ডিভোর্স পেপার

ডিভোর্স পেপার

ডিভোর্সের কাগজে নিজের নামটা লিখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।হাতটা অসম্ভব রকমের কাপছিলো। মাত্র একটা সাক্ষর, তিন বছরের সম্পর্কে ভেঙে চুরমার করে দিলো। শুনেছি কলমের শক্তি নাকি বড় শক্তি। বড় শক্তিই বটে, তা না হলে এক হাজার ভাগের একভাগ কালি দিয়ে নামটা লিখতেই সব সম্পর্ক নষ্ট হতো না। সাক্ষরটা শুধু দুই দাম্পত্যজীবনই ভেঙে দেয় না, ভেঙে দেয় দুই পরিবারের মাঝে গড়ে উঠা অটুট বাঁধনটাও। যে পরিবারে একটু খানি সুখের আশায় যাওয়া সে পরিবারটাকে নিয়ে যায় অনেক দুরে। কলমের শক্তি বড় শক্তি, চাইলেই কাউকে এক করে দিতে পারে। আবার চাইলেই দুরে সরে দিতে পারে।

যেদিন প্রথম পিয়ন এসে হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। সেইদিন আমি আর আমার মাঝে ছিলাম না। কাঁদার শক্তি হারিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো দেহে কী আসলে প্রান নামক বস্তুটা সত্যিই আছে? নাকি ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে অনেকটা দুরে। নিজের অজান্তেই দুইফোটা লবনাক্ত পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল হাতের কাগজটার উপর। কথায় আছে না, “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর?”আমিও পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।

বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল। কিন্তু মনের মত কি আসলেই ছিল? হয়তো ছিল না, যদি মনের সাথে মন মিলতো তবে এই দিনটা দেখতে হতো না। বিয়ের প্রথম রাত, যাকে সবাই বাসর ঘর নামেই চিনে। সে রাত নিয়ে একটা মেয়ের কল্পনা যল্পনার শেষ থাকে না। থাকে অনেক স্বপ্ন। আমিও মেয়ে, আমিও অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু প্রথম রাতেই যখন কিশোর পরিস্কার ভাবে বলে দিলো, ” দেখ, বিয়ে হয়েছে বলে এই না যে সব কিছু তে অধিকার খাটাবে।

কথাটা শুনে এত দিনের স্বপ্ন গুলো নিমিষেই ডানা মেলে চলে গিয়েছিল, অনেক দুরে। ওকে নিয়ে আমার স্বপ্নের শেষ ছিল না। কারণ, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই শুনে এসেছি, আমার খালাতো ভাই মানে কিশোরের সাথেই আমার বিয়ে হবে। যখন শুনলাম তখন থেকেই তাকে ঘিরেই আমার সব ভালোবাসা সব ভালো লাগা। আমি সুন্দর বটে, সুন্দর হওয়ার সুবাদে ছেলেদের লম্বা লাইন কখনও খাটো হয়নি। কিন্তু কখন মনে হয়নি আমারও ভালোবাসা দরকার। কারণ আমার জন্য তো একজন অাছেই। জমিয়ে রেখেছিলাম সব টুকু ভালোবাসা তাকে দিবো বলে। কিন্তু হলো না, সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না, আমারও হয়নি।

বিয়ের এক বছর যেতে কি না যেতেই শুরু হলো শারীরিক নির্যাতন। একসময় আমার লম্বা চুল ওর মন কাড়তো, এখন সেটাই নাকি অসহ্যের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।শ্বশুর বাড়ি থেকেও উঠতো নানান কথা। প্রতিবাদ করতে পারিনি। আসলে আমি চাইনি এর প্রতিবাদ করি। চেয়েছিলাম সব কিছু ঠিক হয়ে যাক।

একদিন শুনলাম তানিয়া নামের এক মেয়ের সাথে ওর ভালোবাসা। কথাটা শুনে আমার কান্না পায় না বলো? দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলাম। সে আমাকে রেখে অন্য কারও সাথে প্রেম করছে সেটা আমার সইত না। আসলেই কি সহ্য করার মত? প্রেমিকের ভাগ না হয় দেওয়া যায়, কিন্তু স্বামীর ভাগ কিভাবে দিবো?

ওদের প্রেমের আলাপ শুনলে মাঝে মাঝে কাঁদতাম, আবার মাঝে মাঝে হাসতাম। ওদের দিস্তা দিস্তা চিঠি পড়ে থাকতো ড্রয়ারে। যে ভালোবাসা পাবো বলে এতটা বছর ওর পথ চেয়ে ছিলাম আজ কি না সে ভালোবাসাতে আমার একটুও ভাগ নেই? বরং সেটা অন্য কারও?

যে বাড়িটাকে স্বপ্নের মত মনে হতো। সে বাড়িটাই দিন দিন নরক হয়ে উঠছিল। একদিকে কিশোরের অন্য দিকে ওর পরিবার। আমিও তো মানুষ নাকি? হ্যাঁ আমি মেয়ে, মেয়েদের সইতে হয়। তাই বলে এতটা! আমি যে তারপরও তো মানুষ। একজন মানুষ আমার কতটা সহ্য করবার ক্ষমতা থাকে? যখন জানতে পারলাম এ বাড়িতে আমার জন্য এতটুকু ভালোবাসা নেই তখন সে বাড়িতে থাকি কি করে বলেন তো? আমাকে একা যেতে হয়নি বাবার বাড়ি। কিশোরই পাঠিয়েছিল। ভাবিনি সেটাই ছিল শেষ বার।

আমি নারী, হাল ছাড়িনি। ৭দিন পর আমাদের ৩য় বিবাহ বার্ষিকী। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদেরও সংসার হবে। ছোট্ট ঘরটা ভরে উঠবে কানায় কানায়। কিন্তু সব ভাবনা কে মিথ্যা করে দিলো পিয়নের হাত থেকে নেওয়া খামটা। খুব সাধারণ একটা খাম, সাদা মলাটে ঢাকা। কিন্তু ভেতরে যে এমন কিছু থাকতে পারে যা তিন বছরের সম্পর্কে এক নিমিষেই নষ্ট করে দিতে পারে, সেটা আবার ভাবনার অতীত।

কিশোর নিজের নামটা আগেই কাগজে লিখে দিয়েছে। পরিশোধ করেছে দেনমোহর। এবার আমার পালা।বাবা মা কি বলবে? বলার মুখ আছে কি? দোষও তো দেওয়া যায় না। ভেবেছিল আমি সেখানেই ভালো থাকবো। কিন্তু চাইলেই কি ভালো থাকা যায়? কপালে লেখা থাকা লাগে। কাঁপাকাঁপা হাতে নিজের নামটা লিখেছিলাম পেপারে। কতক্ষণ আর চোখের পানি ধরে রাখা যায়? পারিনি ধরে রাখতে, মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। মা ও হয়তো কেঁদেছিল মুখ লুকিয়ে।

আর কি? সব শেষ। এখন আমি আমার মত সে তার মত। ভালো আছে ভালোলাগার মানুষটাকে নিয়ে। সে তো ভালো আছে। এবার আমাকেও ভালো থাকতে হবে। জীবনের অনেকটা পথ এখনও যে বাকী রয়ে গেল। কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই যায়। সব দোষ কেন আমার হবে? সব কষ্ট কেন আমার হবে? আমাকেই কেন শুধু গুমড়ে কাঁদতে হবে? আমি মেয়ে এটাই কী আমার দোষ?

কেন ওর দোষ থাকতে পারে না? ওকে সবাই দোষী বানাতে পারে না? আমাকেই কেন একা কাঁদতে হয় মুখ লুকিয়ে সে কেন কাঁদতে পারে না। তিনটা বছর তো কাটিয়েছে আমার বুকে। তারও তো একটি কাঁদা উচিত। রাস্তার কুকুর যদি একটু পিছু পিছু চলে তবে সে কুকুরের প্রতি মায়া জন্মে যায়, আমি তো মানুষ। তিনটা বছর কাটিয়েছে আমার সাথে। এতটুকুও মায়া জন্মেনি? ভালোবাসার কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্তত একটু মায়া? আর সে মায়ার জন্যও তো একটু চোখটা ভিজে উঠা উচিত। আমি মেয়ে বলেই কি সব দ্বায় আমার? সবটুকু খারাপ লাগা আমারই প্রাপ্য? উত্তর জানা নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত