মধ্য বয়সের সঙ্কট: ১০. সময়ের ডানায় ভাসা তিন কন্যা

মধ্য বয়সের সঙ্কট: ১০. সময়ের ডানায় ভাসা তিন কন্যা

১০. সময়ের ডানায় ভাসা তিন কন্যা

কাহিনী—

মানুষের হৃদয়ে এমন কিছু ইচ্ছে লালিত হয় যা প্রথাবিরুদ্ধ, কিন্তু বাস্তব। অবাস্তব মানুষদের সঙ্গে বাস্তবের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষ আসলে মিথ্যের সঙ্গে সত্যের। অবাস্তব, যা মিথ্যে। যা মানবজীবনের জন্য ক্ষতিকর। অকাল বিধবার মতো আমারো মনে লক্ষ প্রশ্ন জাগে এই ভোরবেলায়, যখন মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আড়মোড়াও ভাঙেনি। ভোরের পাখিরা তখনও ভোর জাগায়নি। সেই ভোরে। যে ভোর এতো কালো যে মৃতদেহ চিতায় ওঠানোর আগেও ওরা আরেকটু অপেক্ষা করে। সূর্যের আলোর মতো কিছুর। যার প্রতীক্ষায় কাটতে থাকে পৃথিবীর কোথাও কোন নারীর প্রত্যাশা। সেই ভোরের বেলায়, আমার ঘুমহীন মাথায়, একা বসে ভাবি অনেক নষ্ট কিছু জটিল প্রশ্ন। প্রশ্ন, যার কোনও গ্রহণযোগ্য উত্তর আমাকে কেউ কখনো দিতে পারে না। আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন। যার সাথে আমার কারো না মনে, না মতে মেলে। প্রশ্নগুলোর নাম, কেন? আর এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমি দিনদিনই একা হতে থাকি।

প্রশ্নগুলোর সবকটিই প্রথা ভাঙুনীদেরকে ঘিরে। যারা মানুষের অপছন্দনীয়। যারা অভিশাপ কুড়োনি, একঘরে। প্রথা মানেই কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা। প্রথা আছে বলেই সমাজজীবন অলঙ্করণে রয়েছে এত অবিচার! ধর্মান্ধতা আছে বলেই বর্বরতা। আমি নিজেও প্রথা ভাঙা নারী। যাদের সঙ্গে মিশি তারা ভালো। কিন্তু এই একটি জায়গায় এসে সবার সঙ্গে আমার গোলমাল। তখন নিজের জন্য বড় দুঃখ হয়। মনে হয় কেন জন্মেছিলাম! আর এই জটিলতায় মৃত্যুকে আপন বোধ করি। জানালার ধারে বসেই প্রতিদিন এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমার সকাল হয়।

এখন সকালের পাখিগুলো রোদের তৃষ্ণায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা লাল সূর্যটা ক্রমশ রোদ হচ্ছে। আজ এই তরুণ রোদের আলোয় আমি আমার নিজের শরীর নিজে দেখতে পাচ্ছি। জেগে ওঠা পৃথিবীর–কলরবে নিজেকে আমি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, আছি। সত্যিই বেঁচে আছি, হ্যাঁ, আমি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি, মনে হয়। কারণ গতরাতে আমি তিন কন্যা দেখেছি। আমার মনমানসিকতার তিন কন্যা। আমি শ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি। শ্বাসের শব্দ ছুঁয়ে অনুভব করছি, জীবন। আমি ঘুম। ভাঙা পাখিদের সঙ্গে নিজের চোখ ঝাঁপটে স্বাগত জানাচ্ছি, সকালকে। আমি বেঁচে আছি।

আজ আমি এই তরুণ সকালে এই সময়ের সাহসী তিন কন্যার কাহিনী বলছি। জগতের পঙ্কিল গণ্ডি কাটিয়ে উঠে যারা গোলাপ পেতে চায়। মানুষের সৌন্দর্য যাদের কাছে মানুষের চেয়ে বড়। সত্যের চেয়েও বড়-সত্যবাদিতা। দাম্পত্যের চেয়েও, তার কারণ।

১. প্রথমা

সেদিন দুর্গা পুজোর মণ্ডপে বসেছিলাম। পাশেই খালি চেয়ার আর এই চেয়ারে বসে যিনি হঠাৎ আমার কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি অনন্যা। তার সাথে আমার দেখা হলো প্রায় বছর তিনেক বাদে। ঢাক বাজানোর শব্দের মধ্যে তার এই সহসা উপস্থিতি। চোখে-মুখে নব উচ্ছলতা। ছিল নতুন প্রাণ, যা আগে দেখিনি। এ যেন তার ”কাক্ষিত নক্ষত্র দেখতে পারার উচ্ছলতা।” তিনি আমাদের পাড়ারই বৌ। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও আমি তাকে আপনি বলছি কারণ, সাহসে তিনি আমার চেয়ে ঢের বড়। জীবন সংগ্রামে তিনি আমার চেয়েও সংগ্রামী। প্রথা ভাঙায় তিনি অদ্বিতীয়া। কোন এক বিশেষ কারণে তাকে আমি খুঁজছিলাম। তার সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তার সবটাই প্রথা ভাঙার।

সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে বৈধব্যের এক মাস পর থেকেই তিনি ধুতি ছেড়ে ফের রঙিন পরেন। হাতে, কানে, গলায় অলঙ্কার। পাড়ার লোকেরা প্রতিবাদ করে বললো, দু’ভরি সোনা! এই সাজসজ্জা তোমার নয়। চারদিকের শাসন সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সংস্কারের কারাগারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বৈধব্যের শুরু থেকে অদম্য সাহসের সঙ্গে সমাজকে দেখালেন বুড়ো আঙুল। আর সমাজ তাই একদিন ওকে একঘরে করে দিয়ে বললো–বেশ্যা। ওরা এই সাহসী নারীকে নারী না বলে, বেশ্যা বললো। কারণটা বিশেষ। রঙিন ছাড়াও, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই, তার ঘরে শহরের এক বড়লোক ব্যবসায়ীর আনাগোনা। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মতো ওরা। ঘর বন্ধ করে দেয় যখন-তখন। নবমীতে তখন পুজোর কলরব চলছে। ঢাক বাজছে গুরুম-গুরুম। এর মধ্যেই পাড়ার একটি বৌ আমার কানে ফিসফিস করলো। ওমা! খবরদার। ওর সাথে কথা নয়। ও খুব খারাপ মেয়েমানুষ। এক ভিনজাতের ছেলের সঙ্গে শরীর খাটায়। জানি ও কি বলতে চাইছে। বন্ধুত্ব থাকলেই কি বেশ্যা হয়! বন্ধু ছাড়া মানুষ কি বাঁচে! কথা না বললে! এই যে প্রতি বিকেলে ঐ কলতলায় বসে তোরা নিয়মিত ঝগড়া করিস এও তো একধরনের আড্ডা। শাশুড়ি, বৌয়ের গালাগালি এও একটি অভ্যেস। ঝগড়ার কলরবে, জানিয়ে দেয়া, বেঁচে আছি। বললাম ও যা করেছে, ভালো খুব ভালো। তোদের সে ক্ষমতা নেই। এই যে পরনিন্দে করছিস, এও বিলাসিতা। কথা বলে হালকা হওয়া। ওর এখন সেই মানুষই চাই। আর কেউ যদি তাকে সেটুকু দিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই সে ভালো। ভালো-মানুষ। লাল পেড়ে শাড়ি পরা বৌদি মাথা নিচু করানো। সব মেনে নেয়ার চিহ্ন।

তার নাম রিনি। সুর্বাচন ওর একমাত্র ছেলে। সুর্বাচনের বয়স এখন আঠারো। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজে একবেলা খেয়ে ছেলেকে তিন বেলা খাইয়েছেন। ওকে নিয়মিত স্কুলে পাঠিয়েছেন। প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আর প্রথম দিকে শহরেরই সেই বড়লোকের দেয়া টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে, এনজিওর কাজ, (গৃহ আর শরীর অলঙ্করণ) রাতভর সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রিনির যুক্তি, আমি নিজে কষ্ট করবো কিন্তু সুর্বাচনকে কখনো ওর বাবার মতো কষ্ট করতে দেবো না।

ওর ইচ্ছে পুর্বাচন একদিন অনেক বড়মাপের মানুষ হবে। ভালো মানুষ হবে। এবং ভালো মানুষ হয়ে সে মানুষের ভালোমন্দগুলোকে নিজের ভালোমন্দ বলে ভাববে। যার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই, সুর্বাচন দেবে। পথ্য নেই, দেবে। পথ্য আর ওষুধের অভাবে ক্যান্সারাক্রান্ত স্বামীর শেষ দিনগুলোর যন্ত্রণার কথা রিনির পাথর বুকে মরুভূমির ফসিলের মতো মরে শুকিয়ে আছে।

দিনদিনই রিনির সৌন্দর্য বাড়ছে। যৌবন উথলে উঠছে। ধুতির বদলে রঙিন। রিনির ঘরে শহরের সেই বিত্তশালীর আনাগোনা। একসঙ্গে ওরা চা খায়। আচ্ছা করে। গান গেয়ে ওঠে। ঘর থেকে হাসির শব্দ বাজে। আর সুখের যে-কোন শব্দ পেলে, পাড়ার বুড়ো শিশুদের অসময়ের ঘুম ভেঙে যায়। গালাগাল দিয়ে বলে ওঠে, বেশ্যা মাসি। হেরে বাইর না করলে এই পাড়ায় মান সম্মানে থাকন যাবো না। রিনি ওসব গালমন্দ বাক্যবাণ নীরবে সহ্য করে যায়। তার তো কারো কাছে হাত পাততে হয় না। ওদের কাছে হাত পাতা, শরীর বিছিয়ে দেয়া থেকেও নরক।

রিমি একঘরে। রিমি সমাজ-বিচ্যুত। ওর দোষ মতিনের সঙ্গে সে মাগ-ভাতারে, থাকে। আমি সেই ফিসফিসকে বললাম, তাতে দোষের কি? মানুষের জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কি বাকি জীবনের জন্যে তার সব সুখ চলে যাবে? যদি তাই হয় তাহলে মানুষ বাকি জীবন বাঁচে কি করে? ফিসফিস মেয়েটির মাথা আরো নুইয়ে পড়লো। যেন মস্ত ভুল করে ফেলে সে এখন অপরাধী। বড়লোকের সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হয়। ওকে দেখে মনে হলো, খুব বুঝেছে।

এই বয়সেও কত সখ আমার? সমুদ্রের পাড়ে, স্বামীর বুকে শুয়ে সূর্যের আলো খেতে ইচ্ছে হয়। পূর্ণিমা রাতে এক নিঃসঙ্গ গাছের তলায় শুয়ে ওর গায়ের গন্ধ নিতে আমার ইচ্ছে হয়। ভোর ছুঁই ছুঁই রাতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো চাইতে ইচ্ছে হয় দাও প্রেম, দাও অমৃত সুধা। মধু দাও। দাও গো-ও-ও-ও। এবং আমি জানি মানুষের সুখের চাওয়াগুলো সব, এক। পাথরের তলে, লোহার নিচে, শক্ত মানুষটিও কত দুর্বল তার হৃদয়ের কাছে আমি জানি।

রিনি বয়সে আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট। ওর ইচ্ছেগুলোর বয়সও পাঁচ বছর–তরুণ। তারুণ্যের চাওয়া অধিক প্রখর। কে বলেছে, না! আমাদের সমাজ আজও বলে–বিধবার আবার ইচ্ছে কি? খুলে ফেল হাতের, কানের, গলার! ঝেড়ে ফেল গা থেকে কামের গন্ধ। মেরে ফেল-রতি। হেঁটে দাও মাথার বিনুনি। রঙিন, ফেলে দাও।

রিনিকে সুধালাম ওর ভালোমন্দ। ওকে ঘিরে শোনা নানান নোংরা। রিনি বলেন, যখন না খেয়ে থাকতাম তখন কেউ ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি। আর আজ, ওরা উঁকি দেয় কে এলো দেখতে। বললো, তাতে আমার কিছু এসে যায় না! দারিদ্র আমি ঘৃণা করি। গরিব থেকে থেকে আমার চামড়া পচে গ্যাছে। জানেন! মৃত্যুর আগে সে এমন সব মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাইলো, বললো–আমি কই মাছ, রুই মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাই। আর আমি দশ টাকা কর্জ করে কিনে আনলাম পুঁটি। সেসব মাছ কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। আজ আছে, কিন্তু রঞ্জন নেই। দারিদ্র ঘৃণা করি। …চামড়া পচে গ্যাছে…। কি সাঙ্ঘাতিক কথা তিনি বলতে শিখেছেন! একি তারই কথা! গ্রামের একটি মূর্খ অকাল বিধবার! নাকি দর্শন, যা জীবন ঘেঁটে নেয়া! দর্শনের এই বয়ান, জীবন ঘটতে যারা নর্দমায় যায় শুধু তারাই পাবে। এবং তারাই প্রকৃত মানুষ। রিনি সেই অর্থে প্রকৃত মানুষ। মনে মনে ভাবি।

মতিনের সাথে তোর কি সম্পর্ক! অনেকেই বলছে, মতিন তোকে পৌরসভার ইলেকশনে দাঁড় করাচ্ছে। আর সেজন্য অনেক অর্থও সে ঢালছে তোর পেছনে! পোস্টার, মাইক, আলোচনা! ব্যাপারটা কী।

-রিনি, বললেন হ্যাঁ দাঁড়াচ্ছি। মতি ভাই চায় আমি ইলেকশান করি। চায়, আমি…। বলেই তিনি থামলেন।

আমি মতিনকে চিনি। সে আমাদের প্রতিবেশী। ওদের দুজনের বিষয়ে কৌতূহল ছিল বলেই রিনিকে আমি খুঁজছিলাম। আর সমাজ এজন্যেই, অসুখী। সুখ! মানুষ কি সুখ বোঝে? সুখ মানেই নয়, স্বর্গীয় পবিত্রতা–ব্রাহ্মণ, যা নিষ্পাপ। সুখ, সে নরক থেকেও আসতে পারে। পারে, সঞ্চিত আবর্জনা ঘেঁটে কিছুর সন্ধান করতে। আর এই পেট উগরে আসা আবর্জনার মধ্যে পাওয়া অতীতের কারো এক টুকরো চিরকুট, কিংবা একটুখানি জীবনের সন্ধান পাওয়ার সুখ। কারো কাছে সেটাই স্বর্গ। সেই –জীবন।

বললাম, মতিন তো বিবাহিত। তার ওপর সে মুসলিম। এ তো আগুন নিয়ে খেলা। তোর ভবিষ্যৎ কী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোন দ্বিধা ছাড়াই বললো, মতিন ভাই বলেছে, দু’মাস পর আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবে। তাছাড়া মতিন ভাইয়ের বৌ সারা বছরই অসুস্থ, প্রায় পঙ্গু। সেও জানে। তুই মুসলিম হবি! জিজ্ঞেস করলাম। কেন হবো না। মানুষ মানুষই। ধর্মবোধ যারযার ব্যক্তিগত। সে আমায় বাকি জীবন খেতে দেবে-পরতে দেবে। মতিন ভাই নির্ঘাত দেবতার মতো মানুষ। অন্য কেউ নয় স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সেই আমাকে চরম দুঃসময়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সে নির্ঘাত দেবতা।

এবং এরপর রিনি চলে গেলে আমি ভাবছি রিনি যা পারে, আমি কী পারতাম?

২. দ্বিতীয়া

এরপর এলো একসঙ্গে এক জোড়া সতীনের, একজন। আমার বান্ধবী লিপি। মধ্য বয়সের, ক্ষয়ে যাওয়া চেহারার এক নারী। বাচ্চা হয় না বলে বহু ধর্মকর্ম অনেক টাকা দান-দক্ষিণা, পীর, সন্ন্যাসীশেষে সন্তানের আশা ব্যর্থ হলে শেষে, এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তিনি পরীক্ষা করে বললেন, তোমার যে জরায়ুই নেই! বাচ্চা কি করে হয়? লিপির প্রশ্ন তাহলে এই মন্দির, এই অর্থদান! সব বৃথা। ডাক্তার বললো, ওগুলো ভণ্ডামো। আপনাদের দোষ যে আপনারা ওখানে যান। এবং এই সত্য প্রকাশের এক মাসের মধ্যে স্বামী আবার বিয়ে করলো।

লিপি বললো, নন্দন ওকে ভুলে গ্যাছে। নন্দনের দুই ছেলের মা, সতীনের পাশে সে একটা-না থাকা, ছায়ার মতো। একজন অতিরিক্ত মানুষ যাকে না হলেও চলে। নিজের স্বামীকে এভাবে বছরের পর বছর অন্য নারীর বিছানায় দিয়ে ভেতরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে। বললো এখন সে মৃত্যু চায়। নিজের স্বামীকে অন্যের বুকে বিসর্জন দিয়ে নরকের সঙ্গে তার এক যুগের সংসার সে ঘোচাবে। সে আত্মহত্যা করবে। লিপির দুই মৃত চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন আমার আর ইচ্ছে হলো না বলতে, না মরিস না। বরং বললাম, কর, তোর যা খুশি। তাতেও যদি তোর শান্তি আসে। জীবন আকাশে যখন সূর্যাস্ত, সে জীবন জীবনই নয়। বরং সে জীবন থেকে মুক্তি নেয়া ঢের ভালো। তবুও মনে আমার এক সূক্ষ্ম বিশ্বাস ছিল যে লিপি একদিন না একদিন আলোর সন্ধান পাবে। সে বেরিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত বেরিয়েও এসেছে। শুনেছি, নন্দনকে ডিভোর্স দিয়ে সে সবার বিরুদ্ধে একা, সবার ছিছিক্কার দলিয়ে দিয়ে এক বিপত্নীক তিন সন্তানের পিতাকে বিয়ে করে বিশাল ঘর-গেরস্তি নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই আছে।

৩. তৃতীয়া—

সবশেষে দেখা হলো এমন একজনের সঙ্গে যে আমারই সমস্ত অনুভূতিতে আমাকে সাপটে-লেপটে গেল। মেয়েটি শহরের এক আলোচনার বিষয় বটে। এক বিচিত্র সে। হেঁটে এসে বসলো। কিছুটা আগন্তুকের মতো। আবার চিনি চিনিও ভাব। তার চোখেমুখে ক্লান্তি। ওর দিকে তাকিয়ে সন্দেহ সেই মেয়েটি! না, না। দ্বিতীয় মন বললো, কেন হবে না! পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কি কিছু আছে? কি হাল! অশান্ত অস্থির জীবন খুঁড়ে কোনদিনও কি সে আর, জাগবে? মরা নদী কি জাগে? হা, হ্যাঁ, জাগে। জাগবে না কেন? আয়ুর প্রত্যাশা কার নেই? মৃত্যুর আগেও বলে যাবো না। যাবো না। কিন্তু কবিতা! ওকে দেখে মনে হলো ওর সেই প্রত্যাশা নেই।

বিভ্রান্ত-বিচ্যুতবিদিশা!

মানুষ যখন ভ্রান্তিপাশের শিকার হয়, তখন সে এক ভ্রান্তিপাশ ছেড়ে অন্য ভ্রান্তিপাশে, দৌড়য়। ভ্রান্তিপাশ তাকে ছেড়ে যায় না। তার কাছে মনে হবে এই ভুলই, সত্য। ভুল আর নির্ভুল এই দুটোকেই গুলিয়ে ফেলে ক্রমশই ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো, হাতড়াতে হাতড়াতে একদিন হতাশার প্লাবনে নিঃশেষ হয়ে যায়। অবশেষে সে অস্ত। যায় তার জীবন আকাশ থেকে। মেয়েটির দু’চোখে চাঁদ ছেঁড়া সেই প্লাবন নেই! ছোটবেলায় ওর দু’চোখে প্রতিভার যে আগুন আমি দেখেছি, সে আগুনে আজ জলে থিতোনো ছাই। সে ধসে গ্যাছে।

আমরা একই ক্লাসে একই স্কুলে পড়েছি। স্কুল কেটেছি এক সাথে। আচার কিনে ভাগ করে খেয়েছি। ছোট থেকেই সে ভালো ছাত্রী। গানে ভালো। নাচেও। ওর নাম কবিতা। ওরা আমাদের পাশেই থাকতো। কবিতা আমার মতো। কারো কথাই শুনতো না।

আর একদিন করেও বসলো–যা খুশি। অবিশ্বাস্য কিন্তু ওর জন্যে অসম্ভব নয়। বিলেত যাওয়ার কথা বলে একদিন সে উধাও হয়ে গেল একটি শশীর সঙ্গে। শশী, কবির উপযুক্ত কিছুতেই নয়। সবার মনোযোগ কেড়ে নেয়া এই মেয়েটি–শশীর খপ্পরে কি করে যে পড়লো, ওর বাবা-মায়ের সেটাই দুঃখ। শশী, সব দিক দিয়েই কবিতার নিচু। কিন্তু প্রেম তো প্রেম। প্রেম, অন্ধ। কবিতাই, শশীতে ডুবে গিয়েছিল।

প্রেমের জন্যে অসামান্য ত্যাগের উদাহরণের কি কিছু আকাল পড়েছে? একটি নারীর জন্যে সিংহাসন ত্যাগের মতো ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনী কি, অলৌকিক? প্রেম-সে কি শুধু মোহ? সত্য নয়! স্বর্গ নয়! আলো নয়! যদি নাই হবে তবে, কেন এই সিংহাসন ত্যাগ? আত্মহত্যার মতো ক্ষমাহীনতা! এই দুঃখকষ্টভার! কে ছোট! সিংহাসন। না প্রেম? ধর্মদ্রষ্টাদের রুচিমাফিক, প্রেম। তাহলে তাকে কি বলবো যখন ব্যর্থ প্রেম, মানুষের জীবনকে রক্তাক্ত করে। যখন সে হেলাফেলায় ত্যাগ করতে পারে রাজ সিংহাসনের মতো দুর্লভ সম্মান, সম্ভ্রম। তুচ্ছ করে জীবনের মায়া। আর সেকথাই প্রমাণ করলো কবিতা।

শশী ভালো ছেলে তবুও কবিতার যোগ্য সে নয়। কিন্তু কবিতার চোখে শশী, শশীই। রক্তে হলুদ লাগা পূর্ণিমার চাঁদ সে! শশী ভালো-মানুষ। আর এই ভালো মানুষকে কবিতার বড়ই ভালো লাগতো। পুতুল-পুতুল। সুন্দর। সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখতো কাব্য করে। ওকে দেখলেই কবিতার চুমু খেতে ইচ্ছে করে। শুতে ইচ্ছে হয়। কবি, যৌবনে উত্তাল এক অনন্য কিশোরী।

এক কালের জমিদার বাড়ির মেয়ে কবিতা। জমিদারি নেই। তবে রক্তে আছে ঐতিহাসিক পাপের অতীত। বংশের একটা দুর্নাম আছে। লোকেরা আজো বলে, কবিতার জেঠতুতো কাকার ঠাকুরদা জমিদার ইন্দ্রমোহন সেন, প্রজাদের কর অনাদায়ে নিতেন, তাদের জমি আর সঙ্গে সুন্দরী মেয়ে। অমন অত্যাচারী জমিদার সে সময়ে নাকি আর দ্বিতীয় বলতে কেউ ছিল না। কবিতা তাদেরই বংশ। কিন্তু একবারেই উল্টো সে। শীতের শিশিরকণার মতো সরল। আবার বর্ষার মতো অস্থির। তবে বিদ্যা-বুদ্ধিতে অসামান্যা হলেও, সে হৃদয়ে শিশু। যে শিশুটি তার গোলাপি ভবিষ্যৎ ভালোবাসার কাছে সব তুচ্ছ করে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তও ভাবলো না, … তারপর?

শিগগির বিলেত যাচ্ছি। বিলেত! কেন-কোথায়-কার কাছে-কবে-কি করে! যা জিজ্ঞেস করতেই বললো, একটা ভিসা জুগিয়েছি। প্রথমে নার্গিসের ওখানেই থাকবো। পড়বো। চাকরি করবো। দেশে ভবিষ্যৎ নেই। নার্গিস ওর বান্ধবী। মা সেকথা ভালো জানেন। শুরু হলো ওর বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি। জিজ্ঞেস করলেই মাকে একটা কিছু বুঝিয়ে দেয়। চালাক হওয়ার সুবিধেই তাই। চটজলদি বুঝিয়ে থিতিয়ে দেয়া যায়। কবিও বোঝাত। কবিকে বিশ্বাস করা না করার কারণ নেই, কারণ কবির জন্যে আশ্চর্য কিছু নেই। তবে ওকে বাধাও দেয়া যাবে না। দিলে শুনবে না। ইংল্যান্ড যাওয়াটাকে সে এভাবেই বাড়িতে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করে নিলো। মা ভাবলো, যাক এই সুযোগে সে শশীকে ভুলে যাবে।

সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা। বিপদ বুঝে দু’জনে মিলে ঠিক করলো পালিয়ে প্রথমে রাজশাহী যাবে। গিয়ে প্রথমে সেলিমের ওখানে উঠবে। তারপর রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবে। আর এই পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির নামই বিলেত যাওয়া।

নেই-নেই, লন্ডনের কথা বলে ছ’মাস ওরা নিখোঁজ। শশী আর কবি রাজশাহীতে আছে, কিন্তু বিয়েটা হয়ে ওঠে না। দু’পক্ষেরই বাবা-মা সেকথা জানেন। পরস্পরকে দোষারোপ করেন। শহর জাগিয়ে ঝগড়া করেন। অভিশাপ দেন। ও বলে তুমি, সে বলে তুই। আমার ছেলেকে, আমার মেয়েকে, ভাগিয়ে নিয়েছ, নিয়েছিস, তুই, তোরা, তোর ছেলে, তোর মেয়ে, এ্যাই! এ্যাই। ওরা কেউ যাবে না, কিছুতেই ওই নচ্ছার ছেলেকে-মেয়েকে দেখতে যাবে না। ছ’মাস বাড়িতে শোক। প্রচার হয়ে গেছে–ওদের বিয়ে হয়নি। এমনিই থাকছে। দুর্নামের পর দুর্নাম। বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে শশী আর কবিরও সন্দেহ। তবে সই দিয়ে কিছু ঘটেনি। তাকে কী? ওরা সংসার করে। যায়। আইন ও সমাজের চোখে স্বামী-স্ত্রী হতে হলে সই লাগবে। সামনে বিপদ।

ছ’মাস পর। শুধু প্রেমে হাবুডুবুতে কি পেট ভরে? ভরে না। সঙ্গে যা ছিল, ফুরিয়ে আসছে। ভালো কোনও কাজ হলো না। কথায় আছে, সুখ ছাড়া প্রেম জানালা খুলে পালিয়ে যায়। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। তবুও সংসার। মাটিতে পড়ে থাকা তোশক। দু’চারটে বাসন। দুজনেই জানে, আনুষ্ঠানিক বিয়ের অর্থ ওদের নেই। প্রয়োজন ভালো কাজ। কাজ হলো। বাসা হলো। আর আনুষ্ঠানিকতার রাতেই, দুর্বলচিত্তের শশী, যার নামের সাথে আসে চাঁদের কলঙ্ক, হঠাৎ উধাও। নেই তো নেই। কোথাও নেই। কবি পুরো এক সপ্তাহ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াল ওর শশীকে। কেঁদে-কেটে অনাহারে অসুস্থ হলো। তবুও ফিরে যাবে না। যদি শশী ফিরে আসে। মা বলছে, ও বাবা-মায়ের কাছে চলে গ্যাছে। কবি বিশ্বাস করে না। সে যাবে না। কখনো না। বাবা-মা ঘরে তালা দিয়ে ওকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে সাঙ্গ হলো ওদের ছ’মাসের স্বামী-স্ত্রী খেলার সংসার। যেখানে প্রেম থাকলেও সই ছিল না। এবং যুতসইভাবে ফিরে যাওয়ার পর বিয়ে হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে দুই পক্ষের তুলকালাম, প্রায় লাঠালাঠি। সই হলে এক, না হলে অন্য। শশীকে ওর বাবা-মা প্রহরায় আলাদা করে রাখলো।

শশীর কাছে কবি ছুটে চলে যায়। –আমি যাবো। যেতে দাও। ওকে ধরে রাখা যায় না। লোকেরা ভিড় করে তামাশা দেখে। মন্তব্য করে। কবিকে ওরা বাড়ির সীমানায় আসা বন্ধ করে দিলো। তবুও কৌশলে শশীকে সে দেখে, যাচ্ছে, আসছে। কিন্তু শশী ওকে দেখলে চোখ ঘুরিয়ে ফেলে। যেন-চেনেই না। একি কোনও কষ্টের মুখোশ! এড়িয়ে যাওয়ার! শশীকে ও নাম ধরে ডাকে। কেঁদে কেঁদে ডাকে। শশী একবার কথা বলো। একবার! ধর্ম মনুষ্যত্ব বলে কি তোমাদের কিছুই নেই? শশীর ভেতরে তুফান। ভুলে যেতে হলে, না চেনাই ভালো। না চেনার ভান করে কবিকে ভুলে থাকে। কঠিন সমাজ। সামাজিক কেলেঙ্কারি। এই ঘটনার শেষে ওকে ভুলতে হবেই। হঠাৎ একদিন শশীকে আর দেখা গেল না। সেই থেকে ওর কোনও সংবাদও কেউ আর জানলো না।

তারপর থেকে কবি, পুরো একবছর অসুস্থ। ভোলা কি যায়? যাওয়া কি এতই সহজ? প্রেম, যাকেই ভালোবেসে গড়ে ওঠে সে ভুল হোক আর ঠিক, তার কাছে সেই প্রেম সত্য। সে যত দরিদ্র বা যত কুৎসিত হোক, প্রেমের একটা তৃতীয় চোখ থাকে। সে চোখ অন্ধ। সেই চোখ শুধু তার সৌন্দর্য ছাড়া নোংরা দেখতে পারে না।

অভ্যস্ত প্রেমের শূন্যতা কি অত সহজে মেটে! কবি ওর নিজস্বতা হারিয়ে এবার ভিন্ন এক কবিতে রূপান্তর হয়। এই কবির সঙ্গে আগের কবির কোনও মিল নেই। শূন্যতা পূর্ণ করতে সে নতুন ভ্রান্তিপাশের খোঁজে বের হয়। অস্থির দুর্বলচিত্ত শুধু তাকেই খোঁজে আর খুঁজে খুঁজে হয় আরো ও ভ্রান্তিপাশের শিকার। স্বাভাবিক বুদ্ধি-জ্ঞান তখন লোপ পায়। কবিকে নিতে হলো পাগলের ডাক্তারের কাছে। একবছর, দু’বছর…। কবি সুস্থতার দিকে। তিন বছর পার হয়ে গেল শশীর চলে যাওয়ার। কবি একটু সেরে উঠেছে অতীতের ক্ষত থেকে। এবার বিধান। সে মুগ্ধ হয়। বিধানে সে, শশী দেখে। যেন যমজ দেখে। শশীর কাল সাপটিকে হত্যা করতে কবি দৌড়য় বিধানে।

দুটো ফুল একই বৃন্তের না হলেও যদি একই গাছে ফোটে বা পাশের গাছটি যদি এপাশের গাছের মতো হয় তবে, যমজ নয় কিন্তু ফুলগুলো গন্ধে, বর্ণে, রূপে, রসে এক। ফুটবে এক সাথে। ঝরবেও একই সাথে। পরমায়ু–উদ্দেশ্য–জীবন, সবই এক হবে। শশী আর বিধান এক বৃন্তে না হোক, একই পরামায়ুর। একই পরিতাপের! কবির সন্দেহ যায় না।

কিছু মানুষ জন্মায় সুখ করতে। আর কিছু মানুষ, দুঃখ। কিছু ভালো মানুষ যারা সহজ, সরল, যারা প্রথার তোয়াক্কা করে না, যারা জীবনটাকে দেখে শুধুই ফুরিয়ে যাওয়া পরমায়ু! পৃথিবীতে যাদের জীবনে প্রেম ছাড়া, স্নেহ ছাড়া চাইবার কিছু নেই, যারা পৃথিবীর এত জটিলতা, এই পঙ্কিল আবর্জনা, এত মিথ্যে, নিষ্ঠুরতা, অসুন্দরকে চোখ বুজে এড়িয়ে যায়, যারা বোঝে না কোনও হিংসে, কোনও জাত-বিভেদ! কিছু মানুষ আছে। সত্যিই কিছু মানুষ আছে যারা, উত্তমকে তাদের জীবন দর্শনে অবলম্বন। করে, শুধু কষ্টই পায়। আর কষ্ট করতেই শুধু, জন্ম তাদের।

তারা নির্বোধ নয়, তবে সরল। ফলে মানুষের প্রতারণার বিষ খেয়ে, ওরা নীলকণ্ঠ শিবের মতো নীল হয়ে যায়। নিষ্পাপ, কখনো কখনো অতিরিক্ত সারল্যের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করে দুঃখ। আর কবির মতো সহজ-সরল মেয়েরা, সেই দুঃখই পায়।

কবিতা সেই নীলকণ্ঠ শিবের বিষ। গেছে শশী। এবার গেল বিধান। কি অন্যায়! ভাবে কবি। সেদিন কবি গিয়েছিল–আশুলিয়ায় একটা কাজে। সেখানেই বিধানকে দেখতে পায় অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে। ফ্যান্টাসি আইল্যান্ডে ওরা এক প্লেট থেকে তুলে দু’জন ফুচকা খাচ্ছে। খাইয়েও দিচ্ছে। হাসছে। হাসতে হাসতে প্লেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে। চুলের বিনুনি পড়ছে প্লেটে। কৃত্রিম খেজুর গাছের শরীরে। তারপর আইসক্রিম। আইসক্রিমের পর ফের ফুচকা। তারপর চটপটি। নতুন প্রেমের সব ছেলেমানুষির চিহ্ন। কবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো।

কত সুখ ওদের! দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবি হাঁফ ছাড়ে। ক্লান্ত দেহ মন। আর পারে না। বিসর্জন দিতে চায়। তাও পারে না। ভ্রান্তিবিলাস ওকে সুস্থমতো ভাবতে দেয় না। হৃদয়, বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায়। তৃতীয় চোখে বলে–এটা স্বপ্ন। এই দেখা, ভুল। ওর মতোই কেউ! কিন্তু সে নয়। হায়! কি কঠিন কি দুরন্ত কঠিন এই, বাস্তব! ইচ্ছে হয় মনটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে। অনুভূতিগুলোর শেকড়টা উপড়ে নির্বংশ করতে! তবেই হয়তো কাউকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছে হতো না। এই যে বিধান গতকাল ওর নাইকুণ্ডলীর নিচে নেমেছিল বলে ওর সকল সঞ্চিত স্মৃতি, আর আজ এই যে অন্য একটি মেয়ের নাইকুণ্ডলীর ওপরে ওর হাত, তলিয়ে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি, রাতে যে প্রস্তুতি প্রাণ পাবে সজ্জিত সম্ভারে! সইতে না পেরে হাতের কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলে। খেজুর গাছে মাথা কোটে। আকুল কাঁদে যেমন কেঁদেছিল একদিন শশীকে হারিয়ে। এবার সে একটা রিকশায় চেপে বসলো। বিধান মেয়েটির সঙ্গে গাড়িতে। হাসতে হাসতে গাড়ি চালাচ্ছে মেয়েটি নিজে। পাশেই শীতলক্ষ্মা। রাজ্যের নোংরা-যতরকম আবর্জনা-নৌকোর অস্থিরতা-জেলের ভারি জাল-সব ছুঁড়ে ফেলা দায়ভারে যন্ত্রণা বুকে করে বয়ে চলে, অভিযোগহীন। কবি বাড়ির দিকে যায়। যেতে যেতে তাকায় জলের গভীরে।

আজ এই দুর্গা পুজোর নবমীর রাতে, এই ঢাকের বাজনার ভিড় ছাপিয়ে যে মেয়েটির ক্ষীণ কণ্ঠ আমার কানে আজও বাজে, যে মেয়েটির অযত্নের বিশাল জটপাকানো চুল আমার চোখে বাধে, যে–যে মেয়েটির হাতে নোংরা দুর্গন্ধ–কাপড়ের পুটলি থেকে উদ্ভট গন্ধ–আমার নাক পুড়িয়ে দেয়! পেটিকোটে যার বারো মাসের ঋতুর রঙ লাগানো। লাল ছোপ ছোপ। পথে পথে পড়ে থাকে, ঘুমোয়, আকাশের নিচে। নোংরা, গন্ধ, অসুস্থ, উকুন, পেচ্ছাব সব-সব মিলে যে, নরক! ঠিক ধরেছেন এই সংসারত্যাগী, এই প্রথা ভাঙুনী, কবিতা। সে এখন পূর্ণ পাগল।

হ্যাঁ ও পাগল হয়ে গ্যাছে। পা-গ-ল! পা-গ-ল! লোকেরা সিটি দেয়। পেছন পেছন ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ গান গায়। খোলা আকাশের তলে ইচ্ছে হলেই ওকে চুদে দেয়। প্রতিবাদ করে করে, প্রতিবাদ করা সে ছেড়ে দিয়েছে। পেট ফুলেছিল দু’বার। বারবার ধর্ষণে রক্তপাত হয়ে জণগুলো ধুয়ে গেছে। শহরের মানুষ ওকে চেনে। ব্যথায় কষ্ট পেলে–কেউ এসে ওকে ট্যাবলেট, কেউ খাবার দেয়। শহরের লোকেরা এই জমিদার বংশের কন্যার জন্যে দুঃখ করে। ওকে দয়া করতে চায়। নতুন শাড়ি। টাকা। সে হাতজোড় করে বলে, না-না-না। অতীত ভুলে গেছে সে। দুটো নাম তার মনে পড়ে। শশী আর বিধান। মাঝে মাঝে দূরে তাকিয়েই থাকে। থাকে তো থাকেই। অথচ দেখার কিছুই নেই। তবুও সে দেখে। ওদের কথা বলতে বলতে কবি খালি হাসে। হেসে ভেঙে পড়ে। ওর মধুর স্মৃতি কথা। একমাত্র সম্পত্তি।

কবি মাঝেমাঝেই এই শহরের দুটি বাড়িতে যেতে ভুল করে না। ঘর-সংসারী বিধানের বাড়িতে গেলে বিধান ওকে চেনে না। কবি তবুও বিধানকে হেসে হেসে কি যেন বলে, সেই জানে। কিন্তু শশীটা আজকাল মায়া করতে থাকে। কবি গিয়ে একটু দাঁড়ায়। কিছু বলে না। কিছু চায়ও না। দুয়ারে শীতল দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক পর চলে যায়। এটা ওর একটা নিয়মের মতো।

শশীর এই শহরেই বড় চাকরি হয়েছে। ভালো টাকা বিয়ে-থা সংসার হয়েছে। তবুও ইদানীং বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা কবিকে কেন্দ্র করে নষ্ট হয়েছে ওর। ওর বিবেকে কোথাও গণ্ডগোল বেঁধেছে। একটি মেয়ে, ওর নারী, একদিন যাকে ভালোবেসেছিল। যার শরীর নিয়েছিল। ইদানীং শশীর অপরাধবোধ, সমাজবোধকে ছাড়িয়ে গেছে। সে বিবেকের সগ্রামে ভোগে। ইদানীং সে অস্থির, অশান্ত। কবিকে। বললো, শোন! ওভাবে আর রাস্তায় রাস্তায় নয়। এসো তোমার জন্য একটা ঘর ভাড়া করে তোমাকে চিকিৎসা করাই।

কবি দুই হাত জোড় করে তার নিজস্ব ভাষা ও উচ্চারণে বললো–এই কথা কইয়েন না। …হা সত্যি, দয়া করে এই কথা বলবেন না। আপনাকে আমি চিনি। আপনিও এক প্রতারক। আমি বৈধ নই তাতে কী? কেন সেদিন প্রতিবাদ করলেন না? কি জন্যে? আর আজ কেন? জানেন না, আমার আমার, শশী আছে! তাকে নিয়ে আমি সুখে আছি। জানেন না! রাস্তা ভালো। সেখানে আমি স্বাধীন। আমি ঘর চাই না। কিছু লাগবে না। কিছু চাই না। না-না-না। বলতে বলতে, কবি হেসে গড়িয়ে পড়ে। শশী চুপ করে শোনে। মনে করার চেষ্টা করে, অতীত। আমার শশী! পুরোনো, পরিচিত। চির নতুন। গায়ে শিহরণ হয়। ফের মিলিয়েও যায়। স্নেহভরে, ভাত খাও কবিতা! ভাত! শশী, পরমস্নেহে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। এবার করুণ চোখ তুলে কবি বললো, দিবা! দেও। শশী নিজ হাতে ওর জন্যে একথালা ভাত-মাছ এক গ্লাস জল নিয়ে এলো। এইখানে বসো কবি–এইখানে। ভাত খাও, বললো। পেছন পেছন ওর স্ত্রী আর দুই মেয়েও এসে দাঁড়ালো। কবি খেয়ে চলে গেল। শশীর চোখে জল। বললো, কাল এসো। খেয়ে যেও–কবি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত