৩০. মাথাব্যথা আর নেই
মাধবীলতা আমার ছোটবেলাকার বান্ধবী। লতা আর আমি ছোটবেলায় এক সঙ্গে বহু বিচিত্র এবং ভীতিকর সব অভিজ্ঞতা কুড়োনো দুই মেয়ে, যার মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ-গোপন অপরাধ …। এরকম অভিজ্ঞতা গ্রামের মেয়েদের জীবনে স্বাভাবিক হলেও এসব ঘটনা অজানাই থেকে যায়। তার কারণ মেয়েদের জন্যে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা জানানোর ভাষা কখনোই হয়তো সৃষ্টি হবে না। তা সত্ত্বেও দু’একজন এর ব্যতিক্রম যে নয়, সেকথাও বলা যাবে না। মন্দিরের পেছনে। গোয়ালে। গ্রাম, শহরের অলিগলি। বেড়ার পেছনের ঘুপচি। পায়খানা। দেয়ালের ভেতরে। পরিত্যক্ত-বাসা। তিন বাড়ির মধ্যখানের লম্বা সুড়ঙ্গ হয় অপরাধের অলি-গলি। যেখানে জড়ো হয় পরিচিত অপরিচিত। আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্করা, পর্নো দেখতে, পর্নো খেলতে। অপরাধ যার মূল পরিচয়। অপরাধ যা –ওপেন সিক্রেট।
আমাদের দু’জনেরই ভিন্ন দুই চরিত্র, দু’রকম স্বভাব। দু’জনের বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে এতো দ্রুত কাছে টেনেছিল। যেন অনিবার্য চুম্বক।
অনেকেরই মুখে শোনা, ছোটবেলায় আমি ছিলাম ডানপিটে এবং অস্থির স্বভাবের। মা আমাকে শেখাতেন কাপড় ভাঁজ করা, রান্নার মশলা দেয়া। কার পরে কোনটা। মা বলতেন মেয়ে হতে, স্থির হতে। কিন্তু নারীর চিরাচরিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত আমি, মা যা বলেন শুনি। কিন্তু কি শুনি, মনে রাখি না।
মাধবীলতা আমার ঠিক উল্টো। স্থির এবং শান্ত। বিষণ্ণ চেহারা জুড়ে সুন্দর দুটো চোখ। চিবুকে বড় তিল। প্রতিমার মতো মুখে সুন্দরের অলঙ্কারে ভিড় না বাড়ালেও, বা গালে একটা রক্তজমাট দাগ। সব মিলিয়ে-মিশিয়ে মাধবীলতা আমার চোখেই শুধু নয় বরং শহরের সবার চোখেই পরমা সুন্দরী। ঘরে সত্য, বাইরে ভয়ানক নিষ্ঠুর পৃথিবী, দুটোই বিপজ্জনক। বন্ধুত্বের পাশাপাশি তাই মাধবীলতার ওপর থাকতো আমার অভিভাবকসুলভ দৃষ্টির ছায়া।
লতাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির ডান পাশেরটা। দুই বাড়ির মাঝখানে কুল আর কদম গাছ। দীননাথ কাকার মনোহারী দোকানটা বাম দিকে। দোকানে অনেক কিছুর সাথে কাঠি লজেন্স পাওয়া যেতো। লাল-নীল-কমলা …। বাবা ছিলেন হাড় কিপটে বড়লোক। কাকা, বাকিতে বিশ্বাস করতেন না। বাকির নাম ফাঁকি, কাকার কথা। লজেন্সের দাম না দিতে পারলেও খেতে দিয়ে বিনিময়ে, লতা আর আমাকে যে প্রস্তাব দিয়ে বসততা, তা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। কাকার খুজলি ভরা পাছা চুলকে দিয়ে লজেন্স খাওয়ার মতো রুচি, আমাদের ছিল না। গ্রামের কাকা-জেঠাদের মধ্যে ছোটদের দিয়ে শরীরী কসরত করানোর এই প্রবণতা, ওপেন সিক্রেট।
মেয়েদের জামার মাপ দেয়া খুব বড় ধরনের একটা সমস্যা। খলিফাঁদের ফিতে বালিকাদের বুকের কাছে এসে আর নড়তে চাইতো না। সরতো না। ফিতে আর আঙুল, আমাদের সুপুরি বুকের আশপাশে ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির মতো স্থির হয়ে বসে থাকতো। পাখিটা নড়েচড়ে উঠলে, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেপেও যেতাম, ভয়ে। পোশাক তৈরি করতে গিয়ে, এমন অভিজ্ঞতা, প্রচুর। এ শুধু লতা আর আমার নয়। এ অভিজ্ঞতা অনেকের।
গ্রামে থাকলেও, সাধারণ গৃহস্থ ঘরের বৌ এক রক্ষণশীল স্বামীর স্ত্রী আমার, মা। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মনের মানুষ। দিনের ঝামেলাশেষে, বিকেল হতেই দুয়ারে বসতেন পান পাতা-জর্দা আর তাল পাখা নিয়ে। পাড়ার সধবা-বিধবা ওরাও সবাই আসতো। বসতো গল্পের বৈঠক। অকাল বৃদ্ধ রুনি মাসির স্বামী কি অসুখে মারা গ্যাছে, সে নিয়ে একদিন লাগলো তুমুল ঝগড়া। মাসি বলতে জ্বর। অন্যরা বলতো অন্য কিছু। বলতো, ভদ্রলোক মেথর পট্টির কাছের পতিতালয় থেকে জননেন্দ্রিয়ে গোলগোল চাকা চাকা ঘা নিয়ে এসেছে। যেখান থেকে রক্ত-পুঁজ এসব ঝরে। এক অজ্ঞাত কারণে পালিয়ে যাওয়া মাসির পুরোনো ঠোঁটকাটা এক প্রতিবাদী কাজের মেয়ে বুড়ি নাকি সেই কথা গ্রামসুদ্ধ সবাইকে ইচ্ছে করে রটিয়ে বেড়াচ্ছে। মাসি ওকে কিছু দিয়েই থামাতে পারছে না। অন্যদের তোপের মুখে টিকতে না পেরে মাসি কাঁদতে শুরু করলো। আমি আর লতা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব গল্প শুনি। নীলু মাসি বারোটি সন্তানের পর না পেরে নিজেই স্বামীকে পতিতালয়ে পাঠিয়ে শারীরিক অত্যাচার থেকে বেঁচেছে। রচনা মাসি, এক নিশ্বাসে বলে যায়, বারো বছর তার স্বামী তার বিছানায় ঘুমোয় না। ঝগড়াটে একশ বছরের বুড়ি পিসি, প্রতিদিন এক কথা বলে। বিধবা মালতীর দশবার গর্ভপাতের কথা। পিসিমা মাকে কলিকাল শেষ হয়ে এসেছে বলে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়। পিসি নিজেও বিধবা হয় পঁচিশ বছর বয়সে। মার কাছে শুনেছি, বিয়ের সময় পিসে মশায়ের বয়স ছিল ষাট। পিসিমা বিধবা হলে, কটা গর্ভপাত তিনি নিজে করিয়েছেন একথা অন্য কেউ নয়, আশ্চর্য এই যে, বয়সের ভারে মেয়েদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হারানো-পুরুষ পুরুষ চেহারার পিসি নিজের মুখেই হাসতে হাসতে অবলীলায় সবার সামনে বলে যান।
টুলি মাসিকে দেখে আমার খুব কষ্ট লাগতো। এত অল্প বয়সে, নারীত্বের ভরাট সব চিহ্ন শরীরে বয়ে, চুল কেটে, সাদা শাড়ি পরে, মাংস খাওয়া ছেড়ে কাম-রতি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে তার সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! মাসির দিকে তাকাই আমি অন্য দৃষ্টিতে। কারণ বিদ্যাসাগর বা রাজা রামমোহন রায় তখন আমার পড়া হয়ে গেছে। এবং ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জীবনের সঙ্গে আমি এভাবেই পরিচিত হতে থাকি। হঠাৎ হঠাৎ মাকে অদ্ভুত প্রশ্ন করলে মা বলেন, তুমি বুঝবা না। মনে মনে বলি, আমি কি বুঝি আর কি জানি, মা কেন কেউই সে খবর জানে না। কারণ আমি সেসব কথা। কাউকে কখনো বলি না। বলার ভাষাও জানি না। আমি জানি, অনেকেই যা জানে না। আমি জানি অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন বাড়ির মধ্যখানে দখিনের চাপা গলির ভেতরে গ্রামের বালিকাদের অন্যরকম এক গোপন জীবনের কথা। যে জীবনে, ওদের সাথে নিয়মিত দেখা হয় কামুক বিশেষ করে, মধ্য বয়সের সব মামা, কাকা, দাদা, চাচাঁদের সঙ্গে। যেখানে কেউ কারো আত্মীয় সত্ত্বেও আত্মীয় নয়। পরিচিত সত্ত্বেও অপরিচিত। এক নীল রঙের জীবন।
আমার কষ্ট হতো দীনু কাকিকে দেখলে। কাকি প্রতিদিন একবার করে মার কাছে আসতো। মার সঙ্গে বসে পান পাতা খেতে খেতে কাকার চরিত্রের নিয়মিত দোষগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে প্রতিদিন সে একই স্বস্তি খুঁজতো। কাকার এই দোষ; কাকার সেই দোষ কিন্তু নতুন কিছু নয়। পুরোনো অভিযোগ নতুন ভাষায়। ছোটবেলায়, কাকিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম টকটকে সুন্দরী এক যুবতী। অথচ চোখের সামনে কি দ্রুত সে বুড়িয়ে গেল! কপালের চামড়ায় রুলটানা ভজ, চোখের তলে কালি। এ যেন অন্য এক কাকি। অকালে বুড়িয়ে যাওয়া কাকির শরীরে তখনো ঋতু হয়। শরীরে কামনা হয়; মনে অনুভূতি হয়। মাকে, কাকি গোপনে সেসব কথা বলে। বলে ছয়জন সন্তান-শেষে কাকা, কাকিকে আর স্পর্শ করেনি। মা, কাকিকে বুঝিয়ে বলেন, কুথাও তোর যাওনের। জায়গা নাই। মালতীর মায়েরে তুই তাড়াতাড়ি কৌশলে বিদায় কর। কাকি বলে, দীনু কইছে, তাইলে সেও বাড়ি ছাইরা চইল্যা যাবো। মালতীর মা, বাড়ির কাজের মেয়েলোক। আমার কানে বাজে অন্ধকার গলিতে সেদিন রাতে ফিসফিস গলায় মানুষের আওয়াজ। সেই গলিতে সেই অন্ধকার রাতে আমি আর লতা কাকে দেখেছিলাম। কি দৃশ্য দেখেছিলাম সে কথা কাউকে বলিনি এমনকি কাকিকেও না। মালতীর মায়ের শরীরের ওপরে দীনু কাকার অর্ধ উলঙ্গ শরীর।
গ্রামের অলিগলি। এক ভিন্ন জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত জায়গা। এখানে আসে সময়ের বিভিন্ন প্রহরে ভিন্ন রকমের রকমারি মানুষগুলো। এখানে সবাই সবাইকে জানে, চেনে। জেনেশুনেও একজন আরেকজনকে না চেনার ভান করে। এখানে এসে তখন ওরা চাচা, দাদা, নানা, খালাত ভাই সম্পর্ক ভুলে যায়। এখানে সবাই কামার্ত জানোয়ার। এখানে। সবার শরীর থেকে বেরোয় কামের গন্ধ। চামড়ার গন্ধ। কে মামা, কে ভাই। এখানে সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক, দুটি মাত্র প্রত্যঙ্গ আর সেই সঙ্গে অধরোষ্ট, দাড়িম্ব আর কবি বর্ণিত অনন্ত রূপসুধা পান ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ্রামে, বালিকাদের ঋতু এবং বালকদের কণ্ঠস্বর ভাঙার আগেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ওরা ছোটবেলা থেকেই অভিভাবকহীন জীবনে অভ্যস্ত বলে নিষিদ্ধ পথঘাটগুলো দ্রুত চিনে ফেলে। এভাবেই ওরা, অকাল পক্ক। এবং প্রায় বাড়ির পেছনের অব্যবহৃত আনাচে-কানাচে, গুদাম ঘরে, চিলেকোঠায়, অন্ধকারের একটা নির্দিষ্ট প্রহরে অনেকেই এসে জমা হয়। শরীরের সঙ্গে শরীরের অনুসন্ধান করে জানতে ও জানাতে তাদের কচি শরীরের অনুভূতি। কার কেমন প্রতিক্রিয়া। বালিকাগুলো উদোম করে দেয় তাদের সুপুরি স্তন। বালকেরা সেখানে নানা রকম কসরত করে। অনভিজ্ঞ বালকগুলো নোনতা জল ফেলে বালিকাদের মুখে। মধ্য বয়সের মামা, তালতো ভাই সম্পর্কের পুরুষগুলো যায় শরীরের আরো গভীরে। বিনিময়ে পয়সা, যথেষ্ট লজেন্স, চানাচুর এবং চিনেবাদাম, গলির মধ্যেই মেলে। অন্যের শারীরিক অনুসন্ধান দেখতে দেখতে বিকৃত রুচির একটা অভিজ্ঞতা খানিকটা তারা এখানেই অর্জন করে। মেয়ে-মেয়ে, ছেলে-ছেলেদের মধ্যেও অদ্ভুত মিলন এইসব চোরাগলিতেই সম্পন্ন হয়। অশিক্ষিত, আধুনিক, গ্রাম্য বা শহুরে জীবনের এই মানচিত্র, ছোটবেলায় অনেকেরই স্মৃতিতে চেনা পরিচিত বলেই মনে হবে।
রুমকিকে ওর মা গ্রাম থেকে আসা সত্তর বছর বয়সী চাচার সঙ্গে যাত্রা দেখতে পাঠাল। ফিরে এসে দেখে চাচা নেই। কিন্তু রুমকির সাদা হাফ প্যান্ট রক্তে লাল হয়ে গ্যাছে। এ নিয়ে রুমকির মা হৈ-হুঁল্লোড়ের তাগিদ অনুভব করেনি। কারণ এখানে ঘরের পুরুষের মান-সম্মান জড়িত।
বড়দের ধারণা ছোটদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই, কারণ ওরা ছোট। বড়দের ধারণা যে ছোটরা ঠিক বোঝে না, ওরা কি বলে। ছোটবেলায় জেনেছি, ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই। তাই বড়দের নষ্ট গল্প আমি আর লতা স্বেচ্ছায় চেপে যাই। কমল মামা আর কবিতার নষ্ট গল্প আমি জানি। কমল মামার কাছে কবিতাকে গছিয়ে দিয়ে কবিতার মা গীতা পাঠের আসর শুরু করলে সেই থেকে ওর যে অভিজ্ঞতার শুরু হলো, মামা চলে গেলে স্কুল কেটে নেশাগ্রস্তের মতো কবিতা, অলিগলিতে কিছু খুঁজে বেড়াতো। ক’মাস যেতেই, ওর মা গোপনে দু’-দু’বার গর্ভপাতশেষে ওকে, কোনওরকমে এক খোঁড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাঁচলো।
এক পাষণ্ড বাবা গলির অন্ধকারে, পেছন থেকে জাপটে ধরলো নিজের মেয়েকে। চিনতে পেরে ধরেই ছেড়ে দিলো। কিন্তু পরনের লুঙ্গিটা তখন মাটিতে। ঘরে ফিরে লোকটা আত্মহত্যা করলো।
আমি পড়ালেখা করি ক্লাসে ফার্স্ট হতে। তার মানে এই নয় যে এত দেখাদেখির পর একটা অস্থিরতা আমার মধ্যেও কাজ করে না। তবে আমি এও জানি যে, লতার মধ্যে সেই অস্থিরতা কাজ করে আমার চেয়ে বেশি। পড়া রেখে দীনু কাকার আলমারি থেকে চুরি করে আনা নরনারী, পড়ার বইয়ের পেটে ঢুকিয়ে লতা সেই ছবি দেখে হাসিতে ভেঙে পড়ে। আমি অপেক্ষা করি পড়া শেষ হওয়া অবধি। আর শেষ হতেই আমরা যাই, যেখানে জায়গাগুলো, চেনা। মানুষগুলো তার থেকেও বেশি। তোফা ভাই, মইনুল কাকা, অমলদা, নির্মল মাস্টার–। পাশাপাশি মন্টু-বিলি, উত্তম, মঈন সঙ্গে বিজলী, কবিতা, গৌরী, লিলি …। ভয়ে আমাদের গা কাঁপে। দূরে দাঁড়িয়ে আমি আর লতা এক অলৌকিক পুলকে কষ্ট পাই। কাকার দুই চোখ আমাকে ফেরায় সেই ভিড়ের আমন্ত্রণ এবং লোভ থেকে। কিন্তু কষ্ট কেউ ফেরাতে পারে না। আমি কষ্ট পাই, লতাও পায়। দু’জনেই বলি, দু’জনেই জানি। তবুও যেন না জানার একটা আদিখ্যেতা গোপনেই বয়ে বয়ে যাই।
ক্লাস সিক্সের পরীক্ষায় লতা দুই সাবজেক্টে ফেল করে বসলো। সৎ মা অকারণে ওর স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে, পাড়ায় জানিয়ে দিলো–অর মাথায় খালি গুবর আছে। লতার মাথায় যে শুধু গোবর আছে সৎ মা না বললেও আমি জানি। এবং কেন আছে সৎ মা না জানালেও আমি জানি। জন্মেই মা মরা এই মেয়েটি, জন্ম থেকেই অযত্ন আর। অবহেলায় আগাছার মতোই বড় হয়েছে। সুতরাং ওর মাথায় গোবর না থাকাই অস্বাভাবিক। লতার স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে প্রথম প্রথম আমারই কষ্ট হতো বেশি। কারণ গোবর মাথার লতা আমার প্রতিটি অবসর মুহূর্তের সঙ্গী।
মাধবীলতার সঙ্গে এই আচমকা বিচ্ছেদ, আমাকে নড়িয়ে দেয়। হৃদয়ে একটা ব্যথা প্রথম অনুভব করি যা আগে কখনো করিনি। এবং বুঝতে পারি পরবর্তীকালে আমার অনুভূতিগুলোর কুঁড়ি এখান থেকেই জন্ম নেয়। প্রথম, মাধবীলতাকে ঘিরে পরে জীবনে চলার পথে অন্য অনেককে ঘিরে। হৃদয়ের সেই প্রতিনিয়ত প্রেম ও ভালোবাসার ঘূর্ণি, এই সর্বনেশে সঙ্কট থেকে মুক্তি, মাধবীলতা পেলেও, জীবনে আমি কখনোই পেলাম না।
এভাবে কেটে গেল আরো দু’বছর। আমারও পড়ালেখার চাপ বেড়ে যায়। ক্লাস এইটে বৃত্তি দিতে হবে। সেন্টার পড়েছে, জেলা শহর ময়মনসিংহে। প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে। বাসে, নৌকোয় ব্রহ্মপুত্রের ওপারে যেতে লাগবে প্রায় ঘণ্টা দশেক। এদিকে লতার বিয়ের জন্যে ওকে দেখতে ছেলের অভিভাবকেরা আসতে শুরু করে। এর মধ্যে দুইজনের বন্ধুত্ব আরেক ধাপ শিথিল হলো। আমি ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে লতাও দূরে সরে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ এসে চুপ করে আমার পড়ার বইগুলো দেখে। আমি না বললে, সেও কোনও কথা না বলে চলে যায়। একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে স্পষ্ট। কিন্তু আমি নিরুপায়। তার কিছু দিন পর। বেকার লতা একটা কাজ পেল। গুড় ভাঁজ করার কাজ। কাজটি ওকে দিলো দীনু কাকা।
মার মহিলা সমিতির আসরে অমনোযোগী স্বামীদের অবহেলিত বৌগুলোর সদস্য সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অকাল বিধবা টুলি মাসি তার কাম-রতি পুরোপুরি নিবৃত্ত করতে এবার মাছ খাওয়া ছেড়েছে। কিন্তু সদানন্দকে সে ছাড়তে পারেনি। প্রতিরাতেই সদানন্দ আসে গলির পেছনে, আর লোক দেখানোর জন্যে চুল আরো কেটে, রঙিনের বদলে সাদা শাড়ি ধরেছে। অনেকগুলো শিবলিঙ্গ কিনে সে তার শোবার ঘরের পাশে ছোট মন্দিরটুকু ভরে ফেলেছে। মহিলাদের আসরে বসে মাসি নিয়মিত দাবি করে বলতো, মাঝ রাতে তার শিবলিঙ্গ দেবতার রূপ ধারণ করে। সে নিজ হাতে শিবকে খেতে দেয়। অনেকরকম জটিল চিন্তার মানুষ আমি কাউকেই বললাম না গভীর রাতে যখন সবাই ঘুম, আমি তখন পড়ার ফাঁকে জানালা দিয়ে টুলি মাসির ঘরে তাকিয়ে কি দেখেছিলাম। সদানন্দ কাকা কাকিকে বারবার জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে চলছে তো চলছেই। ওদের এরকম আদর দেখে প্রথম বুঝেছিলাম বিদ্যাসাগর আর রামমোহন রায়ের কথা। বুঝেছিলাম আমার সধবা মায়ের মতোই, বিধবার হৃদয়েও যে প্রেম আছে, থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাম আর রতি আছে। একমাত্র আমি বাদে সবাই অবাক হয়ে মাসির দেবতার গল্প শোনে।
দীননাথ কাকি, একজন চির অসুখী। যার না জীবন, না যৌবন কোনওটাই সুখের হলো। তার অভিযোগ একগুণ থেকে লাফ দিয়ে তিনগুণ হলো লতাকে যেদিন কাকা গুড় ভাজ করার কাজটা দিয়ে দিল। এই কাজটা কাকিই করতো। করে হাতে কিছু পয়সা পেতো। কাকি এ নিয়ে অভিযোগ করলেই কাকা বলে, বাড়ি ছাইরা যাও। মা বলেন, তুই কুথায় যাবি। তর তো যাওনের কুনো জায়গা নাই। কাকির একমাত্র শান্তি, নিরন্ত কি কান্না। কাকি গানের সুরে, কাঁদে। কাকা দোকান থেকে জোরে ধমকে দিয়ে বলে, চোপ …।
মাঝখানে পেরিয়ে গেল আরো একটা বছর, ক্লাস এইটের বৃত্তি পাইনি। কিন্তু সেই থেকে যথেষ্ট পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করি। বিশেষ করে ক্লাস নাইনের ফাইনালেরও বেশ কিছু আগে থেকে তার সঙ্গে এমনকি প্রতিদিনকার নিয়মিত দেখাশোনাটিও তেমন হতো না। এদিকে তার বিয়ের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটিও স্তিমিত হয়ে আসছিল যৌতুকের কারণে। একসময় ওর সৎ মা বিয়ের প্রসঙ্গটিও ইচ্ছে করেই ভুলে গেল।
আমি ম্যাট্রিকের প্রি-টেস্টের পড়া পড়ছি। মা দুটো অতিরিক্ত মাস্টার রেখেছেন। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন চাই বলে বাবা তার আগাম রায় দিয়ে দিয়েছেন। স্কুলের হেডমাস্টার তার আশা-ভরসার লিস্টে আমার নামটা ঝুলিয়ে দিয়ে প্রতিদিন একবার করে মনে করিয়ে দেন আমাকে কোন ডিভিশন পেতে হবে। লতা এলেও তেমন আর সুযোগ পায় না কথা বলার। বসে বসে শুধু বইয়ের স্তূপ ঘাটে। কিন্তু বেশ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও যেন কি বলতে চায়। কিন্তু বলতে গিয়েও বলে না।
একদিন সৎ মার বাবা মারা যাওয়াতে সৎ মা দেশের বাড়িতে চলে গেল। সেখানে সম্পত্তি ভাগ করার কিছু ব্যাপারও আছে। লতা বাড়িতে একা। সৎ মা আসবে মাস তিনেক বাদে, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তবেই। এদিকে দীননাথ কাকি মার কাছে লতার নামে নালিশ করে নিজস্ব ভাষায় বলে যে, মেয়েটি বড় বেহায়া। কাপড়-চোপড়ের কোনও ঠিক নেই। লম্বা পা উদোম রেখে, যখন-তখন দোকানে যায়। মা জানেন লতা তেমন মেয়েই নয়। ঈর্ষা, যেহেতু ওর কাজটা লতা করছে ভেবে, মা কাকির অন্য অভিযোগগুলোর মধ্যে এই অভিযোগটিকেও উড়িয়ে দেন। মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কি কিছু দেখছস? আমি তো দেখি নাই। বললেন মা। মায়ের কথায় আমি সায় দিলেও, তার সবটুকুই মেনে নিতে পারলাম না। মা বললেন, ওইসবে কান দিয়ো না। লতা-ওইরকম মেয়েই না। কাকির মন থেকে সন্দেহ তবুও দূর হয় না।
এবার ক্লাস টেনের পড়াশোনা। প্রি-টেস্ট শেষ হয়ে টেস্ট শুরু। লতা গুড় ভাজ করছে নিয়মিতই, কিন্তু একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে আমার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ওর গলায় এক জোড়া ঠোঁটের লাল চিহ্ন মনে হয় আমি দেখেছিলাম। গলায় একজোড়া ঠোঁট যেন আকাশে চাঁদের মতো ঝুলে আছে। ওড়না দিয়ে ঢেকে লুকোতে চাইছিল কিন্তু আমার চোখ সে এত দ্রুত এড়াতে পারেনি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হলো এবং সেই থেকে ওর দিকে আমি গোপনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলাম। সৎ মা দেশে, বাবা ফেরে গভীর রাতে। রাতের অন্ধকারে ওকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য নিষ্প্রয়োজনের মতোই, কেউ তার প্রয়োজন মনে করে না। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, শুধু আমারই গোপন চোখ, ওর পায়ে পায়ে, হেঁটে বেড়ায়। গলির ভেতরে, হাঁটে। এমনকি দীননাথ কাকিও সে খবর জানে না।
আমি সেদিন পড়ছিলাম, পরীক্ষার পড়া। কার পায়ের শব্দ যেন আমারই কানে আসে। অস্থির হাঁটা, একটু অস্বাভাবিক হাঁটার শব্দ, নিশ্বাস, পালিয়ে বেড়ানো অস্বাভাবিক নিশ্বাস, দৌড়ে যায় আমারই কানের পাশ দিয়ে। পেছন পেছন আমিও গেলাম, পরিচিত সেই চাপা গলিটার ভেতরে। লতা টের পেলো না। আমি গেলাম গোপনে, পা টিপে। হার্টের ড্রামপেটানোর শব্দগুলোকে একটা একটা করে গিলে খেতে খেতে।
লতা হনহন করে দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পিঠভর্তি চুল। কুচি দেয়া গোলাপি রঙের ফ্রক, পরনে। যেন অন্ধকারে সে কিছুতেই লতা নয়। যেন শেওড়া গাছের ভূত। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি, লতা কি দ্রুত অর্ধ উলঙ্গ হলো। যেন শেখানো। যেন স্কুল থেকে শিখে এসেছে। পাজামাটা ওর হাঁটুর নিচে। দীনু কাকার বিশাল শরীর ওর শরীরের ওপরে। কাকা গা দোলাচ্ছে। আমার চোখের সামনে নরনারী পত্রিকার ছবি, ছবির বদলে লতা আর কাকা। এরকম গা দোলানোর দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। অন্যদিন কাকার সঙ্গে ছিল মালতীর মা। টুলি মাসির সঙ্গে সদানন্দ কাকা। ভোলাদা আর বেনুদি। মাসুদ, হেলাল, কাজল সঙ্গে সাথী, কচি, কবিতা। মালা আর মল্লিকা। শিশির আর হারাধন। আমি ফিরে এলাম হতবাক। বোকা। ঘামে ভেজা।
তার চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই লতার মৃত্যু সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লো। বাড়িটা ভরে গেল অযাচিত মানুষের ভিড়ে। যারা শুধুই কৌতূহল খুঁজে বেড়ায়। লোকজন কি সব নষ্ট কথা সব বলতে শুরু করলো। শুনে, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বলছে ওরা এসব! লতার পেটে বাচ্চা? আকাশে তখন মেঘ, সাথে দুর্যোগ। শুরু হলো, ঝোড়োবৃষ্টি, সঙ্গে বিজলি। দুয়ারে লতার মৃতদেহ নিয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন বেকার মাতাল। কয়েক বোতল মদ ওদের জন্য অপেক্ষা করছে শ্মশানে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ওরা মৃতদেহ সামনে রেখে মদের নেশার গল্পে ব্যস্ত। অন্যরা ব্যস্ত লতার পেটে ভ্রূণের গল্পে। ক’মাসের। কার ভ্রূণ। কোন পুরুষ এদিকে আসেনি দু’মাস! কাকে দেখা গেছে এড়িয়ে যেতে! কার মায়ের চোখের তলে কালি। কার মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের বাড়ি যায় কে? কার সংসারে হঠাৎ দাম্পত্য কলহ শুরু হলো। কে কোন ঘরে-কোথায়…।
ক’দিন পরের কথা। সেই গলিতে আমি আবার ফিরে গেলাম। একা অজানা কৌতূহলে, গলির মধ্যে পরিত্যক্ত তোশক আর কয়লা ছাড়াও সেদিন দেখেছিলাম, বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া দু’টুকরো সাবানের অবশিষ্ট। আর একটা ছোট পিচকিরির মতো।
সেদিন বুঝিনি, এসবের অর্থ। তবে এখন বুঝি। বুঝি ওর মৃত্যুর কারণ। গর্ভপাতের ভুল চেষ্টা। পিচকিরিতে সাবানের জল ভরে। যা লতার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। লতা নেই তবে দীননাথ কাকা আজো বেঁচে আছে। দোকানে বসে এখনো সে লাল-নীল কাঠি লজেন্স বিক্রি করে।
কাকার এই বৃদ্ধ বয়সে কাকির প্রতি অস্বাভাবিক রকমের মনোযোগের কারণে দীনু কাকি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়ে কিসব বলে। বুড়ো বয়সে পঙ্গু স্বামীকে টানতে হয় বলে অসুখী কাকি মাকে নিয়মিত অভিযোগ করে বলে, মরদ এহন যায় না গলির পেছনে! ক্যান যায় না? কাকি, আগের মতো আর অনুতপ্ত নয়। সে কষ্ট করে ওসব গলির পেছনে যায় না। বরং পাশের বাড়ির বৌ মরা গীতার বাবার সঙ্গে, চা খেতে খেতে ঘরের ভেতরেই দীর্ঘ সময় কাটায়। অর্ধেক পঙ্গু দেহী কাকার সেসবে কোনও মাথাব্যথা নেই।