২০. ভ্রান্তিপাশ
রিমিকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। মিতু আসছে! মিতু, উত্তীয়র স্ত্রী! সুটকেস গোছাতে গোছাতে রিমির বুক ফেটে যাচ্ছে রাগে, দুঃখে। তাহলে উত্তীয়র সঙ্গে কাটানো এই সাত সাতটি বছর? এই সাত বছর কি এক্কেবারেই জলে গেল! এই যে প্রতিদিন সকালে উঠে কাজে যাওয়ার আগে সে উত্তীয়র জন্যে ময়দা ডলে ডলে কাই থেকে হাতে বেলা রুটি আগুনে সেঁকে, তাতে একটু ঘি-মধু মাখিয়ে খেতে দিতো, এই যে ময়লা আন্ডার গার্মেন্টসগুলোকে পর্যন্ত সে সাবান দিয়ে তার দু’হাতে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দিয়েছে দিনের পর দিন এর কি কোনও মূল্যই থাকবে না। এমনকি ব্লাডপ্রেশারের বড়িগুলো পর্যন্ত নিয়মিত সে মুখে তুলে দিয়েছে। সেজন্যে এতটুকু কৃতজ্ঞতাও কী নেই? কত প্রশ্ন আজ রিমির মনে যার কোনও উত্তর, সামাজিক অর্থে তো দূরের কথা আজ যেন সবই অর্থহীন। মূল্য তো-নয়ই। পৃথিবীটাকে ওর কাছে মনে হচ্ছে এক বিরাট প্রহসন। আর মানুষগুলোকে অমানুষ। তাহলে মানুষের মনুষ্যত্ব, ধর্মবোধ, সবই কি গ্যাছে? রিমি কাঁদে তার নিজের জিনিসগুলো সুটকেসে ভরে। ভরতে ভরতে একসময় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।
মেয়ে মানুষের শরীর, যা না হলে উত্তীয় ঘরে না থেকে বেশ্যাপাড়ায় লুটাতো এই যে নিজেকে সে এত বছর ধরে অকাতরে বিলিয়ে গেল, সাত সাতটি বছর খুব কি কম কথা। সেই কৃতজ্ঞতায় ন্যূনতম সহানুভূতিও কি ওর প্রাপ্য নয়! স্রেফ হাত ঝেড়ে ফেলা! এ কি ধুলোকণা শুধু। দু’হাত দিয়ে ঝাড়ছে তো ঝাড়ছেই। যতক্ষণ না তার চিহ্ন এ-ঘর থেকে শেষ হয়ে যায়। ঝাড়ছে দেয়াল থেকে। ঝাড়ছে টেবিল থেকে। ঝাড়ছে বিছানা থেকে। রিমির পড়ে থাকা এতটুকু জিনিসও, যা সন্দেহের সামান্য চিহ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। একটি চুলের ক্লিপ হঠাত্র উত্তীয় ড্রয়ার থেকে বের করে রিমির হাতে দিয়ে বললো, সর্বনাশ! এসব তুলে নিয়ে যাও! মিতু দেখলেই ভীষণ গণ্ডগোল লেগে যাবে। আর শোন শেষ মুহূর্তে সব। চেক করে নাও, যা যা আছে। লাস্ট মিনিট চেক।
রিমি ভাবছে ওর জায়গায় পরদিন মিতুকে বসাবে উত্তীয়। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এনে বলবে, এই নাও তোমার সংসার বুঝে নাও। বুঝে নাও তোমার আদরের পরবাসী স্বামী রত্নটিকে। সেই রাতেই ওরা দু’জন একখাটে একসঙ্গে শোবে। অথচ এই খাটেই সে উত্তীয়র সঙ্গে কাটিয়ে দিল ব্যক্তিগত একান্ত জীবনের কত কত না উত্তাল, উচ্ছ্বাসভরা মুহূর্ত। কখনও সরবে, কখনও নীরবে। পরম সুখানুভূতিতে, যখন দু’জনের মাঝে অন্য কেউ ছিল না। এবং ভবিষ্যতে যে থাকবে কোনওদিন মনে হয়নি তাও। তখন ওরাই স্বামী স্ত্রী। ওরাই সব। উত্তীয়র যে দেশে কেউ আছে মনেই হলো না ওর ব্যবহারে না আচরণে। একদিনও না।
সযত্নে সাজানো-গোছানো এই সংসার রিমির নিজের হাতেরই তৈরি। এই যে থালাবাসন পর্যন্ত তারই কেনা। উত্তীয়র এই শার্ট, এই গেঞ্জি, এই কলম ওরই দেয়া। মশলার হলুদ রঙ লেগে থাকা প্লাস্টিকের হাতা পর্যন্ত ওরই কেনা। কিন্তু আজকের পর থেকে ওর অস্তিত্বের সব-সবটুকু-এখান থেকে ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যাবে। আসন্ন আগামী কাল-পরশু-তরশু… এই দিনগুলোর কথা ভেবে অচেনা নতুন এক জায়গায় মনে হয় ওর জীবনের একাকিত্বের কথা ভেবে রিমি ভয়ে গুটিশুটি হয়ে যায়। নতুন যে বাড়িতে সে যাবে আজ সেখানে অগ্রিম কিছু টাকা জমা দিয়ে এসেছে। বাকিটা দেবে ওঠার পর। এক বেডরুমের একটি ঘরে একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শেয়ারে থাকবে সে। সেখানে উত্তীয়বিহীন জীবন তার। যে জীবন ওর অচেনা, সে জীবনে কি করে সে অভ্যস্ত হবে? আদৌ হতে পারবে কি! রিমি ভাবতেও পারছে না আর। মাথাটা এবার লাটিমের মতো বনবন করে ঘুরছে। ওর এই চলে যাওয়া এ যে কতবড় অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ কে বলবে সে কথা! কিন্তু প্রথা, যা মানুষেরই তৈরি। প্রথার প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে সে একা লড়বে কি করে! সে যে উত্তীয়র কিছু নয়! কেউ নয়! স্রেফ বান্ধবী যা সমাজের চোখে সম্পূর্ণ মূল্যহীন, অবান্তর। একসঙ্গে ওদের একটি নয়, দুটি নয়, সাত সাতটি বছর, এত সহজেই মূল্যহীন হয়ে পড়লো! এই যে এত আদর সোহাগ, হাসি-খুশি, কানে কানে গুনগুন সবই কি মিথ্যে। হায়রে জীবন! এত নিষ্ঠুরতার ভেতর মানুষ বেঁচে থাকে কি করে?
উত্তীয় থম মেরে চেয়ারে বসে দেখছিল সাত বছর একটু একটু করে, কি করে অতীত ইতিহাস হচ্ছে। পকেট থেকে পাঁচশ’ ডলার রিমিকে দিয়ে ভেজা ভেজা গলায় বললো, রেখে দাও। আর শোন, প্রয়োজনে যোগাযোগ করবে আমার কাজের জায়গায়। খুব জরুরি না হলে ফোন করবে না। জানই তো মালিক একটু অন্যরকম। বরং তোমার নতুন বাড়ির ফোন নম্বর আমাকে দিও। আমিই যোগাযোগ করবো। ওর কথা শুনে এবার সুটকেস গোছানো বাদ দিয়ে রিমি মাথা নিচু করে খাটের ওপর বসে রইলো। পুরো ব্যাপারটাই ওর মনে হচ্ছে, অন্যায়! হাত থেকে টাকাগুলো ওর মুখে ছুঁড়ে ফেলে বিস্ময়ভরা চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা উত্তীয়, এই কি শেষ! আমাদের সংসার সংসার খেলা! এই যে এতদিন প্রতিদিন তুমি আমার সবকিছু ছিলে! এই যে কাছ থেকে খবর নিতে, কেমন আছি! কোথায় আছি। কখন ফিরবো! এই যে আমার অসুখ হলে শিয়রে বসে মাথা টিপে দিতে। একটি রাতও গত সাত বছর ধরে এই যে আমাকে অন্য ঘরে ঘুমোতে দিলে না। কিন্তু আজ! এই সাত বছরের মানেটা কি একটু বুঝিয়ে বলবে! রিমি উত্তীয়র চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ সব অস্থির প্রশ্ন তুলে বসে আছে।
উত্তীয় যার একদিকে রিমি আর অন্যদিকে মিতু। একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে পাপ! রিমির প্রশ্নের কোনও জবাব আছে কি? থাকলে সে দিতে পারছে না কেন? –উত্তর দাও। বলো! এই কি শেষ! উত্তীয় তার কি জবাব দেবে? বিয়ে হলে তার অধিকারই সবচেয়ে বড় হয়। সেই সত্য হয়। এই সত্যের বিরুদ্ধে কি জবাব সে রিমিকে দিতে পারে? বিস্ফারিত দুই চোখে দূরে তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো–হা-রিমি …। এই-ই আমাদের শেষ। সংসার সংসার খেলার এখানেই সমাপ্তি।
–দেখতেও আসবে না আমাকে!
–উত্তীয় চুপ করে থাকে। কোনও কথা বলে না।
–কি, কথা বলো! দেখতেও আসবে না, আমি কেমন আছি! বলো!
–হ্যাঁ, মানে! বলছি তো সময়-সুযোগ পেলেই যাবো। জান তো ওরা আসছে, এখন থেকে আমাকে প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে ফেলতে হবে, তুমি বোঝো না!
–বুঝি-বুঝি–সব বুঝি উত্তীয়। না বোঝার কি আছে। বলে সে ওর দুই পা জড়িয়ে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যেন সে তার স্বামীর সংসার ফেলে অন্য কোথাও যাচ্ছে। যেন ওর বুকে চিরকালের বিচ্ছেদ ব্যথা, সত্যি সত্যি স্বামীর মৃত্যুর চেয়েও যার আঘাত ঢের বেশি।
আজ খালি তার গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করছে ”ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে–শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি…” যে গান ওরা একসঙ্গে, পাশাপাশি শুয়ে গাইতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে ভিজিয়েছে–একে অপরের বুকের সুগন্ধ, কত কত রাত! আগামীর বিচ্ছেদ আর বর্তমানের সুখের মাঝে, দুলতে দুলতে, কত-কত রাত!
পৃথিবীতে কে কার কষ্ট বোঝে? সে সময়টুকুও কারই-বা আছে? মানুষ নিজেকে নিয়েই। বরং ব্যস্ত। যার যার নিজের ভালোমন্দ, নিজের স্বার্থ, সেখানে চুল পরিমাণ ছাড়া কেউ দিতে চায় না। কেউ না উত্তরীয়ও না। রিমির চেয়ে বেশি এই সত্য হাড়ে হাড়ে আর কে বুঝতে পারবে।
–উত্তীয় আমি কিছুতেই যাবো না। আমার বুক ভেঙে আসছে। পারবো না আমি। আমি এখানেই থাকবো। যেমন ছিলাম।
–কি পাগলামো করছো? তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেল।
–পাগলামো নয় উত্তীয়। এভাবে আজ কেন কথা বলছো? আমাকে উচ্ছিষ্টের মতো ফেলে দিচ্ছো কেন? মনে আছে–মাথায় ব্যথা পেয়ে একবার প্রায় মরতে বসেছিলে। বলেছিলে, তুমি না থাকলে যমও আমাকে ছাড়তো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে ফেলবো না। তোমারই থাকবো। -হ্যা বলেছিলাম। কিন্তু সে তো তখন। বললো উত্তীয়। মানে? –মানে সেটা তখনকার একটি মুহূর্তের জন্যে প্রযোজ্য, একটা ইমোশন। কিন্তু আমাদের সমাজ আছে। তাকে তো মানতে হবে! তুমি থাকবে এ আর বেশি কথা কি! আমিও চাই তুমি থাকো। কিন্তু মিতু তা হতে দেবে না। এক পুরুষের ঘরে দুই নারী সম্ভব নয়, তুমিও জানো।
–জানি, কিন্তু তবুও আমি যাবো না। আমি পারবো না উত্তীয়, তোমাকে ছেড়ে। আমি কিছুতেই পারবো না। আমি মানুষ তো! শুনবে, একদিন আমি আত্মহত্যা করছি। কে স্বামী, কে স্ত্রী, বুঝি না। মন্ত্র পড়িনি, কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক তারও ঢের ঢের ঊর্ধ্বে। আমি কি মিথ্যে বলেছি?
–এখন ওসব কথা বলো না। যাও, তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে যাব।
একটা সময় এলো যখন উত্তীয় রিমিকে ধরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল। সে এক দৃশ্য! গাড়িটা চলতে শুরু করলো। নতুন এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আর গাড়িতে বসে এই নারী যে অন্য দশজনের মতো সাধারণ কোনও প্যাসেঞ্জার নয়, স্রেফ প্রথার শিকার, এক ভগ্ন হৃদয়। সে আড় হয়ে বসে রইলো। দু’চোখে অনিশ্চিত জীবনের মাঠ পার। প্রথার বিরুদ্ধে সে একা, নিরস্ত্র এবং নিরুপায়। সে নারী। পরকীয়া নারী।
পরের দিন উত্তীয়র বৌ, ছেলেমেয়ে এলো। প্রায় আট বছর পর দেখা। রিমিকে নিয়ে মিতুর বড় বেশি কৌতূহল। সে বিষয়ে যে-কোনও প্রশ্ন উত্তীয় এড়িয়ে যায়। মিতু ঘরের প্রতিটি কোণা ঘুরে ঘুরে খোঁজে। রিমির কোনও চিহ্ন। কোনও গন্ধ। রঙ। উত্তীয়কে সে হিংস্র জন্তুর মতো ধরবে, সব সত্যি কথা ওর জিভ টেনে বের করে আনবে। যা সে এতকাল শুনে এসেছে, যা উত্তীয় নিজেও এতকাল টেলিফোনে অস্বীকার করে এসেছে।
রিমির সঙ্গে উত্তীয়র সম্পর্ক বরং আট বছর পর স্বামীকে দেখার সুখের চেয়েও বড় হয়ে উঠলো। মিতুর গায়ের রোম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ঘরের প্রতিটি ইঞ্চিতে–পা দিতে দিতে। বারবার শুধু একই কথা। উত্তীয়, এবার প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলো, পাগল হয়ে গেলে নাকি? মাত্র এলে, আর এরই মধ্যে এ কি শুরু করেছ! দেখছো তো আমি ছাড়া বাড়িতে কেউই নেই। আর আমি তো তোমারই আছি যেমন ছিলাম। মাঝখানে কি হয়েছে সেসব কথা ভুলে যাও। তা সত্ত্বেও মিতুর মাথায় শুধু, রিমি।
–ওই বেশ্যা, সেই হারামির বাচ্চা যে ওর স্বামীর বুকে শুয়েছে। স্বামীর পুরুষ ছুঁয়েছে। কোথায় সে! মিতুর একটাই কথা। কোথায় …!
রাতের পর রাত তাকে যে কাঁদিয়েছে। বলো! কোথায়! উত্তীয় আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বলে আট বছর পর দেখা হলো। আজ ওসব বাজে কথা থাক। উত্তীয় ওকে চুমু খেতে যায়, আর মিতুর দুই চোখ তখন কপালে। উত্তীয় এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে। কিছুতেই সে পারছে না, মিতুর সঙ্গে। অন্য নারীর হাতে গোছানো এই ঘরে ঢুকেই মিতু বুঝতে পেরেছে, এই নিপুণ হাতের কাঁচের জানালার পর্দা কোনও পুরুষ কিনতে পারে না। এই বিছানার চাঁদর কোনও পুরুষের পছন্দের নয়। পরদিন সকালে এত সুন্দর গুছিয়ে রাখা মশলার পিরামিড কোনও পুরুষের কাজ নয়। গোছানো চাল-ডাল-মশলা! রান্নাঘরে গিয়েই মিতু ভীষণ ক্ষেপে গেল। পিরামিড ফেলে দিলো। জানালার পর্দা কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে ফেলো। সব-সব ফেলে দেবে সে। কিছুই রাখবে না। উত্তীয়র বুকে ওর মাথার চুলের গন্ধ। উত্তীয়র রুমালে তার স্পর্শ। এবার মিতু পাগলের মতো চিৎকার শুরু করলো। দিন গিয়ে এমনি ঝড়-তুফান তুলে রাত এলো। আর সইতে না পেরে, ওকে থামাতে উত্তীয় প্রবাসের এই দ্বিতীয় দিনেই -ঠাস করে চড় কষালো মিতুর গালে। চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ কখন যেন বাধ্য শিশুর মতো সে ঘুমিয়ে গেলে পৃথিবীটা বড় শান্ত মনে হলো। উত্তীয় যেন এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, উফ! কি ভয়ঙ্কর।
রিমিকে সে দু’সপ্তাহ দেখেনি। সাত বছরেও যা হয়নি। রিমিকে সে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করছে তীব্রভাবে। স্মৃতি উত্তীয়কে কষ্ট দেয়। রিমির প্রসঙ্গে কোনও কথাই সে তুলতে চায় না। অনেক কষ্ট করে, অনেকটা মদ খেয়ে খেয়ে গোপনে সে রিমির কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। যা মিতু জানে না। মিতুকে ওর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যেন অচেনা এক অতিথি। অযাচিত। বরং না এলেই ভালো ছিল। মনে হচ্ছে পারলে ও এক্ষুণি রিমিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এমনটি লাগবে, সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। উত্তীয়র কষ্টগুলো না জানে রিমি, না জানে মিতু।
বিকেলবেলা, আনমনে বসে ভাবছে। হঠাৎ সেলিম এসে ওকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো রিমি খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কেমন আছে?
–ভালো নয় বিশেষ। তোর যাওয়া দরকার। উত্তীয়র মন চাইছে ওকে দেখতে যেতে। রিমি কেন অসুস্থ হলে কি পেলে ভালো হয়ে যাবে, সে খবর ওর চেয়ে ভালো এ বিশ্বভুবনে আর কে জানে! অস্থির চিত্ত, দুর্বল মন, প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে সে মস্ত হাঁফ ছাড়ে। তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় সেলিমকে জানিয়ে দিল। গেলেই সর্বনাশ হবে। এই কষ্টের সংযম, নষ্ট হয়ে যাবে। সেলিম চলে গেল, ভীষণ রেগে। তারও ভালোলাগেনি এত নিষ্ঠুরতা।
সংসারে মন বসে না। বাড়িতে ফিরতে ভালো লাগে না। মিতুকে ভালো লাগে না। মাতালকে মদ-ছাড়া করলে যা হয়। মাতাল অসুস্থ বোধ করে। সেদিন কাজ থেকে ফেরার পথে, ট্রেনে বসে মনে হলো বাড়ি না গিয়ে আজ হাসপাতালে রিমির কাছেই যাবে। রিমি অসুস্থ। গেলেই হাতের মুঠোয় তার প্রিয়তমা। গিয়ে বলবে, দেখো আমি ফিরে এসেছি। তোমার সাত বছর মিথ্যে নয়। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। আমি তোমাকে স্নেহ দেবো। প্রেম দেবো। শুধু তুমি একবার সুস্থ হও। যেমন আমাকে তুমি একদিন সব দিয়েছিলে। এমনকি, মাতৃস্নেহ পর্যন্ত যখন আমি মরতে বসেছিলাম। যেদিন তুমি আমাকে তোমার দুই স্তনের মধ্যে খুঁজে, লেপ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে, শরীরের সমস্ত ওম দিয়ে জ্বরের প্রচণ্ড কাঁপুনি থামিয়েছিলে! সেদিন তুমি আর তুমিতে ছিলে না। আজ আমিও তাই হবো। প্রলাপের মধ্যে আমাকে তুমি আর খুঁজো না। আমি স্বয়ং নিজেই এসেছি তোমার কাছে। চোখ খোল, রিমি! লক্ষ্মী! মানিক সোনা আমার! উত্তীয়র দু’পা কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে। বুকের তলে, ভূকম্পন হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত।
উত্তীয়র দৃষ্টি প্রসারিত। চোখে দেখছে হাসপাতালের বেডে রিমি শুয়ে আছে। দশদিন হয়ে গেল। রিমি দশদিনেও চোখ খোলেনি। শুধু নাকি ঘুমের মধ্যে একবার দু’বার উত্তীয়’র নাম বলে কেঁদে উঠেছিল। আর হাসপাতালের ডাক্তারও কোনও এক ‘উত্তীয়’কে খুঁজছে। তাকে পেলে রোগী সেরে উঠবে। উত্তীয়র পৃথিবীটা চরম অশান্ত। ঝড়ে, ডালপালা ভাঙার মতো ওর সব ভেঙে ভেঙে পড়ছে। হৃদয় ভাঙছে! বিয়ে ভাঙছে। কাকে বাঁচাবে? রিমিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু প্রথা, একজনকে দিয়েছে অপার ক্ষমতা, অধিকার! আর অন্যজনকে করেছে রিক্ত, ভিখিরি।
‘এফ’ ট্রেনের পরবর্তী স্টপ, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল। এখানেই রিমি ভর্তি হয়ে রয়েছে। নামবে কি নামবে না ভাবছে সে। সেলিম বলেছিল দয়া করে অন্তত একবার ওকে দেখে আসতে। সে জানে রিমির মাথায় হাত বুলোলেই রিমি জেগে উঠবে। রিমি ওর গন্ধ চেনে। রিমি ওর স্পর্শ চেনে। মৃত্যু মুহূর্ত হলেও ওর স্পর্শ একমাত্র রিমিই অনুমান। করতে পারে। কারণ তার নিখাদ প্রেম। এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই ট্রেনটা কখন যেন হাসপাতালের স্টপ পার হয়ে ফোরটি সেকেন্ডের দিকে চললো। উত্তীয় আনমনা হয়ে তখনো ভাবছে, সে কি যাবে? গেলেই তো সব ওলট-পালট হয়ে যাবে তার বোতলে বোতলে মদ খেয়ে ভুলে থাকার সব প্রচেষ্টা, ব্যর্থ হবে।
–নামবে কি নামবে না। নামবে কি-না, নামবে না। ওকে দেখলেই মনে হবে মিতু মিথ্যে। অনেক কষ্ট করে এই নতুন জীবনে সে অভ্যস্ত হতে যে যুদ্ধ করে চলেছে!
হায়! এই সেই ভ্রান্তিপাশ! যাকে কবিগুরু পোস্টমাস্টার গল্পে উল্লেখ করেছিলেন, কি নিপুণভাবে। উত্তীয়, এই ভ্রান্তিপাশের কথা মনে করতে করতে ভুলে যায় কখন সে ট্রেনের লাস্ট স্টপে এসে পৌঁছয়। নিজেও সে সেকথা জানে না। স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ওর চৈতন্য হয়। সেখান থেকে ওর বাড়ি অনেক অনেক পেছনে। ভুল করে সে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে এসেছে। আবার তাকে উল্টো ট্রেনে সেখানেই ফেরত যেতে হবে, যেতেই হবে। যে জায়গাটা সে ফেলে এসেছে।