১৪. পুলিশ
দৃশ্যটা খুব অদ্ভুত। নাওয়াজ খানের হাতে হাতকড়া লাগানো। হাতকড়া লাগানোর সময় হাতগুলি পিছনে কেন রাখা হয় কে জানে? তাকে একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে, হাজার হলেও একজন সম্মানী ডাক্তার মানুষ।
ওসমানের হাতেও হাতকড়া, কিন্তু তার জন্যে কোন চেয়ার নেই, সে বসেছে মেঝেতে। দুজনের মুখ খুব গম্ভীর, দেখে মনে হয় গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। নাওয়াজ খানের কপালটা ফুলে আছে, জয়নালের বোতল দিয়ে লেগেছে। ওসমানের বাম চোখটাও প্রায় বুজে এসেছে। অন্ধকারের সেই মারামারিতে কে কোথায় মার খেয়েছে বোঝা মুশকিল।
বড় একটা টেবিলের এক পাশে বসেছেন একজন পুলিশ অফিসার। মাঝবয়সী মানুষ, মুখে মোটা মোটা গোফ। দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করে। টেবিলের অন্য পাশে। বসেছেন জারুল চৌধুরী। তার মুখটাও খুব গম্ভীর। কারণটা কি কে জানে! জারুল চৌধুরীর অন্যপাশে তিনটা চেয়ারে বসেছেন আমার বাবা, সলীলের বাবা আর উকিল সাহেব। পুলিশ অফিসার গভীর রাতে কনেস্টবল পাঠিয়ে এই তিনজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। টেবিলের সামনে একটা বেঞ্চে আমি, সলীল আর জয়নাল চাপাচাপি করে বসেছি। আমাদের চারপাশে অনেক কয়জন পুলিশ, সবাই হাঁটাহাঁটি করছে, ব্যস্ততা নেই, কিন্তু হাঁটাহাঁটির মাঝে খুব একটা গুরুত্বের ভাব।
পুলিশ অফিসারটি টেবিলে একটা পেন্সিল ঠুকতে ঠুকতে বললেন, আমি অনেকদিন থেকে পুলিশে চাকরি করি কিন্তু এরকম কেস একটাও দেখিনি।
জারুল চৌধুরী বললেন, শুনে ভরসা পেলাম। এরকম কেস যে একটাও আছে সেটাই কি বেশি নয়?
তা ঠিক প্রফেসর সাহেব। পুলিশ অফিসার মাথা নাড়লেন, যদি এই ছেলেরা না ধরত, কোনদিন কি আমরা ধরতে পারতাম? পারতাম না। কোনদিনই পারতাম না।
জারুল চৌধুরী বললেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মোটামুটি হাবাগোবা ছিলাম। আর এদের দেখেন, কি বুদ্ধি! এই বয়সে এরকম বুদ্ধি চিন্তা করতে পারেন? বড় হলে কি হবে?
পুলিশ অফিসারটি হা হা করে হেসে ওঠলেন আর হঠাৎ তাকে বেশ ভাল মানুষের মত মনে হতে লাগল। এতক্ষণ তাকে দেখে যে একটু ভয় ভয় লাগছিল সেই ভয়টা কেটে গেল হঠাৎ। পুলিশ অফিসার হাসতে হাসতেই বললেন, কোথা থেকে যে এদের মাথায় এরকম বুদ্ধি বের হল! এরকম বিপদের মাঝেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে কি কি করেছে। দেখেছেন? বারে নিচে পয়সা দিয়ে ফিউজ কেটে দেওয়া, হাতের বাধন খুলেও ভান করা যে হাত বাঁধা, দড়ির মাঝে বোতল বেঁধে অস্ত্র তৈরি করা!
আমি আর সলীল কিছু না বলে নড়েচড়ে বসলাম। খুব কমই হয়েছে যে, কেউ আমাদের প্রশংসা করেছে, প্রশংসা করলে কি বলতে হয় ছাই জানিও না। হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকাই মনে হয় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
এরকম সময় একজন মানুষ এসে পুলিশ অফিসারের সাথে নিচু গলায় বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল। কি নিয়ে কথা হচ্ছিল ঠিক বুঝতে পারলাম না। পুলিশ অফিসারটি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন। তারপর কি একটা বললেন, তখন আরও কয়েকজন পুলিশ এসে নাওয়াজ খান ও ওসমানকে সরিয়ে নিয়ে গেল। পুলিশ অফিসার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কি সাংঘাতিক ব্যাপার! মানুষ যেরকম করে সুপারির কিংবা গুড়ের ব্যবসা করে এরা সেভাবে ছোট ছোট গরিব বাচ্চাদের। কিডনি, লিভার এসবের ব্যবসা করত! চিন্তা করতে পারেন?
উপস্থিত যারা ছিল সবাই আবার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ঠিক এসময় একজন মানুষ বেশ অনেক কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এল। এখন গভীর রাত, বেশি রাত হলে আমি কিছু খেতে পারি না, কিন্তু আজকে বিস্কুটগুলি দেখে হঠাৎ আমার খিদে চাগিয়ে উঠল। পুলিশ অফিসার বিস্কুটগুলি আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর সলীলের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, সলীল আপনার ছেলে?
সলীলের বাবা মাথা নাড়লেন। পুলিশ অফিসার তখন বাবার দিকে তাকিয়ে। বললেন, আর মুনীর আপনার?
বাবা মাথা নাড়লেন।
কেমন করে এরকম বুদ্ধিমান ছেলে হয় আপনাদের? এইটুকু ছেলে, কি বুদ্ধি! কি রকম বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে। শুধু কি বুদ্ধি? আরেকজনকে বাঁচানোর জন্যে কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিল চিন্তা করতে পারেন? কি রকম চমৎকার ব্যাপার। তাই না রে জয়নাল?
জয়নাল জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
পুলিশ অফিসার মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমাকে বলতেই হবে আপনাদের হীরার টুকরা ছেলে। একটু ডানপিটে হয়তো কিন্তু একেবারে সোনার খনি–
সলীলের বাবা একটু নড়েচড়ে বললেন, আপনার কথা শুনে ভাল লাগল স্যার। বড় ভাল লাগল। টানাটানির সংসার, ছেলেমেয়েদের যত্ন করতে পারি না। এই ছেলেটা তো বলতে গেলে নিজে নিজেই বড় হচ্ছে। আশীর্বাদ করেন যেন মানুষ হয়।
অবিশ্যি অবিশ্যি আশীর্বাদ করব। একশবার আশীর্বাদ করব।
পুলিশ অফিসার তখন বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কেমন লাগে যখন দেখেন আপনার ছেলে এরকম সাংঘাতিক একটা কাজ করেছে?
বাবা কিছু বললেন না, নড়েচড়ে বসলেন।
পুলিশ অফিসার হেসে বললেন, আপনার হয়তো বেশি আশ্চর্য মনে হয় না। সব সময়েই দেখে এসেছেন হীরার টুকরা ছেলে! আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তবুও গর্বে বুক ফুলে যায়। যায় না?
বাবার মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সেই অবস্থায় খুব কষ্ট করে খুব দুর্বলভাবে একবার মাথা নাড়লেন।
পুলিশ অফিসার তখন আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর চোখ নাচিয়ে বললেন, আমার ডিপার্টমেন্টে আসলে তোমাদের মত কয়জন মানুষ দরকার! আঁটি ডিটেকটিভ–
জারুল চৌধুরী হাত নেড়ে বললেন, সর্বনাশ! কি করছেন আপনি! ডানপিটে ছেলে এরা, সত্যি সত্যি চোর-ডাকাত-খুনেদের সাথে হাতাহাতি শুরু করে দেবে! ভাল চান তো ওদের আচ্ছামত বকে দিন। আর যেন এরকম না করে।
পুলিশ অফিসার আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, প্রফেসার সাহেব ঠিকই বলেছেন। তোমাদের বেশি উৎসাহ দেখিয়ে কাজ নেই–
হঠাৎ কি মনে হল জানি না, আমি বলে ফেললাম, আমি আসলে আরো একটা কাজ করছি।
সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পুলিশ অফিসার ঘুরে তাকিয়ে বললেন, কি কাজ?
এখানে ভেজাল ওষুধের ব্যবসা হয় সেটা বের করার চেষ্টা করছি।
আমি আড়চোখে বাবার দিকে তাকালাম, তার চোয়াল হঠাৎ ঝুলে পড়ল, মুখ মাছের মত নড়তে লাগল। পুলিশ অফিসারটি একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, ভেজাল ওষুধ?
জী।
কে ভেজাল ওষুধের ব্যবসা করে?
আমি একটু ইতঃস্তত করে বললাম, সেটা বলার এখনো সময় হয়নি।
পুলিশ অফিসার হাসিমুখে বললেন, ইনভেস্টিগেশান বাকি আছে এখনো?
আমি মাথা নাড়লাম।
বেশ! যখন ইনভেস্টিগেশান শেষ হবে, আমাকে বল।
আমি মাথা নাড়লাম, বলব।
জারুল চৌধুরী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, চোখে চোখ পড়তেই তিনি একবার চোখ মটকালেন, যার অর্থ বাইরের কেউ বুঝতে পারল না। সলীল কনুই দিয়ে আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে গলা নমিয়ে বলল, তুই একটা ডেঞ্জারাস মানুষ! আমি বাবার দিকে তাকালাম। তাঁর সমস্ত মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে আছে। এর আগে আমি তাঁকে কখনো ভয় পেতে দেখিনি। আগে লক্ষ্য করেছিলাম, রাগ হলে বাবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে যায়। এখন দেখছি ভয় পেলেও তার চেহারা খুব খারাপ হয়ে যায়।
আগের পর্ব :
০১. আমার বাবা
০২. সলীল
০৩. সাহেব বাড়ি
০৪. জয়নাল
০৫. গাছঘর
০৬. নাওয়াজ খান
০৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড
০৮. ওষুধ ফ্যাক্টরি
০৯. খুন
১০. বিস্ফোরণ
১১. একা একা
১২. গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক
১৩. মুখোমুখি
পরের পর্ব :
১৫. শেষ কথা