১৯. তৃষাদীর্ণ
কিছু কষ্ট আছে, যে কথা কাউকে বলা যায় না। কিছু যন্ত্রণা যা অযাচিত, তবুও আমরা তা মেনে নিতে বাধ্য। কিছু সময়, যা ক্ষমাহীন। কখনো, কারো কোনও ব্যবহার যা অশোভন শুধু নয়–গা কামড়ে ওঠা। কোনও আলো, যা অন্ধকারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মা আর মাতৃত্ব। যা কখনো কখনো ক্ষমার অযোগ্য। এমন হলে কি তার উত্তর, সেই প্রশ্ন হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জা।
রাত গম্ভীর হয়ে গ্যাছে। শহরের নববিবাহিত মানুষ-মানুষীরা তখন, একে অপরের বুকে শরীরের উষ্ণ ওমে আচ্ছন্ন। নববিবাহিত হারুনের শরীরটাও তখন সবেমাত্র শিথিল হচ্ছে। শরীরের তলে ওকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে সোহাগিনী নেলী। দু’জনেরই শরীর প্রচণ্ড ঘামে কুলকুল করছে। সপসপে দু’হাতের শেকল খুলে গেলেও, নেলী কষ্ট করে সে শেকল বারবার আরও জোরে বাঁধবার জন্য উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে অনুভব, অনুভূতির ব্যাপারটা গভীরতর হয়। দু’জনেরই চোখ বন্ধ। উন্মত্ত অধীর ভালোবাসায় চোখের পাতা ভারি। কণ্ঠ-বেসুরো। ঠিক তখনি শব্দ হলো দেয়ালের ওপাশ থেকে দুটো পায়ের। কে যেন হাঁটছে। থপ-থপ…।
–কে? কে ওখানে? নেলী, হারুনকে এক ঝটকায় ফেলে দিল ওর শরীরের ওপর থেকে। চোর! চোর! বলতে বলতে সে উঠে দৌড়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। আওয়াজটা খুব স্পষ্ট। থপ থপ থপ। দ্রুত অপসৃয়মান পায়ের স্পন্দন। হারুন বাথরুমে গেল না। চাঁদর দিয়েই ওর পিচ্ছিল অঙ্গ মুছে কাপড় পরে ফেলো। পরক্ষণেই দরজা খুলে বাইরে এসে জোরে হাঁক-ডাক দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো–কে কে ওখানে? এরপর বাইরের সব বাতিগুলো সে একে একে জ্বালিয়ে দিলো। পেছন পেছন এলো নেলী। ভয়ে ওর সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। নেলী হারুনের পেছন পেছন ওর শার্ট ধরে কম্পমান পা ফেলছে। ভয়ে বিহ্বল নতুন হাঁটা শেখা এক শিশুর মতো লাগছে তাকে। হারুন ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁজে খুঁজে কিছুই না পেয়ে অবশেষে মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বললো, মা ওঠো, ওঠো-ও-ও-ও–না। ঘরে চোর ঢুকেছে।
–মা, ওপাশ থেকে এপাশে ফিরে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিরক্ত কণ্ঠে বললো–কি বলছিস!
–চোর! চোর ঢুকেছে! ওঠো!
–মা উঠলেন স্বাভাবিকভাবে। কি বলিস! চোর! তেমন আশ্চর্য হয়েছেন বলে মনে হলো না। যেন এটাই স্বাভাবিক।
শাড়িটা তার গুছিয়েই পরা ছিল। তিনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ছাদে দেখেছিস?
–না-মা! বলেই হারুন দৌড়ে ছাদে গেল আর সেখান থেকে ফিরে এসে বললো,, কেউ নেই।
নেলী বললো, চোরই যদি হবে, তবে তো একটা কিছু চিহ্ন থাকবে। কই, সে রকম কোনও আলামতই তো দেখা যাচ্ছে না। পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অন্তত দৌড়ঝাপের শব্দ বোঝা যাবে। তাই নয় কী? তেমন কিছুই তো টের পেলাম না!
–ঠিকই তো। কে বলে বুদ্ধি নেই নেলীর! বললো হারুন।
–শাশুড়ির বিচারে নির্বোধ এই মেয়েটির কথায় মনে হলো একটু নড়ে উঠলেন শাশুড়ি স্বয়ং নিজেই। সেই সঙ্গে ছেলের মুখে বৌয়ের সামান্য প্রশংসায় কেমন যেন বিচলিতও মনে হলো।
অকাল বিধবা অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, ওরফে নার্গিস। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি এই অযাচিত শাস্তির শিকার হন। স্বামীর অপমৃত্যুর পর থেকে এই একটি মাত্র সন্তানকে ঘিরে শুরু হয় তার জগৎ। অত্যন্ত মায়া মমতা স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন একমাত্র ছেলেটিকে। এবং এই স্নেহটুকু সম্বল করে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে দেখে কাটিয়ে দিয়েছেন তার যন্ত্রণাদগ্ধ একাকিত্বের দুঃসহ জীবন। এই জীবনের বাইরে, ছেলের এই বিয়েতে তার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না বলে বৌয়ের সাথে কখনোই তার তেমন সমঝোতা গড়ে ওঠেনি।
সে রাতে মন থেকে না চাইলেও, নেলীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একই সুরে তিনি বললেন, তাইতো! সেরকমভাবে ভাঙচুরেরও তো কোনও শব্দ শোনা গেল না। তাহলে নিশ্চয় চোরটোর নয়। এরপর আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি চললো। দরজা-জানালা কোনওটাই তো ভোলা দেখা গেল না। এমনকি একটা ফুটো বা ভাঙা দেয়ালও কোথাও দৃষ্টিগোচর হলো না। নেলী বললো মনে হয় নিশ্চয় কোনও বেড়াল-টেরালের কাজ হবে নিশ্চয়। দুধ-টুধের খোঁজে। হারুন সঙ্গে সঙ্গে বললো, হতেই পারে। প্রয়োজনে মানুষ স্বস্তির জন্যে সবসময় অজুহাত খুঁজে পায়, হারুনও পেলো–বললো, পাশের বাড়ির হুলোটা তো বেজায় জ্বালাচ্ছে।
এরপর সবাই আরেকবার ব্যস্ত হয়ে, এদিক-ওদিক তদারকিশেষে বাতি নিভিয়ে যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। হারুনের মাও ঘরে যাওয়ার আগে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–মনে হয় বেড়ালই হবে। তবে বেড়াল শব্দটার ওপর যেন একটা সবিশেষ জোর ছিল।
নেলীর সঙ্গে হারুনের বিয়েটা সহসাই। এক মাসের পরিচয়ে। নেলীকে ওর কাকাই পরিচয় করিয়ে দিলো হারুনের সঙ্গে। তাতে প্রথমেই বাধা দিলেন নার্গিস বেগম। এক্ষুণি বিয়ে কিসের? মাত্র তো পাস করে বের হলো! আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। জীবন চিনুক। বিয়ে হলে তো হয়েই গেল। এরকম কথা হারুন এর আগেও আরো অনেক শুনেছে। যখনই কেউ ওর বিয়ের কথা বলেছে–মিসেস নার্গিস বেগম প্রথমেই সেখানে বাধা দিয়েছেন।
মাকে যমের মতো ভয় পায় বলে হারুন এতকাল চুপচাপই সব সহ্য করে গেছে এবং যাচ্ছে। কিন্তু ইদানীং মায়ের এই বাড়াবাড়িতে সে নিজেও অধৈর্যবোধ করছে। চায়ের টেবিল থেকে সব লজ্জা ভুলে এবার বললো, মা আমার বিয়ের বয়সই শুধু হয়নি, পারও হয়ে যাচ্ছে। মনে রেখে ত্রিশ হবে আর তিনদিন পর। বলো আমি কি এখনো কিশোর?
চার দেয়ালের ঘরে শুধু মাকে নিয়ে থাকতে থাকতে এই একাকী জীবনে হারুন আজকাল দারুণ হাঁপিয়ে উঠেছে। চা খেতে খেতে সে কথাই তুলো হারুন। অফিস থেকে ফিরে মা আর ছেলের প্রতিদিন একসঙ্গে চা খাওয়া, এ বাড়িতে একটা নিয়ম। এক কাপ চা, ঠিক সন্ধে সাতটায়। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। হারুনের এই ঘড়ির কাঁটা জীবনের প্রতি বিরক্তি এসে গেছে। কিছু বলার আগে, সাদা নিঃসঙ্গ দেয়ালের দিকে একবার তাকালো হারুন। একটা টিকটিকি। সেদিন নেলীর সঙ্গে বিয়ের কথা ওঠানোর আগে একটু হালকা হাস্যরসের প্রয়োজন ছিল। বললো, আচ্ছা মা বলতো, টিকটিকিটা কি আমাদেরকে উল্টো দেখছে! গুরুগম্ভীর মাও হেসে উঠলো। আর সেই সুযোগে হারুন মাকে জড়িয়ে ধরে বলেই বসলো, নেলী খুব ভালো মেয়ে মা। তুমি অমত করো না। ওকে দেখলে তোমার পছন্দ হবে।
কথাটা শুনে, মা যে খুব খুশি হলেন না, তা তার মুখ দেখেই বুঝে ফেলো হারুন। -বিয়ে করছিস তুই। আমার ভালোলাগা না লাগার তুই কি পরোয়া করিস। মন। তো দেখছি ঠিকই করে ফেলেছিস, তো আবার আমাকে জিজ্ঞেস করার কি দরকার। বলে তিনি উঠে অন্যদিকে চলে গেলেন। কথাটা শুনে হারুন খুব খুশি হলো না। হোক না তিনি অধ্যাপিকা। হোক না স্বনামধন্যা এক ত্যাগী, সংযমী, সংগ্রামী অকাল বিধবা, যিনি তার একমাত্র ছেলেকে কোলে পিঠে বুকে করে দৃষ্টান্তস্বরূপভাবে গড়ে তুলেছেন। সমাজ ও ধর্মের অনুশাসনে মানুষ করেছেন। ছেলেকে নিয়ে দারুণ কষ্ট করেছেন, তবুও কারো কাছেই মাথা নত করেননি। কিন্তু এখন তো সে প্রাপ্ত বয়স্ক, তারও তো ভালো লাগা না-লাগার ব্যাপার থাকতে পারে! মুহূর্তের জন্যে ভাবলো হারুন। মায়ের সাথে ইদানীং কথা যেটুকু হয়, তা বিতর্ক। আর সে বিতর্কও একটুক্ষণ পর ফুরিয়ে যায়। তারপর দু’জন যে যার ঘরে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, নেলীকেই সে বিয়ে করবে। এক ধরনের ক্ষোভ। শুধু স্ত্রী নয় এই বাড়ির নীরবতা ভাঙাতে প্রয়োজন হবে একটা বড়সড় প্রলয়ঙ্কর ঝড়।
রাতটা কারোরই ভালো যায়নি। হারুনের চোখের তলে কালি। সে সারারাত জেগেছে। পরদিন মা তার স্টাডি রুমে বসে চা খেতে খেতে লেকচারের জন্য তৈরি হতে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। হারুন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই সাহস করে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মা তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। অন্তত একটা কথা বলার লোক আমার চাই। মা, চায়ের কাপটা নামিয়ে এবার। কিচেনে যেতে যেতে বললেন, আমি তো বলেইছি।
দু’বছর অপেক্ষা কি সম্ভব! এভাবে চলতে থাকলে নিঃসঙ্গতায় সে পাগল হয়ে যাবে। অসহায়ের মতো আর্তকণ্ঠে মাকে বললো, নেলীকে বলেছি তুমি ওদের বাড়িতে যাবে। হারুন মাকে জড়িয়ে সেই ছেলেবেলাকার মতন আদুরে গলায় বলতে থাকে আমার লক্ষ্মী সোনা মা।
মা অনেক কষ্টে শেষমেশ রাজি হলেন।
ত্রিশ বছরের ছেলের বিয়েতে মা রাজি হবেন না, বাঙালি সমাজে এমন ঘটনা বিরল। কিন্তু হারুনের বেলায় এই ব্যতিক্রমের কারণ, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এক কচি শরীরের বিধবা, যার স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল, যিনি স্বামীর অপমৃত্যুর পর চারপাশের মানুষদের মধ্যে লোভ-লালসা আর ধৃষ্টতা দেখে নিজের দেহ-মনকে এক অদৃশ্য শেকলে বেঁধে সঙ্কল্প করলেন আর নয়। অনাথ ছেলেটাকে মানুষ করাটাই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করাই হবে কাজের কাজ। অন্তত এই জন্তু-জানোয়ার আর পাশববৃত্তির দেশে। যে দেশে বিধবা বিবাহ মানেই চাই তার স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ-সম্পত্তি এবং তারপরে তো শরীরের লোভ আছেই। এখানে প্রেম-ভালোবাসা বলে কিছু নেই।
স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। হলেন নামকরা শিক্ষক। আর পাশাপাশি এক আদর্শ মা। আগে কোনও সাহায্য চাইতেই, আত্মীয়-স্বজন বিয়ের উপদেশ দিতেন। কিন্তু ধীর স্থির, সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসনে বাধা এই নারী, পরিমিত জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে বিয়ের সমস্ত সম্ভাবনাই নাকচ করে দেন। স্বেচ্ছায় নিভিয়ে দেন শরীর এবং যাবতীয় অনুভূতির কোষ, স্নায়ুর যন্ত্রণা।
এই ছেলেকে আর রাখা যাবে না। এবার ছাড় না দিয়ে আর নিস্তার নেই। তিনিও জানেন। আর এক ঘরে দু’খাট ফেলে শোয়া নয়।
এবার খাট যাবে আলাদা ঘরে, নেলীর ঘরে। তাই নেলীর সঙ্গে, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এলেও সেকথা মনে করে তিনি বারবার অস্থির হয়ে উঠছেন। একটা উটকো মেয়ে এসে ছিনিয়ে নেবে তিল তিল করে নিজের রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলা তার ছেলেকে! ঈর্ষার আগুনে সেঁকা রুটির মতো ঝলসে যান তিনি। তার ছেলে, যার জন্যে জীবনে সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। তাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসার পর থেকেই তিনি অন্যরকম অনুভব করতে শুরু করেন।
বিয়ের দিন মা ঘরেই রইলেন। উৎসব আছে ঘরে। আনন্দ নেই। ঠিক আছে, তুমি যাও, ছেলেকে অনুমতি দিয়ে তিনি বিছানা নিলেন। সব সত্ত্বেও বিয়েটা হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। মা যে অসুখী হারুন জানে। নেলী জানলো, কিন্তু পরে। হারুনের নতুন খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, ওয়ার্ডড্রব। সব আলাদা। জীবনে এই প্রথম হারুন অন্য ঘরে ঘুমোবে। তবে মায়ের ঘরের পাশাপাশি। নেলী তার ঘরটি গুছিয়ে নিতে শুরু করলো তার পছন্দমতো জিনিসপত্র দিয়ে।
বিয়ের তিনদিন পর, শাশুড়ি দিনদুপুরে শুয়ে আছেন। মুখের হাসি তার উধাও হয়ে গ্যাছে। তিনি খুব বিরক্ত। এদিকে নেলী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ঘরের প্রতিটি জিনিস আসবাবপত্র। দেখে রোমাঞ্চিত বোধ করে। এই তার স্বামীর ঘর। নেলী স্বপ্নসুখের ফেরে পড়ে। স্বামীর ঘরে তার সবকিছু বড় আপন লাগে।
বুকে দুর্বোধ্য যন্ত্রণা। হারুন আর নেলীর দিকে তাকিয়ে একটি কথাও তিনি আর বলতে চাইলেও পারেন না। গোটা বাড়ি জুড়ে সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। নেলী ভয়ে তাকিয়ে থাকে, স্বামীর মুখের দিকে। একি!
-তিনি শুয়ে আছেন। শাশুড়িকে খুশি রাখতে নেলী চেষ্টা করে। মা আপনার কি শরীর খারাপ! নেলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
-বলছি তো না। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নেলী চলে গেল নিজের ঘরে। হারুন বুঝিয়ে বলে, ঠিক হয়ে যাবে সব। একটু সময় দাও। মায়ের কষ্ট তুমি নিজেও একটু চেষ্টা করো বুঝতে লক্ষ্মীটি। কিন্তু দিন যত যায়, বাড়ির পরিবেশ তত অশান্ত হয়ে আসে। নেলী অপেক্ষা করে। আর ঝড়, একটার পর একটা, যা আসছেই।
গভীর রাতে সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ওরা টেলিভিশনে খবর শুনছে। ঠিক এমন সময় আবার কার পায়ের শব্দ! দেয়ালের ওপাশে।
-কে! কে! হারুনকে ঘুম থেকে ওঠায় নেলী। কেউ নেই। চোরের কোন চিহ্নই নেই। ওরা বিড়ম্বনায় পড়ে। কিন্তু মা, নির্লিপ্ত থাকেন।
-সেই ঘটনার তিনদিন পর, ফের সেই পায়ের শব্দ! ওরা বাইরে যায়! গিয়ে চোর খোঁজে, বেড়াল খোঁজে। চোর নেই, বেড়ালও নেই। এরকম প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।
-কার পায়ের শব্দ! কে হাঁটে! কার দীর্ঘশ্বাস! ভূত! পিশাচ!
মধ্যরাতে কে এই চলমান অশরীরী যিনি সারা বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় হারুন! আমার খুব ভয় করছে। নেলী কাঁদে। প্রতিরাতেই নিয়মমাফিক মাকে ওঠানো হয়। কিন্তু তিনিও কিছু বুঝতে পারেন না। বলতেও পারেন না। আর হারুন, প্রতিরাতেই আরেকটু আরেকটু সন্দেহ পুঞ্জিত হয়–কে! কে তিনি! বা কে-সে?
দারুণ এক রহস্য শুরু হলো এই বাড়িতে। তা সত্ত্বেও নার্গিস বেগম এক সময় ছেলেকে বলেই বসলেন, মাঝে মাঝে তার ঘরে গিয়ে তার আগেকার বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে। বললেন, তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নেলী শাশুড়ির ঘরে কিছুতেই ঘুমোবে না বলে জানিয়ে দিল। যদিও বিষয়টা অস্বাভাবিক কিন্তু নেলী খুব বেশি কিছু মনে করলো না এই ভেবে যে এতদিনের অভ্যেস, ঠিক আছে। এরকম হতেই পারে। তবে নিজের মাকে ঘটনাটি জানালো।
কি বলিস! বললেন মা। তার কাছেও বিষয়টি ভালো না লাগলেও তিনিও ভাবলেন এরকম তো হতেই পারে! তারপরেও নার্গিস বেগমের মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। তিনি নেলীকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। বিভিন্ন অজুহাতে শুরু হলো, সারাক্ষণ গাত্রদাহ। যার প্রথম আর শেষ কথা, নেলী তার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে।
-নেলীর ঘুম আসছে না। গতরাতেও দারুণ ঝগড়া হলো হারুনের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও, আবার সে মায়ের ঘরে শুয়েছে। হারুন অপারগ।
বললো, মা অকাল বিধবা। প্লিজ সহ্য করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। একথা তো আগেই পুরনো হয়ে গেছে। আর কতদিন! সন্ধে হলেই এ বাড়িতে শুরু হয় একটা চাপা অস্থিরতা। একটা দারুণ টেনশন। হারুনের শোয়া নিয়ে। দুই নারীর মধ্যে ক্ষমতার যুদ্ধ। আর নয়। ন্যায্য-অন্যায্যের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নেলীর মাথায় ঢুকলো ডিভোর্স।
মায়ের সঙ্গে ঘুমোনোকে কেন্দ্র করে দু’জনের মধ্যে একসপ্তাহ ধরে কথা একদমই বন্ধ। ঝগড়ার পর কেউ কারো রাগ ভাঙালো না। হারুনের জন্যে আজ মায়াও লাগছে। তাকে সে গতকাল জুতোপেটা করেছে। হারুনই-বা কি করবে! কাকে অবজ্ঞা করবে সে! একদিকে মা আর অন্যদিকে স্ত্রী। আপন-পরের দ্বন্দ্ব এবার।
ওঠো, বলে বিছানায় শোয়া নেলী হারুনের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলো, সদ্য বিবাহিতের দীর্ঘ বিরহ যেমন সুখের হয়। অম্লমধুর! রক্তে মাতন, উষ্ণ আবেগ, বুকের সব মধু নিংড়ে নিয়ে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। হারুন তিনরাত ধরে মায়ের ঘরে শুতে যায়নি। বলেছে আর শোবেও না। তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মা চেয়েছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও সে এবার অনড়। নেলী, আজ সেকথা নিজ কানে শুনেছে। সুতরাং নেলীর হৃদয় সঙ্গে সঙ্গে গলে গেল। রাগ চলে গেল। অভিমান ঝরলো। ঝরলো কামের প্রত্যাশা।
তিনরাত পর সে হারুনের শরীর স্পর্শ করলো। আর সে স্পর্শ পেয়েই ঘুমের মধ্যে একটু একটু করে জাগ্রত হতে শুরু করে শরীরের একখণ্ড শিথিল মাংস। ক্রমে তাতে প্রাণ সঞ্চার হলো। জেগে উঠলো পৌরুষ তার আপন বিক্রমে। হারুন তৈরি। ঘুমের মধ্যে যেন তারও অধীর অনন্ত অপেক্ষা। আর অলক্ষ্যে, অপেক্ষা যেন আরো কার! দেয়ালের ওপারে সেই পায়ের শব্দটির অশান্ত আনাগোনা! সন্ত্রস্ত পদক্ষেপ। কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। কে যেন অস্থির শ্বাস নিচ্ছে। বিশ্রী এবং নিঃসন্দেহে তা কোনও বেড়ালের নয়।
হারুন বললো, কেউ না। নেলী, এসব আমাদের ভুল শোনা। দু’জনের শরীর সবকিছু ভুলে এগিয়ে যেতে থাকে। আর ঠিক তখনই, সেই পায়ের শব্দ আরও শব্দ করে কাছে, যেন একেবারে শিয়রে এসে দাঁড়ায়! শব্দ, দাঁড়ায় দেয়ালের একটি ফুটোর কাছে। শব্দ–চোখ বুজে দেখে। শব্দ অস্থির উত্তাল হয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খায়। শব্দ মিলিয়ে যায়।
ছত্রিশ বছরের বিধবা শরীরে আজ রাতে যেন আগুন লেগেছে। মৃত স্বামীর ছবিটা হাতে নিয়ে অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম হঠাৎ এক জ্বলন্ত অনুভূতির প্লাবনে ধসে গিয়ে সেই রাতে অন্য এক নার্গিসে রূপান্তর হয়। যার সামনে কোনও অনুশাসন নেই। না ধর্মের, না সমাজের। তিনি তার মৃত স্বামীকে ছবির অ্যালবাম থেকে জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে তার সার্টের কলার মিছে চেপে ফিরে আসেন শুধুই মুঠো মুঠো শূন্যতা নিয়ে। তার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ধরতে গিয়ে ফিরে আসেন নির্জনতা নিয়ে। অস্থিরতায় ঘাম সমস্ত করতল জুড়ে তার। গায়ে তার আগ্নেয়গিরির মতো লাল কালো তরল পাথুরে আগুন। তিনি কি চান, নিজেও জানেন না। স্বামীর ছবিটাকেই প্রশ্ন করেন, কেন চলে গেলে? কেন? কেন? তিনি চান তৃষ্ণার জল। তাকে ফিরিয়ে চান। সংশোধন করতে চায় অতীতের সব ভুল। শরীফকে ফিরিয়ে আনতে চায়, বৈধব্য সত্ত্বেও তার কামনা হয়। ইকবালের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এলে বৃদ্ধা মাকেও সে অপমান করেছিল। কত ভুল যে সে করেছে! কত ভুল! কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে ঘরের পর্দা কাটতে শুরু করে। নিজের পরনের শাড়িও কাটে। অতীতের গহ্বরে হারানো এই ক্ষতি সে কি দিয়ে পূর্ণ করবে। সবই তো অতীত। সময়, সে কি আর বসে থাকে!
তার সব রাগ নেলীর ওপরে। ঈর্ষা! দারুণ ঈর্ষা! নেলী, হ্যাঁ নেলী নামের নির্বোধ মেয়েটি, সে সুখ করছে তার সুখের বিনিময়ে, যার কারণে সে তার নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছিলেন, ত্রিশ বছর আগে। তা হয় না। হবে না। কিছুতেই না। অবশেষে শরীর ও মনের ভীষণ সঙ্কটে আক্রান্ত অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম ঝড়ের বেগে তার রতি ক্রীড়ায় মগ্ন সন্তানের ঘরে ঢুকেই একটি অবুঝ শিশুর মতো আলুথালু চুলে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। হারুনের পুরুষবৃন্ত মাত্র তখন সবে শৈথিল্যে ফিরছে। তখনো দুই পা বিযুক্ত নেলী অন্ধকারে তার কাপড় হাতড়াচ্ছে। আর অনন্যোপায়, অন্যলোকের বাসিন্দা দু’জন অসহায় স্বামী-স্ত্রী ওরা যেমন ছিল তেমনি গায়ে গায়ে লাগা অবস্থায় পড়ে রইলো। স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে! একচুলও সরলো না। নড়লো না পর্যন্ত। যেন অনড় পাথর।