জারুল চৌধুরীর মানিক জোড়: ০৬. নাওয়াজ খান

জারুল চৌধুরীর মানিক জোড়: ০৬. নাওয়াজ খান

৬. নাওয়াজ খান

গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকের সামনে এসে আমি আর সলীল দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলাম। সলীল এতক্ষণ বেশ বড় বড় কথা বলছিল, কেমন করে নাওয়াজ খানের সাথে দেশের উন্নতি নিয়ে কথা বলবে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট কেমন করে দূর করা যায় সেসব আলোচনা। করবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার উৎসাহ কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমি বললাম, চল ফিরে যাই। খামাখা গিয়ে কি হবে? বড় মানুষ, উল্টো একটা ধমক দিয়ে বের করে। দেবে।

কেন ধমক দিয়ে বের করে দেবে?

বড় মানুষদের আক্কেল কম হয়, সেজন্য।

সলীল আমার দিকে চোখ পালিয়ে তাকিয়ে বলল, তোর ধারণা বড় মানুষ মাত্রই খারাপ, সেটা ঠিক না। পৃথিবীতে অনেক ভাল বড় মানুষ আছে। যদি একজন ভাল মানুষ থাকে তার দেখাদেখি আরো অনেক ভাল মানুষ বের হয়।

কচু হয়।

সলীল রেগে বলল, ধরে একটা থাবড়া দেব। কবি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন তৈরি করেছিলেন, কত বড় বড় মানুষ যেখান থেকে বের হয়েছে জানিস?

আমি সলীলকে রাগানোর জন্যে হি হি করে হেসে বললাম, তুই ভাবছিলি নাওয়াজ খানকে নিয়ে আরেকটা শান্তিনিকেতন তৈরি করবি?

সলীল কিছু না বলে আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকের সামনে দুইবার সামনে পিছনে হাঁটল। তারপর আমার মুখের কাছে আঙুল তুলে বলল, তোর যা ইচ্ছা হয় কর, আমি ভিতরে গেলাম।

তারপর আমি কিছু বলার আগে সত্যি সত্যি গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি একা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি কেমন করে, তাই সলীলের পিছনে পিছনে আমিও ঢুকে গেলাম। গেটের পিছনে রাস্তায় একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস। একজন মানুষ লাল রঙের একটা কাপড় দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়িটা মুছে পরিষ্কার করছে। মনে হয় মানুষটা ডাক্তার নাওয়াজ খানের ড্রাইভার। মানুষটা আমাদের দেখে ভুরু কুঁচকে। খামাখাই গলা উঁচিয়ে বলল, কি চাও?

সলীল কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা ডক্টর নাওয়াজ খানের সাথে দেখা করতে এসেছি।

লোকটা এক পা এগিয়ে এসে বলল, কেন?

তার সাথে একটু কাজ ছিল।

কি কাজ? চাঁদা চাইতে এসেছ? ডাক্তার সাহেব কোন চাঁদা-ফাঁদা দেন না।

না, চাঁদা না। তার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

কি কথা?

সলীল মনে হয় তখন একটু রেগে গেল। বলল, সেটা আমি নাওয়াজ খান সাহেবকে বলব।

সলীলের কথা শুনে ড্রাইভার মানুষটাও মনে হল রেগে গেল। বলল, ডাক্তার সাহেব ব্যস্ত মানুষ, তোমাদের সাথে খোশগল্প করার সময় নাই। যাও, বাড়ি যাও।

সলীলও খুব রেগে গেল, কিন্তু তবু সে গলার স্বর ঠাণ্ডা রেখে বলল, আপনি কে? আপনার কথায় কেন আমরা যাব? আমরা ডক্টর নাওয়াজ খানের সাথে কথা বলতে এসেছি, তাঁর সাথে কথা না বলে যাব না।

ড্রাইভার মানুষটা এবারে রেগে আগুন হয়ে কিছু একটা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ দোতলা থেকে একটা মানুষের গলা শুনতে পেলাম, ওসমান!

আমরা উপরে তাকালাম, দোতলার বারান্দায় ফর্সা লম্বা একজন সুন্দর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই ডাক্তার নাওয়াজ খান। সেখান থেকেই আবার বলল, কি হয়েছে ওসমান?

ওসমান নামের মানুষটা একটু থতমত খেয়ে বলল, এই দুজন ছেলে আপনার সাথে দেখা করতে চায়।

কেন?

আমাকে বলবে না।

ঠিক আছে। উপরে পাঠিয়ে দাও।

সলীল আর আমি ওসমানের দিকে বিজয়ীর মত তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। মানুষটা খুব রেগেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ উপরে উঠতে উঠতে আমরা দেখলাম, ওসমান মাইক্রোবাসের টায়ারে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মেরে বসল।

ওপরে সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ঘর, ডাক্তারের চেম্বারের মত। একটা বড় টেবিল, পিছনে শেলফ, শেলফে ডাক্তারী বইপত্র। টেবিলের এক পাশে একটা চেয়ারে নাওয়াজ খান বসে আছেন। আমাদের ঢুকতে দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?

সলীল আর আমি এক সাথে মাথা নাড়লাম। নাওয়াজ খানের গলার স্বর গুরু গম্ভীর, শুনে কেমন যেন ভয় লেগে যায়।

কি ব্যাপার?

সলীল কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, আমার নাম সলীল। আর এই হচ্ছে। মুনীর।

ও।

আমরা গভমেন্ট স্কুলে পড়ি।

বেশ।

আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি কয়েকটা প্রশ্ন করার জন্যে।

কি প্রশ্ন?

সলীল হঠাৎ একটু ঘাবড়ে গেল। নাওয়াজ খানের গলা রীতিমত কঠিন, এরকম মানুষের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তাই চালানো যায় না, তাকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা তো এক রকম অসম্ভব। সলীল তবু চেষ্টা করল, মাথা চুলকে গলা খাকারী দিয়ে ঠিক কিভাবে শুরু করবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, দেশের মানুষের। উন্নতির জন্যে আমাদের কি করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

নাওয়াজ খান কোন কথা না বলে সরু চোখে সলীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগল তিনি কেমন যেন রেগে উঠছেন। আমাদের হঠাৎ কেমন জানি ভয় করতে থাকে, সলীল আরো একটা কি বলতে গিয়ে হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে যায়। নাওয়াজ খান থমথমে গলায় বললেন, তুমি এটা জিজ্ঞেস করার জন্যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?

সলীল দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।

নাওয়াজ খান মুখ বাঁকা করে টিটকিরি করার মত ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

কি প্রশ্ন?

এত মানুষ থাকতে তোমরা আমার কাছে এসেছ কেন? তোমাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি?

সলীল আমতা আমতা করে বলল, আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নাই। আমাদের এটা তো ছোট শহর, বড় মানুষজন বেশি নাই। বড় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর নাই। আপনি যখন এখানে এসে এত বড় মেডিকেল ক্লিনিক খুলেছেন আপনার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে—

নাওয়াজ খান টেবিলের উপর ঝুঁকে প্রায় বাঘের মত গর্জন করে বললেন, আমার উদ্দেশ্য আছে?

সলীল দুই হাত উপরে তুলে বলল, না না না, খারাপ উদ্দেশ্য না! ভাল উদ্দেশ্য। নিশ্চয়ই ভাল উদ্দেশ্য।

নাওয়াজ খান কোন কথা না বলে আমাদের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলেন। সলীলের কথাবার্তা খুব যে ভাল এগুচ্ছে না তাতে কোন সন্দেহ নেই, সেটা ভাল এগুবে তার কোন সম্ভাবনাও নেই। আমি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম, এবারে চি চিঁ করে বললাম, আপনি যদি খুব ব্যস্ত থাকেন তাহলে আমরা এখন যাই। অন্য কোনদিন না হয় আসব।

নাওয়াজ খান ধমক দিয়ে বললেন, সত্যি করে বল কেন এসেছ?

খোদার কসম, আমি বুকে হাত দিয়ে বললাম, আমরা এমনি এসেছি।

তোমরা যে এখানে এসেছ তার পিছনে আর কোন কারণ নেই?

জী না, নেই।

সলীলও জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না স্যার, কোন কারণ নেই। আমাদের স্কুলে এটা নিয়ে একটা রচনা লিখতে হবে, তাই ভাবলাম, যারা বড় মানুষ, দায়িত্বশীল মানুষ, তাদের সাথে কথা বলে দেখি। আমরা ছোট বলে কেউ বেশি পাত্তা দিতে চায় না, তাই ভাবলাম–

কি ভাবলে?

আপনার সাথে কথা বলে দেখি।

আগে আরো চেষ্টা করেছ?

করেছি। কেউ পাত্তা দেয় নাই। সলীল অত্যন্ত সরল মুখ করে মিথ্যা বলতে থাকে, কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে গিয়েছি, চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গিয়েছি। আরো দুইজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছি।

নাওয়াজ খান মনে হল শেষ পর্যন্ত একটু নরম হলেন। বললেন, ঠিক আছে, বস।

আমরা দুইজন খুব সাবধানে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে কাছাকাছি দুইটা চেয়ারে বসলাম। নিজেদেরকে মনে হচ্ছে ফাঁসির আসামী, যেন এক্ষুনি ফাঁসির রায় দেয়া হবে।

নাওয়াজ খান চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, তোমাদের প্রশ্নটা যেন কি?

দেশের উন্নতির জন্যে আমাদের কি করা উচিৎ?

প্রত্যেকটা মানুষ যদি নিজের উন্নতি করে তাহলেই দেশের উন্নতি হবে।

কিন্তু, কিন্তু-–

কিন্তু কি?

একজন যদি খুব গরিব হয়, পড়াশোনা করতে না পারে, কোন সুযোগ না পায়, তাহলে সে নিজের উন্নতি কেমন করে করবে?

সেরকম মানুষের কথা ভুলে যাও।

ভুলে যাব?

হ্যাঁ। তারা সমাজের বোঝা। দেশের বোঝ।

বোঝা?

হ্যাঁ। সেরকম মানুষ যত কম হয় তত মঙ্গল।

কিন্তু —

নাওয়াজ খান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্যমনস্কের মত বললেন, পৃথিবীটা হচ্ছে একটা বিরাট ফুড চেইন। একদল আরেক দলকে খাচ্ছে। খেয়ে বেঁচে আছে। যার কপাল ভাল সে ফুড চেইনের উপরে, যার খারাপ সে নিচে। চেষ্টা করতে হয় ফুড চেইনের উপরে থাকতে যেন তোমাকে কেউ খেতে না পারে, কিন্তু তুমি অন্যকে খেতে পার।

নাওয়াজ খান কি বলতে চাইছেন আমি আর সলীল ঠিক বুঝতে না পেরে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। নাওয়াজ খান জানালার বাইরে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যারা গরিব, অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষ তারা দুর্বল মানুষ। তারা ফুড চেইনের নিচে। তারা কোন কাজে আসে না। যদি কোনভাবে তাদের ব্যবহার করা যায়, ভাল। করা না গেলে নেই। তাদের নিয়ে মাথা ঘামালে দেশের কোন উন্নতি হবে না। দেশের উন্নতি করবে সমাজের যারা এলিট গ্রুপ, তারা। যারা জ্ঞানে-গুণে, বিদ্যায় বুদ্ধিতে তুখোড়, তারা। চেষ্টা কর সেরকম মানুষ হতে–

সলীল প্রতিবাদ করে আরো কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এই মানুষটার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। নাওয়াজ খান আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোন প্রশ্ন আছে?

আমরা মাথা নাড়লাম, না নেই।

যাও, তাহলে বাড়ি যাও।

গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক থেকে হেঁটে আসতে আসতে সলীল বলল, নাওয়াজ খান মানুষটা অনেক ডেঞ্জারাস।

আমি বলেছিলাম না তোকে?

চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।

আমি আবার বললাম, তোকে বলেছিলাম না আগেই?

তোর জয়নালের মনে হয় অনেক বড় বিপদ হতে পারে। বলিস এই লোক থেকে দূরে থাকতে। একশ হাত দূরে থাকতে।

পারভেজ স্যারের রচনা লিখতে আমাদের একটু ঝামেলা হল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমি লিখলাম বৃন্দাবনের উপর, যে উকিল সাহেবের গরুর দুধ দোয়াতে আসে। থুরথুরে বুড়ো কিন্তু এই বয়সে সে রাস্তার একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মত করে বড় করেছে। সব সময় তার পিছনে পিছনে ঘুরে। সলীল লিখল একজন রিকশাওয়ালার উপরে, ভুল করে একবার রিকশায় একটা ব্যাগ ফেলে রেখে এসেছিল, রিকশাওয়ালা খুঁজে এসে ফেরৎ দিয়ে গেছে। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা ছিল কিন্তু সে খুলেও দেখেনি!

আগের পর্ব :
০১. আমার বাবা
০২. সলীল
০৩. সাহেব বাড়ি
০৪. জয়নাল
০৫. গাছঘর
পরের পর্ব :
০৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড
০৮. ওষুধ ফ্যাক্টরি
০৯. খুন
১০. বিস্ফোরণ
১১. একা একা
১২. গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক
১৩. মুখোমুখি
১৪. পুলিশ
১৫. শেষ কথা

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত