চড় খেয়ে যদি কোন ছেলে, কোন মেয়ের সামনে চুপচাপ বসে থাকতে পারে তবে নিঃসন্দেহে ছেলেটা নোবেল পাওয়ার যোগ্য। আর সেদিক বিবেচনায় এতক্ষনে আমার একটা নোবেল পাওনা হয়ে আছে। পাশে থেকে লোকজন একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। সামনের দিকে গোল হয়ে বসে থাকা মেয়ে গুলোও হেসে কুটি কুটি হচ্ছে…
ব্যাপারটা ঠিকই ছিল। টানা ১৪ দিন ১০ ঘন্টা দেখা না করা আর গত ২৪ ঘন্টায় কোনো ফোন পিক না করার শাস্তি হিসেবেই আজ সকাল ৮ টায় টি এস সি তে আসার কথা ছিল। তবে বরাবরের মত ই ঘুমের বিশ্বাসঘাতকতায় আমি পৌছুলাম সাড়ে দশটায়। সিরিয়াস কিছু একটা বলছিলো, আর আমি অনলাইনে জোকস পড়ে হাসছিলাম। চড়টা হয়তো সেজন্যই।
হ্যান্ডিক্যাপড হয়ে বসে আছি। চশমার ডাট টা ভেঙে গেছে। তাই থাপ্পড়ের জোরটা বুঝে নিতে খুব কষ্ট হয় না। আমি হলাম হুমায়ূন আহমেদের “শুভ্র” টাইপের ছেলে। চশমাই একমাত্র অবলম্বন। তাই এই ট্রাফিক ঠেলে বাসায় যাওয়ার ও সাহস পাচ্ছি না। কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকাল। জানি ঝড়ের পূর্বাভাস এটা। চোখ থেকে ভাঙা চশমাটা খুলে সামনে রাখলাম,
-নির্লজ্জের মতো বসে আছো কেন? বাসভাড়া নেই? বাসায় যাও।সবকিছু শেষ।
-সবকিছু মানে? এই সামান্য কারনে??
-তুই উঠবি? নাকি রাহাতকে দিয়ে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে উঠাবো?
মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেলো। রাহাতের ব্যাপারটা অনেক আগেই সন্দেহ করেছিলাম। প্রমানটা আজই পেয়ে গেলাম। ভাঙা চশমাটা ফেলেই আস্তে আস্তে হাটা শুরু করলাম। রাস্তায় নামতেই রিকশার সাথে ধাক্কা খেলাম। চশমা ছাড়া কোনোদিন থাকিনি, হয়তো এজন্যই। মুনার দিকে তাকালাম। আবছা ভাবে চোখে ভাসছে। অন্যদিন হলে এতক্ষনে তুলকালাম বাধিয়ে দিত। আজ শান্ত হয়ে বসে আছে। সবকিছু শেষ হয়তো তাই।
তিক্ত সত্যটা হল, বাসভাড়া আমার কাছে আসলেই নেই। প্যান্টের পেছনের পকেটটা সুন্দর করে কাটা। কাজের প্রশংসা না করে পারছিনা। আবার দুঃখ না করেও পারছিনা। কারন ৫ টাকার একটা কয়েন বাদে কিছুই পাবেনা। টিউশনির সব টাকা টেবিলের কোনায় ডিকশনারির নিচে রাখা। লাজ লজ্জা ভুলে মুনাকে ফোন দিলাম। কলার টিউনটা পাল্টায় নি। টাকা চাইলাম। পাচ সেকেন্ড ঝাড়া নিরবতার পর কথা বলতে লাগল,
-বাবা, মা ফকির? নাকি তুই নিজে?
-তুই করে কেনো বলছো?
-তাহলে কি আপনি করে বলবো?
-লাগবেনা টাকা, রাখি।
সজলকে ফোন দিলাম। বিপদের সময় কিছু বন্ধু ভাল খেল দেখায়। দশ মিনিটের মাথায় বাইক নিয়ে হাজির হয়ে গেল। পচিশ মিনিটের মাথায় বাসায় পৌছে গেলাম। গত চব্বিশ ঘন্টায় ঘুম সর্বসাকুল্য ৩ ঘন্টা। তাই দেনা পাওনার হিসাবটা মিটিয়ে নিতে আরাম করেই পাশ ফিরলাম। মুনার হিসার আগেই বাদ। আমার মত আফ্রিকান নিগ্রোর সাথে যে এতদিন ছিলো, এটাই অষ্টম আশ্চর্য। দেওয়ার বা দেখানোর মত আমার কিছুই ছিল না। টিংটিঙে স্বাস্থ্য , আর একজোড়া নষ্ট চোখ। সেই তুলনায় রাহাত শতগুনে উপযুক্ত। রবীন্দ্রনাথের গান আমার জন্য রীতিমত সিডাটিভের কাজ করে, তাই ঘুমটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী ই ছিল। টানা ৬ ঘন্টার ঘুম। মোবাইলটা ডেড হয়ে আছে। চার্জে লাগিয়ে অন করলাম। চশমার কাগজ পত্র আর ফ্রেমের ছবি দিয়ে ছোটটাকে পাঠিয়ে দিলাম। খুশিমনেই গেল। খরচ পড়বে সাতশ টাকা। বাকী তিনশ ওর লাভ। একটু পর আম্মু আসল মোবাইল নিয়ে, কতবার নতুন ফোন দিতে চেয়েছি,তবু সেই নকিয়া ১২০০ ই আকরে ধরে আছে
-এই দেখতো, নাম্বারটা কার
-বা বাহ, ২০ টা মিসকল!! কই ছিলা
-তোর ছোটজন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো, টের পাইনি
-তাই নাকি। ইবলিশটার গার্লফ্রেন্ড মনে হয়। দাড়াও ফোন দিয়ে দেখি ফোন দিতে হলনা। একুশতম কলের উত্তর করলাম। নাহ, মেয়ে না, সজলের কন্ঠস্বর।
-ওই ছাগল, তুই কই? তোর ফোন কই?
-বাসাতে, কেন কি হয়েছে
-মুনাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, ওর বাবা তো পুরো ঢাকা তল্লাশি চালাচ্ছে বুকটা ধ্বক করে উঠলো, মুনার বাবা ডি এস পি। এতক্ষনে নিশ্চয়ই আমার নামে ওয়ারেন্ট বের করে ফেলেছে
-হ্যালো, তুই জানিস? মুনা কই?
-সজল তোর বাইক নিয়ে বাসায় আয়।এক্ষুনি।
-তেল নাই।একটুও
-একহাজার টাকার তেল ভরে দিবো আয়।
-আসছি। পাচ মিনিট।
চিরুনি অভিযান শুরু করেছি। বুদ্ধি করে বাস স্টপেজে গিয়ে বেঞ্চে শুয়ে থাকা এক টোকাই কে মুনার ছবি দেখালাম। তার পরের স্টপেজেও একই কাজ করলাম। আমার ধারনাই ঠিক, মুনা এসেছিল। প্রতিটা স্টপেজেই। কিন্তু এখন ওকেই খুজে পাচ্ছিনা। সজলের বাইককে ক্রস করেই একটা পুলিশের গাড়ি ঝড়ের বেগে টি এস সির দিকে ছুটল। নিশ্চয়ই মুনার বাবা। সজলকেও টি এস সির দিকে যেতে বললাম। মুনার বাবার আগেই পৌছুতে হবে। নাহ, টিএসসিতে মুনা নেই। কোনো বান্ধবীর বাসাতেও উঠে নি। কি মনে হত সজলকে বললাম।মোহাম্মদপ
ুরের দিকে যেতে। কটমট করে তাকিয়ে বাইক ঘোরাল, ধারনা অমুলক নয়। ওভারব্রীজের রেলিংয়ের ওপারে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা আকৃতিটা যে মুনার ই, সেটা বলতে জ্যোতিষী হতে হয় না। ওর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সেই ভাবলেশহীন মুখ। নিরবতা ভাঙল নিজেই,
-এতক্ষনে?
-পুরো পুলিশ বাহিনী তো আমার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছো
-ওরা আমাকে খুজছে, তোমাকে না।
-চৌদ্দ শিকের ভেতরে আঠারো ঘা তো তোমার বাবা তো আমার পিঠেই ছুলবে..
-ছুললে তুমি এখানে থাকতে না।
কথাটা আংশিক সত্যি। তাই চুপ করে রইলাম। হঠাত ঘুরে দাড়ালো। বিড়ালের মতো চোখজোড়া জ্বলছে। সুনামির প্রথম আঘাতটা সহ্যর জন্য প্রস্তুত হলাম
-কই ছিলা??
-বাসায়।
-কে নিয়ে গেছে? অনন্যা??
-অনন্যা কেন নিবে? ওতো আমার স্টুডেন্ট, সজল নিয়ে গেছে। ওইতো, নিচেই আছে। উকি দিয়ে সজলকে দেখে নিলো। তারপর ২য় পর্যায় শুরু করলো,
-সজলের সঙ্গে কেন গেছো?
-তা কি করবো? ফোনে যেমনে শুনাইলা। আর কি কিছু করার ছিলো??
৩য় পর্যায় শুরু হওয়ার আগেই সজলকে বিদেয় করে দিলো, আমি বোকার মত চেয়ে দেখলাম। ফোন হাতে নিয়ে সোজা নিজের পুলিশ বাবাকে ফোন দিয়ে বসল
-বাবা, মোহাম্মদপুরের ওভারব্রীজের নিচে লোকমান চাচাকে দিয়ে গাড়ী পাঠাও। সঙ্গে যেন কেউ না থাকে।
-মুনা, তুই..
-বাবা, আমার কিছুই হয়নি। সামান্য কিছু সময়ের জন্য কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। গাড়ীটা পাঠালে ভাল হয়।
আধঘন্টা পর কালো টয়োটা এসে ওভারব্রীজের নিচে দাড়াল। লোকমান চাচাকে আগেই চিনতাম। মুনার নির্দেশে লোকমান চাচা ড্রাইভিং সীট ছেড়ে দিলো..
-চাচা..
-কি মা? বলো?
-এখানে পাঁচশ টাকা আছে, প্লীজ একটু কষ্ট করে বাসায় চলে যান। আমি ড্রাইভ করবো
-কিন্তু মা তুমি তো..
-চাচা, প্লীজ যান। কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হবে না লোকমান চাচা চলে গেলো। আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি। গাড়িতে উঠতে ভরসা পাচ্ছি না। মুনার ড্রাইভিং সস্পর্কে একটু হলেও ধারনা আছে..
-সামনের সীটে এসে বস
-তুমি গাড়ি চালাবে?
-হুম, কোনো সমস্যা??
-নাহ।
-তোমাকে প্রতিটা বাসস্টপে খুজেছি। পাগলের মতো ফোনে ট্রাই করেছি।
-ব্যাটারি ডেড ছিলো।
-তুমি চলে গেলা কেনো?
-তুমিই তো বললে সব শেষ। ভাবলাম রাহাতের সাথে হয়তো স্টার্ট করবে নতুন করে, তাই আর বাধা দেইনি।
মুহুর্তে হার্ডব্রেক করে গাড়ী থামাল। সীটবেল্ট না থাকায় মাথাটা ঠুকে গেল। এবারো ভাবলেশহীন দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করলো
-রাহাতের সাথে শুরু করলে রাত আটটায় মোহাম্মদপুরের এই ওভারব্রীজে আমি থাকতাম?
-নাহ। পার্সটা খুলে একটা প্লাস্টিকের বাক্স বের করলো, আমার চশমা, নতুন ফ্রেম লাগানো
-চশমাটা পড়ো
গাড়ী আবার চলতে শুরু করেছে, আমার বাসার দিকেই চলছে। রাস্তার হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখছি, মেয়েটা কাদছে। অঝোরে কাদছে থাক খানিকটা কাদুক। আমিই জানালার দিকে মুখ ফিরে দুফোটা পানি সাবধানে মুছে ফেললাম। আমার লৌহমানবী কাদছে, সেখানে আমি কি করে নিজেকে সামলাই…