আমার পাঁচ বছরের ছেলে স্বপ্ন কে নিয়ে সবজি বাজারে যাচ্ছি। দিনে দিনে ছেলেটার জেদ বেড়েই চলেছে। সকালে অফিস যাবার সময় তার স্কুলের সামনে রোজ আমি নামিয়ে দিতে গেলে সে আজকাল যেতেই চায়না। “বাবা আমি তোমার মত গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাব” এই আবদার টা তার রোজকার সকালের। ওর আবদার শুনে যখন বলি, “বাবা তুমি বড় হও পড়ালেখা করো তারপর অফিসের দায়িত্বটা নিও।” “বাবা আমার পড়তে ভালো লাগেনা আমি তোমার সাথে অফিসে যাব।”
পাঁচ বছরের বাচ্চার মুখে এমন উত্তর আমাকে চমকে দেয় মাঝে মাঝেই। ছেলেটার যে আল্লাহ কবে সুবুদ্ধি দেবে-
এক কথায় তারে ছেড়ে যে আমি বাইরে বের হবো এমন সুযোগ নেই। ওকে বুঝিয়ে মানাবে সে সাধ্য ওর মায়ের ও নেই। একমাত্র বাচ্চা হিসেবে ভালবাসাটা বেশি পেয়েছে কি না, জেদ টা এজন্যই বোধহয় বেশি। সবজি বাজারে এত ভিড়ের মধ্যে তাকে হাতে ধরে বাজার করা যে কত ঝামেলার তা বোঝাবে কে স্বপ্নকে? বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সায় কোলে ছেলেকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি ফকিরাপুল কাচা বাজারের দিকে। রিক্সাভাড়া দিয়ে ছেলেকে নামিয়ে বাজারে ঢুকে গেলাম।
-দুই কেজি আলু, এক কেজি পেয়াজ, এক কেজি বেগুন দেন তো ভাই।
আমার কথায় সাড়া দিয়ে মুখ পানে হাসিমুখে চেয়ে হ্যা সূচক মাথা দুলিয়ে দোকানী বললো, “দিচ্ছি স্যার।” দোকানী আমার দিকে চেয়েই রয়েছে আমিও চেয়ে রয়েছি উনার দিকে। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছিনা। কে এই দোকানী? কেন তাকে এত চেনা-চেনা লাগছে?
-ভাই আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে আপনার নাম কি?
“আমার নাম রফিক স্যার। চেনা চেনা লাগতাছে মনে হয় সবজি বাজারে আগেও দেখেছেন।” কথা শেষ করেই লোকটা মুখ আড়ালে ঢাকে। ব্যপারটা রহস্যজনিত মনে হলো আমার। সে তার পরিচয় গোপন করতে চাইবে কেন? ”তা ভাই আপনার দেশের বাড়ি কই?” “রাজশাহী।” বলেই জিহ্বায় কামড় দিলেন লোকটা। মনে হয় মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। “রাজশাহীর কোথায়? “না মানে ইয়ে স্যার বাদ দেন না।” বুঝলাম উনি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন কিন্ত কেন লুকাচ্ছেন আর কি লুকাতে চাচ্ছেন?
“না ভাই আপনি বলেন রাজশাহীর কোথায় বাসা আপনার? আপনি কি ২০০৮ সালে শেখ ফরিদ স্কুল এ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন?” এবার লোকটা কেদে দিলেন। চোখ বেয়ে ঝরছে অঝরে পানি। সে তার পরিচয় গোপন করতে চেয়েছে এখন স্কুল জীবণের কথা শুনে সে কেদে দিয়েছে কিন্তু কেনন? আমার মনে এমন অনেক প্রশ্ন কিন্ত কোন উত্তর জানা নেই। কান্নাঝরা কন্ঠে লোকটা বলেই ফেলল, “হ্যা আমি সেই রফিকুল ইসলাম যে ২০০৮ সালে শেখ ফরিদ স্কুলে আপনার সাথে পড়তাম স্যার।”
একরকম ধাক্কা খেয়ে গেলাম আমি। এটা সেই রফিকুল ইসলাম যার সাথে ৭ম শ্রেণী থেকে শুরু করে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনায় কখনো পেরে উঠেনি কেউ। সমস্ত বই যেন ছিল তার মুখস্ত। ক্লাশ হবার আগেই সে পড়াড়াগুলো মুখস্ত করে আসতো। প্রতিটা সাবজেক্টে যার নম্বর ৯৫ এর ওপরে থাকত। হ্যা শেখ ফরিদ স্কুলের ১ম ছাত্র নবম শ্রেনীতে যেই ছেলেটা সাইন্স নিয়েছিল ডাক্তার হবে এই স্বপ্ন নিয়ে সে আজ ব্যস্ততম ঢাকা শহরের ফকিরাপুল কাচা বাজারের সবজি বিক্রেতা। যেই ছেলেটা বুক ফুলিয়ে বলত ১৫ বছর পরে নিজকে ডাক্তার রফিকুল ইসলাম বলে পরিচয় দেবে যেই ছেলেটা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখত এবং তা পূরণে বদ্ধ পরিকর ছিল যে ছিল স্কুল জীবণে আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সবথেকে কাছের বন্ধু আজ সেই আমার কাছে বড় অচেনা। আজ সেই সেরা ছাত্রের এই অবস্থা অথচ আমাদের ব্যাচের তারচেয়ে নরমাল ছাত্র ছাত্রীরাও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে আমিও যথেষ্ট ভালো পজিশনে আছি। তবে রফিকের কেন এই দুরবস্থা??
ভাবনার বিভোর থেকে বেরিয়ে ছেলের হাতটা ছেড়ে দিয়ে রফিককে জড়িয়ে ধরেছি বাজারের অনেকেই তখন হা করে তাকিয়ে আছে। হয়ত আমার স্যুট কোট-টাই এর সাথে বাজারের ময়লা লুঙ্গি পরা একজন দোকানীর গলা জড়ানো তারা মেলাতে পারছেনা। আর এই চক্ষু লজ্জা লুকাতেই হয়ত রফিক আমার কাছে পরিচয়টা গোপন করতে চেয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরতেও সে কেমন ইতঃস্থত বোধ করছিল। সে প্রথমেই আমাকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু বয়সের তারতম্য আর অনেকদিন না দেখে হঠাৎ এমন অবস্থায় তাকে দেখে আমি ই চিনতে পারিনি। “দোস্ত তোর এই অবস্থা কবে থেকে আর কি করে?”
কান্নাজড়িত কন্ঠে রফিক তখনো আমায় স্যার সন্মোধন করে বলা শুরু করলে আমি তাকে তুই করে বলতে অনুরোধ করলাম। এরপর রফিক আধো-আধো কন্ঠে বলা শুরু করল-
“ঐ নবম শ্রেনীতে যখন তুই তোর বাবার ট্রান্সফারের সাথে সাথে স্কুল পরিবর্তন করলি তারপর থেকে তোর সাথে আর যোগাযোগ নেই। দশম শ্রেনীতেও আমি প্রথম হয়েছিলাম। প্রি-টেষ্ট পরীক্ষাতেও আমি ভালো রেজাল্ট করেছিলাম কিন্তু ডিসেম্বর মাসে আমার বাবা মারা যায়। তারপর শুরু হয় আমার জীবণ যুদ্ধ। বাবা হারানোর আর্তনাদ সামলে ওঠার আগেই আমার এসএসসি পরীক্ষা চলে আসে। এরপরেও আমি এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাই। কিন্ত তারপর পরেই আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
পরিবারের অবস্থা খুব ভালো ছিল না তুই তো জানতি। ছোট ভাই বোন আর অসুস্থ মায়ের খরচ চালানো আমার পক্ষে দায় হয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম ঢাকা শহরে এসে কোন একটা কাজ করব আর পাশাপাশি পড়াশোনা করব। কিন্তু ব্যস্ত শহরে বাস্তবিক জীবণে অনেক রকমের ছোট খাট কাজ করেছি কিন্ত সিনেমার নায়কের মত পরিবারের দেখাশোনা আর পড়া একসাথে করে উঠতে পারিনি। দিনে দিনে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ভাই বোনের ভরণপোষণ সব মিলিয়ে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট খাট অনেক কাজের পরে সবশেষে এই বাজারে সবজির দোকান দিয়েছি। ছোট ভাই বোন এখন পড়াশোনা করে আর মাকে বাচিয়ে রাখতে পারিনি বেশিদিন। মা মারা যাওয়া ৬ বছর হয়ে গেছে। এখন দিনকাল এমনই কাটে দোস্ত আমার।
ওর কথা গুলো শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। মানুষের নানান রকম স্বপ্ন থাকে যার মাঝে কিছু অপূরণীয় রয়ে যায়। আকাশ ছোয়া স্বপ্ন রফিক দেখেনি কিন্ত শুধুমাত্র দারিদ্র্যতা নামক রাক্ষস তার স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়। দারিদ্রতা এমন এক জিনিস যা মানুষকে বরে বিব্রত দারিদ্রতা এমন এক জিনিস যা মানুষকে করে লাঞ্ছিত।
দারিদ্র সীমার নিচের মানুষ গুলোর জীবণের সাধ আহ্লাদ বলতে কিছু থাকেনা-থাকেনা স্বপ্ন পূরন করার মত কোন কিছুর বালাই। তারা সন্মান রক্ষার্থে কোথাও হাত পাততেও পারেনা আর ঠিকমত জীবণ যাপন করতেও পারেনা স্বপ্ন পূরন করবে কি?
রফিককে দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। আমারই বন্ধু আমারই ক্লাসমেট ক্লাশের সেরা ছাত্রটির এমন করুন অবস্থা। ফকিরাপুল কাচা বাজারের কেউ হয়ত জানেনা এই সবজি বিক্রেতা রফিক ছিল স্কুলের সেরা ছাত্র। কেউ হয়তোবা খোজ রাখেনি এই সামান্য সবজি বিক্রেতা ২০০৮ সালে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখেছিল। আর কেউ চিনুক না চিনুক আমি তো সেই স্বর্ণ টাকে চিনতে ভুল করিনি। অনেক জোরাজোরি করে তাকে আমার অফিস দেখাশোনা পদে একটা চাকুরি দেয় যদিও প্রথমে রাজি ছিল না। কারণ চক্ষুলজ্জা আর করুনা সে চায়না কিন্ত আমিও নাছোড় বান্দা আমার জীবণে দেখা এমন একটা স্বর্ণকে আমি এভাবে অবহেলিত হতে দিতে পারিনা।
মাস দুয়েক পর–
দিন কাল ভালোই কাটছে আমার এসএসসি পাস বন্ধু আমার অফিস ভালোই সামলে নিয়েছে সেই সাথে ব্যবসার দিকটাও। রফিক এখন আমার পরের পদে কাজ করে মানে আমার অবর্তমানে সেই অফিসের বস। তার কোন কাজে সমস্যা হয়না। সময়মত গাড়িতে করে অফিস করে রোজ জীবণ যাত্রার মান বদলে গেছে তার আমি জানতাম ও পারবে। রফিক এখন আমার ছেলে স্বপ্ন এর সবথেকে ভালো বন্ধু সেই সাথে তার ভালো শিক্ষকও বটে। প্রতিদিন রফিক আমার ছেলেকে যতটা যত্ন সহকারে পড়ায় আর খেয়াল রাখে তা হয়ত আমি বা আমার বউ কখনোই পারি নি। খুব সহজেই স্বপ্নকে মানিয়ে নিতে পারে রফিক।
নিয়তি রফিকের ডাক্তার হবার স্বপ্ন হয়ত পূরণ হতে দেয়নি কিন্ত ও এখন আর ফকিরাপুলের সবজি বাজারের সেই সবজি বিক্রেতা নেই। অতি সাধারণ যেই রফিক আগে সবজির দোকানে সবাইকে স্যার ডাকত সে এখন মোঃ রফিকুল ইসলাম স্যার নামে পরিচিত অফিসের অর্ধ শত স্টাফের কাছে। কিছু স্বপ্ন পূরণ হয়না তবে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলেই যে জীবণ থমকে দাড়ায় না তা রফিককে না দেখলে বা তার জীবণের গল্প না পড়লে হয়ত বোঝা যাবেনা।