হটলাইন: ৭. রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে

হটলাইন: ৭. রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে

৭. রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে

রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে। অন্যপাশে মানুষটা কাঁদছে। বড় একজন মানুষ কাঁদছে। মানুষটা কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না। রত্নার শরীরটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করতে থাকে, মনে হতে থাকে তার শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ করে তার ভেতরে তীব্র একটা অপরাধবোধ এসে ভর করে। তার মনে হতে থাকে সে খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলছে। না বুঝে না জেনে সে একজন মানুষের বুকের ভেতরের গভীর একটা যন্ত্রণার মাঝে হাত দিয়ে ফেলেছে। কে তাকে সেই অধিকার দিয়েছে? সে কেমন করে একজন মানুষের যন্ত্রণাটুকু টেনে বের করে এনেছে? এতো বড় নির্বোধ সে কেমন করে হলো?

রত্না টেলিফোনটা কান থেকে সরিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকালো। রুনু ঝুঁকে পড়ে ফিস ফিস করে বলল, “কিছু বলবে?”

রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমি একা কথা বলতে চাই।”

“একা?”

“হ্যাঁ। প্লীজ। আপু তোমরা ঘরটা খালি করে দেবে?”

রুনু উঠে দাঁড়াল, বলল, “ঠিক আছে।” সে কিছুক্ষণ রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নরম গলায় বলল, “মনে রেখো। একেবারে শেষ মুহূর্তে কিন্তু কোনো নিয়ম নাই। তুমি যেটা বলতে চাও বলো, যেটা করতে চাও করো। সব প্রটোকল ভুলে যাও। এখন প্রটোকল একটা। তুমি একটা মানুষ-সেও একটা মানুষ। বুঝেছ?”

রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “থ্যাংক ইউ আপু।”

ছোট ঘর থেকে সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর রত্না টেলিফোনটা কানে লাগালো। মানুষটা এখনো কাঁদছে। রত্না নরম গলায় ডাকলো, বলল, “শুনছেন।”

মানুষটা মনে হয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, রত্না ঠিক বুঝতে পারল না। সে আবার বলল, “আপনি শুনছেন? আমি একটা কথা বলি? খুব ইম্পরট্যান্ট। আমাকে বলতেই হবে। প্লীজ।”

মানুষটা একটু শান্ত হল। বলল, “বল।”

“আপনি আমাকে মাপ করে দেন। প্লীজ। আমি আপনার কাছে মাপ চাই।”

মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হল, বলল, “মাপ চাও? কেন?”

“আমি খুবই বোকা একটা মেয়ে। স্টুপিড বলতে পারেন। আমি ভেবেছি আমি সবকিছু জানি আর বুঝি। আমি ভেবেছি আমি আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারব। আসলে আমি উল্টো আপনার ভেতরের সব কষ্টটাকে বের করে এনেছি। আমি সরি। আমি আসলেই সরি।

“তোমার সরি হওয়ার কিছু নাই। আমার হঠাৎ করে টুটুলের কথা মনে পড়ে গেল-” মানুষটা আবার শব্দ করে কাঁদতে থাকে।

“আমি সরি। আমি খুবই সরি। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি গাধা একটা মেয়ে সেই জন্যে আপনাকে জোর করে কথা বলিয়েছি। না বুঝে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।”

মানুষটা রত্নার কথা শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না, বলল, “টুটুল যখন ছোট ছিল তখন–যখন বাসায় আসতাম সন্ধ্যাবেলা, তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসতো। আমাকে দেখে কী খুশী হতো-মনে হতো বেঁচে থাকাটা স্বার্থক। এই পৃথিবীতে কেউ একজন আমাকে এতো ভালোবাসে। এখন-”

রত্না ধরা গলায় বলল, “আপনি আর বলবেন না প্লিজ। প্লিজ।”

“শোনো একটু। কাউকে একটু বলি। বুঝেছ পরী, গত ছয় মাস কাউকে কিছু বলি নাই। আমি একবার হাসি নাই। একটুও কাঁদি নাই। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে–”

“বোকা একটা মেয়ে।” রত্না কথার মাঝখানে কথা বলল, “গাধা একটা মেয়ে।”

“যেটাই হোক। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ কী যে হলো কখনো কাঁদছি। কখনো হাসছি। এতোদিন কষ্টটা চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, হঠাৎ করে কষ্টটা যেন বের হয়ে আসছে।”

“আমি এভাবে বের করতে চাই নাই। বিশ্বাস করেন–খোদার কসম।”

“কী বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। বারবার নীলার কথা মনে হচ্ছে। এখন থাকলে কতো খুশী হতো। সবসময় বলতো টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে, টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে।”

“কখনো ভিজেন নি?”

“না ভিজা হয় নাই। আরো কতো কিছু হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব–যাওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন নৌকা করে নদীতে নিয়ে যাব–নেওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম কাদায় মাখামাখি করে মাছ ধরতে যাব-যাওয়া হয় নাই। পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন খুবই কম সময়।”

রত্না চুপ করে রইল।

মানুষটা বলল, “ছেলেটা মনে হয় জানতে সে মাত্র পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন বেঁচে থাকবে। সেই জন্যে সে অবাক হয়ে সবকিছু দেখতো, কাউকে কিছু জ্বালাতন করতো না। ঢাকা শহরে চাঁদ থাকলেও দেখা যায় না। দেখা গেলেও কেমন জানি লাগে। একবার শ্রীমঙ্গল গিয়েছি। একটা চা বাগানে। রাত্রে এতো বড় একটা পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে-একেবারে ঝক ঝক করছে। টুটুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।“ একটু পরে পরে হাত দিয়ে দেখায় আর বলে, “চাঁদ। দেখো চাঁদ।”

রত্না এবারেও চুপ করে রইল। প্রটোকল অনুযায়ী প্রত্যেকটা কথার সাথে তার কিছু একটা বলার কথা যেন মানুষটা জানে সে তার কথা

শুনছে। রত্না আর প্রটোকল মানছে না, মানুষটা যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস

করবে তখন সে উত্তর দেবে। একটা বাবা যখন তার সন্তানের কথা বলছে

তখন মাঝে মাঝে কথা বলার কিছু নেই। সে শুনছে।

মানুষটা হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল, “আমার টুটুল চলে যাবার পর আমি কী করতাম জানো?”

“কী করতেন?”

“তার একটা শার্ট মুখের মাঝে চেপে রাখতাম তার শরীরের ঘ্রাণের জন্য। একটু ঘ্রাণের জন্য। তার কিছু পৃথিবীতে নাই, শুধু তার শরীরের একটুখানি ঘ্রাণ রয়ে গেছে। একটুখানি ঘ্রাণ-” মানুষটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আর কী আশ্চর্য রত্নাও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রত্না নিজেকে কয়েকবার শান্ত করার চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, “আমি বোকার মত কেঁদে ফেলেছি। আমি সরি। আমি রিয়েলি সরি।”

মানুষটা কিছু বলল না। রত্না বলল, “হটলাইনে কথা বলার সময় যদি কেউ কেঁদে ফেলে তাহলে সে ভলান্টিয়ার হতে পারে না। আমি আর ভলান্টিয়ার হতে পারব না।”

“কেন?”

“আমি আর হতেও চাই না। আমি আসলে হতেও পারব না। আমি বোকা। দুর্বল।”

মানুষটি বলল, “না পরী। তুমি বোকা না। দুর্বল না। তুমি অনেক ভালো ভলান্টিয়ার।”

“আপনি আমাকে খুশী করার জন্যে বলেছেন।” রত্না ভাঙা গলায় একটু হেসে ফেলল, “আমার আপনাকে সাহায্য করার কথা। এখন উল্টোটা হচ্ছে। আপনি আমাকে সাহায্য করছেন। থ্যাংক ইউ।”

“তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”।

“আসলে আজকে আমার প্রথম দিন। আমি আসলে খুব নার্ভাস ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম কার সাথে কথা বলতে হবে–সবাই সাহস দিয়েছে

বলেছে কোনো ভয় নাই। বেশীর ভাগ কেস হচ্ছে মায়ের বকা খেয়েছে, বয়ফ্রেন্ড চলে গেছে এ রকম। একবারও ভাবি নাই আপনার সাথে কথা বলতে হবে। আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারি নাই উল্টো মনে কষ্ট দিয়েছি। আমি সরি–”

মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না পরী।”

“আমার আসল নাম রত্না।”

“তোমার না আসল নাম বলার নিয়ম নাই।”

“নিয়ম না থাকলে নাই। আমি আর নিয়ম মানছি না। মানার দরকার নাই।”

“কেন?”

“কারণ আপনার সাথে কথা শেষ করে আমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাব। আর কোনোদিন আসব না–আমি আর ভলান্টিয়ার হব না। কোনও দিনও না।”

“কেন হবে না? তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”

“না। আমি ভালো ভলান্টিয়ার না। ভালো ভলান্টিয়ার কাউকে কষ্ট দেয় না। ভালো ভলান্টিয়ার নিজে কেঁদে ফেলে না।”

মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, “তুমি আসলে আমাকে কষ্ট দাওনি। এইটা আমার ভেতরেই ছিল, আমি শুধু চাপা দিয়ে রেখেছিলাম।” মানুষটা একটু থামল, তারপর বলল, “সেটা মনে হয় আরো বেশী কষ্ট।”

“আমি আপনাকে জোর করে আটকে রেখেছিলাম, জোর করে কথা বলানোর চেষ্টা করছিলাম। আর করব না। আপনি যখন ইচ্ছা কথা বলা বন্ধ করে দিবেন। যখন ইচ্ছা-”

“আসলে টেলিফোনে চার্জ নাই। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজে আছে। যে কোনো সময় লাইন কেটে যাবে। যদি লাইন কেটে যায় তাহলে রত্না তোমাকে থ্যাংক ইউ।”

“আমাকে থ্যাংক ইউ? সত্যি? নাকি আমাকে খুশী করার জন্য বলছেন?”

“সত্যি বলছি। থ্যাংক ইউ।”

“আমি আরো ভাবছি-”

মানুষটা রত্নাকে থামিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা বলতে বলতে আমার খুব অবাক একটা ফিলিংস হয়েছে। অবাক।”

“কী ফিলিংস?”

“মনে হয়েছে নীলা নাই, টুটুল নাই। এখন তাদের কী আছে জান? শুধু তাদের স্মৃতি-যখন আমি থাকব না তখন সেই স্মৃতিটাও থাকবে না। পৃথিবীতে নীলা আর টুটুলের কিছু থাকবে না।”

“তার মানে তার মানে—”

“তার মানে আমার মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে আরও কিছুদিন নীলা আর টুটুলের স্মৃতিটা রেখে দিই, কী বল?”

রত্না কিছু বলল না। বলার কিছু খুঁজে পেলো না। মানুষটা বলল, “কী হল? কিছু বলবে না?”

রত্না ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। শুনতে পেলো অন্য পাশ থেকে এক সময় টুক করে লাইনটা কেটে গেছে।

রত্না টেলিফোনটা রেখে টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটু পর রুনু দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিল, জিজ্ঞেস করল, “আসব?”

রত্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আস।”

রুনু এবং তার পিছু পিছু ইমরান আর রাজু এসে ঢুকলো। রুনু রত্নার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল, “কাদার কিছু হয় নাই। কগ্রাচুলেশনস। রত্না তুমি একজনের প্রাণ বাঁচিয়েছ।”

রত্না অবাক হয়ে তাকালো। বলল, “তুমি কেমন করে জান?”

রুনু ফিস ফিস করে বলল, “জানি। যখন কেউ একজন মানুষের প্রাণ বাঁচায় তখন সে এই ভাবে হাউমাউ করে কাঁদে।”

. ঠিক তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত