বাঘের উপদেশ

বাঘের উপদেশ

এক বাঘ ছিল। জঙ্গলের বাদশাহ ছিল সে। বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসলো তখন সে তার একমাত্র বাচ্চাটিকে বললো, “দেখো বাবা মিলে মিশে থেকো, সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিও, সবার কাছে যেও কিন্তু এই মানুষ জাতের কাছে যেও না। এই বস্তটা বড় অত্যাচারী এবং জালেম। যদি কোন সময় তার কাছে যাও তবে তোমার মস্ত বড় ভুল হবে। বিপদে পড়ে যাবা।”

এই উপদেশ প্রদানের পর জঙ্গলের সে বাদশাহ ইন্তেকাল করলেন। তার মৃত্যুর পর তার বাচ্চা তার স্থলাভিষিক্ত হলো। জঙ্গলের বাদশাহ হলো এখন সে। বাঘের বাচ্চার অভিজ্ঞতা ছিল না। সে ভাবলো, “আমার আব্বু বলেছিল, ‘মানুষের কাছে যেও না, এই জিনিষটা বড়ই জালেম।’ সুতরাং দেখা দরকার মানুষ জিনিষটা কী রকম। আমার আব্বু জঙ্গলের বাদশাহ হওয়া সত্ত্বেও এই জিনিষটাকে ভয় পেতেন। তার এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই বস্তুটিকে ভয় পাওয়ার কারণ কী? মনে হয় মানুষের শক্তি খুব বেশী। বাঘ তো দুই গজ লম্বা হয়ে থাকে। আর মানুষ মনে হয় দশ গজ, বিশ গজ লম্বা হবে! আসলে জিনিষটা কেমন একটু দেখা দরকার।”কিন্তু তার আশে পাশের যে সকল জীব-জন্তু বাস করতো তারা বললো, “দেখো ভাই বড়দের উপদেশ মানতে হয়। বাপ বলেছিল মানুষের কাছে যেও না এইটা বড় জালেম জিনিষ। সুতরাং তুমি মানুষ দেখার ইচ্ছা করিও না। কোনো না কোনো বিপদে পড়ে যেতে পারো।”

-সে বলল, ‘তা হবে কেন ভাই! কমপক্ষে একবার দেখে নেওয়া দরকার এই যাতটা কেমন! ‘

বাপের উপদেশে মানল না। মানুষ দেখতে সে বাহির হয়ে পড়লো। প্রথমেই একটি ঘোড়া দেখতে পেলো। ঘোড়াটি লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিল। বাঘের বাচ্চা ভাবলো, মনে হয় এইটাই মানুষ। কারণ আমার বাপ ছিল দেড় গজ লম্বা আর এইটা তারচেয়েও অনেক লম্বা আর উঁচা। দুই-তিন গুণ বড় বলেই আমার বাপ এইটাকে ভয় পেতো। ভয় পাওয়ার কথাই তো বটে! সে ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার কাছে গিয়ে বললো, “জনাব, আপনার নামই কি মানুষ?”

-ঘোড়া বললো, “এই কোন জালেম বস্তুর নাম নিয়েছো? আমার সামনে আর কখনো মানুষের নাম নিও না। মানুষ যাকে বলা হয় সে অত্যন্ত অত্যাচারী জীব। আমি অনেক মোটাতাজা এবং শক্তিশালী, কিন্তু তবুও মানুষ আমার পীঠে গদি কষে দেয়, আবার তার উপর উঠে বসে। তার হাতে চাবুক থাকে। আমার পীঠে চাবুকের বাড়ি পড়ে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে হয়রান হয়ে যাই তবুও মানুষ এত জালেম যে তখনও ক্ষান্ত হয় না, চাবুক মারতেই থাকে। তাই সব জিনিষের নাম নিও কিন্তু এই জালেম মানুষের নামটি নিও না। এটা একটা মহা মছিবত।”

বাঘের বাচ্চাটি ভাবলো, হায় আল্লাহ! মানুষ তাহলে কত বড় হবে! এই লম্বা-চওড়া জন্তুটিও মানুষকে ভয় পায়! আর বাপ তো ভয় পেতে পেতে মারা গেলেন। কী রকম এই ভয়ঙ্কর মানুষটি? সে আরো এগিয়ে গেল। হঠাৎ একটি উঁট চোখে পড়লো। সে ভাবলো, এইটাই হবে মানুষ। একটি অঙ্গও এর সোজা নয়। ঘাড় একদিকে, কোমর অন্যদিকে, পা গুলি আরেক দিকে বাহির হয়ে কিম্ভূতকিমাকার আকৃতির এই জন্তুটিই মানুষ হবে, এটা ঘোড়ার চেয়েও চার হাত উঁচা।

-সে কাছে গিয়ে উঁটকে বললো, “মানুষ কি আপনারই নাম?”
-উঁট বললো, আরে লা-হাওলা ওয়ালা-কুউওয়াতা!

এই রকম জালেম চীজের নাম নিয়েছো তুমি? এর মতো জালেম আর হয় না। এই নাম আমার সামনে উচ্চারণ করিও না। আমি শুধু একা নই, আমার শত শত ভাই আজ এর হাতে বন্দী। আমার নাকের ডগার ছিদ্রের মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে তারপর সেই দড়ি আমার সামনের ভাইয়ের লেজে বেঁধে দিয়ে শত শত জনকে সারি বেঁধে মানুষের একটি মাত্র ছোট্ট বাচ্চা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কত কাঁদি,কত বিলাপ করি, কত চিৎকার দেই; কিন্তু মানুষের ছোট একটি বাচ্চা আমাদেরকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মানুষের কথার উপরে শত শত উঁটের একটি কোথাও চলে না। এটা বড় জালেম চীজ। এই নাম আমার সামনে আর নিও না।

বাঘের বাচ্চাটি বললো, “হায় আল্লাহ! মানুষ কত বিরাট হতে পারে? এত বড় এই জন্তুটি সে-ও মানুষকে ভয় পায়। ঘোড়া তো শুধু নিজের মছিবতের কথা বলেছে আর এটা দেখি তার সকল ভ্রাতৃত্ব সমাজের মছিবতের কথা বয়ান করলো। এক’শ উঁট এক সঙ্গে মানুষের একটি মাত্র বাচ্চার কাছে বাধ্য হয়ে যায়!”

ভয়ে ভয়ে সামনে অগ্রসর হলো হঠাৎ একটি হাতী দেখতে পেলো। সে ভাবলো, এইটাই মানুষ। কারণ চারটা মোটা মোটা খাম্বার উপর একটা বিল্ডিং এর মত দাঁড়িয়ে আছে, ছাদের উপরে যেন একটি পানির ট্যাংক রেখে দিয়েছে; সুতরাং মানুষ এইটাই। ভয়ে ভয়ে সে হাতের কাছে গিয়ে বললো, “জনাব, আপনার নামে কি তবে মানুষ? মানুষ আপনাকে বলা হয়?”

-হাতী বললো, “তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ! এই কোন মছিবতের নাম নিয়েছো? আমার সামনে এই নাম উচ্চারণ করিও না। এই জিনিষটা বড় জালেম। আমার দেহ বিরাট হতে পারে, দেখতে মনে হয় একটি বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। তা সত্ত্বেও একটি মাত্র বাচ্চা মানুষ আমার পীঠে চড়ে বসে। তারপর তার হাতে লোহার হান্টার থাকে, একটু যদি এদিক-ওদিক করি, সেই লোহার হান্টার আমার মাথায় মেরে দেয়। আমি শুধু কাঁদতে পারি, বিলাপ করতে পারি, আর কিছু করতে পারি না। ঘোড়ার মুখে তবু লাগাম লাগিযয়ে সওয়ার হয়। আর আমাকে বিনা লাগামেই কাবু করে ফেলে। লাগামও নাই আবার নাকে দড়িও নাই তবু আমি মানুষের কাছে বাধ্য হয়ে পড়ি। এই মানুষ একটা আজীব চীজ!”

-বাঘ বললো, “হায় আল্লাহ! মানুষ তাহলে কোন জিনিসকে বলবো? যাকেই দেখি সেই মানুষকে ভয় পায়, মানুষের নাম শুনলে কেঁপে ওঠে আর বলে, মানুষ বড় জালেম জিনিষ। আমি এখন কোথায় যাবো? কোথায় মানুষ পাবো”?

এই বলে সে আরো আগে অগ্রসর হলো।দশ-বারো বছর বয়সের এক মিস্ত্রির ছেলে একটা মোটা কাঠ চিরার কাজে ব্যস্ত ছিল। কাঠের খণ্ডটি উঁচুতে একটা মাচায় রাখা ছিল। করাত চালাতে সুবিধার জন্য দুই পাশের কাঠ যেন ফাঁকা হয়ে থাকে সেজন্য আধা-চিরা কাঠের মাঝখানে একটা কাঠি দিয়ে গোঁজ দিয়ে রেখেছিল। বাঘের বাচ্চা ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে তার সামনে কাঠের খন্ডের উপর বসলো। সে কল্পনাও করতে পারেনি যে এই ছেলেটি মানুষ। কারণ সে ঘোড়া দেখেছে, উঁট দেখেছে এবং হাতী দেখেছে। সবাই মানুষকে ভয় পেয়েছে। এত বড় বড় জন্তু এই ছোট ছেলেটিকে দেখে ভয় পাওয়ার কথা নয়। সুতরাং এটা মানুষ বলে কল্পনাও হলো না তার। শুধু অনুসন্ধানের জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “ভাই মানুষ কোথায়পাওয়া যায়?”

-মিস্ত্রির ছেলে বললো, “আমাকেই মানুষ বলা হয়।”
-বাঘের বাচ্চা বললো, “লা-হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা!গজ খানিক লম্বা একটা ছেলে বলছে আমিই মানুষ!

আমার বাপ কি তবে বোকা ছিল যে তোকে ভয় পাবে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? এক থাপ্পর মেরে তোর কাম সারা করে দিব এখনই!” ছেলেটি ভাবলো, হাজার হলেও এটা বাঘ। এর সঙ্গে শক্তিতে পারা যাবে না। তর্ক করেও লাভ হবে না। বুদ্ধির জোর না হলে শক্তি দিয়ে এর কাছ থেকে প্রাণে বাঁচা যাবে না। সে দেখলো, যে-কাঠের খণ্ডটি সে চিরার সময় একটা গোঁজ ঠুঁকে দিয়েছিল বাঘের লেজটি তার ফাঁকে ঢুকে গিয়ে নীচের দিকে ঝুলে আছে।

-সে বললো, “বাঘ মশাই, আপনি সব-কিছুই করতে পারেন। আপনি জঙ্গলের বাদশাহ। আপনার শক্তি আছে, আমার শক্তি নাই। তাই এই গোঁজটি আমি খুলতে পারছি না। যদি আপনার শক্তি দিয়ে এই গোঁজটি খুলে দেন তবে আমার বড় উপকার হয়।”

-বাঘ বললো, “এটা আবার একটা কাজ নাকি?”

এই বলে সে এক থাবা মেরে সেই গোঁজটি খুলে ফেললো। আর অমনি দুই দিকের চিরা কাঠ চেপে এসে বাঘের লেজ আটকিয়ে ফেললো। বাঘের বাচ্চা চিঁ চিঁ করতে লাগলো। লেজা আর ছাড়াতে পারলো না। এদিকে ছেলেটি চিৎকার করে “বাঘ ধরেছি, বাঘ ধরেছি” বলে গাঁয়ের লোক ডাকতে লাগলো।

মুহূর্তের মধ্যে সারা গাঁয়ের লোক জমা হয়ে বাঘের বাচ্চাকে বন্দী করলো লোহার খাঁচায়। মানুষ চেনার আগেই সে মানুষের একটি বাচ্চার হাতে এখন বন্দী। সে এখন মানুষ চিনেছে। কিন্তু এখন আর চিনে কি লাভ? আজ তার রক্ষা নাই।কেউ বল্লম আনলো, কেউ বন্দুক, কেউ দা-বটি, মোটকথা যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে এসে বাঘের খাচাঁ ঘেরাও করলো। আজ সবাই মিলে তাকে হত্যা করবে। আজ তাদের উৎসব। বুঝতে পারলো বাপের উপদেশ না মানার কারণে আজ আমার এই দুঃখ, লাঞ্ছনা আর এই মৃত্যু।

সুতরাং বাঘের শক্তি পরাজিত হলো। এলেমই বড় শক্তি। এলেম এর কাছে সকল শক্তি-ই নিঃশেষ হয়ে যায়। এলেন সব কিছুকেই জয় করতে পারে। হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যাদের এলেম আছে তাদেরকে ছাড়া সকলেই ধ্বংসশীল”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত