উচ্চ জীবন: ২. শহর ও পল্লী জীবন

উচ্চ জীবন: ২. শহর ও পল্লী জীবন

২. শহর ও পল্লী জীবন

পল্লীতে যারা বাস করে, তারা ভাবে–শহরের সবাই বড়লোক, সম্মানী এবং সুখী। বড়লোক শহরে থাকে সত্য, তাদের আয়ও হয় অনেক টাকা, দালানে তারা বাস করে; কিন্তু টাকা থাকলেই যে মানুষ সুখী হয় তা ঠিক বলা যায় না। পাপ ও অন্যায় হতে যে মুক্ত, সেই প্রকৃত সুখী। শহরের অনেক অর্থশালীর মন পাপে ভরা। অনুভূতি নাই বলে তাদের মনে কোনো শঙ্কার উদয় না হতে পারে; কিন্তু প্রকৃত সুখী তাদের বলা যায় না। দস্যু যদি মানুষ খুন করে হাসতে থাকে তাহলে কি তাকে সুখী বলা যায়? পাপ করবার প্রথম অবস্থায় তার মন হয়তো আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু সে তা শোনে নি।

মহা মানুষ যাঁরা, তাঁরা মানুষকে একটা কঠিন কথা বলে বেদনায় হয়তো সারা রাত্রি ঘুমান না। আবার যারা নিকৃষ্ট তারা অনবরত অন্যায় করে মহানন্দে জীবন কাটায়। অন্ধের মতো তারা নিজেদের সুখী ভাবতে পারে, কিন্তু সত্যি করে তারা মোটেই সুখী নয়।

এক সাধু একটা ভার মাথায় করে একস্থানে যাচ্ছিলেন। অনেক পথ চলে তিনি দেখতে পেলেন, বোঝার উপর একটা পিঁপড়ে ব্যাকুল ভাবে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মনে হল, পিঁপড়াটাকে তার বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তিনি নিয়ে এসেছেন, তাই হৃদয় বেদনায় এদিক ওদিক, সে ব্যাকুলভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। সাধু অবিলম্বে ফিরে তাঁর প্রথম যাত্রার স্থানে এলেন এবং বোঝাটাকে মাটিতে নামিয়ে পিপড়াটাকে মাটিতে ছেড়ে দিলেন। সাধুর মনে খুব আনন্দ হল। তার কষ্ট স্বীকারের মাঝে–যে একটা আনন্দ রয়েছে সে আনন্দের সন্ধান অত্যাচারী ও বড় লোকেরা সব সময় খুঁজে পাবে না। সাধুর কাজের ভালোমন্দ বিচার করতে চাই নে। দেখতে হবে তাঁর মনের সহানুভূতি, ন্যায়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি।

ন্যায়-অন্যায়ের কথা না ভেবে বিবেককে হত্যা করে বহু মানুষ অর্থ জমিয়ে বড়লোক হয়। তাদের গৌরবে ও সম্মানে দশদিক মুখরিত হতে থাকে। কত মানুষ তাদের ওষ্ঠের একটু মৃদু হাসির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে, কত দাস-দাসী, কত খানসামা, দারোয়ান তাদের সম্মুখে মাথা লুটায়। অফুরন্ত সুখ, অজস্র আনন্দ তাদের চিত্তকে সুখাবেশে মত্ত রাখে, কিন্তু সত্যি কি এরা সুখী? এই অবোধ মানুষগুলির হাসিতে কি গোরস্থানের মৃত্যুগীত ধ্বনিত হয় না? কে তাদেরকে বোঝাবে–সুখ কোথায়?

এক ভদ্রলোক রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। বয়স তার অনেক হয়েছিল। হঠাৎ একদিন তার মনে হলো আমি যে বেতন পেয়ে থাকি তার প্রতিদানে ঠিক ওজন মতো কাজ দিতে পাচ্ছিনে। এই কথা মনে হওয়া মাত্র তিনি কাজ ত্যাগ করলেন। ঘুষ দিয়ে কাদাকাটি করে অনেক মানুষ চাকরি বজায় রাখে; তাদের জীবনে উল্লাস চাঞ্চল্য যথেষ্ট। সে শুধু নিজে সুখী হয় না, তার পত্নী ভাই, বন্ধু যারাই তার সংস্পর্শে আসে তাদের মনও আনন্দপূর্ণ হয়ে ওঠে।

মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ-দুঃখের জ্ঞান বদলাতে থাকে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে অনেক সুখের উপাদান দেওয়া হয়েছিল, সে সব তিনি গ্রহণ করেন নি। তাঁর জীবনের আনন্দ ছিল সত্য ও ন্যায়কে জয়যুক্ত করায়।

শহরের বড়লোকদের মতো জীবনকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে না তুলতে পারলে জীবন সার্থক হল না। এ চিন্তা করা ভুল। মানুষকে নিজের অধীনে আনতে পারাতেও লোক সুখ। বোধ করে! মানুষ ভয়ে ভয়ে তোমাকে দেখে দিন কাটাবে; এ সুবিধাটুকু শহরে সম্ভব নয়, শহরের লোক সবাই স্বাধীন; কেউ কাউকে গ্রাহ্য করে না। পল্লীগ্রামে জমিদার এবং কতকগুলি অর্থশালী লোকের পক্ষে মানুষকে পরাধীন ও ভীত শঙ্কিত করে রাখা সম্ভব শহরে নয়। অসভ্য ও অনুন্নত সমাজে কোনো বড় কাজ করবার জন্যে লোকের উপর আধিপত্য প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু শুধু মানুষের উপর সর্দারির উদ্দেশ্যেই মানুষকে অধীন করে রাখা পাপ।

দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যে সহস্র সহস্র কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পার; কিন্তু অনবরত টাকা সংগ্রহ করে লোহার বাক্সে জমা করে কী লাভ? মরবার পর অপদার্থ পুত্র-কন্যারা সে টাকা হয়তো পানির মতো বিপথে উড়িয়ে দিবে।

চরিত্রহীন বড়লোকের ছেলেরা দুদিনেই লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেয়। এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যায়। এক উচ্চ রাজকর্মচারীর ছেলে ছোটকালে বড় সুখে পালিত হয়েছিলেন। বাল্যে দশজন দাস-দাসী তার পেছনে পেছনে হাঁটতো। খোকা যখন যুবক হয়ে উঠলেন তখন বৃথা আমোদ-প্রমোদে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে আরম্ভ করলেন। বন্ধু মহলে তার কত প্রশংসা হতো। শেষকালে প্রৌঢ় বয়সে তার এত দুঃখ হয়েছিল যে দুই পয়সার মাছের জন্যে তাকে দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতে হতো।

টাকা খরচ করতে আমি নিষেধ করি নি, কিন্তু উপায় করবার জন্যেও সাধনা চাই। শহর যেমন খরচের জায়গা, উপায় করবার পথ তেমনি অনন্ত রয়েছে। আমার বাপ একজন বড় রাজকর্মচারী ছিলেন; অতএব কি করে আমি হীন হয়ে টাকা উপায় করবো–এ কথা ভাবলে জীবনের দুঃখ আরও বেড়ে যাবে। দয়াভিক্ষা না করে পরের গোলামী না করে। স্বাধীনভাবে পয়সা উপায় করবার জন্যে মনপ্রাণ ঢেলে দাও। লোকে কি বলে, এই সর্বনাশ। চিন্তা মানুষকে শয়তান অপেক্ষাও অধম করে ফেলে। মনের এই সঙ্কোচ দারিদ্র্যকে। একেবারে চেপে মেরে ফেলতে হবে, নইলে জীবনের চরম অধঃপতন হবে। লোকে যাই বলুক, যা সত্য বলে জেনেছে, তা করতেই হবে। স্বাধীনচিত্ত ব্যক্তিকে মানুষ কোনোকালে কিছু বলে না; লজ্জা সংকোচ আমাদের মনের ভিতর।

কিছু থাক আর না থাক শহরের মানুষগুলি খুব বাবু ধরনের হয়ে থাকে। নিতান্ত আত্মীয় অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও তারা সালাম করে বাড়ির বের করে দেয়। পরিষ্কার বাবু হয়ে চলাটা দোষের তা বলছি না। যারা টানাটানি করে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত তাদের টানাটানি বোধ হয় কোনো কালে শেষ হবে না।খরচ করতে পার, বাবু হয়ে চলাতেও বিশেষ বাধা নাই, কিন্তু চাই তোমার ভিতরে একটা ভীষণ উদ্যম। তোমার শক্তিতে একটা কঠিন বিশ্বাস। সাবধান, জীবনকে উন্নত করবার উদ্যমে যেন কোনো প্রকার কলংক এসে না জোটে। অন্যকে হত্যা করে নিজেকে বাঁচাতে তো কোনোই আনন্দ নাই। মানুষের সুখ দুঃখের অনুভূতি সকলেরই এক। অন্যকে বেদনা দিয়ে নিজে কী সুখী হতে পারা যায়?

শহরে বহু বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন। এরা ইচ্ছা করলে, জাতি ও সমাজের কত কল্যাণ করতে পারে তা হয়তো এরা জানেন না। আমেরিকার এক ধনী ব্যবসায়ী গ্রাম্য লোকদের মধ্যে পাঠাগার স্থাপনের জন্যে, কোটি কোটি টাকা দান করে গিয়েছেন। কেউ ধর্ম প্রচারের জন্য–কেউ কুষ্ঠ ব্যধির চিকিৎসার জন্যে অজস্র টাকা দিয়েছেন। টাকা পয়সা উপায়ের সার্থকতা কীসে হয় এই কথা যখন বড়লোকেরা বোঝেন, তখনই তাদের টাকা উপায় সার্থক হয়। দীন-দুঃখীর অশ্রু মুছাতে, জাতির কল্যাণ ও জ্ঞান বর্ধন করতে যদি রিক্ত হস্ত হতে হয় সেও ভালো। টাকা এক জায়গায় জমা করে কোনো লাভ নাই। সেবা কার্যে যে টাকা ব্যয় না হয়ে মানুষের পাপের ইন্ধন যোগায়, সে টাকা সাগরজলে। ফেলে দেওয়াই ঠিক। জঘন্য সে টাকা, তাতে মানব-সংসারের কোনোই প্রয়োজন নাই।

শহরের একটা বড় রকমের বেদনা হচ্ছে প্রাণহীনতা, এ জন্যে পল্লীবাসীরা শহরের লোককে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। মিথ্যা সম্মান-জ্ঞান বজায় রাখবার জন্যে অনেক শহুরে মানুষ অত্যন্ত হীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। একবার বাড়ি ভাড়া নেবার জন্যে এক যুবকের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি তার এক আত্মীয়কে আমাদের কাছে চাকর বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন নি, পরে তার এই অপকর্মের কথা বুঝতে পেরেছিলাম এবং লজ্জায় আমাদের। মাথা হেঁট হয়েছিল। শহরের লোকই এমন রুচির পরিচয় দিতে সাহস পান।

পুণ্যবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের পাশে শহরে একশ্রেণীর লোক তৈরি হয় যারা অত্যন্ত দুর্মতি। কোনো ভদ্রঘরের ছেলে তাদের সংস্পর্শে এলে সর্বনাশ হতো। অষ্টাদশ বছরের কম বয়সী কোনো যুবককে স্বাধীনভাবে শহরে আসতে দেওয়া ঠিক নয়। এখানে মানুষকে কুপথে নেবার এত প্রলোভন রয়েছে যার হাত থেকে বেঁচে থাকবার মতো মনের বল। অনেকেরই নাই। সঙ্গে অভিভাবক থাকলে যুবকদের থিয়েটার ও অন্যান্য বিপজ্জনক স্থান হতে দূরে রাখতে পারেন। অন্য দেশে কি হয় জানি নে, কিন্তু আমাদের দেশে থিয়েটারগুলি। মানুষকে পাপের পথে নেবার জন্য সর্বদা আহ্বান করছে। থিয়েটার দেখলে মনের উন্নতি হতে পারে এ আমি বিশ্বাস করি না। যদি হয়ই তাহলে সে এদেশে নয়; যেখানে নায়িকারা ভদ্রঘরের মেয়ে নয়। যারা পথের নারী। চোখে মুখে যাদের একটা উদ্দাম কামুকতার আকর্ষণ লেগে রয়েছে। এখানে রঙ্গালয় মানুষকে কোনো উচ্চ শিক্ষা দিতে পারে না। রঙ্গালয়ের অপবিত্র হাওয়া হতে সর্বদা ছেলেমেয়েদের দূরে রাখতে হবে। অন্তত হিন্দু ভদ্রঘরের বউঝিরা যদি অভিনয় করেন তা দেখে উপকৃত হওয়া যায়। এইসব চরিত্রহীন স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে মন কোনো উপদেশই নিতে চায় না।

প্রাণহীনতা সম্বন্ধে যে বলছিলাম এটা শহরে বড় বেশি। এখানে ভদ্র ব্যবহারগুলি সাধারণত প্রাণের সঙ্গে যোগ না রেখে হাতমুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। কাজ আর ব্যস্ততায় এখানকার মানুষের উন্নত চিন্তা, হৃদয়ের কোমল ভাবগুলি চূর্ণ হয়ে যায়। সে জন্যে মনে হয় শহর-বাজারে মানুষের স্থায়ী বাসভবন হওয়া ঠিক নয়। এটা হচ্ছে কেবল কাজের জায়গা; এখানে ভাবের প্রণয় মোটেই নাই। অপরিচিত ও অনাত্মীয় যারা তাদের সংগে পরের মতো ব্যবহার করা যায়; কিন্তু অবস্থায় যদি কুলায় তাহলে আপন লোকের সঙ্গে খুব প্রীতিভরা ব্যবহার করা উচিত। শহর বলেই কি সবাইকে এখানে অমানুষ হতে হবে? অবস্থায় না কুলায় আলাদা কথা; তাই বলে মিষ্টি মিষ্টি কথাও কি দুর্মূল্য?

বহু পণ্ডিত, জ্ঞানী ও উচ্চশ্রেণীর লোক শহরে এসে জমা হয়। এদের সংগে মিশলে প্রাণে তৃপ্তি থাকে; মনেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। পণ্ডিত ও উচ্চ শ্রেণীর লোকের পক্ষে শহরে বাস করা সুবিধাজনক হলেও পল্লীকে তারা ভুলতে পারে না। ব্যবসা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও স্বাধীন জীবনের অনেক সুবিধা শহরে আছে। এখানে সমস্ত দেশের সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় ও অভাব-অভিযোগের শেষ মীমাংসা হয়। সারা দেশের অন্যায় ও অবিচারকে ধ্বংস করবার জন্যে এখানে রয়েছে শাসনের মেরুদণ্ড। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের মিলন হচ্ছে এখানে। শহরের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের রুচি, সভ্যতা পল্লীবাসীরা গ্রহণ করেন। শহর। দেশের মস্তিষ্ক বলে পল্লীরূপিনী হাত-পাগুলিকে আমরা ঘৃণা করতে পারি না।

শহরে আর একটা মর্মপীড়ক দৃশ্য সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে : রাস্তার ধারে দুঃখী নর-নারীর আর্তনাদ। কোথা হতে আসে তা জানি নে। সবারই বাড়ি যে শহরে তা নয়। পল্লীতে এদের হয়তো স্থান হয় না, তাই শহরের পাষাণ বুক বিদীর্ণ করে কিছু রস সংগ্রহ করবার জন্যে তারা এখানে আসে। মানুষ থাকতে মানুষের সন্তান ভাত পায় না। এ ভাবতেও আমার মন দুঃখে বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গ্রামের দুঃখী আতুরের জন্যে গ্রামবাসীরা কী অবস্থা করিতে পারেন, তা পরে বলবো।

শহরের রাস্তার ধারে দেখা যায়–কোনো আশি বছরের বুড়ো শীর্ণ দেহখানি প্রখর রৌদ্রের মধ্যে এলিয়ে দিয়ে একটা পয়সার জন্যে কাঁদছে। কারো হাত-পা খসে পড়েছে, অতি কষ্টে ব্যথিত দেহখানি টেনে নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কত মানুষ অদেখা অপোছা হয়ে রাস্তায় মরে কে তার খবর রাখে? স্মরণ রাখবেন–এরা মানুষ, পশু নয়, আমাদের দেশের মানুষ আমাদের ভাই। কত যে ভিখারিনী দলে দলে দুটি চালের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে, তাদের কোলে ছোট ছোট শিশু। কোনো নারীর পুরুষের মতোই হাত পা খসে পড়েছে। কোথায় এরা রাত্রি কাটায় তাও জানি না। মুক্ত আকাশতলে বৃষ্টি-বাদলায় গাছের তলায় হয়তো এরা বিশ্রাম করে। এদের মধ্যে অনেক যুবতীও আছে যারা দুদিন আগে রূপের ঝলকে পথিককে মাতিয়েছিল।

অনেক দিন আগে, একদিন কলকাতার এক রাস্তায় দেখলাম একটা বালিকা তার শিশুপুত্রকে কোলে করে শীতে কাঁপছে। কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম–তোমার বাড়ি কোথায়? সে বললো, নদীয়া জেলায়। অনেকক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, দু বছর আগে সে কোনো যুবকের প্ররোচনায় বাড়ির বের হয়! যুবকটি তাকে নিরাশ্রয় করে পালায় নি, সম্প্রতি কী একটা অন্যায় করে জেলে গিয়েছে। এখন নিরাশ্রয় হয়ে পথে বেরিয়েছে। যেখানে বাস করছিল, বাড়ির খাজনা না দিতে পারায় তারা তাকে বের করে দিয়েছে। শিশুটির বয়স মাত্র তিন মাস। তার বাপই হচ্ছে সেই লোকটি। কোথায় এর বাড়ি? যখন সে ছোট ছিল কত লোক তাকে সোহাগ করেছে আর আজ সে কোথায়? স্নেহ নাই, মায়া নেই, আপন বলতে তার এ সংসারে কেউ নাই। তার ঘর-দুয়ার, তার পরিচিত খেলার সাথীরা আজ কোথায়? একটুখানি ভুল করায় জীবন ভর তাকে এক নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হবে। সে যে নারী–তার হৃদয়-বেদনা বোঝবার মতো কেউ নাই। এই শ্রেণীর বহু মেয়ে শহরে বাস করে। শয়তান প্রকৃতির লোক যুবতী মেয়েদের চুরি করে এনে শহরে পাপ কাজের জন্যে বিক্রি করে–যারা এককালে ছিল পল্লী পরিবারের শুভ্র ফুলের মালা। আর একটা মেয়ের কথা জানি। এই মেয়েটির বাড়ি হচ্ছে এক পল্লীতে। একটা বুড়ি গঙ্গা স্নানের কথা বলে তাকে কালীঘাটে নিয়ে আসে। বালিকাটি সরল মনেই স্নান করে পুণ্য অর্জন করবার জন্যে রেলে চড়ে শহরে এসেছিল। স্নান করে যখন সে উপরে উঠলো তখন বহু অন্বেষণ করে সে বুড়িকে খোঁজ করতে পারলো না। তারপর তার জীবনে বহু ঘটনা ঘঠেছে। শেষকালে উদরের জ্বালায় ও লজ্জা নিবারণের জন্যে লজ্জা বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করেছে। একে ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই বুঝছি। খোদার উপর তার খুব বিশ্বাস। পাপ জীবনের কথা স্মরণ করে সে বলল–কপালে লেখা ছিল; কী উপায় আমার, তাই বলুন। কষ্টে আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। ইচ্ছা করেছিলাম একটা সেলাই-এর কল কিনে দিয়ে তাকে স্বাধীন ও পবিত্র-জীবন যাপনের পথ করে দেবো; কিন্তু সাহিত্যিকের তো পয়সা। নাই। কেবল বেদনা আছে। মানব-জীবনের এই কঠিন দুরবস্থার কথা যখন মনে হয় তখন খোদাকে বলি, হে খোদা, আমাকে হত্যা করে এদের বাঁচাও অথবা এদের পথ করে দাও। অত্যাচারী সমাজের বিধানে এতভাবে কত মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

আরও একটা পতিতা স্ত্রীলোক আমাকে যা বলেছিল, তা শুনলে আপনারা স্তম্ভিত হবেন। রাস্তার ধার থেকে সে আমাকে এ কথাগুলি বলে আহ্বান করছিল–আপনি আমার মা-বাপ, আমার ঘরে আসুন, আমাকে কিছু দিয়ে যান, নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন আপনাকে। দেব, তার পরিবর্তে আপনি কী কিছু দিবেন না? হারে হতভাগিনী, যদি পয়সাই থাকতো তা হলে সর্বস্ব দিয়ে তোমাদের এ পাপজীবন হতে উদ্ধার করতাম।

নদীয়া জেলা হতে মেহের আফজানকে শয়তানেরা কেমন করে চুরি করে এনেছিল, সে খবর সকলেই জানেন। সে ছিল কুলবধূ। শেষকালে তাকে হতে হয়েছিল এসেন্সমাখা সাধারণ নারী। কী বিস্ময় কী বেদনা–যা ভাবতে চোখে পানি আসে। এরূপ বহু ঘটনা নিত্যই ঘটছে। সেদিনও চব্বিশ পরগণার একটা মেয়েকে তার খালা মুখ বেঁধে চুরি করে এনে বালিগঞ্জে কুব্যবসার জন্যে বিক্রয় করে। শহরে যেসব পতিতারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের অনেকের জীবনের প্রথম পৃষ্ঠা যারপর নাই শোকাবহ, এদের কথা কে ভাবে? চরিত্র হারাবার ভয়ে কলঙ্কে লজ্জায় ভদ্রলোকেরা এদের কাছ থেকে দূরে সরে যান; কিন্তু শিক্ষিত মহিলারা কি এদের জন্যে কিছু করতে পারেন না?

সকল দেশেই কুস্বভাবা নারী পাপ ব্যবসা করে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো অন্নের জন্যে কিংবা সমাজের অত্যাচারে তাদের এই কদর্য জীবন অবলম্বন করতে হয় না। যে শয়তানী সে ধ্বংস হয়ে যাক তার জন্যে কিছু হয়তো করবার নাই।

অন্যান্য দেশে রাস্তায় আর্ত-পীড়িতের জন্যে আশ্রম আছে কিনা ঠিক জানি না। রাস্তায় মানুষ মরতে দেখে কি ঘরের দুয়ার দিয়ে কি শুয়ে থাকা সম্ভব? এদের আঁখিজল, এদের ব্যথা কী চিরকালই ব্যর্থ হয়ে যাবে?

শহরে যে সব বড় বড় মান্যস্পদ ব্যক্তিকে দেখা যায় তাদের বাড়ি প্রায়ই শহরে নয়। পল্লীর অজ্ঞাত কুটিরে যিনি একসময় খেলা করেছিলেন আজ তিনি নগরে উচ্চ বেদীর উপর দাঁড়িয়ে জাতির কর্তব্য-কথা শোনাচ্ছেন। ভবঘুরে শহরবাসীরা চিরকালই ভবঘুরে। নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান ভেবে অল্প বয়সে অত্যধিক চালাক হয়ে শহরে বালকেরা জীবনকে মাটি করে দেয়। পল্লীর শান্ত শীতল নির্জন মাঠ, গোধূলিলগ্নে পশ্চিমাকাশে সোনালি রাগ, নদী-তীরে পল্লীবালাদের কলহাসি, পালতোলা নৌকাগুলির অন্তহীন পথে যাত্রা শহরে কারো মনকে ভাবময় করে তোলে না। এখানে কেবল মুহূর্তে মুহূর্তে চিত্রপটের মতো দৃশ্য বদলাতে থাকে; মনে কোনো চিন্তা করবার সুযোগ পায় না। যে হৃদয় নিরালায় বসে মানব-সমাজ তথা বিশ্বের শত লীলা-রঙ্গ সম্বন্ধে চিন্তা করবার কিছুমাত্র অবসর পায় না, তার কী মনুষ্যত্ব থাকে? কল-কারখানার মতো শহরের লোকগুলি সুশৃঙ্খল জীবন কাটায়। কল-কারখানার সঙ্গে যেসব ভাব ও প্রাণের কোনো যোগ নাই–শহরের লোকগুলির জীবনও ঠিক তেমনি। নিত্য সকালবেলা উঠা, কাজের মতো করেই কিছুক্ষণ। খবরের কাগজে পাঠ করা, তারপর বাধা কাজে জীবন শেষ করে দেওয়া। চিন্তা করে বা ভেবে তারা জীবনের সময় নষ্ট করবার সুযোগ পায় না। ভাবপ্রবণ হয়ে শহরে লোক কাউকে আপন মনে করতে পারে না। স্বার্থ ও টাকার গন্ধ যেখানে পায় সেখানে যেয়েই। তারা হাজির হয়। তারা আপন মনে করে কেবল হয়তো পত্নীকে। জগতে আর কারো সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ নাই।

একটা মানুষ মরে গেলে পল্লীর সকল মানুষের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। শহরে কী তাই? কে কার খবর রাখে? কারো ব্যাধি হলে তাকে দূর করে দিতে পারলেই শহরের লোক নিশ্চিত হয়।

পল্লী বালকের স্নেহপ্রবণ ভাব কোনোকালে যায় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবটি আরও উদার ও ব্যাপক হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে শহুরে লোক যতই বড় হতে থাকে জীবন সংগ্রামের কঠিন ভাবনা ভাবতে হয়, ততই তার মনের সঙ্কীর্ণতা ও স্বার্থপরতী বেড়ে ওঠে।

শ্যামল প্রকৃতি-ছায়ার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ শহরবাসীর নাই। দেশের এত খবর, এত রক্তারক্তি, এত ওলট-পালট এসবের কোনোটির সঙ্গে তার সহানুভূতি নাই। সে কেবল নিজের ভাবে মশগুল।

নিরালা নির্জন স্থান জীবনের বা মনের উন্নতির পক্ষে খুবই অনুকূল। মনে উন্নতি না। হয়ে শুধু পয়সায় যদি মানুষ বড় হয় তবে সে বড় হওয়ার কোনো মূল্য নাই। শহরে লোকের পক্ষে একাকী হয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব। সহস্র নতুন মুখ সহস্র নতুন চিত্র তার মনকে সর্বদা উত্তেজিত করে রাখে। কোনো জিনিসের ভেতরের দিকে তাকাবার তার কোনো অবসর নেই।

গ্রামের মাঠে ধানের ক্ষেতের শ্যামল শোভা শহরে নেই। ফসল তৈরি করবার জন্যে পল্লীর মানুষেরা মাঠে যে পরিশ্রম করেন তাতে আনন্দ। কৃষকেরা অশিক্ষিত বলে লোকে তাদের ঘৃণা করে থাকেন। শিক্ষিত লোক এই সমস্ত কাজ করলে কেউ তাদের ঘৃণা করতে পারে না।

কী করে ধান তৈরি হয়, দেশের মানুষ কেমন করে ফসল তৈরি করে, পল্লীবাসীরা কেমনভাবে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করে, এ বিষয়ে শহরে লোকের কোনোই ধারণা নেই। সুতরাং দেশ সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান খুব অসম্ভবপূর্ণ।

বিলেতের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার গ্রামের মায়ের ছেলে। নদীর নিচে রেলের রাস্তা তৈরি, বড় বড় সেতু নির্মাণ এ সব শহরের লোকের দ্বারা হয় না।

নিউটন, জর্জ স্টিফেনসন বাল্যকালে অজ্ঞাত পল্লীতে মানুষ হয়েছিলেন। পল্লীতে অজ্ঞাত হয়ে অনেক বড় মানুষ জাতির সেবা করে থাকেন। নাম যখন তাদের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, পল্লীবাসী যখন সাধনা পথে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন তারা বাধ্য হয়ে শহরে আসেন। সাহিত্যিক বাফুন (Buffon) কিন্তু চিরকালই পল্লীমায়ের আঁচলে বসে জাতির সেবা করেছিলেন। তিনি শহরে জীবন পছন্দ করতেন না।

শত শত মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি যিনি পাচ্ছেন, যাঁর চারিদিকে কত মানুষ ভীত ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–তিনি যে কোনোকালে খোকা ছিলেন, মায়ের বুকে কেঁদেছেন, তা বিশ্বাস করতে মনে যেন চায় না। অধ্যাপক আলেকজাণ্ডার মারে (Alexander Murray) এরা এক সময়ে মাঠে মাঠে মেষ চরাতেন। গ্রামের সুখ-দুঃখের এক সময় বিমলিন করেছিল। মধ্যাহ্ন নিঝন মাঠের মাঝ দিয়ে অথবা নদী পথে যাবার সময় প্রাণের মাঝে যে ভাবের উন্মেষ হয় তা শহরে তা অনুভব করতে পারি নে। প্রান্তরের বুক কাপিয়ে দিগন্তের বাতাস পথিকের মনে স্পন্দন আনে, তা শহরে কই? জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতির পুলক উৎসব, বর্ষাকালে মেঘের মাতামাতি ঝিল্লিমুখর নিশীথরাত্রি; গ্রামান্তরে নারী দুঃখের করুণ প্রতিধ্বনি শহরে নাই। কতদিন নির্জন মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে কত কথা ভেবেছি, কোনো দূর জগতের অব্যক্ত আহ্বান এসে প্রাণকে ব্যাকুল করে তুলেছে; শহরে তা কই।

পল্লী মাঠ-প্রান্তরগুলি মানুষকে চিন্তাশীল করে তোলাবার পক্ষে খুব অনুকূল। চিন্তার সঙ্গে যে হৃদয়ের যোগ নেই, সে হৃদয় বড় দরিদ্র। বেঞ্জামিন ব্রডি (Benjamin Brodie) মাঠে মাঠে ঘুরে চিন্তা করতে শিখেছিলেন। নতুন নতুন সত্যের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন, যখন তিনি একাকী পল্লীর পথ ধরে ঘুরে বেড়াতেন।

দেশের গ্রামগুলির অবস্থা বড়ই শোচনীয়। সেখানে না আছে রাস্তা, না আছে কোনো পাঠাগার। বিদ্যালোচনা ব্যতীত সাধারণ লোকের উন্নতি হবে কীসে? বই না পড়ে কী মানুষ আত্মার দারিদ্রে লজ্জিত হয়? সকলেই মুখে বলে, সদা সত্য কথা বলা উচিত; কিন্তু মনের উপর কথার দাগ ফেলান কি সহজ কথা? মানুষকে এত বিচিত্র পন্থার ভিতর দিয়ে সত্যে দীক্ষিত করতে হবে, তার কী ঠিকানা আছে? লেখক ও সাহিত্যিকরা কবিতা, গল্প, ইতিহাস ও কাব্যের ভিতর দিয়ে মানুষকে সত্য পথে অহ্বান করছেন। জীবনকে বড় করে তোলাবার জন্যে সর্বদা বই পুস্তক পড়তে হবে। সাধারণ মানুষকে উচ্চ প্রেরণা দেবার জন্যে তাকে জ্ঞান সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে; অথচ এ কাজের জন্যে কোনো চেষ্টা নেই। জ্ঞানের সেবা না করলে কোনো মানুষের বা কোনো জাতির দুঃখ ঘোচে না। কলেজ ও স্কুলে ক’টি লোক যেতে পারে? পল্লীতে যারা অজ্ঞাত জীবন-যাপন করছে তাদের দুয়ারে যেয়ে জ্ঞান ও সাহিত্যের উপহার নিয়ে দাঁড়াতে হবে।

মানুষের সহিত মানুষের যোগ হবার, সুবিধা গ্রামে খুব কম। মানুষগুলি কুপমণ্ডুক হয়ে বসে থাকে, এর কারণ রাস্তাঘাটের গ্রামের লোক জানতে পারে না। একে সেখানে মোটেই ভাব নেই; তার উপরে যেটুকু আছে, তারও আদান-প্রদানের সুবিধা সেখানে খুব কম। জাতিকে বড় করতে হলে পল্লীর মানুষকে প্রথম জাগাতে হবে। গ্রামে গ্রামে পাঠাগার খুলতে হবে; চলাচলের সুবিধা করে দিতে হবে। যারা শিক্ষিত তাদের ঘৃণা অহঙ্কার পরিহার করে পতিত মানুষের জন্যে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মানুষের জন্যে মানুষের মাথাব্যথা হওয়াই প্রয়োজন। মানুষকে ভুলে যারা ধর্মজীবনের আদেশগুলি পালন করতে যান, তাদের ধর্ম-পালন কিছুই হয় না। মানুষের জন্যে মানুষকে কাঁদতে হবে।

গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের উপর রাজা, জমিদারদের কর্মচারীরা বিলক্ষণ অসদ্ব্যবহার করে থাকেন। সে অসদ্ব্যবহার সহ্য করে ভদ্র ও শিক্ষিত লোকের পক্ষে সেখানে বাস করা। কঠিন। রাজকর্মচারীরাও গ্রামবাসীদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করে থাকেন। মানুষকে দলিত ও লাঞ্ছিত করতে পারলেই যেন তাদের মনে আনন্দ হয়। সেখানে সবলেরা সর্বদা দূর্বলের রক্ত চুষে খাওয়াতেই জীবনের সার্থকতা অনুভব করেন।

গ্রামে নারীদের যে দুর্দশা হয়, তা আর বলে কী হবে? পল্লী-নরনারীর দুঃখ-বেদনা বোঝবার জন্য কার মাথা ব্যথা হবে।

ডাক্তার আরনডের পল্লীর জীবনের প্রতি একটা আন্তরিক টান ছিল। তিনি ছেলেদের নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। পল্লীর লতাপাতা, শ্যামল মাঠ, উঁচু গাছগুলি তাঁর প্রাণে আনন্দের ধারা ঢেলে দিত। প্রকৃতির মাঝেই তো আমরা জীবনের সন্ধান পাই–অনন্তের সঙ্গীত শুনি। হৃদয় যাদের বড় তারা প্রকৃতির শ্যামল মাধুরীর ভিতর থেকে জীবনের হাজার সম্পদ কুড়িয়ে নেন। কী হবে–ইট-পাথরে, দালানে, অর্থের কাঁড়ি দিয়ে? চাই শান্তি পাপের পরাজয়, মানব দুঃখের অবসান আর আত্মার পুলক।

কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ পল্লীমায়ের আদুরে সন্তান। মৃত্যু পর্যন্ত জগৎকে তিনি প্রকৃতি জননীর সঙ্গীত শুনিয়েছেন। মানুষ বিহ্বল হয়ে কবির সে গান শুনতে থাকবে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের বীণাধ্বনি নীরব হবার নয়।

সিডনী স্মীথ (Sydney Smith) গ্রামে বাস করে এডিনবরা রিভিউয়ের জন্যে প্রবন্ধ লিখতেন। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শেষ জীবনে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিন্তু গ্রাম্য জীবনের আনন্দ ও তৃপ্তি হতে বঞ্চিত হয়েছিলেন বলে তিনি অনেক সময় দুঃখ করতেন।

দার্শনিক কার্লাইল পল্লীর অজ্ঞাত কুটিরে জন্মেছিলেন। তিনি জগৎকে যে চিন্তা সম্পদ দিয়ে গিয়েছিলেন, তার মূল্য হচ্ছে–বাল্যকালে তার সেই নির্জন পল্লীবাস। লেখাপড়ার জন্য তিনি কিছুদিন এডিনবরা শহরে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর হতেই তিনি পুনরায় পত্নীকে। নিয়ে এমন নিরালা নিভৃত স্থানে বাস করতেন যে, সেখানে যেতে হলে অপরিচিত লোককে বিলক্ষণ গ্রামের মাঝে যেয়ে তাকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। কার্লাইল নিতান্তই একা একা বাস করতেন। তাঁর বাড়ির কাছে একটা জনপ্রাণী ছিল না, যার সঙ্গে খুলে তিনি একটু কথা বলতে পারেন। কাছে একটা পাদরী ছিলেন মাত্র, তার সঙ্গে আলাপ হতো। অবশিষ্ট সময় পরীর সঙ্গে আলাপ করে আর বই পড়ে তিনি কাটাতেন।

দেশে মন টেকে না–একথা অনেককেই বলতে শুনেছি। গ্রামের লোকগুলি অসভ্য ও নীচাশয়। রাস্তা-ঘাটগুলি কর্দমাক্ত–এ সমস্ত কথাও অনেকে বলে থাকেন। পল্লীকে ঘৃণা করে তারা বন্ধু-বান্ধবের কাছে প্রশংসা লাভ করতে চান; এটা ঠিক নয়। পল্লী যদি জঘন্য স্থানই হয় তবে তাকে বড় করে নিতে হবে। গ্রামের লোকগুলি যদি দুর্মতিই হয়, তবে দেশ ছেড়ে নিজের সুখ ও উন্নত মনটি নিয়ে পালিয়ে এলে চলবে না।

মান উন্নত হয়ে লাভ কী? যদি না মন অন্য মানুষকে উন্নত করতে পারে? জগতের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য এই ধরনের উন্নত মন দিয়ে পৃথিবীর কোনো উপকার হয় না।

অনেক জায়গায় দেখেছি বড়লোকেরা কতকগুলি লোককে বাড়ির পার্শ্বে দাস করে রাখে। নিজেদের বড়মানুষেতা অক্ষুণ্ণ করে রাখবার জন্যে কতকগুলি মানুষের জীবনকে কি ব্যর্থ করে দিতে হবে? ছোটলোক লেখাপড়া শিখলে ভদ্রলোকের সম্মান থাকবে না, এ কথা তারা বলে থাকেন। এরা যে কত বড় অমানুষ তা আর বলে কী হবে।

যে অর্থ মানব-কল্যাণ ব্যয়িত হয় না, যে ক্ষমতা মানুষের দাবি রক্ষার জন্যে অর্জিত হয় না, যে বিদ্যা মানুষকে সত্য ও ন্যায় মহিমা শোনাবার জন্যে লাভ হয় নাই–সে অর্থে, সে ক্ষমতা, সে বিদ্যার কোনো মূল্য নাই।

রোমান জাতি সর্বদাই গ্রাম্য লোককে ঘৃণা করতেন। ভদ্রলোক যারা তারা শহরে। থাকবে। নিম্নশ্রেণীর সাধারণ লোকদের জন্যে গ্রাম–এই ছিল তাদের ধারণা এবং জাতীয় প্রথা। মানুষকে যে মানুষ ঘৃণা করে, একজনের দাবি যে আর একজন অপহরণ করে, এর মূলে ঘৃণিত ও অপহৃত ব্যক্তির অনেকখানি দোষ দুর্বলতা থাকা সম্ভব; কিন্তু রোমানেরা যাদের গ্রাম্য ছোটলোক বলে ঘৃণা করতেন শেষকালে তারাই হয়েছিল জাতির চালক।

পল্লীর যে-সব মানুষ অবজ্ঞাত হয়ে থাকে, তাদের জাগরণ হয় তখন, যখন তারা জ্ঞানের স্পর্শে আসে। যে জাতি বা যে মানুষের মনে দাম্ভিক ও আত্মসর্বস্ব হয়ে তৃপ্তি আসে, তাদের স্থান খুব নিচে। এটা হচ্ছে পতনের পূর্ব লক্ষণ। অত্যাচারী জাতি বা অত্যাচারী মানুষ ছোটকে জ্ঞানান্ধ ও ছোট করে রাখতে চায়। পাপী ও পতিতকে ঘৃণা করতে আনন্দ বোধ করে। ছোটকে বড় করাই মনুষ্যত্ব ও বড় ধর্ম। এ জগতে যত মহাপুরুষ এসেছেন তারা দরিদ্র, হীন ও পতিতকে বড় করেই জীবনের দানকে সার্থক করেছেন।

পুস্তকে যা পড়ি তার চেয়ে কাজ হয় বেশি মুখের কথায়। কিন্তু জীবন্ত মানুষের মুখ থেকে যে ভাব ও শব্দ বের হয় তা বৈদ্যুতিক শক্তির মতো মনের উপর ক্রিয়া করে। পুস্তকও মানুষকে বড় করবার জন্যে নীরবে কাজ করতে থাকে, সাহিত্যের শক্তি অসাধারণ।

শহরের বাজারে এক শ্রেণীর দুর্মতি লোক দেখা যায় যাদের পতিত আত্মাকে রক্ষা করবার জন্যে কারো বেদনা নেই। জাতিকে শক্তিশালী করতে হলে এদের কানের কাছে। বড় কথা ও বড় চিন্তার ধ্বনি তুলতে হবে। মানব-আত্মাকে আঘাতের উপর আঘাত করতে। হবে। শাসনতন্ত্রে সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে ভালো করবার জন্যে বহু সমিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। পল্লীতে পল্লীতে গ্রামে গ্রামে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে; ছোট ও দুর্মতি লোকদের নিয়ে মনুষ্যত্বের কথা বলতে হবে! বিলেতে পতুিত মানুষের উদ্ধারের জন্যে বহু চরিত্রবান নারী-পুরুষ সেবক সেবিকা আছেন। আমাদের দেশে কি শহরে, কি পল্লীতে এরূপ কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। যে সামান্য শক্তি আছে, তাই নিয়ে–হে দেশের মানুষ, মানব সেবায় বেরিয়ে পড়। সভ্য জাতির সেবাধর্ম একটা স্বভাব। মানব কল্যাণই তার যাত্রাপথের সাধনা। ছোট, দরিদ্র, হীন, অবজ্ঞাতকে নিয়ে আজ আমাদের পাগল হতে হবে।

খ্রিস্টানকে যতই আমরা ঘৃণা করি, সেবা ধর্মের দিক দিয়ে এঁরা কত বড়। কিছুদিন হল সার্কুলার রোডে এঁরা একটা নতুন ফ্রি স্কুল খুলেছেন। সেখানে ছোট-বড়, মুটে মজুর শ্ৰেণীর ছেলেরা পড়ে। ছেলেদের পড়ার অনেক পুস্তকও সেখানে জমা করা হয়েছে। এরূপ একটা স্কুল নয়, শত শত ফ্রি স্কুল তারা দেশের সর্বত্র খুলেছেন। মানুষকে সভ্য পথে, জ্ঞানের পথে আনবার জন্যে ফ্রান্স, আমেরিকা ও বিলেতের বহু মানুষ জীবনের সমস্ত অর্জিত ধন দান করে যান। সেকি দু একটা টাকা? এইসব টাকা দিয়ে প্রচারকার্য দীন আর্তের সেবা, পুস্তক প্রচার প্রভৃতি বহু ভালো কাজ হয়ে থাকে।

আমার একটা পাদরী বন্ধু এক বাঁশ বাগানের ভিতর থেকে একটা ছোট মেয়ে কুড়িয়ে এনেছিলেন। সে যখন সেয়ানা হয়েছিল, তখনই তাকে দেখেছি। মানুষের প্রতি তাদের এই যে প্রেম, এ যে শ্রদ্ধার চোখে না দেখে সে মুসলমান নয়। কত নিঃসহায় বালক বালিকা, কত অনাথিনী, কত কানা খোঁড়া তাদের আশ্রমে আশ্রয় পায়। আমরা কি মানুষের জন্যে। কিছু করতে পারি নে? শুধু হৃদয়হীন ধর্মবিশ্বাস কি মানুষকে মুক্তি দেবে? আজ বেদনা নিয়ে শহরে পল্লীতে সর্বত্র বেড়াতে হবে, কথা বলতে হবে, গান গাইতে হবে।

কবি গোল্ডস্মিথের বিখ্যাত বই ‘ভিকার অব ওয়েকফিল্ড’ এ গ্রাম্য জীবনের মনোহর ছবি ফুটে উঠেছে। ফিলডিং (Fielding) স্মলেট (Smolet), জর্জ ইলিয়টের (George Eliot) বইগুলি পল্লী কাহিনীতে ভরা। ওয়াল্টার স্কটের বইগুলি পাহাড় পর্বতের বর্ণনায়, উপত্যকা ও গ্রামের সবুজ ক্ষেত্রগুলি ছবি পড়লে মনে প্রভূত আনন্দের সঞ্চার হয়। সে সব বর্ণনা কত প্রাণ, কত প্রণয়, কত আশা কত সুখ-দুঃখের পরশ জড়ানো। পল্লীর পরিত্যক্ত বনভূমি নির্জন নদীতীর, রাখাল বালকের সঙ্গীত ধারা কবির মনকে পরিপূর্ণ করে রেখেছিল।

কবি বায়রনকে প্রৌঢ় বয়সে শহরে বাস করতে হলেও বাল্যে তিনি পল্লীর সরল শোভার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। মহাকবি শেক্সপীয়ারের কবিতায় গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃশ্য কেমন বিচিত্র হয়ে উঠেছে। পাখিগুলি দিন অবসানে নীড়ে ফিরে আসছে, ফলের গাছগুলি সৌন্দর্য পুলকে মানুষের চিত্তকে পুণ্য পবিত্রতায় ভরে তুলেছে। তিনি ছেলেমানুষী করে পল্লীবালকদের সঙ্গে এক হরিণ চুরি করেছিলেন। মধ্য জীবনে তিনি লণ্ডনে থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু জীবনের শেষের দিকে পল্লীর শান্ত শীতল কোলে ফিরে গিয়েছিলেন।

সেনস্টোন (Shenstone) কাউলে (Cowly) কাউপার (Cowper) ফিলিপ সিডনী (Philip Syddeny) সবাই গ্রাম থেকে এসেছিলেন। অধ্যাপক বসুর বাড়ি বাংলাদেশে। হেরম্ব মিত্র, পি. সি. রায়–গ্রাম বাড়ি শহরে নয়। কবি মাইকেল ছিলেন যশুরে বাঙালি মায়ের ছেলে। পল্লী প্রকৃতির শ্যাম দোললীলার মাঝে কবি-সাহিত্যিক নিজেদের ভাবের সাড়া পান। রবীন্দ্রনাথ জীবনের অনেক সময় নদী বিহারে কাটিছেন। ইট পাথরের মধ্যে মাঠের পারে, শেষ বিদায়ের অশ্রু সম্ভাষণে, স্রোতস্বিনীর কুলধ্বনিতে, ফুলের শোভানৃত্যে, মুক্তাভরা দুর্বা আস্তৃত গ্রামের পথে আর নিগৃহীত পীড়িতের মর্মবেদনায়।

ব্যস্ত অধীর, বিধাতার সিংহাসন হতে বহু দূরের শহরে লোকগুলি এসব কথার কিছুই বোঝে না। তাদের কানের গোড়া দিয়ে নিয়ত বিশ্বের আলোক বাতাস যে সঙ্গীত গেয়ে। ফিরছে, তা তাদের জানা নেই।

পল্লীর মানুষই জাতিকে বাঁচিয়ে রাখে। অর্থ দিয়ে? হৃদয়ের রক্ত দিয়ে তারা জাতির সেবা করে। শত্রু এসে দেশ আক্রমণ করলে কে তাদের বাধা দেয়? গ্রামে অজ্ঞাত অবহেলিত জনসাধারণ, পল্লীর লক্ষ মানুষই জাতির মেরুদণ্ড। এদের অস্বীকার করলে চলবে না। এদের অর্থ ও জ্ঞানে বড় করতে হবে। শহরের মানুষ দেশকে ভালবাসে কি না

জানি নে। গ্রামখানিকে পল্লীর মানুষ কত আপনার মনে করে। প্রতিবেশীর সঙ্গে তার কত আত্মীয়তা। পল্লীর মাঠ-ঘাট, পুরানো অশ্বথ গাছ, বোস বাবুদের কানা পুকুরটির ছার, প্রবাসী পল্লীবাসী কত আদরে স্মরণ করে। সেখানে তার জীবনের কত স্মৃতি, কত বেদনা, কত জয়, কত ব্যর্থতা জড়িয়ে আছে। এই অন্ধ অনুরক্তির সঙ্গে তার মনে আত্মমর্যাদা জ্ঞান জাগিয়ে তোল, দেখবে সে কি হয়–আর কি করে, শহরে মানুষগুলি তো কতগুলি অতিথি। আপনার মধ্যে সে আপনি সীমাবদ্ধ। জগতের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নেই। সে নিষ্ঠুর, কটুভাষী ও স্বার্থপর। সে ভিখারির মুখের উপর সশব্দে দরজা আটকিয়ে দেয়। দেশ বলতে তার কিছু নেই। জগতে সে ভাড়া দিয়ে বাস করে।

যখন স্পেনের রাজা বিলেত আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হলেন, তখন দেশ রক্ষার আহ্বান এসেছিল পল্লীর ইতর ও ভদ্র, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের কাছে। ওটারলুর যুদ্ধে গ্রামে চাষীরাই বিলেতের গৌরব রক্ষা করেছিল।

কিছুদিন হল, আমার বাড়ি হতে দুটি ছেলে পত্র লিখেছে–কলকাতা এসে তারা কোনো চাকরি করবে। শহরে এসে থাকতে পেলে যেন তাদের কত সম্মান হবে। বাড়িতে যে তাদের কিছু নেই তা নয়। পরের গোলামী করে এখানে থেকে নিরন্তর কষ্ট পেলেও তাতে তাদের দুঃখ হবে না। পল্লীবাসীরা মনে করে গ্রামে যারা থাকে তাদের সম্মান মোটেই নেই। যে জমি আছে তাই যদি পরিশ্রমের সংগে চাষ করা যায় তাতে কত সম্মান, কত স্বাধীনতা।

গ্রামের লোকের এতকাল ধারণা ছিল, যার বংশ যত গোলাম তৈরি করতে পারে সে তত শরীফ বা ভদ্রলোক। লোকে গল্পের সময় বলে থাকে, তার শ্যালক ডেপুটি বাবু, চাচা উকিল–অতএব তারা যে খুব ভদ্রলোক তাতে আর সন্দেহ কী? এই ধরনের জঘন্য চিন্তা জাতির দীনতা ও পাতিত্য প্রকট করে তুলেছে। পল্লীতে থেকে জমি চাষ কর, জ্ঞান ও সত্য জীবন অবলম্বন কর–তোমার স্বাধীনতা উন্নত ললাটকে আমি চুম্বন করবো। ঘুষ, মিথ্যা ও দাস জীবনের কলঙ্ক ছাপে তুমি উচ্চস্থান অধিকার করে বসেছ, ধিক তোমার জীবনের, ধিক তোমার অর্থে। সেই শুভদিন কবে আসবে, যেদিন পল্লীর মানুষ সত্যের সেবক হয়ে নীচতাকে ঘৃণা করতে শিখবে। অভাবগ্রস্ত দীন জীবনের উঁচু মাথাকে চাকর ভদ্রলোক হওয়া অপেক্ষা বেশি শ্লাঘার বিষয় বলে মনে করবে।

পল্লীতে যে সমস্ত মানুষ খুব আদর সম্মানে থাকেন, শহরে এলে তাদের কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। পল্লীতে থাকলে তার জীবন দেশের অনেক উপকারে আসতো, শহরে থাকাতে তা নিতান্তই নিরর্থক হয়ে গেছে।

বহু পণ্ডিত ও জ্ঞানী শহরে এসে সমবেত হন। যে মানুষের মূল্য পল্লীগ্রামে কেউ বোঝে নাই শহরের মানুষেরা তাকে বুঝে এবং সম্মান করে। গ্রামে অজানা অচেনা হয়ে বহু শক্তি নষ্ট হয়ে যায়–কেউ তাকে বড় করে তোলে না। বারুদে আগুন দিলে যেমন করে জ্বলে ওঠে, পণ্ডিত মানুষের সহবাসে প্রতিভাও তেমনি করে জ্বলে ওঠে।

এক সাধুকে এক ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, দেখ সাধু, আমি তোমার চেয়ে ভদ্রলোক। সাধু তখন বলেন–এতে তো আমার দুঃখ নেই। জগতে যত ভদ্রলোক হয় ততই ভালো। মন যখন ছোট ও অবনত থাকে, তখন সে মানুষের শক্তি ও গৌরব শক্তি স্বীকার করতে লজ্জা পায়। এই জন্যে দেখে থাকি, পল্লীর অনেক মানুষ ছোটর উন্নতি ও মঙ্গলে আনন্দ পান না, মহত্ত্ব ও গুণ স্বীকার করতে সঙ্কোচ, কুণ্ঠাবোধ করেন। যে শক্তি পল্লীতে অসাড় ও শক্তিহীন হয়েছিল শহরের গুণগ্রাহী পণ্ডিতমণ্ডলীর স্পর্শে এসে তা অনুরূপ তেজে জ্বলে ওঠে। বড় ও মহৎ যিনি, তিনি সত্যের জয়। যেখানেই মনুষ্যত্বের দীপ্তি তিনি চান দেখেন, সেখানেই তারা মাথা নত হয়ে পড়ে। এই মাথা নত করতে তার আনন্দ হয়। সত্য ও মহত্ত্ব স্বীকার করাই যে তার ধর্ম। দুষ্ট ও শয়তানের শুভ দেখলে মনে যদি বিরক্তি আসে তবে তা বিশেষ দোষের নয়।

প্রাচীনকাল হতে শহরে রাজার শাসন-কেন্দ্রের পীঠস্থান হতে সর্বপ্রকার মঙ্গলসূচিত হয়। রাজাসনের অপব্যবহার হয়েছে সত্য কিন্তু রাজার অর্থ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটা প্রাণময় শক্তি। মানুষ নিজের মঙ্গলের জন্যে নিজেদের সত্যবুদ্ধি ও ন্যায় বিচারকে শরীরী করে উঁচুতে বসিয়ে রেখেছেন। রাজশক্তির নিকটে চিরকালই পণ্ডিতদল সমবেত হয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানালোচনা, ভাবের আদান-প্রদান ও নানা শুভ উদ্দেশ্যে তারা শহরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে এ কথাও বলে রাখি, যে পণ্ডিত বা যে দার্শনিক সম্মান ও অর্থ লালসায় রাজা সম্মুখে হীন হয়ে ব্যক্তিত্ব হারিয়েছেন তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞান সাধনা বৃথা। জ্ঞানের সেবক যিনি, সত্য উদ্ধার যার জীবনের ব্রত, তাকে সর্বপ্রকারে সকল স্থানে, কি শহরের পল্লীতে স্বাধীনচিত্ত হয়ে থাকতে হবে।

শহরের সম্পদ দেখে গোটা জাতির অবস্থা সম্বন্ধে বিবেচনা করলে চলবে না। দেশের সমস্ত মানুষের মঙ্গল চাই। শহরের বিলাস-জীবন উচ্চ অট্টালিকা দেখে জাতির সাধারণ মানুষের কথা ভুলে থাকলে চলবে না।

শহর হচ্ছে গোটা জাতিটাকে শুদ্ধ ও বড় করে তোলবার জন্যে কতকগুলি ঋষি ও মানব সেবকের সাধনা নিকেতন। তাদের ঘিরেই নিয়ত একটা কর্ম কোলাহল বাজতে থাকে। এটা আসলে মানুষের সম্পদ আহরণের স্থান নয়।

মানুষের নিত্য নিত্য যতই নতুন বিধান হোক না সে কখনও মৃত্যু ও দুঃখের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। তার কোথাও সুখ নেই। মানুষের মধ্যে বড় রকমের দুঃখ অসন্তোষ জাগিয়ে দেওয়া চাই; তাহলেই আমাদের মুক্তি হবে। তৃপ্তির মাঝে জীবন নেই, চাই শহর পল্লী সকল মানুষের অতৃপ্তি ও বেদনানুভূতি ভর্তি-শুদ্ধির জন্যে একটা জীবনব্যাপী সংগ্রাম।

জনসন শহরে থাকতে বড় ভালবাসতেন। জসুয়া রেনলডস বলতেন, লণ্ডন শহর ছাড়া আর কোথাও কথা বলে আমি সুখ পাই নে।

মানুষ যদি তার চিন্তা ও ভাব কারো সঙ্গে বিনিময় না করতে পারে তাহলে তার জীবনে অনেক সময় সুখ থাকে না। বিয়ের পর স্বামী-পত্নীতে যে অমিল হয় তার কারণ অনেক এই।

প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা পল্লীতে জীবনের প্রতিধ্বনি না পেয়ে শেষকালে শহরে এসে সমবেত হন। বহু সাহিত্যিক জীবনে অনেক কষ্টের দাগা পেয়েছেন, তবুও তারা শহর ত্যাগ করে পল্লীতে সুখ করতে যেতে পারেন নি।

শহরে আমাদের স্বাধীনতা খুব বেশি। কে কী বলবে, এ কথা বড় ভাবতে হয় না। পল্লীতে সমাজের ভয়ে অনেক সত্য কথা চেপে রাখতে হয়। পল্লীতেও যেদিন শহরের এই স্বাধীনতা লাভ করা যাবে, সেদিন আমাদের কী শুভ দিন, দাগা পেয়ে পণ্ডিতেরা যেদিন গ্রাম ছাড়বেন না সেদিন হবে আমাদের মুক্তির দিন, পল্লীতে বাস করেও আমরা জীবনের সকল সুবিধা পাবো, জীবনকে সার্থক করতে পারবো–সেই দিনের অপেক্ষা আমরা করছি। বিলেতে ও মার্কিন পল্লী তা পেরেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত