রাত্রির গিফট

রাত্রির গিফট

রাত্রি আজকে আমাকে কল করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। পাক্কা তিন মিনিট ঊনিশ সেকেন্ড কথা বললাম। ভেতরটা এখনো ধুকপুক করছে। এটা ধারনার বাইরে ছিলো। এখন বাজে ঘড়ির কাঁটায় বরাবর রাত তিনটা। ঘুম আসছে না আর।

প্রায় বছর খানেক আগে হঠাৎ রেগেমেগে রাত্রি আমাকে থাপ্পড় মেরে বসেছিল। অবশ্য থাপ্পড় মারার মতো আমি তেমন কিছুই করিনি, তাও। শুধু এটাই বলেছিলাম, “রাত্রি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।” রাত্রি আমাকে থাপ্পড় মেরে বলেছিল, “পুরুষ মানুষদের লায় দেয়াটাই অনুচিত, ঘৃণা লাগে। কাঁধে উঠে যেতে চায় একদম। সব পুরুষ’ই এক। ভেতরের শয়তানটাকে ধামাচাপার পাঁয়তারায় রাখে মাত্র। সুযোগ পেলেই বের করে ফেলে। খবরদার আর আমার সাথে আপনি কথা বলা এবং যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবেন না।”

আমিও আর যোগাযোগ করিনি। চরম অপমান বোধ হয়েছিল আমার। আমি এতোটা কঠিন ধাচের মানুষ না। খামোখাই এতোগুলো কথা শুনালো রাত্রি। মেয়েটাকে সত্যি সত্যি ভালো লেগেছিল। বাইরে থেকে এতো নিষ্পাপ আর এতো মায়াবী লাগতো যে ভালো না বেসে থাকাটাই অস্বাভাবিক যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ভালোবাসতে আমার থিওরিতে যে যে উপাদান থাকা চাই তার সবটাই যেন সৃষ্টিকর্তা রাত্রির মধ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন। সবার চোখে এটা নাও পড়তে পারে। এজন্য দেরি আর বনিতা না করে বলে ফেলি। তাও হুটহাট না। আমি এটাও নিশ্চিত হয়েছিলাম যে তার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই এবং সে অবিবাহিত।

সেবার কিছুদিন পর আমি চাকুরিটাও ছেড়ে দেই। কারণটা অবশ্য রাত্রির থাপ্পড় না। ইপিজেটে একটা জব কনফার্ম হওয়ায় এটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তার আগে রাত্রি আর আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতাম। এখানেই পরিচয়। খুব কম কথা বলতো রাত্রি। কাজের কথার বাইরে এক্সট্রা কোন কথা নাই। আমাদের কোম্পানিটা ছিলো রি-এক্সপোর্টেড কোম্পানি। বিশেষত কাঁচামালগুলো মিয়ানমার, ভারত, নেপাল এই কান্ট্রিগুলো থেকে ইমপোর্ট করা হতো। দ্যান প্রসেসিং করে আবার এক্সপোর্ট করা হতো।

আমি যেদিন চাকরিতে জয়েন করি সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। আরাম করে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মতো একটা দিন। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম থাক, চাকরি করবো’নে পরে কোনদিন। ঘুমাই আগে। এরকম করে চারটা চাকরির ভাইভা আমি মিস করেছি। সেবার আম্মা আর মামা এটা আর করার সুযোগ দিলেন না। বৃষ্টির মধ্যেই গাট্রি বোঝকা বেঁধে একদম পাঠিয়ে দিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সেদিন আমার জন্মদিন ছিলো। বোধকরি এটার জন্যই রাত্রি আমার জন্মদিনটা মনে রেখেছে। বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে চুপসে কোম্পানির স্টাফ কোয়ার্টারে লাগেজগুলো রেখে অফিসে আসি। আর সেদিনই রাত্রির সাথে প্রথম দেখা। যদিও একদিন আগে আসা উচিত ছিল। লম্বা একটা জার্নি তারপর আবার অফিসে জয়েন করা এটা একজন পরিপাটি ব্যাক্তির কার্যক্রম হতে পারে না। রাত্রিই আমার সব ফরমালিটিস কমপ্লিট করে দিয়েছিলো সেদিন। জীবনের প্রথম চাকরি। ফিলিংসটা ছিলো প্রথম দিন স্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো।

সবচেয়ে পজিটিভ সাইট হলো আমাদের কোম্পানির আমি যে ব্রাঞ্চে জয়েন করি সেটা সিলেটে, কজ আমি সিলোটি। আবার নেগেটিভ সাইট হলো আমার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব যতটুকু তার চাইতে কম দূরত্ব ঢাকার মেইন ব্রাঞ্চ। তাও নিজের এলাকার একটা আবাস’ই ছিলো ভরসা। এভাবেই চলছিল মোটামুটি। একটা সময় আমি কোয়ার্টার ছেড়ে শহরের বাইরে একটা বাংলো ভাড়া নেই। কোয়ার্টারে থাকা আর জেল হাজতে থাকার অনুভূতি বোধহয় এক’ই। আমার এমনটাই মনে হতো।

আমি যে বাংলোটা ভাড়া নেই ওখান থেকে মেঘালয়ের সুউচ্চ কালো মেঘের মতো পাহাড় দেখা যেতো। আমি প্রকৃতিপ্রেমি মানুষ। প্রকৃতির সাথে আমার ভালো বোঝাপড়া আছে। আমি প্রকৃতির সাথে কথা বলি, মিশে একাকার হয়ে যাই। আমার আর কাউকে দরকার পরে না তখন। আমি বাংলো থেকে হেঁটে হেঁটে চৌরাস্তার মোড়ে যেতাম, ওখানে রাত্রি এসে দাঁড়াতো। তারপর একসাথে সিএনজি করে অফিসে যেতাম।

আমাদের সিলেটে প্রাইভেট যাতায়াত করা লাগে। বাস কিংবা লোকাল জার্নি করার সুযোগ নাই বললেই চলে। রাত্রি দু’একটা কথার বেশি কখনো বলতো না। এই ধরেন; “হাই রবিন সাহেব, কেমন আছেন? চলেন যাওয়া যাক।” “আরেকদিন বলেছিলো, “কি ব্যাপার আজকে আমারো লেট আপনারো লেট!” রাত্রিকে এটা জানাইনি যে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। তা’না হলে আমার লেট হতো না। আরেকদিন রাত্রি বলেছিলো, “আচ্ছা রবিন সাহেব আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম আপনার কোয়ার্টার তো অফিসের কাছে আপনি বাগানের ভেতর দিয়ে আসেন ক্যানো?” আমি বলেছিলাম, “আমার প্রকৃতি ভালো লাগে। কোয়ার্টারে নিজেকে কয়েদী মনে হয়। আর এজন্যই বাগানের ভেতর একটা বাংলো ভাড়া নিয়েছি। ওটা এমনিতেই খালি পড়ে ছিলো।” সেদিন রাত্রি হেসে ফেললো। রাত্রির হাসি দেখার ভাগ্য অফিসের আর কারোর হয় নাই এটা আমি নিশ্চিত। অনেক কথা বললো। তারও প্রকৃতি ভালো লাগে। তারও ইচ্ছে করে এভাবে থাকতে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেদিন জানতে পারি রাত্রির বাড়ি কুষ্টিয়াতে। একটা মেয়ে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এসে চাকরি করছে এটা আমার কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো। আরো লক্ষ্য করে দেখলাম মেয়েটার চোখ টলমল করছে। আকাঙ্ক্ষাগুলো বহুদিন পর যেনো তাকে জাগিয়ে তোললো। অনেক জমানো কষ্টের পাহাড়গুলো যেনো আর বহন করার ইচ্ছাই হচ্ছে না। অসহ্য ক্ষোভ ভেতরে আটকে পড়ে আছে। আমি এতকিছু বলছি কারণ আমি মানুষ পড়তে পারি। মানুষ পড়তে কিছু টাস্ক আছে সেগুলো এপ্লাই করলেই মানুষ তার ভেতরের সোল’টা প্রকাশ করে ফেলে আস্তে আস্তে।

রাত্রিকে একটা ছুটির দিনে ইনভাইট করেছিলাম আমার বাংলোতে। খুব সহজেই গ্রহণ করেছিলো। বলেছিলো, “আমি আসবো।” আমি নিজেও জানতাম না সত্যি সত্যিই রাত্রি চলে আসবে। আমি আমার বাংলোর সামনে কিছু বাঁশ দিয়ে একদিন সারাদিন কামলা খেটে একটা বসার বেঞ্চ বানিয়েছিলাম। এখানে বসে দূরের পাহাড় দেখে দেখে চা খাওয়া যায়, বই পড়া যায়। বর্ষার বৃষ্টি থামার পর মেঘ ছোঁয়া যায়। সেদিনও আমি সেখানে বসে বই পড়ছিলাম। নিচে হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখি রাত্রি সাদা রঙের একটা ড্রেস পরে এদিকে আসতেছে। মাথায় সাদা ওড়না মোড়ানো তাই আর উপর দিকে আমাকে খেয়াল করে নাই। আমি দৌড়ে রুমে ঢুকে হাফ প্যান্ট ছেড়ে একটা জগার্স পরে নিলাম। সিগারেটের স্ট্রে লাথি দিয়ে খাটের নিচে ঠেলে দিয়ে বিছানার চাদর ঠিকঠাক করতেই দেখি রাত্রি এসে হাজির। দরজার কাছে এসে বলতেছে,

– বাহ্ ছেলে মানুষ এতো পরিপাটি আর এতো গোছানো জানা ছিলো না তো।
– সবাই এলোমেলো হয়না রাত্রি।
– তবে এলোমেলো’টাই কিন্তু ছেলেদের সাথে যায় খুব। হাহাহা।

এখন নিজেরই আফসোস হচ্ছে। কষ্ট করে এসব ঠিকঠাক করা মোটেও ঠিক হয়নি আমার। আমি এলোমেলোর চাইতোও কতটা এলোমেলো এটাতো রাত্রি জানে না। সেদিন রাত্রিকে নিয়ে আমার বানানো বেঞ্চে বসে দূরের মেঘলা আকাশ দেখিয়েছিলাম। অনুভূতিগুলো কেমন সায় দেয় সেখানে তাও বুঝিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক বৃষ্টি বাতাসের সাথে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। রাত্রি তা চোখ বুঁজে অনুভব করছিলো। আর আমি রাত্রিকে।

ভালোবাসা আসলে অদ্ভুত একটা জিনিস। পবিত্র অনেক, এটাকে অনুভবে রাখা উচিত। এখান থেকে বের করে ফেললেই সর্বনাশ হয়ে যায়। আমি তার উপযুক্ত ব্যাবহারটাই করেছিলাম। একটা মেয়েকে এভাবে কাছে পেয়ে কামনা ভাব আনাটাই কাপুরুষদের স্বভাব। এখানেই পুরুষ আর অমানুষের পার্থক্য।

চায়ের কাঁচা পাতা মুড়িয়ে শুকিয়ে এক ধরনের উপাদান আমি তৈরি করেছিলাম যা ফুটানো পানিতে এক চামচ কাঁচা পাতার গুড়া আর এক চামচ চিনি মিক্স করে খাওয়া যেতো। এর বিশেষত্ব হলো “আপনি চা পান করার আগে চোখ বুঁজে একটা ঘ্রাণ নিলে আপনার মনে হবে আপনি কাঁচা সবুজে মিশে গিয়েছেন।” আমি এটা বলেছিলাম রাত্রিকে। রাত্রি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা হয়েছিল এটা শুনে। আমাকে বলেছিল, “আপনি বড্ড পাগল আছেন। পারেনও বটে।”

আমি বলেছিলাম আপনাকে একদিন খাওয়াবো। সত্যি সত্যি আজকে বানিয়ে দিয়েছি। এখন আমাকে অবাক করে দিয়ে সে সত্যিই চোখ বুঁজে আছে। আর বলছে, “রবিন ইউ আর অ্যাবসোল্যাইটলি রাইট। রাত্রি আমাকে সেদিন যাওয়ার আগে বলেছিলো, “আপনি আসলে একটা নেশাদ্রব্যের মতো, আপনার সংস্পর্শে থাকলে যে কেউ মাথাল হতে বাধ্য।” আমিও সেদিন মনে মনে বলেছিলাম, “আপনিও আমার জন্য সেটাই।”

আমি আসলে রাত্রির মধ্যে আমাকেই খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো একে ছাড়া বাঁচা দায়, অহেতুক আর অনর্থক। তাই আমি পুরুষ থেকে বের হয়ে এসে একদিন কাপুরুষের মতোই বলে ফেলেছিলাম, “রাত্রি আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।” থাপ্পড়টা এখনো গালে অনুভব করি। তবে আমি এখনো রাত্রিকেই ভালোবাসি। যেকোন মূল্যে রাত্রিকে পাওয়াটা আমার জন্য জীবনের সেরা অর্জন হবে। কিছুক্ষণ আগে রাত্রি আমাকে কল করে পাক্কা তিন মিনিট ঊনিশ সেকেন্ড কথা বলেছে;

– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। শুভ জন্মদিন।
– ওয়া আলাইকুমুসসালাম। ধন্যবাদ, কে বলছিলেন?
– রাত্রি।
– কোন রাত্রি?
– কয়টা রাত্রিকে চিনেন?
– আপাতত দুইটা। দুটোকেই আমি ভালোবাসি।
– বাহ্ এটাই পুরুষদের পরিচয়।
– হয়তো।
– আমি হয়তো দ্বিতীয় রাত্রি এখন?
– নাহ্ আপনি প্রথমটা। আর দ্বিতীয়টা আজকের এই মুহূর্তের রাতটি।
– হাহাহা আপনি পাগল আছেন ঠিক আগের মতোই। সিলেটে?
– জ্বি।
– কাল একটু দেখা করা যাবে? আপনার জন্য গিফট আছে।
– হুমম। কোথায় আসবো?
– আপনার সেই বাংলোতে আসেন।
– তাহলে তো অনেক বেলা হয়ে যাবে। তার উপর সেটা খালি আছে কিনা কে জানে।
– সেটা আপনি যাওয়ার পর আমি ভাড়া নিয়েছি। আপনি আসতে পারেন।

এবার সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আজকে সকাল সকাল রওনা হলাম। আজকেও আকাশ মেঘলা। কিছু জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে আবার কিছু জায়গায় একদম রোদ। আমি বাইক নিয়ে বের হয়েছি। অবশেষে আসলাম। রাত্রির সাথে এক বছর পর দেখা। অবিকল সেই আগের রাত্রিই। দুজনে পাশাপাশি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছি। রাত্রি অনেকক্ষণ পর বললো, – রবিন আমাকে এখনো ভালোবাসেন?

– হুমম এখনো বাসি, সারা জীবন বাসবোও। আপনি না বাসলেও। সব পুরুষ আপনার চেনা পুরুষদের মতো হয়না।
– আমি জানি আপনি এক্সেপশনাল। আমি এটাও জানি শত দূরত্বেও আপনি আমাকে ভুলবেন না। তবে একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো এই একটা বছর। আপনি যাওয়ার পর যেনো আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনার চাইতেও বেশি। তবে আজকে বলে সব আফসোস আর খারাপ লাগার ইতি ঘটাতে চাই। জানি দিনশেষে আমি একাই হবো আবার। তাই ভয়ও হয়। তবে বলাটাই সবচেয়ে বড় গিফট হবে আপনার জন্য।

– এবার একা হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই রাত্রি।
– এতো নিশ্চিত!
– হুমম।
– হাতটা ধরবেন একটু। আমি কিছু বলতে চাই আপনাকে।
– ধরলাম, আপনি সব বলেন। আজ কোন ভয় নেই। আমি আছি পাশে। আপনার চোখ ছলছল করছে কেনো? আমি এটা নিতে পারছি না রাত্রি।

– রবিন আমি একটা ধর্ষিতা মেয়ে। জানেন? আমার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। আমি এই সিলেটে পড়ে আছি আজ চার বছর ধরে। আমার একটা অব্যক্ত গল্প আছে। যা আপনিই শুধুমাত্র নোটিশ করতে পেরেছেন। আমার পরিবার, আমার মা বাবা, আমার ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে আমি আজ একা। সবাইকে ছেড়ে না, সবাইকে মুক্ত করে বলতে পারেন।
পৃথিবীর কোথাও একটা ভালো পুরুষ আর আমি দেখিনা। আমার বাবা ছিলেন শেষ আশ্রয়দাতা। উনিও না ফেরার দেশে পারি জমান। আমাকে একা ফেলে। মা আর আপন করে রাখতে পারেননি আমাকে। খুব কষ্ট হচ্ছে রবিন। আমাকে অন্য কেউ ধর্ষণ করলে এতোটা কষ্ট হতো না কোনদিন জানেন?

আমাকে আমার আপন দুলাভাই ধর্ষণ করে। এটা আমি নিতে পারি না এখনো। যাকে আপন বড় ভাইয়ের জায়গাটায় রেখেছিলাম। আমার বোন ছিলো প্র্যাগনেন্ট। তারা ঢাকায় ছিলো। আমি ঢাকাতে এসেছিলাম আমার বোনের সেবা করতে। কোন এক গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো দরজার ঠকঠক শব্দে। ওঠে দরজা খুলে দেখি অফিস থেকে দুলাভাই ফিরেছে। আপু অসুস্থ, সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমায়। ঘুমু চোখে কিচেনে গিয়ে খাবার গরম করে টেবিলে খেতে দিয়েছিলাম ওনাকে। এই খাবার খেয়েও যে উনার আরো খিদা অবশিষ্ট ছিলো আমি তা জানতাম না রবিন। সেদিন এক ফোঁটা শক্তিও আমার ছিলো না নিজেকে রক্ষা করার। আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে।

তারপর বাড়ি এসে আর সাহস করে কিছুই বলতে পারিনি। তখন অনেকটাই ছোট। এতো কিছু বুঝতাম’ই না। ভয়ে আতঙ্কে আমি আমার চিন্তা ভাবনা স্থির করতে পারিনি। হঠাৎ একদিন আমার ভেতর আরেকটা প্রানের অস্তিত্ব টের পাই। সেবার আমি বনে গিয়েছিলাম নষ্টা। অনেক মেরেছিলো আমার মা আমার ভাই আমার চাচারা মিলে। এর মধ্যে আমার বোনের একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছিল। সত্যটা আমার পরিবার জানাজানির এক পর্যায়ে আমার বোনের সংসার নষ্ট করার দায়িত্ব নিতে পারবে না তারা, সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো। বোনের হাজব্যান্ড প্রতিষ্ঠিত ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন লোক পাওয়া যায় না আজকাল। বেটা মানুষের এতো দোষ থাকেনা। সবটাই আমার উপর চাপানো হলো। সবকিছু সহ্য করে আমার বাচ্চাটাকে একটা গ্রামের ক্লিনিকে গোপনে নষ্ট করা হয়েছিলো।

আমি অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। এই অসুস্থ সমাজ ছেড়ে, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কতো আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। পারিনি আমি। সাহসে কুলায় নি। তার অনেকদিন পর একদিন আবার ধরা পরেছে আমার আমার জরায়ুর টিউবে ময়লা আটকে ছিলো। এটা থেকে ইনফেকশন হয়ে গেছে। এটা কেটে ফেলে দিতে হবে। সেটাই করা হলো। আর এই সমাজকে আমি কলঙ্ক করিনি। কারো সাজানো সংসার ভাঙিনি। কারো সমাজের কলঙ্ক হয়ে থাকিনি। অনেক কষ্টে পালিয়ে এসে এখানে বাঁচার চেষ্টা করছি সবকিছু ত্যাগ করে। আমি আর স্বপ্ন দেখিনা। আমার সবকিছু শেষ রবিন। অনেকদিন পর একটা মানুষকে এসব বলা যাবে বলে মনে করেছিলাম। সেই মানুষটি আপনি। আপনাকে বলা যায়। এই সত্যটাই ছিলো আপনার গিফট। আশা করি আর ভালোবাসবেন না আমাকে। আপনিও চলে যান।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি এতক্ষণ যা শুনেছি এটাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন ব্যাথা করছে। অসুস্থ সমাজের প্রতি ঘৃণায় সারা শরীর আমার কাঁপছে। রাত্রির হাত কখন ছেড়েছি আমি নিজেও টের পাইনি। আর ধরার মতো সাহস নাই আমার। এটাই আমার ভালোবাসা। এখন সমাজের আর পাঁচটা পুরুষের সাথে আমার কোন পার্থক্য নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত