০৫. আত্মতৃপ্তি
ক. প্রথাবিরোধী বাক্যই চতুর্দিক থেকে পাগলা ঘণ্টির মতো বেজে উঠতে থাকে সর্বনাশের কলরব কোলাহলে। আমাদের জীবনটা যেন শুধু সংসার আর সংসারকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। আমাদের বিশ্বাস, সংসার না হলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? সংসার না হলে সত্যিই কি জীবন অসম্পূর্ণ?
সব মানুষই সমান হয়ে জন্মায় না। সব মানুষের মনমানসিকতা, ইচ্ছা, রুচি এক হতে পারে না। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই যার যার নিজের মতো আলাদা। এদের মধ্যে, যারা শুধুই বেঁচে থাকার জন্য জন্মায় তাদের জন্যে সংসার হলো একটি সঠিক চৌরাস্তা। নিজেকে এখানে কারণে-অকারণে ব্যস্ত রাখার অনেক সুড়ঙ্গ খোলা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা তাদের নিয়ে যারা শুধু কারণে-অকারণে বেঁচে থাকার জন্যে জন্মায় না। পৃথিবীকে কিছু দেয়ার জন্যে জন্ম যাদের।
যারা অসাধারণ, কিছু দেয়ার জন্যে জন্ম যাদের, তাদের জন্যে চাই সংসারের চৌরাস্তার চেয়েও আরও অনেক বড় কিছু। চাই অনুভবে, চাই শূন্যতায়। চাই প্রথার কারুকার্যের বাইরে, সৃষ্টির অমূল্য পাথর। চাই কোহিনূর! হ্যাঁ কোহিনূর! এবং এই অনন্য হীরক খণ্ডটি পেতে হলে নিজেকে নিয়ত পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার হতে হয়। আর সংসার, এখানে পুড়িয়ে অঙ্গার হওয়ার চেয়ে নিয়ত পোড়া অঙ্গার হতে হয়। এই অঙ্গারে শুধু ছাই আছে। কোহিনূর নেই। সুতরাং অসাধারণ মানুষদের জন্যে চাই, সংসারের বাইরের অন্য কিছু এবং অনেক কিছু, যেখানে তারা খুঁজে বেড়াবে–সেই দুর্লভ হীরক খণ্ডটি।
জীবন, অনুভবের। অনুভব, যা উপভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার, একধরনের প্রাপ্তিযোগ। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিক্রমী কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ আছে যারা উপভোগের বদলে অনুভবের মধ্য দিয়ে খুঁজে পায় তাদের সৃষ্টির প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা। সংসারে বা সংসারের বাইরে থেকেও, অনুভবের পুঁজিটুকু দিয়ে তারা সৃষ্টি করে শিল্প। সৃষ্টি করে সাহিত্য। আর এই লেখাটি সাধারণ এবং অসাধারণ এই দুই ধরনের মানুষের জন্যে। দুই পিঠে যার, উপভোগের বিরুদ্ধে অনুভব। গৃহীর বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধী মানুষ।
আমাদের খিদে পায়। ক্ষুধার কামড় বলে একটা কথা আছে। যতক্ষণ না খাওয়া হবে, ততক্ষণ এই কামড় খাবারের সবরকম রসনা ও আস্বাদনের অনুভূতি দেবে। কিন্তু খাওয়া মাত্রই ক্ষুধার তীব্র অনুভূতি শেষ হয়ে যায়। তখন মনে হতে পারে কেন খেলাম! তেমনই, কাম ও রতি। না পাওয়ার তীব্রতা থেকে অনুভব হয় শরীরের পুলক ও রোমাঞ্চ। কল্পনা, মুহুর্মুহু রতি অনুভবের। প্রেম হয়ে গেলেই, হৃদয় ভরে ধরে রাখা, সেই সুখানুভূতিও চলে যায়।
না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে সৃষ্ট সারাক্ষণ পাওয়ার অনুভূতির মধ্যে সকল পাওয়ার যে নিবিড় সুখ, উপভোগ থেকে তা আসে না। সেই পাওয়াকে বরং তুলনা করা যেতে পারে হারানোর সঙ্গে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ শুধু অনুভূতি আর কল্পনা নিয়েই বাঁচবে। আসলে বলতে চাওয়া হচ্ছে স্বল্পসংখ্যক, সেই সব মানুষের কথা যারা বাতাসে, জলে, সমুদ্রে, নক্ষত্রে, ঘাসে, যেদিকে খুশি তাকায় না কেন, কিছু না কিছু অনুভব উপলব্ধি করে সেখান থেকে খুঁজে বের করে নিতে পারে, সৃষ্টির জন্যে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা।
তবে অনুভবী মানুষগুলো সংখ্যায় বড় অল্প। স্বেচ্ছায় এই কষ্ট, এই নির্বাসন, সহজ কোনও কাজ যে নয়, একমাত্র ভুক্তভোগীরাই তা জানে। তবুও কিছু কপালপোড়া মানুষ এই নিঃসঙ্গতাই বেছে নেয়। পৃথিবীতে তারা সংসারে থেকেও, নির্বাসিত ভেতরে এবং বাইরে। জীবনানন্দের ‘বোধ’ নামের কবিতাটির সঙ্গে কবির এবং আমাদের এই নিঃসঙ্গ নির্বাসনের একটা অনন্ত মিল।
“আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বার্থ নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে!
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা! …”।
খ. মনে হয় শিল্প ও সাহিত্যের জগতে যত সার্থক এবং স্মরণীয় সৃষ্টি রয়েছে তার অধিকাংশ স্ৰষ্ঠাই নিঃসঙ্গ এবং অনুভবী জগতের মানুষ। এমন সৃষ্টির মধ্যে ‘গীতবিতানের’ নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। গীতবিতান, জীবনের যাবতীয় সঙ্কট মুহূর্তে, সব প্রশ্ন এবং সব উত্তরের বিশ্বকোষ। উত্তর, যা তাৎক্ষণিক। যা সত্য। মনে হবে গানটি একান্তভাবে তারই জন্যে রচিত যে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আকাশ-সমান ধরন-ধারণ ক্ষমতা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। কবিগুরুর সব বয়সের অনুভূতিগুলো, যার সবটাই তার নিজের সঙ্কট হয়েও যা আমাদেরও সঙ্কটের সঙ্গে মিলে গিয়ে রচিত হয়, গীতবিতান। তার অনুভূতি, আমাদের প্রাপ্তি। একজনের অনুভব বিতরণ হয় কোটি কোটি মানুষের সমস্যার উত্তর হয়ে।
গ. আমরা কি নিজেকে চিনি! আমি ও আপনি মিলে আমরা যে চারদিকে সারাক্ষণ অসুখী মানুষের পাহাড় গড়ে চলেছি, এই গুজব কি মিথ্যে? প্রতিদিনই আমরা কি অসুখী নই। কোনও না কোনও অজুহাতে। কেউ সরবে। আবার কেউ-বা নীরবে। যার বিত্ত আছে, যার নেই, সবাই কিন্তু একসঙ্গে গলা মিলিয়ে কীর্তনে যোগ দিই। যে বন্ধ্যা, যে নয়। যার টইটম্বুর, যে শূন্য। ব্যাধিহীন যে, যার শরীরে ক্যান্সার। মানুষ অসুখী, সব উপভোগ, সব অনুভব, সব সত্ত্বেও মানুষ অসুখী। আপন মনে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়বেই। যে সব পেয়েছে, আরো চাই বলে। যার কিছুই নেই, সামান্য চাই বলে। চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হওয়া। সংসারের দায়িত্বে পড়ে আমরা ভুলে গেছি, আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ নিজেকে চেনা। আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো সংসারের তাগিদে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
সংসার থাকলে, চাহিদা ও সমস্যা থাকবেই। এবং সে কারণে নিজের সঙ্গে একটা সমঝোতা গড়ে নিতেই হয়। সংসারী মানুষের থাকে কতরকমের দায়বদ্ধতা। ছেলেমেয়ে, রোজগার, আত্মীয়স্বজন। মানুষদের জীবন থেকে সংসার গিলে খায় সময়। সময় গিলে খায়, বয়স। আর সংসারের গর্ভে হারিয়ে যায়, সময় এবং বয়স দুটোই। সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্যে সংসারের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা, সর্বনাশের চিহ্ন।
উপভোগ আর অনুভবের নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা ঠিকঠাক দেয়া কি সম্ভব। বিষয়টা-মনস্তাত্ত্বিক। শুধু চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শুনে, যা দেখি, যা বুঝি, তাই বোঝাতে চাই। অনুভবের যেমন রয়েছে উত্তাপ। উত্তাপ, যা জ্বালিয়ে দেয় বোধের কোষ। সেই জ্বালানো-পোড়ানো থেকে সৃষ্টি হয় কোহিনূর। কিন্তু সংসারী মানুষদের মধ্যে যারা সৃষ্টিশীল তারা সংসারের দায়িত্বে ক্লান্ত হতে হতে একসময়, নিরুত্তাপ হয়ে ওঠে বলেই তাদের বোধের কোষে সৃষ্টির আর কোনও যন্ত্রণা থাকে না। ফলে তারা হতাশা নামক শূন্যতার এক অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। এজন্যই মহাজনরা সংসারের নাম রেখেছে সৃষ্টিশীলদের জন্যে সর্বনাশের তীর্থক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি, ‘সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।‘ সংসারের তাগিদে এই অবক্ষয় প্রথম অনুভব হয় যে বয়সে সেটাই মধ্য বয়স।
ঘ. আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। থাকে সক্ষমতা। কেউ তাকে সাহসের সাথে উন্মুক্ত করতে পারে। কেউ তাকে অজুহাত দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কেউ ভয়ভীতি দিয়ে ঢেকে রাখে। অধিকাংশ মানুষই তাদের সক্ষমতাকে ভয় পায়। প্রতিভা অপচয়ের ব্যাখ্যায় সংসারের অজুহাতের জুড়ি নেই। এ কারণ, সে কারণ। কতই না কারণ আমাদের অজুহাতের! ছেলের অজুহাত, মেয়ের অজুহাত সংসারের অজুহাত। কিন্তু সময় কাউকে ক্ষমা করে না। এবং অলস সময়গুলো, বয়স গিলে খাওয়ার সাথে সাথে মনের অধঃপতনকে দ্রুত করে। মন, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রহস্য। মন, যার কোনও বসতি নেই, পরিচয় নেই, ঠিকানাও নেই। মন, যা সকালের আবহাওয়ায় যেমন থাকে, দুপুরে থাকে না। যা প্রতিদিন এক পোশাকে থাকে না। প্রতিটি সকাল এক মনে হয় না। কখনো দুঃখ, কখনো সুখ কোন কারণ ছাড়াই। সন্ধেবেলায় পুকুর পাড়ে নির্জনে বসলে যেমন লাগে, কোলাহলে তেমনটা লাগে না। টিন-ইজ মনের সঙ্গে মধ্য ত্রিশের মনের সম্পর্ক আলাদা। সন্ন্যাসীর আলাদা। গৃহীর আলাদা। পথিকের আলাদা। জীবনের প্রকৃত অনুভূতিগুলোকে একমাত্র সৃষ্টিশীল মনই যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারে। সুতরাং ‘বন’ রক্ষার মতো ‘মন’ রক্ষাও জরুরি। এবং সৃষ্টিশীলদের মনের বেলায়, এখানে কোনওরকম হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাব –নিষিদ্ধ।
স্বামী, স্ত্রীর প্রভাবে, স্ত্রী স্বামীর। সংসারে আমাদের চিন্তাধারাগুলো অন্যের রুচি ইচ্ছা-ফরমায়েশে চলে। অন্যের বা অন্য কিছুর প্রভাব সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টির মৌলিক চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করে। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হলে, মৌলিক চিন্তাগুলো হারিয়ে সে নিঃস্ব হতে পারে। অনুভূতি তখন আর অনুভবে সীমাবদ্ধ থাকে না। এবং তা গতি পরিবর্তন করে রূপান্তরিত হয় দায়িত্বে। দায়িত্ব, অন্যের প্রতি। এবং এর ভেতর থেকে যা সৃষ্টি হবে–তা ঘুণে ধরা। তা মৌলিক নয়। যা মৌলিক নয়, তা সৃষ্টি না করাই ভালো। নিরঙ্কুশ নিঃশর্ত নিঃসঙ্গ না হলে, সেই সৃষ্টির মূল্যও নেই। সেই সৃষ্টিও, দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সেজন্যেই অপসৃষ্টি বা কু-সৃষ্টি দিয়ে বাজার ভরে গেছে। অনেকটা অক্ষম অনুবাদ সাহিত্যের মতো। অন্যের জিনিস, অন্যের চিন্তার, অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াসে, বিকৃত রূপান্তর।
নিজের চিন্তায় নিজে বিকশিত হতে হলে অন্যের প্রভাব সেখানে টিকতে পারে না। টিকলেই সংঘাত, সৃষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির। শূন্যতার সঙ্গে ব্যক্তির। নিঃসঙ্গ নির্বাসনের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়ের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়, আগেও বলেছি কাউকে ক্ষমা করে না। সময় নিষ্ঠুর নিঃসন্দেহে। এবং তা অপচয়ের যন্ত্রণা, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে প্রথম আসে মধ্য বয়সে। তখন তারা মদ-গাঁজা-ভাং ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচে।
ঙ. সংসার বাদি আর সংসার বিবাদি। সাংসারিক মানুষগুলোর সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক তোলা যায়। ধরা যাক, ওদের বিশ্বাস, কেউ কেউ ভণ্ড, নীতিহীন সমাজসংস্কারক। সংসারে থেকেও, যতটা স্বাধীন ও সৃষ্টির ক্ষমতা ভোগ করা যায় তারা তা না। সুতরাং সে মানুষটি পথবিচ্যুত তো বটেই বিভ্রান্ত বলেই সংসারের বিরুদ্ধে ওকালতি করছে। এই সব সংসারী মানুষগুলোর জন্যে সত্যিই সবার করুণা হওয়া উচিত। ওরা সেসব কথা ধরতে না পেরে, শুধু তর্কই করে গেল। অথচ এদের প্রায় প্রত্যেকেরই যথেষ্ট শিক্ষিত বলে সমাজে পরিচিতি আছে। ওরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারত। কিন্তু করলো না। যা করলো তা–সমঝোতা, সংসার-দায়িত্ব আর সময়ের সঙ্গে। ওরা উপভোগের উপাসক। তবে মধ্য বয়সে পৌঁছে এই সংসারী মানুষেরা প্রথম বুঝতে পারে পৃথিবীতে তাদের কিছু না রেখে যাওয়ার ব্যর্থতা। এই প্রথম তারা অনুভব করে তারা এমন এক বৃক্ষ, যাদের বুড়ো হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই।
আমাদের দিনের সমস্যা মিটিয়ে রাত আসে। আর রাতের সমস্যা মেটাতে মেটাতে হয়ে যায় সকাল। আমরা সমস্যাপ্রিয়। সমস্যা না থাকলে, সৃষ্টি করি। একটা সন্তান থাকলে, দুটো। একটা ঘর হলে, তিনটে। এক জোড়া থাকলে, নজোড়া। চেয়ারম্যান হতে পারলে সাংসদ। সংসদে পৌঁছুলে মন্ত্রিত্ব। মন্ত্রী হলে দেশের সর্বোচ্চ মন্ত্রীর পদটি। আমাদের, চাওয়া-পাওয়ার, সমস্যার, কোনও আদি-অন্ত নেই। অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। আমাদের আরো চাই, চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হতে। সুতরাং, চাহিদা আর সমস্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। আমরা পরাধীন অনেক কিছুর কাছে। যা করি তা অন্যের জন্যে, তা অন্যের ইচ্ছায়। অনুতাপ একদিন আসবেই। তবে তা প্রথম এবং প্রখরভাবেই আসে, মধ্য বয়সে। কিন্তু তখন, সৃষ্টির মতো মন বা ইচ্ছা কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।
চ. সবশেষে, আমার অনুভূতি। আমার সন্দেহ হয় যে, মধ্য বয়স এমন একটা সময় যেখানে এসে আমার মতে সৃষ্টিশীল স্বামী বা স্ত্রীর মুক্ত হওয়া উচিত একে অন্যের স্বত্বাধিকার থেকে। যৌবনে সয়েছে তবে, জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে, নারী বা পুরুষ উভয়েই নিজেরা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এবং নিজের মতো করে। যা চাইলেও সে এতকাল পারেনি। মধ্য বয়সে এসে জেগে ওঠে নারীর স্বাধীনতার তীব্রতা। আর নারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে আগে বাদ সাধে পুরুষ। মধ্য বয়সী পুরুষ। তার ইচ্ছে অনুভূতি স্বাধীনতা ও অধিকার, পুরুষ নিয়ন্ত্রণ করে। আর তার সৃষ্টির আগুন যা বিয়ের পরপর পুরুষই তা নিভিয়ে দিয়েছে আবার রুখে দাঁড়ায়।
কি নিষ্ঠুর আর নির্মম! বিয়ের আগে যে মেয়েটি সুন্দর গাইতো, ছবি আঁকতো, বিয়ের পর সে আর গান গায় না, আঁকে না! বিয়ের পরপরই তার স্বামী, এই কুকর্মটি সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে ভালোভাবে সেরে ফেলে। কারণটা, সেই স্বত্বাধিকার। স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টিকে বাঁচাতে হলে কখনো কখনো অনেক ত্যাগ, অনেক বাস্তব, সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক সময় আমার মনে হয়েছে, প্রতিভাবান নারীর প্রতিভা বাঁচাতে প্রয়োজন একটা বিবাহ চুক্তির, তার প্রতিভা তার প্রাপ্তিকে রক্ষা করতে। প্রয়োজনে এই চুক্তি নবায়ন না করার স্বাধীনতা, শুধু থাকবে নারীরই অধিকার। তবেই নারীর মুক্তি আসবে। তবেই সে স্বাধীন। তবেই সে শিল্পী। তবেই, নারী। আর না হলে–ওরা অর্ধ মানুষ।