ড্রয়িংরুমের সোফায় আমি ও মা দু’জনে বসে বসে ছোট বোন তিন্নীর বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতেছি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ। গুরুত্ব আলোচনার মাঝে কোনো প্রকার বাঁধা আসলে মায়ের রাগটা চড়াও হয়। বেল বাজছে তো বাজছেই। পাশের রুম থেকে তিন্নী দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম তিন্নী কারো সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
মা চেঁচিয়ে তিন্নীকে ডাকতে শুরু করে। ও না এসে ওখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মাকে বসিয়ে রেখে দরজার কাছে যাই। গিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখি মর্জিনা খালা। অন্যের বাড়ির বুয়া হিসেবে কাজ করে। স্বামী দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ। বয়স্ক হওয়াতে তেমন খাটতে পারে না বলে কেউ কাজ দিতে চাইনা। সমাজের নিয়মটা বোধই এমনি। বয়স্ক হলেই তার কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। খালা আমাকে দেখা মাত্রই আনমনা মনে বললো,
-একটু বাজারে যেতে পারবে?
-কিভাবে যাবো খালা? তিন্নীর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতেছি মায়ের সাথে। এখন বাজারে গেলে মা হৈচৈ করতে পারে।
-আমার মেয়েকে যেতে বললাম। ও সাহস পাচ্ছে না ঘোর সন্ধ্যা বেলায় বাজারে যেতে। ও বলে পথে ঘাটে তেমন মানুষের হাঁটাচলা নেই। মানুষের সাথেই নাকি মানুষ রূপি মানুষের বসবাস।
খালার কথা গুলো অযৌক্তিক ভেবে উড়িয়ে দেয়াও চলে না। নিজের ঘরে প্রাপ্ত বয়স্ক এক বোন আছে। সেদিকেও ভেবে নিলাম। পরক্ষণেই মায়ের ডাক। খালাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ও তিন্নী মায়ের কাছে আসি। মা গম্ভীর কণ্ঠে ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে,
-একটা গুরুত্ব আলোচনা করছি আর তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস। হেয়ালীপনা বাদ দিয়ে খেয়ালী হো একটু।
এক পলক মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে বললাম,
-মর্জিনা খালা আসছে মা। একটু বাজারে যেতে বলতেছে। যাবো? খেয়াল করি মা বিরবির করে কি যেন বলছে। কিছুক্ষণ পর মা বললো,
-বলে দে এখন সন্ধ্যা হয়েছে, কাল সকালে এনে দিবো। মায়ের কথাটাও অমান্য করা ঠিক মনে হয়নি। দরজার কাছে গিয়ে খালাকে বললাম,
-আপনি এখন বাড়িতে যান কাল এনে দিবো আমি। খালাও মাথা নিচু করে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে সোফায় বসলাম।
সকাল হতেই মর্জিনা খালার বাড়িতে গেলাম। দেখি ভিতর থেকে দরজা লাগানো। কয়েকবার ঠকঠক আওয়াজ করলাম। মর্জিনা খালার মেয়ে ফাতেমা এসে দরজা খুললো। ও আমার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
-তোমার মা কোথায়?
-মা তো কাজে গেছে। ভিতরে এসে বসেন ভাইয়া। ফাতেমার সমাদর দেখে কিঞ্চিত হাসি দিয়ে বললাম,
-বসবো না, কাল সন্ধ্যা বেলায় খালা আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল কিসের জন্য এই ব্যাপারে জানো কিছু?
ও চুপচাপ বুকের সাথে থুতনি লাগিয়ে মাথা নিচু দাঁড়িয়ে রইলো।
-বলো, জানো কিছু?
-এখন শোনেই কিই বা লাভ? তখন ছিল সন্ধ্যা, এখন রাত পেরিয়ে সকাল। মাঝে বারো ঘন্টার পরিবর্তন। ভুলে যাওয়াই ভালো এ ব্যাপার। সন্ধ্যা, বারো ঘন্টার পরিবর্তন, ভুলে যাওয়াই ভালো! এগুলোর কিছু রহস্য বুঝলাম না। মনে প্রশ্ন নিয়ে বলি,
-দুঃখিত ফাতেমা। তখন সন্ধ্যা বেলায় তিন্নীর বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করলাম মায়ের সাথে। তাছাড়া দেশের যে দুর্গম পরিস্থিতি, কখন যে কি হয়ে যায় বলা মুশকিল। ফাতেমার চোখের দিকে তাকাতেই হীমসিম খেতে হয়। চোখের কোণে জল জমাট বাঁধা। ও বললো,
-আপনার বোন তিন্নীকে নিয়ে যেমন দুঃচিন্তার সম্মুখীন হোন, তদ্রূপ আমার মা বাবা এমন দুঃচিন্তার সম্মুখীন হয় আমাকে নিয়ে। আমি রুমের ভিতর গিয়ে চৌকির উপর পা ঝুলিয়ে বসলাম। বললাম,
-কি হয়েছে বলো এখন।
-আপনাদের বাড়ি থেকে আসার পর মা বাসায় আসে। বাবা অসুস্থ থাকায় ঔষুধের জন্য বাজারে যেতে বলেছিল আপনাকে। শেষ-মেশ আমিই যায়। অনেক ভয় নিয়ে বাজার থেকে বাড়ি আসি। কথা গুলো নিজ থেকে বলে আমাকে শুনাচ্ছে আর চোখের পানি মুছছে। আমি বললাম,
-কান্না করো কেন? আন্টি কোথায় এখন? আর আঙ্কেলের কি অবস্থা এখন?
-বাবাকে রাতে ঔষুধ খাওয়ানোর পর সুস্থ হয়। দু’জনেই সকালে কাজে গিয়েছে। ও অসস্থি নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
-আপনার বোন তিন্নী চার দেয়ালের মাঝে থাকে। ওর কিছু দরকার হলে আপনি নিয়ে আসেন। কিন্তু আমাদের কিছু হলে আমি নয়তো মা গিয়ে নিয়ে আসি। ভাইয়ের অভাবটার জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে আমার।
-ক্ষতি? কিসের ক্ষতি?
-কয়েকদিন পর আমার বিয়ের কথা ছিল। কাল সন্ধ্যা বেলায় বাজারে গিয়েছিলাম সেটা কেউ হয়তো বদনাম করে ছেলে পক্ষের বাড়িতে বলে দিয়েছে। তারা এখন আমাকে নষ্টা মেয়ে ভেবে বিয়ে করবে না।
-তুমি কিছু বলো নাই?
-মা ও আমাকে অনেক অপমান করেছে। মা নাকি অন্যের বাড়িতে কাজের উছিলায় খারাপ কাজ করে।
ফাতেমার কথা শোনে নিজের অজানতেই চোখের কোণে পানি এলো। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে এখন। আমার জন্যই মেয়েটির ভবিষ্যৎ নষ্ট হলো। এই দায় কে নিবে? সমাজ কি এই দায় নিতে পারবে? অন্যের প্রয়োজন না বোঝে, না জেনেই মন্তব্য কতোটুকু বিপদ ডেকে আনে যেটা কল্পনার বাহিরে। ফাতেমাকে কিছু বলার ভাষা পেলাম না। ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।