মায়া

মায়া

চার পাঁচ মিনিট পর একজন আন্টি এসে দরজা খুলে বললেন,

— কাকে চাই?
— আস্সালামু আলাইকুম। জ্বি এটা কি মায়াদের বাসা?
— হ্যাঁ, আমি ওর আম্মু আর এটা মায়াদেরই বাসা। কিন্তু তোমাকে তো চিনলাম না!
— আমাকে আপনি চিনবেন না। আচ্ছা আন্টি মায়া কি বাসায় আছে?
— হ্যাঁ আছে।
— একটু ডেকে দিবেন প্লিজ?
— তুমি ভেতরে এসে বসো আমি ডেকে দিচ্ছি।
— সমস্যা নেই আন্টি আমি এখানেই আছি৷ আপনি একটু ওকে ডেকে দেন।
— আমিতো তোমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না তো ওকে গিয়ে কি বলবো?
— ওকে শুধু বলবেন পাবনা থেকে একটা ছেলে তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। এটা বললেই ও আমাকে চিনবে।
— আচ্ছা বাবা তুমি একটু দাঁড়াও আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
— আচ্ছা ঠিক আছে।

অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে মায়াদের বাসা খুঁজে পেতে। তবে হাল ছাড়ি নি৷ গত চারদিন ধরে খুঁজে অবশেষে সফল হলাম৷ খুব বেশি কিছু জানতাম না৷ শুধু জানতাম ওদের বাসা কক্সবাজার আর ও ওখানকারই একটা সরকারি কলেজে পড়ে। তবে সেই কথাটাও প্রায় ছয় বছর আগের বলা। আর এই ছয় বছর আগের কোনো শিক্ষার্থীর ডাটা বের করা আসলেই সহজ না৷ তবুও! বর্তমানে অসম্ভব খুব কম জিনিস! তাই শেষমেশ পেয়েই গেলাম বাসা।

— বাবা, মায়াকে বললাম যে পাবনা থেকে একটা ছেলে তোর সাথে দেখা করতে এসেছে তবে ও তো চিনলো না৷
— ওহ্। তাও যদি একটু আসতে বলতেন!
— আচ্ছা দাঁড়াও আবার বলে আসি। বলেই মায়ার আম্মু আবার চলে গেলেন। তারপর মিনিট খানেক পর এসে বললেন,
— না বাবা৷ ও তোমাকে চিনলো না৷ উল্টো বললো,

“কোথা থেকে কে না কে এসে আমাকে চাইবে আর তুমি তার সাথেই দেখা করার জন্য আমাকে পাঠাবে”? আর বাবা ওরা কোথায় যেন যাবে তাই ও রেডি হচ্ছে। জামাই বাবা অবশ্য বললো, হয়তো তোমার পরিচিত কেউ যাও দেখা করে এসো তবুও এলো না৷

— ওহ্। হিহিহি। সমস্যা নেই আন্টি। আচ্ছা আন্টি মিহুর কতদিন হলো বিয়ে হয়েছে?
— মিহু কে?
— মায়াকে আমি মিহু বলে ডাকতাম।
— ওহ। ওর বিয়ে এইতো প্রায় দু’তিন মাস হলো হয়েছে।
— ওহ্।
— তা বাবা তুমি একটু ভেতরে এসে বসো?

— না আন্টি। এখানে এসেছিলাম শুধু ওর সাথে দেখা করতে। ভেবেছিলাম হয়তো চিনবে। যেহেতু চিনলোই না তাই আর খামোখা বিরক্ত না করি। অবশ্য না চেনারই কথা। ছয় বছরে অনেক স্মৃতিই ধূসর হয়ে গেছে! সেখানে আমি কে? এই বাক্যটা ধূসর হওয়া খুব কঠিন কিছু না! হিহিহি।
— আচ্ছা বাবা তোমার নাম টা তো বলে যাও।
— আসফু! হিহিহি!

এরপর! চলে এলাম ওদের বাসা থেকে। খুব কনফিডেন্স ছিল আমার। আর যাই হউক মিহু আমাকে চিনবে৷ ছয় বছর কেন ছয় যুগ পর গেলেও চিনবে। হয়তো আমার কনফিডেন্স লেভেল একটু বেশিই ছিলো তাই বরাবরের মতোই আমি ব্যর্থ হলাম! ওদের বাসা থেকে বের হয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর ওর দেখা পেলাম। মিহুর দেখা! আগে অনেক শুকনো ছিল মেয়েটা। তবুও ওই শুকনো মুখটাই কেন জানি খুব বেশিই ভালো লাগতো আমার। শুকনো মুখের সাথে চিকন ঠোঁটের ওর মলিন হাসিটাও খুব ভালো লাগতো৷ আর সবচে বেশি ভালো লাগতো ওর চোখ৷ খুব বড় বড় চোখ ছিল আমার মিহুটার। কতশত রাত ওই চোখ দেখে কাটিয়ে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। যদিও এক সময় ও চোখ দুটো দেখার অধিকার টুকু ও কেড়ে নিয়েছিল। না করিনি। কারণ মনের মাঝে শক্তপোক্ত ভাবেই ওর মুখটার স্কেচ আঁকা ছিলো। সেই ছবি ছয় বছর কেন ছয়শো বছরেও হয়তো ধূসর হবে না!

তবুও মেয়েটা আমার চোখজোড়া ধূসর করে দিয়ে চলে গেল গাড়িতে করে। কাছ থেকে আর দেখা হলো না! ধূসর হয়ে আসা চোখটা মুছে নিলাম। হিহিহি! ওর হাসিটা আর আগের মতো শুকনো নেই। ঝর্ণার মতো মুখোরিত এখনকার হাসি। আচ্ছা, ও কি জানে? যে, ওকে সেই শুকনো হাসিতেই বেশি মানাতো? হয়তো নাহ্। সব কিছু জানতে নেই। বিগত চারদিন এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। মিহুকে এক পলক সামনে থেকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। আজ পূর্ণ হলো তা! ঘুমও পাচ্ছে খুব। এদিকে বাড়ি ফিরতে হবে। প্রায় বাইশ ঘন্টার বিশাল জার্নি! অনেক সময় পাবো ঘুমানোর! অনেক! হিহিহি!

— জানিস মায়া ছেলেটা খুব আজব। রাতে খেতে বসেছিল সবাই তখনই মায়ার আম্মু বললো।
— কোন ছেলেটা মা?
— আরে বিকেলে তোকে বললাম না একটা ছেলে তোর সাথে দেখা করতে এসেছিলো।

সেই ছেলেটা। পাবনা থেকে এসেছিলো বললো। আবার বললো ছয় বছর পর তো! বললো তোর নাম নাকি মিহু! আবার নিজের নামও আসফু না কি যেন নাম বললো অতটা মনে নেই। আবার কথার মাঝে মাঝে কেমন আজব করে হিহিহি হিহিহি করে হাসে৷ কি জানি ছেলেটা কে! মিহু! আসফু! হিহিহি! শব্দ গুলো খুব অচেনা শহরের ডাস্টবিন থেকে হঠাৎই ডাকযোগে মায়ার কাছে চলে আসে। এত বছর পর ও আমাকে খুঁজতে এসেছিল? ওকে তো আমি আমার ঠিকানা টাও বলি নি। কলেজের নাম টাও না৷ সবচে বড় কথা হলো এতদিন পর!

— কি জানি মা৷ চিনলাম না ছেলেটাকে!

চিনি না বললেও ঠিক চিনেছে মায়া। একমাত্র একজনই ওকে মিহু বলে ডাকতো। একজনই সব সময় হিহিহি করে হাসতো৷ মায়ার খুব পরিচিত মুখ ছিল সে। তবে কালের বিবর্তনে ডায়নোসরের মতো সেই মুখটাও আজ বিলুপ্ত!
আচ্ছা, ও কেন এসেছিল? আমিতো ওকে সেই তখনই বলে দিয়েছিলাম আমাদের এক হওয়া সম্ভব না। ছেলেটা আস্ত পাগল ছিল। অগোছালো পাগল! কয়েক বছর ধরে আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল। অনেক ভাবে। ও আমাকে খুব করে দেখতে চাইতো কাছ থেকে। মাঝে মাঝেই আবার বলতো, আপনার চোখ দুটো কাছ থেকে দেখার খুব শখ আমার! একদিন দেখবো! অনেকদূর থেকে এসেছিল ছেলেটা। না জানি কত কষ্ট করে একবার হলেও আমার সেই চোখ দুটো দেখার জন্যই এসেছিল৷ সে কি দেখেছে আমাকে? কিভাবে দেখবে। আমিতো যাই নি!

— এইযে শুনছো?
— হ্যাঁ বলো। তনয়ের( মায়ার হাজব্যান্ড) কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে মায়ার।
— বলি খুব ঘুম পায় আমার একটু এদিকটায় এসো না৷

কথার সাথে ভালোবাসা আর দুষ্টামি মেশানো হাসি তনয়ের। মায়া টেবিল থেকে উঠে তনয়ের পাশে গিয়ে বসে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও বিয়ের আগে তনয়ের সাথে কথোপকথনে দু’জনেই খুব ইজি হয়ে গেছিলো। তাই ভালোবাসারও কমতি নেই এই ছোট্ট সংসারে। হাজারো খুনসুটির গল্প আর ভালোবাসার প্রবাহে খুব কম সময়েই আবার স্রোতের সাথে হারিয়ে যায় সেই ছেলেটা! মিহুটা! হিহিহি করা হাসিটাও! হয়তো কয়েকশো বিলিয়ন বছর পরে হঠাৎই কারও বুক চিঁড়ে এই হাসিটার ফসিল খুঁজে পাওয়া যাবে! আবার হয়তো বা হাসিটার নিচে চাপা পড়ে যাবে ছেলেটা নিজেই!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত