০৯. মেয়েদের যৌনজীবন
মেয়েদের যৌনজীবন সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। আমরা ভাবি, সংসারের অন্য অনেক দায়িত্বের মতোই নারীর যৌনজীবনটাও যেন সন্তান উৎপাদন যন্ত্র আর স্বামীর সুখের গর্ত। আবার এও বিশ্বাস করতে হয় যে মেয়েদের যৌনজীবন সাময়িক। যেমন বিয়ের প্রথম কয়েক বছর কিংবা গুটি কতক সন্তান সৃষ্টি। এবং এই পর্ব শেষ হতে না হতেই দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। শুরু হয় দাম্পত্যে। অরুচি। কেন? মেয়েরা অনেকে নিজেরাও জানে তাদের এই সীমিত জীবনের কথা।
আজ এই আধুনিকতার যুগেও, আমাদের মা-মাসিরা তাদের জীবন গুটিয়ে ফেলে, সন্তান-সন্ততি প্রসব শেষ হতে না হতেই। পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ বা তার কিছু কম বয়সেই আমাদের মা-মাসিরা, স্বামীর বিছানা ছেড়ে স্বেচ্ছায় আলাদা বিছানায় ঘুমোতে শুরু করে। তাদের ধারণা, একটা সময়ের পরে সঙ্গম আর করতে নেই। ওতে স্বামীর পৌরুষই নয় আয়ুও নষ্ট হয়। নারী নিজেও নিজেকে গুটিয়ে নেয় ভেবে যে ওসব আর নয়। এখন সময় মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন।
কিন্তু বাস্তব মেনে নিলে, মেয়েদের যৌনজীবন আসলেই সেরকম নয়। শিক্ষার অভাব, কুশিক্ষা এবং অপসংস্কারে অভ্যস্ত মেয়েরা জানে না বা জানতে চায়ও না যে, তাদের শরীরের চাহিদা এবং কামনা-বাসনা অনুশীলন –প্রয়োজনীয় এবং উচিতও। নারীর শরীর অনেকটা বেস্ট সেলার বইয়ের মতো। বেস্ট সেলার। বিয়ের পরপরই প্রথম প্রথম স্বামীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দু’এক বছর গেলেই রুচি চলে যায়। তখন দিশেহারা মেয়েগুলো বুঝে উঠতে পারে না কাজের মেয়ের মশারির তলায় যাকে দেখলো বা গেস্ট হাউজ থেকে ফিরে আসা এই অতি সুখী স্বামীকে নিয়ে ওরা কি করবে!
সেকচুয়ালি উজ্জীবন, সঙ্গম, প্রেম বা প্রেমের চিন্তা একটি মানুষকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে পারে উজ্জীবিত রাখার সঙ্গে সঙ্গে। স্বীকার করি আর নাই করি যৌন বিষয়ক চিন্তা, অন্যান্য সুস্থ চিন্তার মতোই, বদ্ধ জলাশয়ে ঝরনার নতুন জলের মতো। প্রাণের সঞ্চরণ হয়, উজ্জীবিত হয়। চেহারায় আসে কমনীয়তা। ঝিমোনের বদলে ঝিকিয়ে ওঠে চোখের তারা। যখন জানে তার জন্য রয়েছে কারো ভালোবাসা। কেউ তাকে ভালোবাসে। দূরে বা কাছে। মেয়েদের মন ও চেহারায় দ্রুত বার্ধক্যের আরেক কারণ আর হারিয়ে যাওয়া হীরে সমেত–যৌন অনুভূতি। যে অনুভূতিমালা উপভোগের চেয়েও মূল্যবান। মানসিক অনুপ্রেরণাও। অনুভবের মাধ্যমে অনুভূতিকে ধরে রাখাও একটি বিরাট কাজ। একটি শিল্প। শিল্পচর্চা। শিল্পবোধ। শিল্পীর অলঙ্করণ। সাধারণ জীবনের প্রতি আগ্রহের বিকাশ ঘটে এভাবেই। প্রেম ও শরীর বিষয়ক ভাবনা, অস্বীকারের উপায় নেই যে, এক ধরনের প্রেম তাড়না, চাঞ্চল্য জাগায়। আগ্রহ ফিরিয়ে আনে। জীবন জাগায়। সুস্থ প্রেম বা কামনা, এসব চিন্তার কোনও বিকল্প নেই।
তবে নারী এবং পুরুষের যৌনজীবনকে অনেকগুলো বিষয়, বাইরে এবং ভেতরে প্রভাবিত করতে পারে। বিয়ের প্রথম দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে সন্তান-সন্ততিরা যা জন্ম নেয়ার তা জন্মে যায়। সন্তান সৃষ্টির আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে যৌন আকর্ষণ তা কমতে কমতে প্রায় শূন্য এসে দাঁড়ায় বিয়ের চৌদ্দ কি পনেরো বছরের মাথায়, হয়তো তার মধ্যেই তাদের শেষ সন্তানটি জন্ম নিয়েছে। এই পনেরো বছরে মা-বাবা দু’জনই ব্যস্ত থাকে সংসারের সমরাঙ্গনকে সামাল দিতে। কারণ তখন প্রধান দায়িত্ব হয়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করা। কারো হাই স্কুল, কেউ কিন্ডারগার্টেন। দায়িত্ব এবং বাস্তবতা নিয়ে দু’জনকেই থাকতে হয় ব্যস্ত। এবং এই পনেরো থেকে কুড়ি বছর সময় হলো তাদের জীবনের সবচেয়ে জটিল সময়। এই সব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক উদ্ভূত সমস্যার কারণে সামাজিক এবং সাংসারিক দিক থেকে নিজেদের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আকর্ষণ অনেকটা কমে গিয়ে তারা পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। এত বছরের এই সঙ্গত ব্যবধানে এবং নিজেদের দূরত্বের কারণে শারীরিক আকর্ষণ কমে যাওয়াও স্বাভাবিক। মানসিক যোগাযোগের ব্যাপারেও তাই। এরই মধ্যে ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে।
এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে নিজেদের জন্যে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। সন্তানদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়টা পার হয়ে যাওয়ার পর, অন্য মন, অন্য শরীর নিয়ে তখন দু’জনই আবার সম্পূর্ণ নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাও হয়ে উঠতে পারবে। কিংবা চিড় ধরে যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক সময়েই হয়তো এই দীর্ঘ ক’বছরের সৃষ্ট দূরত্বে, দু’জনের প্রতি দু’জনের আগেকার সেই আকর্ষণ আর একই তরঙ্গে বইছে না। তার মানে এই নয় যে তাদের কাম বা রতি কমে বা শেষ হয়ে গ্যাছে। তখন তাদের মধ্য বয়স। তাদের আকর্ষণ অন্য নারী বা অন্য পুরুষে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই সত্য। শরীরে ফের অনুভূত হয় প্রথম যৌবনের পুলক।
তখন মেয়েদের মেনোপজের ঠিক সাত থেকে দশ বছর আগের বয়স। এই বয়সে মেয়েদের অনুভূতি আগের চেয়েও অধিক হতে পারে। মধ্য বয়সে ফের ফিরে আসতে পারে নতুন করে তার মধ্যে প্রথম যৌবনের প্রেম, মন ও মানসিকতা। নারীর শরীর, তার মেনোপজের অল্প আগে, বয়স ও সময় পরিবর্তনের ক্রান্তিকালে হয়ে উঠতে পারে, জান্তব। যে জান্তবতা সে আগে কখনোই অনুভব করেনি। নতুন উন্মাদনা, শরীর নিয়ে। পুরুষ সেও শরীর শৈথিল্যের পূর্বে বা বীর্য কমে আসার আগে অনুভব করে ভিন্নতা। সেও খুঁজতে পারে, অন্য জীবন। এখান থেকে আবার প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় যা অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। এই ঝড় কখনো স্থিতি পায়। কখনো ধ্বংস করে দেয়। আর সবকিছুর মূলেই কিন্তু কাজ করে ঐ মধ্য বয়সে।
পরকীয়া, বা অন্য কোনও অভ্যেস, অভিজ্ঞতা, বিকল্প, যার ওপর কারোরই নিয়ন্ত্রণ নেই। নারী এখানে পরাজিত পক্ষ। একে অশ্লীলতার ব্যাখ্যা দিয়ে উতরানো যাবে না। ভুল করেও যদি কেউ ভাবে নারীর যৌনজীবনে বয়সের সাথে সাথে ভাটার টান নেমে আসে তাহলে বুঝতে হবে প্রকৃতি সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবে হ্যাঁ, পুরুষ এবং নারীর যৌন অনুভূতি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন তরঙ্গে বদলাতে পারে। এই পরিবর্তন বোঝার মতো বিশুদ্ধ বুদ্ধি, খোলামেলা মন, আলোচনা, জানাজানি সবই জরুরি। এ নিয়ে লজ্জার কিছু নেই। খোলামেলা শিক্ষামূলক যৌন বিষয়ক আলোচনা সমস্যাগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়। এখন এসব আলোচনা পারিবারিক বা ঘরোয়া হওয়া উচিত। মুক্ত খোলামেলা বিজনেস্ হিসেবে। এবং সেটাই ভালো। সেটাই মঙ্গল এবং বিজ্ঞানসম্মতও।