জারুল চৌধুরীর মানিক জোড়: ০৪. জয়নাল

জারুল চৌধুরীর মানিক জোড়: ০৪. জয়নাল

৪. জয়নাল

সকালে স্কুলে যাবার সময় দেখি জয়নাল আমাদের বাসার সিঁড়িতে বসে আছে। জয়নাল আমাদের বাড়িওয়ালার কাজের ছেলে। আমাদের বাড়িওয়ালা একজন উকিল, নাম গজনফর আলী, সবাই গজু উকিল বলে ডাকে। উকিল সাহেবের মনে হয় পশার খুব বেশি নেই, সংসার চালানোর জন্যে তার ওকালতি ছাড়াও আরো নানারকম কাজকর্ম করতে হয়। আমরা তার ভাড়া বাসাতে থাকি। শীতের সময় উকিল সাহেব গরুর গাড়ি করে গ্রাম থেকে ধান আনেন। তার বাসায় একটা গাইগরু আছে, তিনি সেই গরুর দুধ বিক্রি করেন। জয়নালকে রাখা হয়েছে এই গরুটাকে দেখাশোনা করার জন্যে।

উকিল সাহেবের গরুটা খুব দুবলা, বাছুরটা তার থেকেও দুবলা। প্রত্যেকদিন সকালে দুধ দোওয়ানোর জন্যে বৃন্দাবন নামে একজন থুরথুরে বুড়ো মানুষ আসে। শুকনো হাড় জিরজিরে গরুটা থেকে বৃন্দাবন কিভাবে কিভাবে জানি ছোট একটা বালতিতে আধ বালতি দুধ বের করে ফেলে। সেই দুধে পানি মিশিয়ে পুরো বালতি করে দুধ বিক্রি করা হয়। দুধে যে পানি মেশানো হয় সেই খবরটাও আমরা জয়নালের কাছে পাই। উকিল সাহেবের কথামত সেই মিশায়। দুধে নাকি একটু পানি মেশাতে হয়, একেবারে খাঁটি দুধ নাকি স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল না।

জয়নালের বয়স আমার থেকে বেশি হবে না, কিন্তু তাকে দেখায় অনেক বড়। প্রথম কারণ, সে সব সময় লুঙ্গি পরে থাকে, লুঙ্গি পরলে মানুষকে কেন জানি একটু বড় দেখায়। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন সে লুঙ্গির গোজ থেকে সিগারেট বের করে খায়। তার সিগারেট খাওয়াটা একটি দেখার মত দৃশ্য, চোখ বন্ধ করে এমন। একটি ভাব করতে থাকে যেন সিগারেট নয়, রসগোল্লা খাচ্ছে।

জয়নাল এমনিতে খুব হাসিখুশি ছেলে। কিভাবে এত হাসিখুশি থাকে কে জানে! যেভাবে থাকে সেখানে হাসিখুশির কিছু নেই। আজকে অবিশ্যি তাকে হাসিখুশি। দেখাচ্ছে না। সিঁড়িতে মুখটা গোমড়া করে বসে আছে, সামনে তার হাড়জিরজিরে গরু। গরুটার দড়ি তার হাতে। কাছেই বাছুরটা দাঁড়িয়ে আছে, গরুটা তার খসখসে জিব দিয়ে বাছুরটাকে চেটে যাচ্ছে, শব্দ শুনে মনে হয় চামড়া তুলে ফেলবে। বাছুরটার মুখে একটা উদাস উদাস ভাব, দেখে মনে হয় কেমন জানি এক ধরনের শান্তি এসে ভর করেছে!

আমি বললাম, কি রে জয়নাল!

জয়নাল আমার দিকে তাকিয়ে নালিশ করার ভঙ্গিতে বলল, শালার বাছুরটার কারবারটা দেখেছেন?

যদিও তার বয়স আমার কাছাকাছি তবুও সে আমাকে আপনি করে বলে, আমি তাকে তুই করে বলি। কাজের ছেলেদের এভাবেই বলা হয়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?

দড়ি ছিঁড়ে রাত্রে সব দুধ খেয়ে ফেলেছে। পেটটা দেখেছেন?

আমি বাছুরটার দিকে তাকালাম। সত্যিই পেটটা ফুলে ছোট একটা ঢোলের মত হয়ে আছে। চেহারায় সে জন্যেই মনে হয় শান্তশিষ্ট ভালমানুষ সুখী সুখী চেহারা! আমি দাঁত বের করে হেসে বললাম, ঠিক করেছে! একফোঁটা দুধ খেতে দিস না বাছুরটাকে, দড়ি ছিড়বে না তো কি? মায়ের দুধ তো তার বাচ্চাই খাবে–

জয়নাল মুখ বাঁকা করে বলল, আর মারটা? সেটা কে খাবে?

আমি আর কথা বাড়ালাম না। বড়দের হাতে মার খাওয়া ব্যাপারটা শুধু আমার জন্যে সত্যি না, আরো অনেকের জন্যে সত্যি। খানিকক্ষণ বাছুরের ঢোলের মত পেটটাকে দেখে স্কুলে যাচ্ছিলাম, জয়নাল পিছন থেকে ডেকে বলল, ভাই, মনির ভাই।

কি?

আজকে একটা চিঠি লিখে দেবেন?

যেহেতু জয়নাল লিখতে পড়তে পারে না, আমি তাকে মাঝে মাঝে চিঠিপত্র লিখে দিই। সে তার বাড়িতে যখন টাকা পাঠায় আমি তার মানি অর্ডার ফরম ফিলআপ করে দিই। সহজে অবিশ্যি রাজি হই না, সবসময় প্রথমে খানিকক্ষণ গাইগুই করি। আজকেও শুরু করলাম, বললাম, আবার? সেই দিন না লিখে দিলাম?

সেইদিন কি বলেন? কার্তিক মাসে দিলেন। এখন অগ্রহায়ণ।

আমার বাংলা মাসের হিসেব ভাল থাকে না। মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে শেষে বললাম, ঠিক আছে, বিকালে নিয়ে আসিস।

জয়নাল একেবারে গলে যাওয়ার ভান করে বলল, ঠিক আছে মনির ভাই। ঠিক আছে।

.

বিকাল বেলা জয়নাল একটা মানি অর্ডার ফরম আর একটা ভুসেভুসে কাগজ নিয়ে হাজির হল। বারান্দায় বসে আমি তার মানি অর্ডার ফর্মে লিখতে থাকি। কত টাকা পাঠাচ্ছে জিজ্ঞেস করতেই হঠাৎ জয়নাল কেমন যেন অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কত পাঠাবি?

তিনশ।

তিনশ? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, এত টাকা কোথায় পেয়েছিস?

জয়নালের বেতন কত আমি খুব ভাল করে জানি। উকিল সাহেব বলতে গেলে তাকে পেটে-ভাতে রেখেছেন। জয়নাল মুখ কাচুমাচু করে মাথা চুলকে বলল, পেয়েছি এক জায়গা থেকে।

কোন্ জায়গা থেকে?

জয়নাল আমতা আমতা করে বলল, বলা নিষেধ আছে মনির ভাই।

চুরি করেছিস?

সাথে সাথে জয়নালের মুখ কাল হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মনির ভাই, আপনার তাই মনে হয়? মানুষ গরিব হলেই চুরি করে?

তাহলে বলছিস না কেন?

চুরি করিনি। জয়নাল জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, খোদার কসম চুরি করিনি। আল্লাহর কসম। খোদার কীরা।

তাহলে? তিনশ টাকা?

মনির ভাই, আমার বলা নিষেধ। আমি পেয়েছি এক জায়গায়। ন্যায্য টাকা। হালাল রুজি। খোদার কসম।

ঠিক আছে। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে যদি বলতে না চাস বলিস না। আমি উকিল সাহেবকে জিজ্ঞেস করব।

সাথে সাথে জয়নালের মুখ একেবারে কাদো কাঁদো হয়ে যায়। একেবারে আমার হাত ধরে ফেলে বলল, আল্লাহর কসম লাগে আপনার মনির ভাই, উকিল সাহেবরে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। যদি করেন আমার সব টাকা নিয়ে যাবে। গরিব মানুষের টাকা। এত কষ্টের টাকা

আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, তাহলে বল কোথায় পেয়েছিস।

জয়নাল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কাউকে বলবেন না?

বলব না?

খোদার কসম?

খোদার কসম।

জয়নাল মাটি থেকে একটা কাঠি তুলে খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, আমি গরু নিয়ে নদীর পাড়ে যাই মাঝে মাঝে। নদীর ঘাটে মিনতির কাজ করে কিছু পোলাপান। একজনের নাম রশীদ।

জয়নাল পিচিক করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলে বলল, রশীদ শালার সৎ মা। বাপ রিকশা চালায়। ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। হঠাৎ দেখি নবাবের বাচ্চা একটা নতুন শার্ট আর লুঙ্গি পরে এসেছে। পকেটে চিরুণী। নদীর ঘাটে চায়ের দোকানে বসে মালাই দিয়ে চা খাচ্ছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম, টাকা কই পেলি? চুরি করেছিস? রশীদ কিরা কেটে বলল চুরি করে নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে? প্রথমে বলতে চায় না, শালারে অনেক তেল মালিশ করলাম। তখন বলল।

কি বলল?

বলল, সুতরাপুরের কাছে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক আছে, সেখানে বড় ডাক্তারের নাম নাওয়াজ খান। নাওয়াজ খান দিয়েছেন।

নাওয়াজ খান টাকা দিয়েছেন?

জে।

কেন?

জয়নাল ঠোঁট উল্টে বলল, জানি না। নাওয়াজ খান সাহেব এমনিতে ফিরিশতার মত মানুষ। রোশনাই চেহারা। গরিব পোলাপানদের খুব আদর যত্ন করেন। কেউ যদি খান সাহেবের কাছে যায় খান সাহেব সাহায্য করেন। খালি কিরা কেটে বলতে হয়। কাউরে বলা যাবে না। সেই জন্যে আপনারে বলতে চাই নাই।

কাউকে বলা যাবে না?

না।

কি বলা যাবে না?

এই যে টাকাপয়সা দেন, সাহায্য করেন–সেই কথা।

কেন?

ফিরিশতার কিসিমের মানুষ, জানাজানি করতে চান না মনে হয়।

গেলেই টাকা দেন?

জয়নাল একটু আমতা আমতা করে বলল, গেলেই সব সময় দেন না। মাঝে মাঝে দেন। কেউ বেশি কেউ কম?

কেউ বেশি কেউ কম?

জে।

কেন?

জয়নাল মাথা নেড়ে বলল, খান সাহেবের ইচ্ছা!

আমি তবু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, যার বেশি। দরকার তাকে বেশি?

জে না। সেইভাবে না।

তাহলে কিভাবে?

নাওয়াজ খান সাহেব আগে সবাইকে টিপে টুপে পরীক্ষা করেন। তারপর রক্ত পরীক্ষা করেন। এক্স-রে করেন। একটা ছোট বোতলে পেশাব করে দিতে হয়। সেই সব কিছু পরীক্ষা করেন। একটা কাগজে তারপর নাম ঠিকানা লিখেন। ক্যামেরা দিয়ে ফটো তুলেন তখন। তারপরে–

তারপরে কি?

তারপরে টাকা দেন। কেউ বেশি কেউ কম। খালি একটা শর্ত।

কি শর্ত?

যখন নাওয়াজ খান সাহেব খবর পাঠাবেন তখন যেতে হবে।

আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

জানি না। সব ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখেন মনে হয়।

তুই কি বেশি পেয়েছিস না কম?

জয়নাল দাঁত বের করে হেসে বলল, বেশি।

আমি জয়নালের কথা শুনে একটু অবাক হলাম। নানা রকম সন্দেহ হল, কিন্তু একটা ছেলের রক্ত, কফ, পেশাব পরীক্ষা করা, এক্স-রে –এর মাঝে সন্দেহ করার কি আছে? কে জানে, আসলেই নাওয়াজ খান মানুষটা হয়তো ফিরিশতার মত। মানুষের উপকার করতে চান, গরিব বাচ্চাদের সাহায্য করতে চান। বাবাকে দেখে আমার মনে হয় মন বিষিয়ে গেছে, সব মানুষকেই শুধু সন্দেহ করি।

জয়নাল মুখ কাচুমাচু করে বলল, আপনি কাউকে বলবেন না তো?

না।

খোদার কসম?

খোদার কসম।

জয়নালের মুখটা আবার তখন হাসি হাসি হয়ে গেল। পিচিক করে একবার থুতু ফেলে বলল, নাওয়াজ খান সাহেব বলেছেন, জানাজানি হয়ে গেলে আর এক পয়সাও দিবেন না।

ভয় পাস না। জানাজানি হবে না।

আমি জয়নালের মানি অর্ডার ফরম লিখে তার চিঠিটাও লিখে দিলাম। চিঠি লিখে লিখে তার ভাইবোন সবার নাম, কে কি করে, সবকিছু আমার জানা হয়ে গেছে। বাবা নেই, বড় ভাই একটা অপদার্থ, টাকাপয়সা নষ্ট করে। বার বার চিঠিতে তার মাকে সেটা সাবধান করে দেয়। ছোট একটা বোন, রওশন, স্কুলে যায়, খুব পড়াশোনার শখ। রওশনের জন্যে তার খুব মায়া। সে যেন স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে, সেটা বারবার করে লিখতে থাকে। যেহেতু সে নিজে লেখাপড়া জানে না, তার চিঠি লিখে দেয়া খুব শক্ত ব্যাপার। একটা কথাই সে বারবার বলতে থাকে। কথায় গুরুত্ব দেয়ার জন্যে মুখে। একটা কথা কয়েকবার বলা যায়। কিন্তু চিঠিতে একটা কথা কয়েকবার আবার কেমন করে লিখে? কিন্তু জয়নালের চিঠিতে সেটাই করতে হয়। তাকে বুঝিয়েও কোন লাভ হয় না। আজকে এক জাগায় লিখতে হল

.. রওশনের দিকে বিশেষ নজর দিবেন। বিশেষ নজর দিবেন। স্কুলে যেন। সময়মত যায়। পড়ালেখা যেন করে। সেই জন্য বিশেষ নজর দিবেন। পড়ালেখায় নজর দিবেন। স্কুলে যেন যায়। সেই দিকে বিশেষ নজর দিবেন। বইপুস্তক লাগিলে কিনিয়া দিবেন। টাকা পাঠাইলাম। বইপত্র কিনিবেন। বিশেষ নজর দিবেন … আমি আজকাল আর আপত্তি করি না, যাই বলে তাই লিখে দিই। চিঠি লেখা শেষ হলে তাকে পড়ে শোনাতে হয়। সে তখন খুব গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, মনির ভাই, আপনি খুব ভাল চিঠি লিখেন। একেবারে ফাস কেলাশ।

আগের পর্ব :
০১. আমার বাবা
০২. সলীল
০৩. সাহেব বাড়ি
পরের পর্ব :
০৫. গাছঘর
০৬. নাওয়াজ খান
০৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড
০৮. ওষুধ ফ্যাক্টরি
০৯. খুন
১০. বিস্ফোরণ
১১. একা একা
১২. গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক
১৩. মুখোমুখি
১৪. পুলিশ
১৫. শেষ কথা

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত