেষ কোনো সাধনা ধরে থাকলে পাঁচ অথবা দশ বছর পর তুমি তোমার সাধনার ফল দেখে বিস্মিত হবে। নিজের কোনো লাভের জন্যে যদি পরিশ্রম না করতে চাও, তবে মানুষ–তোমার প্রতিবেশীর জন্য তুমি তোমার জীবনকে সার্থক করো।
এ জগতে জ্ঞান-সাধনা ব্যতীত কোনো জাতির সম্মান হয় না। যদি জাতির সম্মান বাড়াতে চাও তা হলে জ্ঞানের সাধনা করতে হবে। জাতিকে বড় করবার জন্যে তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। কারো দ্বারা অপমানিত হয়ে তোমার মর্মবেদনা উপস্থিত হয়েছে, শুধু মানুষকে গালি দিয়ে তুমি নিজের বা জাতির সম্মান বাড়াতে পার না। যার মধ্যে মানুষ জ্ঞান ও চরিত্রশক্তি দেখে তাকেই লোকে সম্মান করে। তুমি নিজে জ্ঞানী ও চরিত্রবান হও, মানুষকে জ্ঞানী ও চরিত্রবান করতে চেষ্টা কর।
বিপুল অর্থ জমিয়েছ, কিন্তু বিশ্বাস কর যাদের জন্যে তুমি এই অর্থ রেখে যেতে চাও তারা যদি জ্ঞানী ও চরিত্রবান না হয়, তাহলে তোমার অর্থ তাদের কল্যাণ না করে শুধু অকল্যাণই করবে। তোমার অর্থ হবে তাদের পাপ অন্যায়ের সহায়। যদি পুত্ররা স্কুল কলেজে লেখাপড়া না শেখে তা হলেও ইচ্ছা করলে তাদের তুমি মানুষ করে তুলতে পার। এজন্যে তোমার সাধনা চাই। বাইরের শিক্ষকদের সাহায্য না নিয়ে তুমি নিজেই তোমার পুত্রগণকে নৈতিক বল দেবার জন্য পরিশ্রম কর কুড়েমি করে অথবা ক্রোধে তাদের জীবনকে ব্যর্থ করে দিও না।
এ জগতে তুমি মানুষকে যা কিছু দাও না, জ্ঞান দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দান আর নেই। পতিতকে পথ দেখান, জ্ঞানান্ধকে জ্ঞান দান করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। জ্ঞানী হতে হলে স্কুল কলেজের সাহায্য ব্যতীত তা হবে না। এরূপ মনে করা নিতান্ত ভুল। মানুষ যে কোনো অবস্থায় চেষ্টা করলে বড় হতে পারে।
মানুষের ভিতরে এমন কোনো জিনিস আছে, যাকে তৈরি করলে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। এমন রহের মালিক হয়ে যদি তুমি তোমার জীবনকে ব্যর্থ করে দাও, তাহলে তুমি পাগল। কত লক্ষ কোটি মানুষ মানবাত্মার অধিকারী হয়ে জীবনকে কেমন মূল্যহীন করে দিচ্ছে।
তোমার ভিতরে অফুরন্ত ক্ষমতা রয়েছে, তুমি অজেয় শক্তির রাজা। কেন তুমি তোমার শক্তি, এত সম্পদ হেলায় মাটি করে দিচ্ছ? তুমি মানুষ, তোমাকে জাগতে হবে, তোমাকে দাঁড়াতে হবে, তোমাকে গান গাইতে হবে, তোমাকে বিশ্বের সাথে যোগ স্থাপন করতে হবে। তোমার লুকিয়ে থাকবার অবসর নেই।
জীবনে যদি কিছু করতে চাও, তাহলে অসীম ধৈর্য চাই। মানুষের সাফল্যের অন্যতম কারণ ধৈর্য। আচার্য বসু বলেছেন, বিফলতা দেখে যে দমে যায় না, সেই জয়ী।
কুরানে বহুস্থানে খোদা মানুষকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন।
কত প্রতিভাশালী যুবকের জীবন আলস্যে ও মূল্যহীন আমোদ-উৎসবে নিরর্থক হয়ে গিয়েছে। সাধনা ও পরিশ্রমের দ্বারা কত সাধারণ মানুষ জীবনকে বড় করে তুলতে পেরেছেন।
ইয়াগো (lago) বলেছেন, আমাদের জীবনটা কতকটা বাগান বাড়ির মতো। এ বাগানে যেমন ফুলের গাছ লাগাবে, তেমন ফুলই ফুটবে।
সাধনার কোনো কোনো ব্যাপারে যদি প্রথম বারে ব্যর্থ মনোরথ হও, পরাঙ্মুখ হয়ো না–বারে বারে আঘাত করো, দুয়ার ভেঙ্গে যাবে। তাড়াতাড়ি না করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হও। ধরে থাক, ক্রমশ তোমার শক্তি ও সুবিধা বাড়তে থাকবে। গিরি-শির হতে যখন পাথরখণ্ড নামতে থাকে, তখন তাকে প্রথমটায় দেখে মনে হয় এই নগণ্য পাথরের টুকরাটা কিছু নয়। ক্রমে যখন সে নিচে নেমে আসে, তখন তার শক্তি হয় কত ভয়ানক। সম্মুখে যা কিছু পায় ভেঙ্গে চূর্ণ করে নিয়ে যায়।
ব্যর্থতা, দুর্ভাগ্য ও বিপদ তোমার সকল উদ্যম ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তোমার মনে যে উৎসাহ, যে কর্মশক্তি ছিল, তা যেন নিবে যাচ্ছে। এটা ঠিক জেনো কোনো সাফল্যই সহজে লাভ হয় না। রাস্তার পার্শ্বে যে বড় বড় বাড়ি দেখতে পাও, তার পেছনে একটা মানুষের কত সাধনা, কত বেদনা রয়েছে, তা কি কল্পনা করেছ? এ জগতে শক্তি সাধনার জয় হয়ে থাকে। বাপ-দাদার সম্পত্তি ও টাকা যারা পায়, তাদের পক্ষে সংসারের কঠোরতা অনুভব করা খুব কঠিন, কিন্তু সাধারণের পক্ষে সুখ ঐশ্বর্য সহজে লাভ হয় না। ধৈর্য ধরে দুঃখজ্বালা বাধা-ব্যর্থতাকে উপহাস করে ধরণীর ঐশ্বর্য লাভ করতে হবে।
দুঃখ-বেদনার ভিতর দিয়েই তো মানুষের মনুষ্যত্ব জাগে। সুতরাং দুঃখ দেখে ভয় পেলে চলবে না। দারিদ্র্য ও কষ্টের আঘাত খেয়ে যে জগতে আসন রচনা করেছেন তার মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও সুখ পালিত মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।
অনেক বড় লোক তাই নিজেদের ছেলেদেরকে বাল্যে সাধারণ কাজ করতে দেন। এটি উত্তম প্রথা। যতই বড় হও না কেন, বড় আসন ধরে রাখবার জন্যে জীবনের বহু অবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতে হবে। যে সমস্ত বড়লোকের ছেলে কোনো কালে দুঃখের পরশ পায় নি, তাদেরও কালে চরিত্রহীন, যথেচ্ছাচারী ও মূর্খ হবার খুবই সম্ভাবনা। ভবিষ্যৎ জীবনে সম্পূর্ণ মানুষ হবার জন্যে আমাদের বাল্যকালের যাবতীয় সাধারণ কাজ করতে হবে, তা আমার অবস্থা যতই ভালো হোক।
অবস্থা যেমন হোক না, যত বিপত্তিই আসুক না, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়ে যাবেই। বিশ্বাসই আমাদের মুক্তি অব্যর্থ করে দেয়-সঙ্কোচ অবিশ্বাস মানুষকে নিতান্ত দরিদ্র করে রাখে। বিশ্বাসের শক্তি কতখানি, মানবজীবনের কাছে এ যে কত বড় দান তা আমি ভালো করে পরে বলবো। ইচ্ছা ও বিশ্বাসের সঙ্গে তোমার কর্মশক্তি তোমার জাগ্রত হবে, তোমার সম্মুখের কুয়াশার ভিতর দিয়ে জয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
জীবনকে যদি উন্নত করতে না চাও, তবে ধীরে ধীরে তোমার পতন হতে থাকবে। মানুষ একই অবস্থায় থাকতে পারে না–তাকে সামনে এগোতে হবে, নইলে পেছনে হঠতে হবে, এইটে হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এক জায়গায় সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অহঙ্কারে যদি মন ভর্তি হয়ে থাকে অথবা চুল পেকেছে বলে নিজেকে জ্ঞানী মনে করে চুপ করে বসে থাক, তবে প্রতিদিন তোমার অধঃপতন হতে থাকবে। জীবনের কোনো অবস্থায় নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করো না। এ করলে তোমার মনের অবনতি অবশ্যম্ভাবী–সে অবনতি তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না।
অর্থ, ক্ষমতা ও মর্যাদার অহঙ্কারে যদি ভিতর ও বাইরের দিকে না তাকিয়ে চোখ বুজে বসে থাক, তা হলে বুঝব তুমি দরিদ্র, একটা অনাবশ্যক মাংসস্তূপ–সে জগতে এসেছিল একেবারেই বিনা কারণে–তার গুণহীন দেহটাকে শুধু বাঁচাতে।
অসত্য জীবন যাপন করে মানব সেবায় কোনো আবশ্যকতা নেই। যে হৃদয় পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে না, তার মানুষের কল্যাণ কামনা করবার কোনো অধিকার নেই। এক ডাক্তার ভায়াকে আমি দেখেছি, তিনি দিবারাত্রি জাতির কল্যাণ কামনা করেন, অথচ তিনি মানুষের নিকট হতে অম্লানভাবে ঘুষ গ্রহণ করেন।
ইসলামের মুক্তির অর্থ সত্য ও ন্যায় জীবনের প্রতিষ্ঠা–মানব প্রেম অসত্যের বিনাশ। যে মানুষ প্রতিবেশীর অর্থ অপহরণ করে, যে নিজের চরিত্রকে পবিত্র ও নির্মল করতে সচেষ্ট
হয়, যে মূর্খ ও নীচ, যে মানুষকে কঠিন কথা বলতে লজ্জা বোধ করে না–সে যেন সমাজের কল্যাণ চিন্তা না করে। সেই দুর্বত্ত ভণ্ড যেন ইসলামের স্বাধীনতা না চায়। দূর হোক সে আমাদের ভিতর হতে।
ফিলিপ সিডনী (Philip Sydney) বলেছেন, কোনো পথ যদি না থাকে তবে আমি একটা তৈরি করে নিতে পারি। সত্যি তো–জীবনকে উন্নত করবার পথ কোনো। অবস্থাতেই রুদ্ধ হয় না, চাই তোমার আগ্রহ। যে কাজে পাপ ও অন্যায়ের ছায়া নেই তা করতে এত লজ্জা কেন? মানুষের পদলেহন করতে লজ্জা হয় না? খোদার আদেশকে অমান্য করে পয়সা উপায় করতে তোমার মনে ভয় হয় না? অন্ধ সমাজ যে কাজকে হীন বলছে–বিশ্বাস কর সে কাজ হীন নয়। তোমার উপর যারা নির্ভর করে আছে, তাদের দারিদ্র্য ঘুচাবার জন্য মানুষের কাছে দুর্বলতা জানিও না বা অর্থ ভিক্ষা করো না। আল্লাহর দেওয়া দুই বাহু আছে; তাই পরিচালনা করে তুমি জীবনের পথ কেটে নাও। যদি সমাজ ও পরিচিত লোক দেখে লজ্জা হয়, তবে কোনো অপরিচিত দূর দেশে চলে যাও। আমেরিকা, বিলেত ও জাপানের বহু উদ্যমশীল মানুষ কত সাধারণ কাজ করে জীবনকে উন্নত করেছেন, সে খবর হয়তো তোমরা রাখ না।
মহৎ মানুষের একটা স্বভাব হচ্ছে এই যে, তারা মানুষের ব্যথা দেখে চুপ করে থাকতে পারে না। ডাক্তার জনসনের বাড়ি ছিল দীন-দরিদ্রের আখড়া। অপরিচিত দুঃখী মেয়ে পুরুষ সবাই তাঁর পরম আত্মীয় ছিল। একবার একটা খোকা পথের মাঝে কেঁদে তাদের দুরাবস্থার কথা জানায়। সেই ছেলেটিই তার বুড়ো মায়ের একমাত্র অবলম্বন। কোনো লোকের দরকার ছিল না, তবুও জনসন ছেলেটিকে তখন-তখন চাকরি দিলেন।
মানুষের ব্যথা-বেদনা যার মনকে দুর্বল না করে, সে বড় দরিদ্র। মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য কী?–একরত্তিও না–অনুভূতি সবারই সমান। ব্যথিত মানুষকে সম্মুখে দেখে কোন প্রাণে আনন্দ কর? এ জগতে দেখি বহু মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা দুস্থ মানুষের জন্যে সর্বস্ব দান করেছেন, কিন্তু তবুও তাদের অভাব হয় নি। খোদার উপর যাদের গভীর বিশ্বাস আছে, তারাই এমন মহাপ্রাণের পরিচয় দিতে পারেন। খোদার উপর বিশ্বাসের অর্থ এ নয় যে, তিনি সোজাসুজি আকাশ থেকে নেমে এসে তোমার বালিশের নিচে ধনরত্ন রেখে দেবেন। খোদা পরিশ্রম ও সাধনার মূল্য দিয়ে থাকেন। মানুষের দুঃখে যদি সত্যি তোমার দয়া হয়, তা হলে তাদের কথা স্মরণ করেই তোমাকে চতুগুণ পরিশ্রম করতে হবে। ঘরে বসে তুমি মানুষকে সাহায্য করতে পারবে না। মানুষকে সাহায্য করবার জন্যে যদি তুমি জীবন ভরে সুযোগের আশায় বসে থাক তাহলে সুযোগ হয়তো জীবনে আসবে না। দরিদ্রকে সাহায্য কর এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রম কর, খোদা তোমাকে অর্থ দেবেন। তুমি যে মানুষের সেবক–তোমার হাতে অর্থ যদি না আসে তা হলে খোদার মহিমা, তার সব কথাই যে মিথ্যা হয়ে যাবে।
মানুষকে ভুলে দরিদ্রকে ব্যথা দিয়ে যদি তুমি অর্থ আহরণ করতে থাক, তা হলে খোদার অভিশাপের জন্য তোমার মাথা ঠিক করে রেখো। কে সেই নরপিশাচ, যে দরিদ্রের বুকের রক্ত নিংড়ে গৃহিণীর গয়না প্রস্তুত করে? ঈদের দিনে ছেলেদের জামা-কাপড় কিনে দেয়? তোমরা কে কে তার সঙ্গে কথা বলছ?
অনেক মানুষ আছে, যারা নিজের আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ছাড়া বাকি সকল মানুষের প্রতিই নিষ্ঠুর, বলেছি তো মানুষে মানুষে পার্থক্য কী? মানুষের যে ভাই, সে তো তোমারই ভাই, অতএব তাকে আঘাত দাও কোনো সাহসে? মানুষকে তুমি কেমন করে কঠিন কথা বল? তোমার লজ্জা হয় না? তুমি কার পয়সা নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছ? কাকে ক্ষুধিত রেখে তুমি নিজের উদরপূর্তি করবার আয়োজন করছ?
ছোটদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করা মোটেই ভদ্রতা নয়। যে মানুষ দরিদ্র ভৃত্যের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে পারে না, সে যেন মানব দুঃখে বেদনা প্রকাশ না করে। এই অসহনীয় ভণ্ডামির শেষ হোক। একসময় রাজা পিটার তার ভৃত্যকে প্রহার করেন, সেই প্রহারেই ভূতত্যর মৃত্যু হয়। সম্রাট কেঁদে বলেছিলেন আমি মানুষকে শাসন করবার ব্রত গ্রহণ করেছি কিন্তু হায় নিজকে শাসন করতে পারি নি।
বড় লোকরা জানে না, তাদের দরিদ্র পিতা-পিতামহেরা মানুষের কাছে কত ছোট হয়ে যশ ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। সুখের কোলে পালিত বড় লোকদের দরিদ্র, অত্যাচারিত মানুষের বেদনা বোঝবার কোনো ক্ষমতা নেই। তারা অজ্ঞাতসারে অত্যাচারী হয়ে পড়েন। জগৎ ও মানব সমাজ সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুবই অসম্পূর্ণ।
জীবনকে উন্নত করবার জন্যে তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। উত্তরাধিকারসূত্রে অতি অল্প লোকেই পূর্ব পুরুষের অর্থ সম্পদ লাভ করে থাকে। পিতার বা শ্বশুরের সম্পত্তির লোভ তুমি করো না। শক্তি সাধনা করে তোমাকেই বড় হতে হবে। কে বলে পুরুষের সম্মুখে বাধা রয়েছে? চাই শুধু তোমার উন্নত জীবনের ইচ্ছা। চাই তোমার জীবনের প্রতি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার। হাসি-গল্পের আবশ্যকতা আছে, কিন্তু হাসি-গল্প করবার জন্যে তো তোমার স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধব রয়েছেন। রহস্যালাপ করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ, কিন্তু তাই বলে রহস্য করে জীবনের অধিকাংশ সময় নষ্ট করে ফেলো না–কাজ কর, কাজ করতে অভ্যাস কর। এমন দিন আসবে যখন অবসর তোমার কাছে মোটেই ভালো লাগবে না। জীবনে যে কাজ কর না, যে অবস্থাতেই থাক না, ‘তোমার সকল উন্নতির মূল তোমার বুদ্ধি ও জ্ঞান। জীবনের সকল অবস্থায়, সকল সময়ে তোমাকে ভাবতে হবে, পড়তে হবে। জ্ঞানের আলোক-রথ নিয়ে তুমি যেদিকেই যাও না কেন–সিদ্ধি তোমার ধরা রয়েছে। জ্ঞানকে বাদ দিয়ে যিনি জীবনকে উন্নত করতে চান, তিনি সফলতা লাভ করতে পারবেন না। এ জগতে মূখের কোথাও স্থান নেই।
অনবরত কাজ করে করে চিত্ত যেন নীরস-কঠিন না হয়ে উঠে। পত্নী-ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে স্নেহ-মমতার আদান-প্রদান হওয়া মানুষের সঙ্গে লৌকিকতা করা জীবনে এ সবেরই প্রয়োজন আছেনইলে মানবজীবন একটা অভিশাপ বিশেষ হয়ে উঠবে। জীবন শুধু কাজ নয়, এর একটা রসের দিকও আছে। প্রীতি-ভালবাসা প্রেম-প্রণয়হীন কাজের যন্ত্র হয়ে যদি সংসারে বাঁচতে চাও, তা হলে তুমি হতভাগ্য। দারিদ্রের কষাঘাত অসহ্য। অভাবের তাড়না লজ্জাজনক, পাওনাদারদের তাগাদা জীবনের সুখ-শার্ট : নষ্ট করে, তা ঠিক; কিন্তু তাই বলে অনবরত কাজ নিয়ে হৈ হৈ করে বেড়ানোও ঠিক নয়। অত্যধিক পরিশ্রমে মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, কোনো কঠিন ব্যাধি হওয়াও অসম্ভব নয়। জীবনের যাদের সঙ্গে যোগ রয়েছে তাদের কাছেও অপ্রীতিকর হয়ে উঠতে হয়।
যারা অত্যাধিক মানসিক পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত তারা যেন নিয়মিতভাবে শারীরিক আমোদ ক্রীড়ায় যোগ দেয়। আজকাল বন্দুক জিনিসটি সংগ্রহ করা বড় কঠিন, নইলে বন্ধুক নিয়ে শিকার সন্ধানে বের হওয়া খুব চমৎকার। এতে যেমন আনন্দ তেমনি পরিশ্রমও হয়।
যারা মানসিক পরিশ্রম করেন তারা সংসারের কাজও খুব করতে পারেন। উচ্চশ্রেণীর চিন্তাশীল লেখক ও পণ্ডিতেরা হাতে কোনো কাজ করতে লজ্জাবোধ করেন, তা বলছি না। আলস্যবশত অথবা শরীরের প্রতি অবহেলা করে তারা সাধারণত কোনো পরিশ্রমের কাজই করতে চান না। মানসিক পরিশ্রমের সঙ্গে ভালো আহার ও শারীরিক পরিশ্রম যদি না হয়, তা হলে নানা ব্যাধি এসে দেখা দেবে। মাটি কোপান, কাঠ ফাড়া এবং সংসারের কাজে কোনো লজ্জা তো নেই বরং এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যারা শারীরিক পরিশ্রম করবার সুযোগ পায় তাদের শরীর খুব শিগগির ভাঙ্গে না। এজন্য গৃহস্থ ঘরের শরীর ও মন কুড়ে –বিলাসী ঘরের মেয়েদের চেয়ে অধিক সুস্থ ও প্রফুল্ল।
দানিয়াল ওয়েবেস্টর (Daniel Webster) সাহিত্যালোচনার সঙ্গে সঙ্গে নিজ হস্তে জমি চাষ করতেন। কিছুকাল আগে দেশের কতগুলি লোককে নিজ হাতে জমি চাষ করবার জন্য ভারি উৎসাহান্বিত দেখেছিলাম। এখন সে ফুর্তি আর নেই। যে জাতি মনে করে, শারীরিক পরিশ্রম মানুষকে ছোট করে, তারা নিকৃষ্ট, তারা পতিত। পাপ ও অন্যায় কর্মে মানুষ ছোট হয়, পরমুখাপেক্ষী হয়ে এবং মনের স্বাধীনতা হারালে মানুষের অসম্মান হয়। সত্য ও পবিত্র জীবন ত্যাগ করে যে সব দুবৃত্তের দল অন্যায়ের সেবা করে পয়সা উপায় করে, ধিক তাদের জীবনে, মন তাদের কত ছোট, এই শ্রেণীর লোক নিজেদের ভদ্রলোক বলে যদি পরিচয় দেয়, তাহলে মানুষ যেন তা শুনে হাসে।
শেলী পানির মধ্যে কাগজের নৌকা ভাসাতেন। এইভাবে সাহিত্যলোচনার শ্রান্তি হতে তিনি শান্তি সংগ্রহ করতেন। প্রতিদিন চার মাইল হাঁটার কমে ডিকেন্সের পেটে ভাত হজম হতো না, নিত্য ঝড়-ঝাঁপটা, বৃষ্টি-বাদলা কিছু না মেনে মুক্ত আকাশতলে একটু ঘোরা ফেরা তার চাই। সাদি (Southey), ওয়ার্ডসওয়ার্থ খুব হাঁটতেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে রাজ্যসুদ্ধ ঘুরে বেড়াতেন তা তাঁর লেখা হতেই বোঝা যায়। ফুলে ভরা মুক্ত প্রান্তর, নিঝরের সঙ্গীত, মেঘে-ভরা আকাশ, ছবি, এসবের মাঝে তিনি ভাষা খুঁজে বেড়াতেন। মৌন প্রকৃতির অন্তরের মাঝে মিশে তিনি আত্মার বাণী শুনতেন–বিশ্বব্যাপী বিরাট অনন্ত পুরুষের বাঁশি তার শিরায় ধ্বনিত হয়ে উঠত।
শেলী অনেকবার ঘোড়া হতে আছাড় খেতেন, কিন্তু তবু তাঁর শিক্ষা হতো না। যেমন পড়তেন তেমনি চড়তেন, শেষকালে একেবারে পাকা ঘোড়সোয়ার হয়েছিলেন।
শিক্ষিত ভদ্রলোক যিনি, তিনি নড়ে বসবেন না, একটা না একটা ব্যাধি লেগে আছে–কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে তার নিতান্ত অনিচ্ছা, ঘোড়ার চড়া তো একেবারেই অসম্ভব। এসব হচ্ছে অভিশপ্ত জীবনের দুরবস্থা। উচ্চ জীবনের সঙ্গে কী শক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিশ্রমের কোনো যোগ নেই? জগতের অনেক মহৎ ব্যক্তি দুর্বল হয়ে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের শিক্ষা ও সত্য যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করছেন, তাঁদের কিন্তু কৃশ ও দুর্বল হয়ে কাজ চলে নি।
দরিদ্র, অশিক্ষিত পরিচিত আত্মীয় বন্ধুকে আপন বলে পরিচয় দিতে সঙ্কোচবোধ করা ভাল, কিন্তু দরিদ্র পূত চরিত্র, সরল, বর্বর, পরিশ্রমী মানুষকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে মনে যেন কোনো সঙ্কোচ না আসে। জীবনের পক্ষে এ একটা বড় কলঙ্ক। মানুষের নাম নিয়ে তুমি বড় হতে যেয়ো না, তোমার নামেই মানুষের সম্মান হোক।
বেলজিয়ামের মন্ত্রী মেলাম, বিলেতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ গ্লাডস্টোন কুড়োল দিয়ে প্রকাণ্ড গাছ কেটে নামাতেন। এজন্য তাদেরকে কেউ ছোটলোক বলে নি। এগুলি হচ্ছে পৌরুষ।
ইংরেজ জাতি হাজার লক্ষ পথে নিজেদের জীবনকে সার্থক করে তুলতে চেষ্টা করে। ইংরেজকে ঘৃণা করলে চলবে না। উপযুক্ত গুণ স্বীকার না করলে আমাদেরই ক্ষতি হবে। আফ্রিকার বনজঙ্গলে, মেরুপ্রদেশের তুষার তরঙ্গে, অনন্ত সমুদ্রের বুকে, অতলের তলে, ভূগর্ভে, আকাশে, পর্বতে–সর্বত্র সে তার শক্তি নিয়ে ছুটাছুটি করছে। তাদের মধ্যে শক্তি ও গুণ আছে বলে যে তাদের, কোনো জাতিকে অসম্মান করবার ক্ষমতা আছে, এ আমি বলছি না।
কত ইংরেজ সামান্য সামান্য বিষয় নিয়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। এইসব কলকারখানা ও নৈমিত্তিক সুখ উপকরণের অন্তরালে কত মানুষের চিন্তা ও সাধনা রয়েছে তা কি কেউ ভেবে দেখবে না? শুধু চাকরি-দাসত্ব মানব জীবনের গৌরবের জিনিস নয়। নানা রকমে আমাদের জীবনের শক্তিকে সার্থক করতে হবে। যে জাতি এক সময় জগতে কত উচ্চ স্থান অধিকার করেছিল, সে আজ সামান্য দু-একশো টাকার জন্যে কত দীনতা স্বীকার করে। নিজেদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস হয়তো কেউ জানে না। ভিতরে যাদের বড় বলে অনুভূতি রয়েছে সে কি কখনও অস্থিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।
অজ্ঞান ও মূর্খতা হচ্ছে সকল দুঃখের মূল। আবার একথাও ঠিক, যারা অত্যন্ত মূর্খ তাদের বিশেষ কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। গরু-ঘোড়া বা কুকুর-শৃগালের কোনো বেদনা নেই। তার মানে এদের আত্মসম্মান জ্ঞান নেই। তার মানে এদের ভিতর কোনো বোধ বা চিন্তা করবার ক্ষমতা নেই। মানব জীবনের দুঃখ-কষ্টের হাত এড়াবার জন্যে কেউ কি খোদার কাছে প্রার্থনা করে–হে খোদা, তুমি যদি আমায় কুকুর করে সৃষ্টি করতে, তা হলে জীবন কত সুখেরই না হতো। হীন জীবনের অসম্মান ও নিগ্রহ কুকুরে না বুঝলেও মানুষ তা দেখে অশ্রু ফেলে, পশুর অনুভূতি নেই বলেই সে তার দীনতা ও বেদনা বুঝতে পারে না, সত্য করে কী তার জীবন মানুষের ঈর্ষা আনে? মূর্খর জীবনে পশুর সুখ থাকতে পারে, কিন্তু চিন্তাশীল মহানুভব ব্যক্তি তার পতিত জীবন দেখে অশ্রু বিসর্জন করেন। মানুষের জীবন এমনভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে এ তার সহ্য হয় না। তিনি মানুষ মানুষ বলে পাগল হয়ে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। মহানবী মুহম্মদ (সঃ) এর জীবন-কথা আবৃত্তি করতে যেয়ে অনেকে বলেন, “আমাদের মহানবী তাঁর উম্মতের (শিষ্যমণ্ডলী, মুসলমান জাতি) জন্যে অসীম প্রেম পোষণ করতেন। এদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হবেন না। তিনি খোদার কাছে দাবি করে বলবেন–হে দয়াময়, তুমি আমার শিষ্যমণ্ডলীর মুক্তি দাও।”
এইখানে একটা কথা বলা দরকার। জাতিকে যত কথাই বল না, নৈতিক যত বিধিই প্রণয়ন কর না, যত ধর্ম ব্যবস্থাই থাক না–যাবৎ না তার ভিতরের মানুষটি চোখ খুলে প্রত্যেক কথা বুঝতে চেষ্টা না করে, তাবৎ তার কল্যাণ নেই। কোনো বিধি ব্যবস্থা, কোনো মহাপুরুষের বাণী তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। তার অধঃপতন হবেই। প্রত্যেক মানুষের ভিতর এমন একটা জিনিস আছে যে সুবিধা ও সুযোগ পেলে জগতের প্রত্যেক কথা বাজিয়ে গ্রহণ করতে চায়। ইংরেজ পণ্ডিতেরা এই জিনিস বা শক্তিটাকে যে কথায় প্রকাশ করেন, তার বাংলা অনুবাদ ‘বিবেক’। ভালো মন্দ বুঝিয়ে দেবার জন্যে মানব জাতির পক্ষে এর মতো মহাগুরু আর নেই। ইনিই আমাদের ভিতরের অন্তর মানুষ। আঘাত করে যদি একে অন্ধ করে ফেলা হয়, তবে তুমি যত বড় মহাপুরুষই হও না, তুমি বড় দুর্ভাগা। তোমার পতন হবেই। মহাপুরুষেরা যেসব কথা বলেছেন তা শুধু মেনে নিতে হবে। তার সত্য ভালোমন্দ বিচার করাটা দোষের এইরূপ চিন্তা নিয়ে যারা জীবন চালায়, তাদের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ। বিনা কারণে নিজের বাহাদুরি ফলাতে গিয়ে কোনো মহানবী বা কোনো মহাপুরুষকে উড়িয়ে দিতে হবে, এ আমি বলছি নে–আমি বলছি বিনয় ভাবে সত্য অনুসন্ধানের মন নিয়ে তোমাকে প্রত্যেক কথায় সমালোচনা করতে হবে। তবেই তোমার মুক্তি।
যা বলছিলাম–হযরত মুহম্মদ (সঃ) পতিত পাপান্ধ অনুভূতিহীন মানুষের জীবন দেখে। অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন–সোনার মানব জীবন কেন এত পাপে কলঙ্কিত হবে? মানুষের পাপ তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।
তিনি তাঁর শিষ্যমণ্ডলীকে ভালবাসেন, শেষ দিন তিনি ‘মানব’ নাম উচ্চারণ করবেন বলে এই কথা বলেই আমরা যদি তৃপ্তি লাভ করি, তা হলে আমরা অপদার্থ। তিনি আমাদের পাপ ও অন্ধতা দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন সে কথা আমাদের স্মরণ নেই, আমরা কেবল তাঁর দয়ার মহিমা প্রচার করি। কী বিড়ম্বনা, বিবেক ও চিন্তাহীন জাতির পতন কী আশ্চর্যভাবে সংঘটিত হয়।
জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে তুলতে হবে। কারণ এটাই ধর্ম। শুধু উপাসনা ও মহাপুরুষের ভক্তিপূর্ণ নামোচ্চারণে আমাদেরকে মুক্তি দেবে না।
জীবনের পাপ ও কলঙ্ক মুছতে চেষ্টা না করে আল্লাহ্ দয়াময় একথা বলো না। উহা নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকের কথা। জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করবার জন্যে তোমার ভিতরে একটা আন্তরিক চেষ্টা হোক। সাধুরাই জীবনকে পবিত্র করবে, এরূপ কল্পনা করা নিতান্তই অন্যায়। প্রত্যেক মানুষকে বড় হতে হবে। প্রত্যেককে ব্রাহ্মণ দরবেশ হতে হবে। মানুষের পক্ষে ছোট ও শুদ্র হয়ে থাকা অধর্ম ও পাপ। সাধু-সন্ন্যাসী বলে কী স্বতন্ত্র একটা মানবসমাজ আছে।
নিষ্ঠুর কথা বলতে, একটা কঠিন বাক্য ব্যবহার করতে তোমার যেন লজ্জা হয়। নিষ্ঠুর কথা প্রয়োজন হলে বলতে হবে, কিন্তু এই রূঢ় কথা ব্যবহার করবার আগে ভেবে দেখ, তোমার কার্যটি ন্যায়ানুমোদিত কিনা।
মানুষের সঙ্গে নিষ্টুর ব্যবহার করে যে, খোদার সঙ্গে প্রেম করতে যায় তার বুদ্ধি খুব কম। মানুষের একটা বিশ্বাস এসেছে–অন্যায় ও পাপে জীবনকে কলঙ্কিত করে, কোনো ক্ষতি নেই–আল্লাহকে ডাকলেই সকল পাপ ধুয়ে যাবে এটা যে মিথ্যা কথা–এ সকলে বিশ্বাস করো।
আমি দ্বিতীয়বার বলছি, জীবনের পাপকে দূর করবার চেষ্টা না করে শুধু আল্লাহর কাছে প্রেম জানালে চলবে না। তার দয়া ভিক্ষা করলেও কাজ হবে না, তিনি দয়াময় একথা বলাও কিছু নয়। প্রাণান্ত সাধনা করেও যদি ভুল হয়ে যায় তবে সে জ• খোদার স্নেহ রয়েছে, এ সত্যি–তিনি দয়ালু এটা ঠিক, তাই বলে পাপ ও অন্যায় করবার অধিকার নেই।
পাপ ও অন্যায় বুঝতে হলে আত্মার অনেকখানি জ্ঞান লাভ করতে হবে। মূর্খ যে কাজ বা যে ঘটনাকে নির্দোষ বলে মনে করে, জ্ঞানী সেখানে হীনতা ও অসম্মান ভেবে সরে পড়েন। জীবনের পাপ ও কলঙ্ক বোঝবার মতো মন হওয়া চাই। আমি একটা মানুষকে জানি তিনি জীবনে বহু পাপ করেছেন অথচ অসঙ্কোচে আল্লাহূকে লক্ষ্য করে বলে থাকেন–হে খোদা! আমি তো জীবনে কোনো অন্যায় করি নি!
মানুষের সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করে যে বড় গলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে সে মূর্খ। যার কাছে যে অপরাধ করেছ ক্ষমা চেয়ে নাও–তারপর ঊষার মহিমার মাঝে আল্লাহর প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলো। ব্যথিতের দীর্ঘশ্বাসকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য খোদার দূতেরা আকাশ পথে এগিয়ে আসেন এ কি কেউ জান না?
দুবৃত্ত নরপিশাচের মনে ব্যথা দিতে হবে না তা বলছি নে। দুবৃত্তকে তো শাস্তি দিতে হবেই। সাধু ও উচ্চ জীবন দুবৃত্তকে দমন করেই তো সার্থক হয়।
অন্যায়ের অভিশাপ বড় ভয়ানক, পীড়িত মানুষ যত ছোটই হোক তার ব্যথাকে ভয় করতে হবে। তোমার অর্থ, তোমার পোষাক, তোমার দাস-দাসী, তোমার গায়ের শক্তি তোমাকে পীড়িতের নিক্ষিপ্ত অদৃশ্য বাণ হতে রক্ষা করবে না।
মানুষকে সম্মান করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। ছোটলোককে সম্মান করতে তার ক্ষতি হয় একথাও ঠিক। দুর্বল ও পাপীকে সম্মান করলে অনেক সময় তার মাঝে মনুষ্যত্বের কিরণ যেয়ে পড়ে, তার ফলে তার কল্যাণ হওয়া সম্ভব। যে মানুষ মূর্খ ও দুবৃত্ত তাকে শ্রদ্ধা করলে সে নিজেকে বড় মনে করে, মহৎ জীবনকে অবজ্ঞা করলে লজ্জাবোধ করে এও ঠিক। জীবন কীভাবে চালাতে হবে, মানুষের সঙ্গে ঠিক কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, জীবন পথের শত শত রহস্যের কীভাবে মীমাংসা করতে হবে–এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলে ওঠা কঠিন। তোমার ভিতর যে অন্তর মানুষ রয়েছে, তাকে অপমান করো না। অপমানে তার মরণ হয়। ওগো, তাকে মেরে ফেলো না। জীবনের সকল সময়, অবস্থায়, আলোকে, অন্ধকারে, সকল পাহাড়ে, মাঠে, মরুভূমে, সাগরে সর্বত্র তোমার শুভ সে বলে দেবে।
মানুষকে যত পার ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখে না। যতটা সম্ভব মানুষকে আদর ও শ্রদ্ধা করতে হবে। অনেক মানুষ আছেন যারা বলে থাকেন–তাদের মতো ভদ্রলোক আর দেশে নেই। যথার্থ ভদ্রলোকদের পক্ষে ঐরূপ কথা বলা কঠিন, একথা বলে তিনি আদর পান না। মানুষ ছোট হয়ে থাকাতে প্রকৃত ভদ্রলোকের মনে আনন্দ হয় না–তিনি চান মানুষের কল্যাণ, পতিতের উন্নতি। গৌরব-অহঙ্কার করে নিজের বংশমর্যাদা প্রচার করবার সময় তার নেই। হায়, যারা বংশ মর্যাদার অহঙ্কার করবার জন্যেই বেঁচে আছে, তারা কত দরিদ্র!
তোমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা–আল্লাহর কাজ করা। শুধু অর্থের জন্যে বেঁচে থাকা নয়। জীবন সংগ্রাম খুব কঠিন হয়েছে,তা স্বীকার করি, কিন্তু এরই মধ্যে তো বেশি করে আল্লাহর কাজ করতে হবে।
আল্লাহর কাজের অর্থ শুধু মসজিদ তোলা, কোরান পড়ান এবং কাবা শরীফে যাওয়া নয়। এ তুমি বিশ্বাস কর, মসজিদ তোলা, কোরান পাঠ, কাবা শরীফে যাওয়া আমি অবজ্ঞা করছি এ যেন কেউ মনে না করে। অন্ধের মতো সঙ্কীর্ণ নিষ্ঠুর প্রাণ নিয়ে এই তিনটি কাজ করলেই আল্লাহর কাছে তোমার মঙ্গল হবে না।
আল্লাহর কাজের অর্থ–মানুষকে কল্যাণ ও মহত্ত্বের পথে টেনে নেওয়া। শত মূর্খকে মসজিদে ভর্তি করে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করলে মসজিদের কোনো গৌরব বাড়বে না। আল্লাহর ধর্মও তাতে পালন হবে না। আল্লাহ্ চান খাঁটি মানুষ, সত্যের সৈনিক, তাঁর জীবনের সেবক, পরদুঃখকাতর মহাপ্রাণ বান্দা। দুঃখীকে রক্ষা করে আল্লাহর কাজ কর, পতিত ও পাপীর জন্য অশ্রু বিসর্জন কর, ক্ষুধার্ত দেশবাসীর জন্য তোমার প্রাণ অস্থির হয়ে উঠুক, অত্যাচার ও অবিচার দেখে তোমার কঠিন শোক উপস্থিত হোক।
আত্মসর্বস্ব হয়ে যদি কোরান পাঠ কর–তুমি আল্লাহর কাজ করছ এ কথা বলা হবে। ওরে অন্ধ! কোরানের মাঝে কী লেখা আছে তা কি তুমি দেখ না? শুধু অক্ষর আবৃতি করেই জীবন শেষ করলে!
নারী পাঠিকার জন্যে বিশেষ করে গুটিকয়েক কথা বলবার আছে। নারী সব সময় নিজেকে নিঃসহায় মনে করে, তার কারণ সে তার হাত-পায়ের ব্যবহার জানে না। শুধু সাজ পরে পুরুষের মনোরঞ্জন করেই নারীর বেঁচে থাকা কঠিন। আজ স্বামী বেঁচে আছেন, কাল যদি হঠাৎ তিনি মারা যান তা হলে তুমি কোথায় যাবে? যদি বাপের বাড়ি চলে যাও, তাহলে তোমার ছেলেমেয়েদের ভার কি ভাই-বৌরা নেবেন? যে এতদিন সমাদরে রাজ রানীর হাতে স্বামীর ঘর করেছে তার পক্ষে পরের মুখের দিকে চেয়ে দাসীর অসম্মানে বেঁচে থাকা কী সম্ভব? তুমি তোমার জীবনকে ইচ্ছা করলে পুরুষের মতোই সার্থক করে তুলতে পার। তোমার চারিদিককার পুরুষগুলি তোমাকে ঠাট্টা করুক, কিন্তু তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর। তোমার ভিতর মানুষের আত্মা আছে, তোমার জীবন পথে ভেসে যাবার নয়।
যখন ইংল্যাণ্ডে রানী বোর্ডেসিয়া রাজত্ব করছিলেন তখন বিদেশী এসে তাঁর রাজত্ব আক্রমণ করে। রাণী দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বেরিয়েছিলেন। তাঁর তখনকার সেই মূর্তি দেখলে আমাদের মনেও ভয় হয়। শ্রদ্ধা ও সম্ভমে অবনত হয়।
মানুষকে যদি ছোট করে রাখা হয়, সে তার শক্তির কথা বুঝবে না। তুমি নারী বলে তোমাকে দেশের মানুষ ছোট করে রেখেছে। তোমাকে বিয়ে দিয়েই পুরুষ তার কর্তব্য শেষ করেছে। উচ্চ জীবনের কথা ভাববার আগে নারীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, স্বাধীনভাবে তাকে হাত ও মস্তিষ্কের ব্যবহার শিখতে হবে। তার অর্থ নেই, জীবনের স্বাধীনতা নেই, তার আবার উচ্চ জীবন কী? বেটা ছেলের মতই নারী, তুমি বেড়ে ওঠ। পুরুষের সাহায্য না নিয়েই তুমি বেঁচে থাকতে পার, তার জন্যে প্রস্তুত হও।
তোমাকে পুরুষ হাত-পা বেঁধে খাঁচার মধ্যে পুরে রেখেছে, এর ফলে তোমার মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়েছে। মানবসমাজের সঙ্গে মিশলে তুমি বিশ্বে পাপ সৃষ্টি করবে, এর মতো অন্যায় কল্পনা আর নেই। তোমার কী নিজের বিবেক নেই? তোমার কি শুদ্ধ জীবনের মর্যাদা বুঝবার ক্ষমতা নেই।
বিশ্বের কেউ যদি তোমাকে সাহায্য না করে, তুমি সেজন্যে কেঁদো না। তোমার ভিতর যে শক্তি রয়েছে, তাকে আজ জাগিয়ে তোল। তুমি লেখাপড়া শেখ। তুমি এত পরাধীন থেকো না। স্বামী তোমাকে ভাত না দিলেও তুমি নিজের ভাত যাতে সংগ্রহ করতে পার, তার ব্যবস্থা কর। পুরুষ তোমার উপর বহু অত্যাচার করেছে, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তোমাকে আজ দাঁড়াতে হবে। প্রতিশোধ ঘৃণা নিয়ে নয়, ক্ষমার বিনয় নিয়ে। নিজের জীবন যদি নিরর্থক হয়ে থাকে, তবে তোমার সন্তানের জীবন যেন নিরর্থক না হয়। ছেলের মঙ্গলের জন্যে টাকা ব্যয় করছ, তোমার অনাথিনী ভিখারিনী মেয়ের কথা তুমি ভাববে না? সে কেমন করে এ সংসারে বেঁচে থাকবে? যদি সে স্বামীর ভালবাসা না পায়–পরের বাড়িতে যদি স্থান না হয়–যদি তার স্বামী মারা যায়, তা হলে তার কি হবে? এই সহজ কথা তুমি বোঝ না? মেয়েকে সম্পত্তি লিখে দিলেও মূর্খ মেয়ে তা কি রাখতে পারবে? কত নারী আত্মশক্তির অভাবে দারিদ্ভারে জন্মভূমি ত্যাগ করে শহরে অভাগিনীদের জীবন গ্রহণ করে, সে শোকের কথা কি জান?
ফরাশি দেশের এক কৃষকের মেয়ে লক্ষ লক্ষ পুরুষ সৈনিকের অধিনায়িকা হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তা শুনলে তুমি দুর্বলা অন্তঃপুরচারিকা ভয়ে মূৰ্ছা যাবে।
জাতিকে বড় করবার জন্য তোমার নিজের জীবনকে বাঁচাবার জন্যে তোমাকে আজ ঘরের বের হতে হবে। ইসলাম তোমাকে ঘরের মধ্যে থাকতে বলে নি–তবে তোমার এই বন্দিনী অবস্থা! কে তোমাকে হাতকড়া দিয়ে রেখেছে? সমাজে লজ্জা–দুবৃত্ত সমাজকে উপহাস করে, হাতের কড়াকে চূর্ণ করে আজ জীবন-সন্ধানে বেরিয়ে পড়। তোমার গতি সর্বত্র হোক। পাপী লম্পট পুরুষসমাজ তোমাকে বন্দিনী করে সতী করে রাখতে চায়। তোমার সতিত্বের মর্যাদা কি তুমি নিজে বোঝ না? একি তোমার অপমান নয়?
পারস্যে আরবে, মিশরে হাট-বাজারে বিপণীতে সর্বত্র নারীদের অবাধ গতি ছিল। তারা স্বাধীনভাবে প্রয়োজন হলে এমনকি নির্জনে পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন। পৃথিবীর অতীত কালে কী বর্তমান সময়ের কোনো জাতির মধ্যে নারীদের এই বন্দিনী অবস্থা ছিলো না ও নেই, অভদ্রভাবে এক কাপড়ে বাইরে বের হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষে নিষিদ্ধ।
আরব মহিলা যুদ্ধক্ষেত্রে যে শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা শুনলে তোমার মুখ হয়তো কালো হয়ে যাবে কিন্তু জানো তোমার ঐ রাঙ্গা মুখ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না, এ জগতে রাঙ্গা মুখের কোনোই মূল্য নেই। রূপকে ভ্রমরের মতো মানুষ কিছুক্ষণের জন্য বাহবা দিতে পারে; কিন্তু শক্তি ও গুণ ব্যতীত এ জগতে কোনো স্থান পাওয়া যায় না। গুণের অর্থ শুধু স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ীর ভক্তি নয়।
তুমি সেলাই-এর কাজ শিখতে পার। বই বাঁধাইয়ের কাজ, কাঠের কাজ, কামারের কাজ, সোনারুপার কাজ যে পুরুষ মানুষই করবে এর তো কোনো কারণ নেই। দেশের সর্বত্র মেয়ে চিকিৎসকের বহু অভাব রয়েছে। জ্ঞানার্জন লেখাপড়া শেখার কথা যেন সব সময়ই মনে থাকে। নইলে তোমার কল্যাণ হবে না।
গ্রেজ দালিং বলে এক খ্রিষ্টান বালিকার কথা শুনলে তোমার হৃৎপিণ্ডের রক্ত নেচে উঠবে। তোমার নিজের জীবনের সঙ্গে তার জীবন তুলনা করে দেখ, তাকে তুমি বুঝবে, নারী এমন কী অপরাধ করেছে, যাতে সে ছোট হয়ে থাকবে। কী এমন পাপ সে করেছে, যাতে আঁখিজলে জীবন শেষ করতে হবে।
গ্রেজ সমুদ্রের ভিতর ডুবো জাহাজের যাত্রীদিগকে উদ্ধার করেছিলেন। ভীষণ ঝড়ে সমুদ্রের ঢেউগুলি কী ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল, তার মধ্যে নৌকা ভাসান কি সহজ কথা? বিপন্ন হৃদয়ের আশাহীন মৌন কঠিন আর্তনাদে তার নারী-হৃদয়ের কী গভীর অনুভূতি জাগিয়েছিল। সমুদ্রের গর্জনকে উপহাস করে, প্রতিমুহূর্তে মরণকে আলিঙ্গন করে এমন অসীম সাহসের কাজ করা কি সহজ কথা? নুরজাহান, রানী এলিজাবেথ, কবি জেবুন্নিসা, রিজিয়া, চাঁদ সুলতানা, খনা, জোন এরা সবাই নারী ছিলেন। কুমুদিনী মিত্র, কাজী সোফিয়া খাতুন, গুহ, সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী, শান্তা ও সীতা দেবী, শৈলবালা, ঘোষজায়া, ইয়াজদানী-পত্নী, সারা তৈফুর, সাখাওয়াত হোসেন-পত্নী এরা সবাই নারী।
তোমাকে শুধু নিজের কথা ভাবলেও চলবে না। নারীকে আজ নারীর ভিতর প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। শত বোন অন্ধকারে, দারিদ্রে ব্যথায় চূর্ণ হচ্ছে, তাদের জন্যে পাগলিনী হয়ে আজ তোমাকে পথে বের হতে হবে। তাদের মধ্যে তোমাকে কথা বলতে হবে, তাদের মধ্যে তোমাকে জীবনের গান গাইতে হবে। পরদা আজ ছিঁড়ে দূর করে ফেলে দাও, ভগ্নির ব্যথায় আজ তোমার সকল কাজে ভুল হয়ে যাক। কাজ শেষে তুমি আবার ঘরের মধ্যে প্রবেশ কর, তাতে আপত্তি নেই। আজ নারীর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে–আজ নিঃসহায় হয়ে সবার কাছে আঘাত পেয়ে–সে ‘বোন, বোন’ বলে ডাকছে। তবু কি ঘরের মাঝে বসে থাকবে?