শীত এসে গেছে। আমার শ্বশুর বাড়িতে খুব তোরজোড় চলছে শীতের পিঠা বানাবে। চিতই পিঠা খেজুরের রস জ্বাল করে ভেজাবে। আমার ননদের শ্বশুর বাড়িতে ও দাওয়াত দিয়েছেন আমার শাশুড়ি। কিছুদিন আগে আমার বাবার বাড়ি থেকে ও এই বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিলো শীতের পিঠা খাওয়াবে বলে।কিন্তু আমার শ্বশুর শাশুড়ি যায়নি। যাবেই বা কেন? আমি যে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। যেখানে আমাকেই ঠিক ভাবে মেনে নেয়নি সেখানে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের দাওয়াতে আমার শাশুড়ী মা যাবে না বলে দিয়েছে। আর শ্বশুর শাশুড়ীকে রেখে আমি ও যেতে পারিনি নিহানকে নিয়ে। মা আর পিঠা তৈরি করেনি।
-নিহান?(শাশুড়ি মা)
-হ্যা মা বলো।(নিহান)
-আগামীকাল বাড়িতে মেহমান আসবে।তোর বোনের শ্বশুর বাড়ির সব লোকজনকে দাওয়াত করেছি। শীতের ভেজানো পিঠা বানাবো। তোর শ্বশুর বাড়ি বলে দিস তারা ও যেন আসে।আর তোর বউ এর ও অনেক কাজ কিন্তু সে যেন বাহানা না করে।
-না মা।মিতু তো সব কাজ করেই কাল ও করবে চিন্তা করো না তুমি। কিন্তু মা মিতু তো চিতই পিঠা ভেজানো খায় না যদি….
-এখনই বউ এর খাওয়া না খাওয়া দেখছিস? সে খায়না বলে কি আর কেউ খাবে না? ইচ্ছে হলে খাবে না হলে না খাবে।
এসব বলেই আমার শাশুড়ী মা চলে গেলেন৷ বারান্দায় ছিলাম বলে শুনতে পেয়েছি।রুমে এসে দেখি নিহান বসে আছে মাথা নিচু করে।
-তুমি আবার এসব কেন বলতে গেলে?আমি কি বলেছি আমি খাবো না।
-আমি জানি মিতু তুমি এই পিঠা খাও না।কিছু মনে করো না মিতু বাবা মা ও ঠিক একদিন সব বুঝবে।একটু রাগ তো তাই হয়তো এমন করছে।
-আরে জানি আমি বাবা মা অনেক ভালো। এখন রেগে আছে ঠিকই একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।বাদ দাও তো।
-মা তো বললো তোমাদের বাড়িতে দাওয়াত দিতে।আমি দিলে কি আসবে তারা?
-আমি জানি না। বলে দেখো। মায়ের কাছে ফোন দিলো নিহান..
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আম্মা।
-আম্মা মা তো কাল আপনাদের আসতে বললো। কি যেন চিতই পিঠা ভেজাবে বললো।
-আসবেন না?
-আচ্ছা ঠিক আছে। কি হয়েছে মা কি বললো?
-তেমন কিছু না।আসবে না কেউ।আসবেই বা কেন? মেয়ের জামাই বলেছে। আমার বাবা মায়ের তো উচিৎ ছিলো বলার।
-বাদ দাও।হয়তো এমনি আসবে না।
নিহান বাইরে চলে গেলো। ভালবাসার বিয়ে আমাদের।এক প্রকার জোর করেই বিয়ে করেছে নিহান আমাকে। নিহানের বাবা মা কে বাধ্য করেছে এই বিয়েতে রাজী হতে।আমার পরিবার চেয়েছিলো এখানে বিয়ে না হোক। কিন্তু নিহানের পাগলামোর কাছে হার মেনেছে আমার বাবা মা।কিন্তু নিহানের পরিবার এতোটুকু ও অপমান করছে ছাড়েনি আমার বাবা মা কে।তবুও মেয়ের শ্বশুর শাশুড়ী বলে আমার বাবা মা সহ্য করে গেছে।আর সবসময়ই দাওয়াত করে আমার বাবা মা।যতটা সাধ্য আপ্যায়ন করতে চায়। কিন্তু বারবারই অপমান হয়। কাল ও হয়তো ব্যতিক্রম হতো না।তাই আসবে না হয়তো আমার বাবা মা।না আসাটাই ভালো কোন মেয়ে চায় নিজের চোখের সামনে বাবা মায়ের অপমান দেখতে।নিজেরটা না-হয় মেনে নেওয়া যায় কিন্তু বাবা মায়ের অপমান মেনে নেওয়া যায় না।নিহানদের পরিবার যে অনেক উচ্চবিত্ত। নিহানের বাবা মা কে খারাপ বলবো না।হয়তো তারা রাগে থেকেই এমন করে। পৃথীবির কোনো বাবা মা খারাপ না। তাদের ও হয়তো কষ্ট লেগেছে তাই এমন করে। কিন্তু একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ্।
সকাল থেকেই সব কিছু তৈরি হচ্ছে।নানান রকমের রান্না বান্না। ননদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলো বলে।তা ও প্রায় ১০-১৫ জনের মতো আসবে।মোটামুটি সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। নিহান সব বাজার করে দিয়ে সেই কখন গেলো এখনো আসেনি।
আমার ননদের শ্বশুর বাড়ির সবাই এসেছিলো। ননদের বরের মামার বাড়ির ফুপির বাড়ির খালার বাড়ির সবাই এসেছিলো।খুব ভালোভাবেই তাদের আপ্যায়ন করে দিলাম এখন একটু শান্তি লাগছে। আমার শাশুড়ি ও অনেক খুশি। সব বাবা মা চায় তার সন্তানের সুখ দেখতে। সন্ধ্যা হয়ে এলো নিহান এখনো আসছে না।একটু পরেই মাগরিবের আযান দিবে।এসব ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। শাশুড়ি মা হয়তো রেষ্ট নিচ্ছে আমিই যাই। কলিংবেল খুলতেই দেখি নিহান দাঁড়িয়ে আছে দু’হাতে ২ টা হাড়ি নিয়ে।
-কি ব্যপার সারাদিন কই ছিলে আর হাতে এসব কি?
-আগে তো ভিতরে যেতে দাও।
-হ্যা আসো। ভিতরে গিয়েই নিহান একটা বাটিতে করে রসবোড়া পিঠা নিয়ে এলো।
-এই নাও তোমার পছন্দের রসবোড়া।চিতই পিঠা ভেজানো যে খাবে না সেটা তো জানি।
-কিন্তু এই পিঠা তুমি কোথায় পেলে?
-আগে হা করো পরে বলছি।
নিহান জোর করেই এক প্রকার খাইয়ে দিলো আমাকে। সাথে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। কিরে মা পিঠা পেয়ে অবাক হয়েছিস তো? সেই ছোট বেলা থেকে সবাই চিতই পিঠা ভেজানো খেতে চাইলে ও তোকে আলাদা করে রসবোড়া পিঠা বানিয়ে দিতে হতো। সেদিন যখন তোর শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত দিলাম তারা তো আসলো না। আমি সব যোগার করে রেখেছিলাম।তোর শ্বশুর শাশুড়ি তো আসলো না।হয়তো তোর এই গরিব বাবা মায়ের বাড়িতে আসবে না তারা।কিন্তু আমাদের এই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ও যতোটা সম্ভব চেষ্টা করতাম তাদের আপ্যায়ন করতে। তোর জন্য রসবোড়া ও বানাতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু কাল যখন জামাই ফোন দিয়ে বললো ভেজানো পিঠা বানাবে তোর শ্বশুর বাড়িতে তখন থেকেই তোর বাবার একটাই চিন্তা তার মেয়ে তো এই পিঠা খাবে না। আর তোর শ্বশুর বাড়ির কেউ হয়তো জানে ও না তুই এই পিঠা খেতে পারিস না।তারাতাড়ি করে রসবোড়া পিঠা বানিয়ে তোকে দিতে বললো। সবাই খাবে আর আমার মেয়ে চেয়ে থাকবে সেটা তো হবে না। তাই তো পিঠা বানিয়ে জামাই কে খাইয়েও দিলাম আর দিয়ে ও দিলাম।তোর শ্বশুর শাশুড়ি সবাই কে নিয়ে খেয়ে নিস। ভালো থাকিসরে মা। তোর এই গরিব মা বাবা যতদিন বেচে আছে সাধ্যমত চেষ্টা করবে তোর আবদার পূরন করার। মনে কখনো কষ্ট নিস না।
-তোর বাবা মা চিঠিটা পরে চোখের কোনের অশ্রু আর কিছুতেই বাধ মানছে না। সব বাবা মা কেন এমন হয়? তারা কি করে বুঝতে পারে? এখনো শুধু সন্তানের কথাই চিন্তা করে যায় বাবা মা।হয়তো নিজে না খেয়েই সব আমার জন্য আর এই পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়ের কথা ভেবে।মেয়ের খুশির কথা ভেবে। সত্যি এমন বাবা মায়ের ঘরে জন্ম নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি আমি। বাড়ি গাড়ি টাকায় যা দিতে না পারে।আমাদের বাবা মায়ের ভালবাসা তার থেকে অনেক অনেক গুন বেশি কিছু দিয়ে যায় আমাদের জীবনে।