০৬. একান্ত কিছু মেয়েলি সমস্যা
মেয়েদের সমস্যার কি শেষ আছে? মধ্য জীবনের সঙ্কট লিখতে বসে মনে হচ্ছে আমি যেন সাপের গায়ে খোঁচা মেরেছি। আর সাপগুলো যারা এতকাল ছিল ঘুমিয়ে, সব তেড়ে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে কিলবিল করতে করতে। যেন গুণে ওদেরকে কখনোই শেষ করা যায় না। সাপ গোণার এই অক্লান্ত পরিশ্রম, দূরে বহু দূরে পরিবার পরিজনকে ফেলে এসে এই নিঃসঙ্গ নির্বাসন আমার, একাকিত্বের নিঃশব্দ যন্ত্রণা; সব মিলিয়ে আজ মনে হচ্ছে আমি যেন কোথায় ভুল করে ফেলেছি। সাপের গায়ে খোঁচা মারাটা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি। এখন না পারি গিলতে, না উগরাতে। আমি তো কোনও সাপুড়ে নই। আমি পড়েছি এক মহা-বিপদে। যারা রক্ষা করার, তারা আরো উসকে দিয়ে বলছে, সাপ ধরো, সাপ মারো। ইচ্ছে হয় জানতে-এই সাপ ধরার দায়িত্ব কি শুধুই আমার একার? তবে সে যাই হোক, যে দায়িত্ব একবার কাঁধে নিয়েছি তা শেষ করে ছাড়ছিও না।
মেয়েদের মিডলাইফ নিয়ে অনেক সমস্যার কথাই লিখেছি। তবে অধিকাংশই অলিখিত রয়ে গিয়েছে। কেননা অকূল সমুদ্রের তলায় মুক্তো খুঁজে বেড়ানো আমার। পক্ষে আর সম্ভব নয়। যে ক’টি পেয়েছি সে ক’টিই পাঠকের সামনে পেশ করেছি।
তবে এর মধ্যে দুটো বিশেষ প্রসঙ্গ আবার হাইলাইট না করে পারছি না। তা হলো মেয়েদের ঋতু আর জরায়ুর গুরুত্ব। মেয়েদের ঋতু আর জরায়ুর সঙ্গে ক্রাইসিসের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর বলেই এই টুকরোটি লিখতে হচ্ছে। একটি মেয়ের ঋতু আর জরায়ু তার শরীরের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তবে ঋতু, যা শুরু হয় ন’ থেকে তের বছর অবধি যে-কোনও সময়ে তা মধ্য বয়সে এসে বন্ধ হয়ে যায়। প্রক্রিয়ার নাম, মেনোপজ। মেনোপজ কারো হয় মধ্য চল্লিশে। কারো কারো পঞ্চাশ পার হয়ে। শরীরের হরমোন কমে আসে। অর্থাৎ তখন গভীরের রস রক্ত শুকিয়ে আসে। শুষ্কতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ঋতুও বন্ধ হয়ে যায়। এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেখা যায় বিভিন্ন রকমের সমস্যা। মেয়েদের এই পরিবর্তনের কারণে শুরু হতে পারে, অতিশয় করুণ যৌনজীবন। ফলে অনেক সংসারেই আগুন লাগে। পুরুষরা বিকল্প চিন্তা করে। আর মেয়েরা সম্মুখীন হয়, নিষ্ঠুরতার।
ঋতু বন্ধ হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। এখানে মেয়েদের করার কিছুই নেই। ঋতু হারানো মেয়ের শরীরে এটা একটা মূল্যবান সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনার মতো। এই মেয়ে সম্মুখীন হতে পারে প্রতিকূল মানসিক ভারসাম্যতার। একটি মাসিক শিশু, প্রতিমাসে একবার করে কেঁদে উঠতো। এখন সে আর কাঁদে না। মেয়েদের শরীরে এই পরিবর্তন থেকে তার সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। শরীরের গভীরে শুষ্কতা, ধ্যান-ধারণা, স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তির শৈথিল্য মনমানসিকতা জীবনধারণ সবই পাল্টে যেতে পারে। মিডলাইফ আসে এই ক্রাইসিসগুলোকে নিয়ে। এখান থেকে উত্তরণ নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছা, বোধ ও চেষ্টার ওপর। এক হয় সে নিজেই ক্রাইসিসে নিমজ্জিত হয়। না হয় সে তরতর করে এই নদী পার হয়ে যেতে পারে। কিংবা গোপনে কষ্ট সহ্য করে যায়। বেঁচে থাকে, না বাঁচার মতো; কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। মেয়েদের মাতৃত্বের দুটি পাসপোর্ট। এক–ঋতু, দুই–জরায়ু।
জরায়ু মেয়েদের আরেকটা সম্পদ, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতে পারে একটি ভয়ানক সমস্যায়। যেমন টিউমার, ক্যান্সার, উল্টে যাওয়া, নেমে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি। ফলে এই মাংসপিণ্ডটিকে ফেলে দিতে হয়। এই অঙ্গটি নারীর জীবনের অন্যতম অলঙ্কার। যার ওপর নির্ভরশীল নারীর মাতৃত্ব। এই অঙ্গটি হারিয়ে নারীর অনেক রকমের সমস্যা হতে পারে। তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা অন্যতম। হতাশা, হঠাৎ হঠাৎ গরম লাগা, নীল অনুভূতি, হতে পারে নানারকম রোগব্যাধি। সঙ্গের পুরুষটি হয়ে ওঠে তার অন্যতম সমস্যা। সে আর আগের মতো স্বাদ অনুভব করে না তার একান্ত নিজস্ব নারীটির প্রতি। ফলে অবজ্ঞা, দুস্থ যৌনজীবন, নারীর জীবনকে ঠেলে দেয় না বেঁচে থাকার অনুভূতি দিয়ে।
ঋতু হারানো মেয়ে যত দ্রুত পাল্টায়, সমবয়সী বীর্য কমে আসা পুরুষের বেলায় তা হয় না। মেয়েদের বার্ধক্য ছেলেদের চেয়ে দ্রুত। তার সংসার–মাতৃত্ব, ঋতু, জরায়ু। অনেক কিছুই সেজন্য দায়ী। তাছাড়াও আরো অনেক মেয়েলি রোগ সংক্রান্ত সমস্যার পাহাড় নিয়ে নারীর অন্তহীন দুর্দশা থেকে সে উতরাতে কমই পারে। সে হতে থাকে জীবন্ত পুতুল। মধ্য বয়স থেকে চলতে শুরু করে বার্ধক্যের ঘড়ি। বার্ধক্য যা সবাইকেই হাত ধরে সত্যের দিকে নিয়ে যায়-নীরবে। জীবন্ত পুতুল নারীটিও যায়। নারী যে শুধু একটা অপচয়।