মধ্য বয়সের সঙ্কট: ০৮. দাম্পত্য, সমাজ, সংসার

মধ্য বয়সের সঙ্কট: ০৮. দাম্পত্য, সমাজ, সংসার

০৮. দাম্পত্য, সমাজ, সংসার

১. মধ্য বয়সের নিক্তি

বিশ্ব সংসারে আমাদের সৃষ্ট নানাবিধ সাংসারিক সামাজিক সঙ্কট যার দায়ভার পরবর্তীকালে আমাদেরই বইতে হয়। আমরা সৃষ্টি করি সংসার। তার কারণ আমরা সামাজিক জীব। সৃষ্টি করি সন্তান। সংসার ও সন্তান থাকলে থাকবে অর্থনৈতিক বিষয় আশয়গুলো। সংসারের ঘানিতে চাহিদা থাকে। থাকে দায়িত্ব। সেগুলো মেটাতেই হয়। আর থাকে দাম্পত্য, যা থাকলে তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী থাকবে কলহ। থাকে অভিযোগ।

স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি দেবর, ননদ, ননদাই, জেঠা, খুড়ো, তালতো ভাই, বেয়াই …। সব নিয়েই তো সমাজ! সমাজ আছে বলে আছে সামাজিকতা। পালন করলে অনেক বড়। না করলে কিছুই নয়। সমাজ বলে বিশাল এক বাধ্যবাধকতা আছে, যার কারণে চাইলেও ভালো থাকা থেকে, স্বাধীন জীবনযাপন থেকে পেছনে পড়ি, পিছিয়েও পড়ি। সংসারে কত রকম নিয়ম-যৌক্তিকতা। পালন না করলে, নেই। করলে অনেক কিছু। আবার না করলে–হায়-হায়! ও করলো না! কেন করলো না! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! কেন কি হয়েছে! কি হয়েছে! খোঁজ! খোঁজ! ওর পেছনে কতগুলো ছিদ্র, কতবড় ঘা ওর গুহ্যদ্বারে। এটাই সত্যি এবং এর সবই আমাদের বোধের অক্ষমতা! দায়ভার। বোধ, যা বুদ্ধির উঁচু বা নিচু স্তরের, থার্মোমিটার।

জীবনের সকল সঙ্কটের পুঞ্জীভূত ও পরিপূর্ণ মেঘ যে আকাশে, তার কেন্দ্রবিন্দু হয় আমাদের মধ্য বয়স! কেন এবং কি এই মধ্য বয়স? আর এই বয়সে কেন, অতীতের ফেলে আসা বা আগামীর আকণ্ঠ সঙ্কটের সকল ভার এসে মুখ থুবড়ে পড়ে? কিসের এ ভারসাম্যহীনতা এই ‘৪৫’-এ! প্লাস-ও মাইনাস, ফাঁইভ। মানুষ যদি গড়ে নব্বই বছর বাঁচতো, তবে ৪৫-কে বলা যেতো নিক্তির মধ্যস্থলের কাঁটা, যেখানে ডাইনে–বায়ে মিলে ওজনের একটা ভারসাম্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মানুষের গড়পড়তা আয়ু তো মাত্র ৫৫ থেকে ৭০। কিন্তু বাস্তবে ৪৫-এর আশপাশে ভিড়েই মানুষ প্রথমে নড়ে ওঠে তার সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে। তার অতীত তার ভবিষ্যৎ এবং তার বর্তমান। এবং এই ৪৫-এর প্রকৃত অর্থ হতে পারে মৃত্যুর সময় কতটা বাকি তার চেয়েও বরং জীবনের পথ কতটা পেরিয়ে এলাম। এবং ফেলে আসা পথের সকল ভুল-ভ্রান্তি ফিরে দেখা। অতীতের কত জানা-অজানার ভুল থেকে উদ্বুদ্ধ পরিতাপ। দাম্পত্য, শরীর, মন, সমাজ, সন্তান, অর্থ সম্পদ, ধর্ম সব ভারের প্রভাব এসে এখানেই ঘাঁটি গাড়ে। খুঁটি শক্ত হলে সে ভার টেকে। না হলে নড়ে যায়।

২. পাল্টানো জীবনের মোড়

মধ্য বয়স, জীবনের মোড় পাল্টানোর শুরু এখান থেকেই। পথ পরিবর্তন, বিকল্প, বিচ্যুতি, বিধ্বস্ত, গড়ে ওঠা, সূর্যাস্ত, চন্দ্ৰাস্ত-এখানেই। সব এখানেই। যাকে ভালো লেগেছে এতকাল, সেই দাম্পত্য আর ভালো লাগে না। এখন ভালো লাগে অন্য একজনের ঠোঁট, কি চিবুকের গাঢ় তিল। কৃষ্ণকালো চোখ কিংবা তার শাড়ির আঁচলের পাটপাট ভাঁজ। আগে, সপিং মল না হলে মাতালের নেশা না জমার মতো গা বমি বমি লাগতো। আজকাল বরং শুনলে, গা বমি বমি লাগে। আগে লাগতো শহর, এখন গ্রাম। লাগতো গ্রাম, এখন শহর। আগে মাসে একবার সঙ্গমেই হাঁপিয়ে উঠতো আর ৪৫-এ পৌঁছে মনে হয় আহা কত প্রেম! কতরূপ তেরা মাস্তানা! কত কাভি কাভি মেরে দিল মে! মনে বসন্ত আর চোখে সবুজ। তার চোখে সে সুচিত্রা সেন। তার চোখে সে উত্তম কুমার। ওকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ। মনে হয় কবি নজরুল। বিছানায় নিজেকে মনে। হতো জন্তু! এখন মনে হবে নপুংসক। আগে যেতো বেশ্যালয়; এখন মন্দির-মসজিদ। ক্লাব ছেড়ে দিয়ে হজ। মন্ত্রিত্বেও সুখ নেই। উল্টো মনে পড়ে মায়ের কবর। পেশার চেয়ে ভালো লাগে নেশা। মাছ ধরা, নৌবিহার। সন্তানকে মনে হবে অভিশাপ, মনে হবে বন্ধু। মুখ দিয়ে মিথ্যে বেরোত না। কিন্তু অসদাচরণ এমন পেয়ে বসলো যে টাকার লোভে বা পরকীয়ায় এক মিথ্যে লুকোতে সহস্র মিথ্যে। একসময় মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যেও আর রোচে না। টাকার লোভ–সেখানেও ক্লান্তি এসে যায়।

অতীতের ছলচাতুরি প্রতারণা সে অভ্যেসেও মোড় ঘোরে। বা অতীতের সৎ-সাধু জীবন, ছলচাতুরি প্রতারণার প্রভাবে সিক্ত হয়। জীবনের রুপোর কাঠি-সোনার কাঠি, দিক পাল্টায়। যে নেশাখোর ঢোকে ঢোকে শ্বাসের সঙ্গে মদ গিলতো, তার ভালো লাগে শুষ্কতা। জীবনে যে ছোঁয়নি, প্রয়োজনে সে পচা পান্তার বাংলা গিলতে হরিজন পল্লী ছুটে যায়। ইচ্ছে হয় নতুন বন্ধনের। নব বন্ধুত্ব। কামনা হয় নব্য শরীর। বদল হয় দাম্পত্য রুচি। জাগে নতুন অনুভূতি পুরুষে, নারীতে। জাগে মাতৃত্বে। চেতনা হয়। অতীতের অবহেলা থেকে। নতুন দায়িত্ব কর্তব্যবোধ এসে শির উঁচু করে দাঁড়ায়, ক্ষতিপূরণ চেয়ে। সকল দায়িত্ব কর্তব্যবোধ পালন করতে গিয়ে নিজের প্রতি চরম অবহেলা। নিজেকে খুইয়ে, সংসার,অন্যের প্রভাবে নিজের সব খুইয়ে মানসিক ও বৌদ্ধিক যন্ত্রণা–সব এখানেই, এই ৪৫-এই। এখানে ভারসাম্যতার নিক্তি ডাইনে বায়ে দুলতে থাকে।

আমাদের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয় মূলত আমাদের সমাজ দ্বারা। সমাজের প্রচলিত অনিয়ম। মরচে ধরা সমাজের সেকেলে অবিচার। শ্বশুর-শাশুড়িসহ একান্নবর্তী পরিবার আমাদের। কিন্তু পরিবারের নববধূটির ওষ্ঠাগত প্রাণ। তার ওপর চাপানো সংসারের সব দায়িত্ব। তার ওপর পরীক্ষা আর পরীক্ষা। সতীত্বের পরীক্ষা, মাতৃত্বের, জরায়ুর। সকলের চাহিদা তারই ওপর। তাকেই বিয়ের নামে এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে স্থান বিচ্যুত করা হয়, এবং এনে তাকে কঠিন শাস্তি ও পরীক্ষার আগুনের সামনে নিক্ষেপ করা হয়। দজ্জাল শাশুড়ি। ননদ সাক্ষাৎ এক যম। স্বামী একজন জল্লাদ। আর ঘরে বসে তছবিহ্ গুণতে গুণতে সব কিছুতে ইন্ধন যোগান শ্বশুর। সব-সবাই-সবকিছু অচেনা। অজানা। রিক্ত।

অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতারণা। যখন-তখন নারী স্বাধীনতার স্লোগান। মধ্য বয়সের জন্যে জমা হয়ে থাকে। ফোড়া, যেমন পুঁজ হতে হতে এক সময় ফেটে বেরোবেই। মধ্য বয়সে, অতীতের যত পুঁজ, বহুমুখী ফোড়ার মতো, ফেটে বের হবেই। পুঁজের সেই থলে খালি হলে, সে নতুন করে কি দিয়ে ভরবে পুঁজ না অমৃত, নির্ভর করে তার জীবনের আকাশে তখন চন্দ্রোদয় নাকি চন্দ্ৰাস্ত। যদি চন্দ্রোদয় হয় ভালো। যদি উল্টো হয়, তবেই ডুববে তরী। নিভবে বাতি।

হেলে-খেলে অপচয় হয়েছে কত সময়! তখন অনুভব হয়নি। আজ হয়। ৪৫-এ হয়। অনুতাপ হয়। ফেলে এসেছে বলে অশ্রু হয়। অপচয় বলে গ্লানি হয়। নেই বলে আফসোস হয়। পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখে শূন্য হাত। যে গ্যাছে যা গ্যাছে। অতীতের সব–সব অতীত। নেই সে আর ফেরে না। আর ফিরবেও না। সে মৃত। অনুভূতি ফিরে এলো, কিন্তু সে নেই।

ইচ্ছে হয় তাকেও কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ! তাকে রেখে পতিতালয়ে যাওয়া, সেজন্যে তার অশ্রু। তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ দেয়। আজ কবরে বসে স্রেফ অশ্রু ছাড়া কিছু নেই।

ইচ্ছে হয় তাকে কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ। তাকে রেখে পরকীয়া, সেজন্য স্বামীর অশ্রু, তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ। দেয়। আজ কবরে বসে শুধু অশ্রু ছাড়া কিছু নেই। সবই ফিরে এসেছে। কিন্তু হায়, সে কোথায়? যার জন্য সমাজ ত্যাগ, পালিয়ে আসা যার হাত ধরে, তার সঙ্গে দশ বছর জীবনযাপনের পর, বিবাহ বিচ্ছেদ। পরকীয়া।

দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা –দু’জনকে আবার এক করে। দূরত্ব নিঃসঙ্গতা দু’জনকে দুই করে। মতামত, ব্যক্তিত্ব, ঐশ্বর্য, যোগ্যতা, মানুষকে দূর করে। মানুষকে এক করে। জীবনের ট্রেনের ৪৫ নম্বর প্লাটফর্মে পৌঁছে মল্লিকাঁদের প্রথম অনুভব হয় ছুটে পালিয়ে বাঁচতে। আর নয় স্বামী নামের এক দানবের অত্যাচার! এতকাল যাতে অভ্যস্ত, এখন তাতে বিদ্রোহ।

৩. সামাজিক অবকাঠামো

আমাদের সামাজিক অবকাঠামো, নির্দেশ করে আমাদের মধ্য বয়সের ঋতু। শুষ্ক ঝোড় না বসন্ত। দুঃসংবাদ যে, আমাদের সামাজিক অবকাঠামোগুলো আধুনিকতার কাছে এতই অবৈজ্ঞানিক, এতই বাতিল বলে গণ্য হয়, যে কারণে আমাদের জীবন হয় দুর্বিষহ। তথাকথিত বিজ্ঞজনেরাও এই পঙ্কিলতার বৃত্ত থেকে বাইরে নয়। বরং যত বেশি বিজ্ঞ, ধর্মান্ধতা, সমাজন্ধতা, সংস্কারন্ধতা তত বেশি।

গ্রামে-গঞ্জে মূলত একান্নবর্তী পরিবার ও নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত পরিবার। নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার। এই পরিবারগুলোতে ছেলের বৌয়ের অপমৃত্যুর হার অনেক। তার কারণ–একান্নবর্তী পরিবারের সকল কুসংস্কার। শাশুড়িজনিত কষ্ট, স্বামীর তাচ্ছিল্য ও অত্যাচার; এসব সংসারে একটা সুস্থ মানুষকে করে তোলে অসুস্থ। একান্নবর্তী পরিবার একটি অসুস্থ জায়গা, যেখানে সংসারের নামে চলে জল্লাদখানা। নারীর অধিকার, স্বাধীনতা কিভাবে হরণ করতে হয় জানতে হলে এখানে আসতে হয়।

একটা সমুদ্রে ঝরে যায় কত খড়কুটো, ডালপালা, ছেঁড়া কাগজ, কত হারানো মণিমাণিক্য। ভেসে যায় কত জেলে নৌকো, তারুণ্যের কত নৌবিহার! আর জীবন! সেতো পৃথিবীর সব-জল একত্র করলে, তার চেয়েও বড় সমুদ্র। অথচ এই সমুদ্রকে সঙ্কীর্ণ মনের মানুষেরা কল্পনা করে পুকুর। এখানে ঘটে-যাওয়া কোনও ব্যতিক্রমকে আমরা বলি অসামাজিক। আমরা কি আসলেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে অন্ধ হয়ে যাইনি?

কত সমস্যাই ঘটে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। সুখ সে আর কতটুকু! হাসি সে আর কতক্ষণ! পূর্ণতা সেও ক্ষণজীবী! তাহলে!

সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের হাসি, সুখ, পূর্ণতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ফলে আমরা যথেষ্ট হাসতে পারি না, সুখী হতে পারি না, পূর্ণ হই না।

৪. দাম্পত্য দুঃখ-সুখ

সার্বক্ষণিক বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দাম্পত্য সুখ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। সকল সমস্যার মধ্যেও এই সুখটুকু যদি আমাদের থাকে, তাহলে অন্য সব অসুখ একসঙ্গে বয়ে নেয়া সহজ হয়। কিন্তু দাম্পত্যের এই সুখটুকুই বড় বেশি ঝোড়ো হাওয়ার সম্মুখীন। এর কারণ ব্যাখ্যার অতীত। দু’জন দুই মানুষ। দুই মতবাদ। দুই ব্যক্তিত্ব। দুই ভালো-মন্দের। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য, বিবাদ, চরম হতাশা, নিষ্ঠুরতা সুখের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দাম্পত্য ভাঙার কারণের শেষ নেই।

এমতাবস্থায় কি করা উচিত যখন নপুংসক স্বামীর পাশে শুয়ে সখিনা, বছরের পর বছর অতৃপ্ততার কষ্ট পেয়ে বৃদ্ধ হলো! কিন্তু কোনদিনও কাউকে সে জানায়নি তার দুঃসহ কষ্ট! এই সমাজে এসব জানানোর কারণ নেই, ভাষাও নেই। নিরক্ষর সখিনার অর্ধেক জীবন কাটালো–অর্ধপাগল। পাগলা গারদ।

অন্যদিকে শিক্ষিত ও চালাক মেয়ে সূচনা–নপুংসক স্বামীর অগোচরে দীর্ঘ বছর ধরে গোপনে যৌনজীবন চালিয়ে গ্যাছে মিজানের সঙ্গে। মিজানের সমস্যা তার স্ত্রী পক্ষাঘাতে পঙ্গু। মানবিক কারণেই সে মুনমুনকে ডিভোর্স দেয়নি। কিন্তু তার যৌনজীবনেও সে কোনও সমঝোতা করেনি।

সমস্যার কোনও সমাধান সমাজ করবে না। কিন্তু যদি কেউ বিকল্প খুঁজে নেয়, সমাজ তখন বৈরী হয়! দা-কুড়োলে। শ্বাস ও কণ্ঠনালিতে। তাহলে এই কথা বললে কি ভুল হবে যে, আমাদের সমাজ, সুস্থ সূচনার বদলে অসুস্থ সখিনা তৈরির প্রসূতিকাগার? আমাদের অসুস্থ সমাজ। ভাগাড়-সমাজ।

দীপের পাশে শুয়ে মল্লিকা বিয়ের পনেরো বছর পরেও ভাবে শমসেরের কথা। দীপকে জড়িয়ে ভাবে তার শমসের। দীপকে খেতে দিতে দিতে ভাবে শমসেরকে দিচ্ছে। কারণ তুচ্ছ। সে শমসেরকে ভালোবাসতো। শমসের মুসলিম তাই, অন্ধ সমাজের কারণে ওদের প্রেম, প্রাণ পায়নি। দীপকে সে কখনো পরিপূর্ণ করে আপন ভাবতে পারে না।

অতিরিক্ত কামুক স্বামীকে আটটি সন্তান দেয়ার পর মাসুদা ক্লান্ত। সে করিমের কাছে যেতেই চায় না। অনেক অনুনয়-নিষেধ সত্ত্বেও করিম ফের বিয়ে করে নিয়ে আসে জোবেদাকে। এতগুলো মাতৃত্বের এতদিনের বিবাহ, এত ত্যাগ স্বীকার! সবই কি বিফলে গেল, প্রশ্ন?

পাশাপাশি রাতের বেলায় সতীনের ঘরের বাতাসে কামের গন্ধ মাসুদার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে! শুলেই যুগল দৃশ্য ভাসে চোখে। এই কষ্ট সইতে না পেরে মধ্য বয়সে পৌঁছে মাসুদা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। একদিন ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়ে তার সন্তানগুলোকে মাতৃহীন করে দিয়ে –মনে ক্লান্ত মাসুদা ইহজগৎ ত্যাগ করলো।

অকাল বিধবা হেমলতার সঙ্গে রাতের বেলায় ঘুমোত এগারো বছরের এক কিশোর। হেমলতা তাকে মহাভারত পুরাণের গল্প শোনাত। সজল–হেমলতা ছাড়া অন্য ঘরে ঘুমোবে না। বাবা-মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও না। মায়ের তৃতীয় চোখ। বাবা। বললো স্রেফ অপত্য স্নেহ। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মা বলে-না। একদিন গভীর রাতে উঁকি দিয়ে দেখলো সজল হেমলতার স্তনে মুখ দিয়ে। কারো শরীরেই কাপড় নেই। জানি, এর উত্তর নেই। তবে বিধবা হলেই যে রতি মরে যাবে, একথা ভুল। বিধবারা যাবে যাবেই। রতির তাড়না তাকে নিয়ে যায়। সন্তানের বয়সী থেকে গোয়াল ঘরে এমনকি ষাড়ও সই। রতির যন্ত্রণা এতই যন্ত্রণাদায়ক শতকরা পঁচানব্বই জন বিধবারই গোপন। যৌনজীবন থাকে এবং বিপত্নীকদের তো বটেই। এবং তা ভালো। তা মঙ্গলজনক। তা স্বাস্থ্যকর।

স্ত্রীর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে ৭০ বছর বয়সে মি. শহীদুল্লাহ আবার বিয়ে করলেন। ছেলেমেয়েরা তাকে ত্যাগ করলো একই দিনে। মি. উল্লাহর যুক্তি ছিল আমার একজন সঙ্গী চাই। কথা বলার, পাশে বসার। তার প্রয়োজন কি যুক্তির বাইরে ছিল? প্রয়োজন কি সবসময় যুক্তি মানে? যুক্তির তলায়–মর্মবেদনা কি যুক্তি শাস্ত্রের চেয়েও মানবিক শাস্ত্র হতে পারতো না? মি. শহীদুল্লাহ দুঃখ করে বলেছিলেন, ওরা তো যার যার সংসারে সুখে আছে। ওরা কী জানে, আমার দিন কি করে কাটে?

সমমনা নয় বলে বাবুল আর শাহীনা বিয়ের তৃতীয় বছর থেকে ভিন্ন বিছানায়। তারপর ডিভোর্স। সেই থেকে শাহীনা ভ্রান্তিপাশের শিকার। এক ভুল থেকে অন্য ভুল। এক পুরুষ ছেড়ে অন্য পুরুষ। ধোকার পর ধোকা। চরম দুঃখশেষে মুক্তি পেতে আসক্তির আশ্রয়। তারপর একদিন অনিবার্য আত্মহত্যা।

রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজের তিন বছর আগে বিজয়া এমন জান্তব হয়ে উঠলো যে প্রতিরাতে ওর কামনা মেটাতে ওর স্বামীর হিমশিম অবস্থা। প্রতিরাতেই তার পুরুষ চাই। অপারক স্বামী তাকে ভুল বুঝলো। গোপনে শুরু হলো–বিজয়ার বিভিন্ন রকমের বিকার। সমকামী এবং উভকামিতার জীবন।

শফিকের পতিতালয়ে যেতেই হবে। কারণ ঘরের পুরোনো মেয়েমানুষের শরীর বড় একঘেয়ে। হায়দার তা না করে পরকীয়া করতো। আর মুনীর? বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটা গরুর গোয়াল ছিল, সেখানে চারটি দুধেল গাভী ছিল। সে লুকিয়ে যেতো গাভীর কাছে। গাভীর শরীরে মেটাতো ওর কাম।

মিশু, তরু, নদী ওদেরকে নষ্ট করার পর খেরু মামা তার দু’মাসের ভাগ্নীকেও ছাড় দিল না। একলা ঘরে এনে ওর প্যান্ট খুলে, না ফোঁটা ফুলে আঙুল প্রক্ষেপণ করে মেয়েটিকে সুযোগ পেলেই কাঁদাতো।

ঘটনাক্রমে প্রদীপের সঙ্গে বেবীর মাত্র দু’বার যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। প্রদীপ, বেবীকে যেভাবে নিয়েছিল, যে কারুকার্যে সে ফুটিয়ে তুলেছিল ওর নারীত্বের অলঙ্কারগুলো! বিছানায় বেবী নিজেকে মাত্র দু’বার যেভাবে আবিষ্কার করেছিল প্রদীপের সঙ্গে, সালমানের সঙ্গে তা দশ বছরে একবারও ঘটেনি। সালমান শুধু শরীর কিন্তু প্রদীপ বোঝে প্রেম। সেই থেকে বেবীর জীবন, সালমানের সঙ্গে কখনো আর এক হলো না।

দাম্পত্য, নির্ভর করে সমস্যার গভীরতার ওপর। একে কেন্দ্র করে বিয়ে ভাঙে। বিয়ে গড়ে।

৫. জীবনের গলিত লাভা

পরম-আয়ু। মানুষ কি পরমায়ুর হিসেব বোঝে? এই ‘পাটিগণিত’, মানুষ বোঝে কী? অফুরন্ত মনে হতে পারে, আয়ু। মনে হতেই পারে বেঁচে থাকবো সত্তর, আশি, নব্বই, একশ’ বছর। সেতো অনেক সময়।

হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন হলে, সত্তর, আশি, নব্বই, অনেক অনেক সময়। মাঠ মাঠ সময়। মানুষের গড়পড়তা আয়ু ভূগোল বিশেষে ৫-৭০।

শৈশব। কৈশোর। যৌবন। বার্ধক্য। শৈশব থেকে বার্ধক্য–মাঠ মাঠ সময়। সত্তর থেকে, দশ-কুড়ি-ত্রিশ এমনকি চল্লিশ বছর পরমায়ু ফুরিয়ে যাওয়া কিছুই নয়। এই ফুরিয়ে যাওয়া শেষেও অনেক সময় সামনে পড়ে থাকে। তাই বিচলিত হওয়ার কোন কারণ থাকে না।

এমনকি জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় ফুরিয়ে গেলেও অনুভব হয় না–পরমায়ু। হয় না পঞ্চাশেও। মনে হয় অনেক সময় সামনে পড়ে আছে। ততদিনে তারুণ্যের ঝোঁক গেলেও, অস্তমিত যৌবনের আকাশে ছিটেফোঁটা যৌবনের রেশ লেগে থাকে। তখনও ইচ্ছে হয় কাম, ইচ্ছে হয় ভরা যৌবনের কিছু কিছু উন্মাদনা। মনে হয় অনেক সময় সামনে পড়ে আছে। পঞ্চাশেও লোভ-লালসা, চাহিদা, দায়িত্বের ভারে ভুলে যাই মৃত্যু হবে। আমাদের মৃত্যু হবে। মনে হয় আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী। মাঠ-মাঠ সময় আছে, মনে হয়। আমরা হয়ে উঠি–আরো লোভী। বাড়াই বোঝ। জড়িয়ে পড়ি অধিক দায়িত্বে। দাম্পত্য, মধ্য বয়স, শরীর ততদিনে হয় বাধাগ্রস্ত। আমরা সেসব এড়িয়ে চলি। মাঠ মাঠ সময় আছে।

বার্ধক্য আসেনি? মধ্য বয়সে, নাকের দু’পাশের মাংসে ঠোন বরাবর গভীর ভজ, এ কিসের আলামত! বার্ধক্য আসেনি? গালের দু’পাশ ভারি। শরীর তার হাল ছেড়ে দিয়েছে। নাইকুণ্ডলীর চারপাশে বালিশের মতো ফুলে ওঠা তলপেট, বার্ধক্য আসেনি এখনও? বয়স পঞ্চাশ তখন। মধ্য বয়স।

বার্ধক্য! ষাটের পর? সত্তর হতে কত বাকি? সত্তরই যদি পরমায়ু হয় তবে মৃত্যুর ক’বছর বাকি? চল্লিশ, পঞ্চাশ! যেমন ছিল কৈশোর! ছিল যৌবনে? যখন দশ, বিশ, ত্রিশ বছর চলে যাওয়ার পরেও মনে হয়েছে, মাঠ মাঠ সময় আছে!

ষাটের পর? সত্তর যদি পরমায়ু হয় তবে মৃত্যুর ক’বছর বাকি? পাটিগণিতের সোজা অঙ্ক তবে ৭০-৬০=১০। সেতো কৈশোরের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ ৭০-১০=৬০।

সুতরাং কৈশোরে ত্রিশ বছর চলে গেলে কিছু নয়। কিন্তু ষাটের পর প্রতিটি বছর। মৃত্যুর ঘড়ি আরেকটু স্পষ্ট বাজে। ষাটের পর, মৃত্যুঞ্জয়ী এবার মৃত্যুর ডাক শোনে। ষাটের পর। একেবারেই সময় নেই। মৃত্যু দুয়ারে। মৃত্যু বলছে, ওঠো, ওঠো তৈরি হয়ে নাও। আমেজ, একটা বছর, ষাটের শেষে, অতীতের দশ বছরের সমান। তবুও শোনে না।

এইটুকু জীবন। কোথাও শান্তি নেই। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ শেষে, মধ্য বয়সে এসে মানুষ যখন শান্তি পাবে, তখনই জ্বলে ওঠে আগুন। পরমায়ু ফুরিয়ে যেতে থাকে। আমাদের তাতে ক্ৰক্ষেপ নেই। আমরা আগুনে জ্বলি জীবনের গলিত লাভায়।

মরে যাই, পরমায়ু শেষে। ক্রাইসিস, মৃত্যুই যার একমাত্র উত্তর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত