ঘুম

ঘুম

পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এসে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। আর এদিকে আমি দরজা বন্ধ করে সাজুগুজু করতে গিয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছি। দরজায় বাড়িশুদ্ধ লোকের চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো।ঘুমের ঘোরেই ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলে দেখি সবার সাথে আমার হবু বরও ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবি আমাকে একপাশে ঠেলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি করছিলি তুই? ছেলে পছন্দ হয় নি আমাকে বললেই পারতিস। তাই বলে সুইসাইডের চেষ্টা?

চোখ ডলতে ডলতে ভাবিকে বললাম, কে বলেছে ছেলে পছন্দ হয়নি? ছেলের জন্যই তো ঘরে সাজতে এসেছিলাম। তবে দরজা বন্ধ করেছিস কেন? একটা লম্বা হাই তুলে ভাবিকে উত্তর দিলাম,আমার আসলে প্রচুর ঘুম পাচ্ছিলো। পাত্রের সামনে তো আরেকদিনও যাওয়া যাবে। কিন্তু এমন ঘুম কি রোজ রোজ পাওয়া যায়? বিয়ের চেয়ে ঘুম ইম্পর্টেন্ট। সবাই আমার দিকে ভ্যাবলার মত হা করে তাকিয়ে আছে। পাত্রকে এই ফাঁকে আমার বড় খালা বুঝিয়ে শুনিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেছে। কোনোরকম সাজুগুজু করে ভাবি আমাকে ছেলের সামনে নিয়ে গিয়ে একেবারে পাশে বসিয়ে দিলেন। পাত্রের বড় মামা আমার দিকে কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি নাম যেন মা তোমার? ধুমের ঘোরেই টেনে টেনে উত্তর দিলাম,

-সু ..হা..সি..নী..
-অনার্স পড়ছো তো,তাই না? তা এবার কোন ইয়ার?
-আংকেল যা প্রশ্ন করবেন ,খুব শর্টে করুন।

আমার চেয়ে আমার ভাবি আমার সম্পর্কে ভাল উত্তর দিতে পারবেন। প্রশ্নগুলো ওকেই জিজ্ঞেস করুন। আমার খুব ঘু..ম.. পা..চ্ছে.. কথা বলতে বলতে ছেলের কাঁধেই ঢলে পড়লাম। এরপরের ঘটনা মনে নেই। পরদিন সকালবেলা ভাবি ঘরে এসে বলে গেলেন, ছেলে তোকে পছন্দ করেছে। কাল অমন রেমান্টিক একশন না নিলেও পারতিস।

-ভাবি, আমার আসলে প্রচুর ঘুম পাচ্ছিলো। তাই ঘুমিয়ে গেছিলাম।
-কি..!!
-হ্যাঁ। এখন তুমি যাও। আমি আরেকটু ঘুমাবো।

ভাবি চোখ উল্টিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।বিয়ের জন্য আমার তর সইলেও বাবার তর সইলো না। বাবা চিন্তায় আছেন কোনোভাবে তার ঘুম কাতুরে মেয়ের বিয়েটা হয়ে গেলেই হয়। এর আগে চারটা বিয়ে ভেঙে গেছে আমার ঘুমের কারণে। প্রতিবারই সাজতে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে এত লম্বা ঘুম দিয়েছি যে পাত্রপক্ষ অধৈর্য্য হয়ে ফিরে গেছে। এইবারের সুযোগ বাবা কোনোমতেই মিস করতে চান না।তোড়জোড় করে বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন। বিয়ের আসরে কাজী কিসব বিড়বিড় করে বলেই চলেছে। ঘুমের ঘোরে ততটা বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু সবার ধাক্কাধাক্কিতে বুঝলাম আমাকে কবুল বলতে হবে।

ক….বু..ল
ক….বু..ল
ক….বু..ল….

তারপর ধপাস করে একটা আওয়াজ কানে এলো। মনে হয় আমার ঘুমে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ ওইটা। যখন ঘুম ভাঙলো নিজেকে আবিষ্কার করলাম ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে। হয়ত আমার বাসর ঘর। আবছা আবছা চোখে দেখলাম সুন্দর মত পান্জাবী পরা একটা ছেলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে। তাতে আমার কি? আলাপ পরেও করা যাবে। এখন আরেকটু ঘুমের দরকার। একটা লম্বা হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

-ওগো ওগো শুনছো চোখ মেলে দেখি আমার বর আমাকে ডাকছে। বাসর রাতে বরের সাথে অন্তত দুটো কথা বলা আমার দ্বায়িত্ব। ভীষণ কষ্টে ঘুমটাকে আটকে বরের পাশে উঠে বসলাম। উনি আমার হাতটা আলতো করে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

-তুমি বিয়ে নিয়ে অনেক ভয়ে ছিলে তাই না? ভয়ে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে।
-আপনাকে এইটা কে বলেছে?
-কেন? তোমার ভাবি..
-ভাবি মিথ্যে বলেছে। আমি আসলে প্রচন্ড ঘুমের ঘোরে ছিলাম।
-আচ্ছা যাই হোক। আমি তোমার বর। আজ থেকে তোমার সব দ্বায়িত্ব আমার । যা কিছু তোমার দরকার,আমাকে বলবে।

-আমাকে শুধু শান্তি করে ঘুমুতে দেবেন প্লিজ।আমার সারাজীবন শুধু এইটুকুই দাবী।
-কি! এ আবার কেমন চাওয়া?
-হুম,এটাই চাওয়া। দিলে দিবেন, না দিলে ঘর থেকে বের হোন।আমি ঘুমাবো।
-প্লিজ লক্ষী বউ আমার। আজ আমাদের বাসর রাত। আজকের দিনে এমনটা করে না।

এই বলে ও আমায় কোলের মধ্যে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আমি ততক্ষণে ঘুমের ঘোরে বিছানায় চিৎপটাং করে পড়ে গেলাম। সে রাতে স্বামী আমার নাকি সারারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকেছে। প্রথম প্রথম আমার ঘুমের জন্য কেউ কিছু না বললেও আস্তে আস্তে কাজের চাপ বেড়ে গেলো। সাথে ঘুমেরও ব্যাঘাত শুরু হলো।

উহু! এভাবে পারা যাবে না। বাপের বাড়ি থেকে ফিরনি করে আমি যাওয়ার পর শশুরবাড়ি সবার ঘুমের পরিমান বেড়ে গেলো।এর সমস্ত ক্রেডিট আমার দাদি শাশুড়ির। উনার প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে পাশের ফার্মেসী থেকে ঘুমের ওষুধ এনে সবাইকে এক আধ ডোজ করে এক সপ্তাহ খাওয়ানোর পর আর ওষুধের প্রয়োজন পড়েনি। সবাই এমনিতেই ঘুমে ঢলে পড়ে। আমাদের পরিবারের নাম হয়ে গেলো “স্নিপিং ফ্যামিলি”। আস্তে আস্তে এই খবর দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমেরিকাতেও শুনলাম পৌঁছে গেছে। একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎকারে এসেছিলেন। জোরে জোরে কিছু একটা শব্দ হচ্ছিলো। আমার ননদ ঘুমের ঘোরেই বললো, আকাশে এত বাজ পড়ে কেন রে? আমার স্বামী পাশ ফিরে শুয়ে উত্তর দিলো,

-মেঘ করেছে কিনা কেউ আখিঁ মেলে দেখো রে একটা লম্বা হাই তুলে কাঁথাটা মুড়ি দিয়ে বললাম,
-কে বা আঁখি মেলে রে!!

শুনেছি সেদিন নাকি সরকারী লোকেরা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে ফিরে গেছে। এরপর আরেকদিন গিনেস বুকের কর্মচারীরা এলো। হাজার হোক বিদেশী,তার উপর আমাদের নাম নাকি গিনেস বুকে লিখা হবে। কোনোরকমে চোখ ডলতে ডলতে দুজন সাদা চামড়া লোকের সামনে গেলাম। একজন খ্যাকখুক করে কি জানি প্রশ্ন করলো।কান দুটো যথাসম্ভব প্রসারিত করে শুনে দু-একটা ওয়ার্ডের বাংলা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমের কারণে জীবনেও পরীক্ষায় পাশ তো দূরে থাক পড়াশোনাটাই তেমন করতে পারিনি। চেয়ারে কাঁত হয়ে শুয়ে বললাম,

-যা বলার বাংলায় বলেন। তোঁতল্যামি ভাষা ব্যবহার করে কেমনে যে গিনেসের মত প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন..!
তারপর একজন বাংলাদেশী এসে জিজ্ঞেন করলো,

-আপনাদের এত ঘুমের রহস্য কি?
-রহস্য আমি।
-রহস্যের উৎস কি? দুইটা লম্বা হাই তুলে বালিশে মাথা রেখে উত্তর দিলাম,
-রহস্যের উৎস ঘুম।
-ঘুমের উৎস কি?
-ঘুমের উৎস ঘুম।
-সেই ঘুমের উৎস কি?
-সেই ঘুমের উৎসও ঘুম।

এরপর আর কি কি প্রশ্ন করেছিলো শুনতে পাইনি।যখন ঘুম ভাঙলো কোনোরকম চোখ মেলে দেখি কাজের বুয়ার স্কুল পড়ুয়া বড় ছেলে পত্রিকা হাতে কয়েকটা মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলাম বুয়া গত আট দিন আগে কাজ করতে এসে বাড়ি ফেরত যায়নি।বাসাতেই ঘুমিয়ে আছে। পত্রিকায় ছাপিয়েছে আমাদের নাম নাকি গিনেস বুকে লিখে হয়েছে। কাজের বুয়ার ছেলেকে এক নজর দেখে চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম, “দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, ওরে সাকুর ছেলে,আমার ঘরে এত লোক কেন রে??”

বুয়ার ছেলে উত্তর দিলো, আপনাদেরকে জেলে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই শাস্তিস্বরূপ আপনাদের জেলে পাঠানো হয়েছে। এই দেখুন প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী সহ সবাইকে আমরা পরিবারের লোকজন এক ধাক্কা দিয়ে আমাদের সারিতে ফেলে দিলাম। এখন জেলখানার সবাই ঘুমায়। কারণ,ঘুমের সুখ ঘুমন্ত মানুষগুলোই বুঝে। ” ঘুম শান্তি, ঘুমই প্রশান্তি। ঘুমের জন্য হোক এওয়ার্ড কিংবা জেল, তবুও অনলি ঘুম ইজ রিয়েল।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত