বসন্তের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে পার্কের একেবারে শেষ মাথার একটা বেঞ্চিতে আমি আর আয়শা বসে আছি। দু’জনের মাঝে প্রায় কয়েক ফুট দুরত্ব। পুরো পার্ক জুড়ে নিস্তব্ধতার ছোঁয়া। সেই নিস্তব্ধতা এসে জুড়ে বসেছে আমাদের মাঝেও।
“চুপ করেই থাকবে?” আয়শা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকাল।
“কী বলব?” আমি অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ অন্যসব কাপলদের খুনসুটি দেখতে লাগলাম।
“অভ্যাসটা যায়নি এখনও?” আয়শার কথা শুনে আমি তৎক্ষনাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে ফেললাম।
“আমি গাছের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।” আয়শা এবার একটু আড়চোখ করে আমার দিকে তাকাল।
“মিথ্যা বলছ কেন?”
“আরে তোমায় মিথ্যা কেন বলতে যাব আমি?”
“এটা তো তোমার পুরোনো একটা স্বভাব।”
আমি আয়শার দিকে একটু তাকালাম। চোখে সামান্য কাজল দিয়ে এসছে আজকে। কাজলগুলো চোখের সাথে লেপ্টে লেগে আছে। এতে আরও বেশি সুন্দরী লাগছে ওকে।
“চোখে কাজল দেয়ার সময় খেয়াল করো না?”
“কেন?”
“কাজল লেপ্টে থাকে।” আয়শা তার হাতে থাকা মোবাইলটা নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখের কাজলটা একটু দেখে নিল।
“কখন এরকম হয়ে গেছে খেয়াল করিনি।”
“কাজল লেপ্টে থাকলে তোমায় কিন্তু দারুণ লাগে, জানো তো?”
“কচু।”
“বাদাম খাবে?”
“হ্যাঁ, খাওয়া যায়।” আমি একটু সামনে গিয়ে ২০ টাকার বাদাম কিনে নিয়ে এলাম। দু’জন মানুষ খাওয়ার জন্য ২০ টাকার বাদামই যথেষ্ট।
“বাদামগুলো বেশি মিষ্টি না।”
“একটু চিনি এনে দেব?” আয়শা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল।
“ফাইজলামী করো?”
“তুমিই তো বললা মিষ্টি না। ভাবলাম একটু চিনি মিলিয়ে খেলে হয়তো মিষ্টি লাগবে।” আয়শা আমার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বাদাম চিবুতে লাগল।
“আর কিছু খাবে?”
“আইসক্রিম খাব।”
“আচ্ছা, টাকা দাও।”
“কীহহ?” আয়শা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাল।
“লজ্জা করে না তোমার আমার থেকে টাকা চাইতে?”
“আমি কী প্যান্ট খুলে রাস্তায় হাঁটছি যে আমার লজ্জা লাগবে!”
“ছিইইই!” আয়শা আমার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি দিল।
“ভেংচি দিলে তোমায় কার মতো লাগে জানো?”
“কার মতো?” আয়শা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
“চিড়িয়াখানায় গেছ কখনও?”
“হ্যাঁ, গেছি তো।”
“গন্ডার দেখছ সেখানে?”
“হ্যাঁ, দেখেছি অনেকবারই।”
“তুমি ভেংচি দিলে তোমাকে সেই গন্ডারের মতোই লাগে।” আয়শা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
“এভাবে তাকিও না। খুন হয়ে যাব।”
“তোমাকে কী করতে ইচ্ছে করছে জানো?”
“কী করতে?”
“বিলের পঁচা পানিতে চুবাতে।” কথাটা বলেই আয়শা আবার বসে পড়ল। আমি আয়শার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
“তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।”
“কেমন ভালো?”
“শান্তশিষ্ট ভদ্র লেজবিশিষ্ট।”
“হারামজাদা তোরে আমি…!” আয়শা আমার কান টেনে ধরল।
“এই ব্যথা লাগছে তো, ছেড়ে দাও।”
“হারামী আর এমন করবি বল?”
“না না আর করব না। জীবনেও করব না।”
“মনে থাকবে তো?”
“আলবাত থাকবে।”
“প্রমিস করে বল।”
“প্রমিস, আর এমন করব না।” আয়শা আমার কানটা ছেড়ে দিল। আর একটু হলে কানটা ছিড়েই যেত।
“আজকে হঠাৎ শাড়ি পড়ে আসলে যে?”
“শাড়িতে নাকি আমায় ভীষণ সুন্দর লাগে।”
“কে বলেছে?”
“বলব না।”
আয়শার কথাবার্তা কিছুটা সন্দেহজনক। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা আমি কী কখনও বলেছি? অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো, আরে হ্যাঁ এই কথা তো আমিই আয়শাকে বলেছিলাম।
“আমায় গাছ থেকে একটা কৃষ্ণচূড়া এনে দেবে?” আমি আয়শার দিকে একটু তাকালাম।
“খোপায় দিবে?”
“হ্যাঁ, ইচ্ছে করছিল।”
আমাদের বেঞ্চের পাশেই একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছ থেকে ফুলগুলো ঝরে ঝরে নিচে পরছে। বেশ ভালোই লাগছে। আমি গাছ থেকে ফুল আনার জন্য গাছে উঠতে লাগলাম। কিন্তু তার পরক্ষণেই মনে হলো, আরে আমি তো গাছেই উঠতে পারি না। ফুল আনব কী করে?
“আমি যে গাছে উঠতে পারি না আয়শা।”
“আমি জানি।”
“জেনেও কেন বলেছ তাহলে?”
“দেখলাম তুমি কী বলো।” আমি আয়শার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। এরকম পরিক্ষা করা আমার একদমই ভালো লাগে না।
“আঙুলের নখ এত বড় কেন?”
“এমনি, শখ করে রেখেছি।”
“আমার এসব দেখলে ঘেন্না হয় খুব।”
“কেন কেন?” আমি আয়শার থেকে খানিকটা দূরে সরে গেলাম।
“বাম আঙুলের নখের ভিতরে আটকে থাকে না?”
“কী আটকে থাকবে?”
“যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাও?”
আয়শা চোখ দু’টো বড়বড় করে আমার দিকে তাকাল। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় তাড়া করতে লাগল।
“ওরে হারামজাদা, দাঁড়া তুই। আজকে তোর একদিন কী আমার একদিন।” আয়শা আমায় তাড়া করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়ে পার্কের সাইডে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বেঞ্চিতে বসে পড়ল। মেয়ে মানুষের দম কী আর ছেলে মানুষের মতো হয়! আমি আস্তে আস্তে আয়শার সামনে গেলাম। আমাদের কাণ্ড দেখে পার্কে থাকা কয়েকটা কাপল আমাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে।
“হাঁপিয়ে উঠেছ?”
“তোমারে ইচ্ছেমতো থাপ্রাইতে মন চাচ্ছে।”
“তো নাও, থাপ্রাও।” আয়শা আমার দিকে আড়চোখে তাকাল। তারপর তার ওড়না দিয়ে মুখের ঘামগুলো মুছতে লাগল।
“আর জীবনেও এমন করে তাড়া করব না তোমাকে।”
“কেন কেন?”
“শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।”
“কেমন শিক্ষা?”
“আমায় দেখে বুঝো না?” আয়শার পুরো মুখ ঘেমে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।
“আমি আমার মুখ দিয়ে তোমার মুখের ঘামগুলো মুছে দিই?”
আয়শা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“আমার পায়ে কী দেখেছ?” আমি আয়শার পায়ের দিকে তাকালাম।
“পায়েল।”
“পায়েলের নিচে কী?”
“তোমার পায়ের হাড্ডি।”
“তার নিচে?”
“তোমার পায়ের চামড়া।”
আয়শা খানিকটা বিরক্ত হয়ে আমায় বলল,
“আরে হারামী, আমার পায়ের চামড়ার নিচে কী?” আমি আয়শার পায়ের নিচে একটু তাকালাম।
“পায়ের নিচে তো তালু।” আয়শা কিছুটা রাগান্বিত স্বরে আমায় বলল,
“তোর ভাগ্যটা ভালো রে হারামী আমি হয়রান হয়ে গেছি। নয়তো তোরে এখন!”
“আমারে এখন কী?”
“আমার স্যান্ডেল দেখেছিস?”
“কমদামি সেটাই তো বলবা। আচ্ছা যাও, দামি দেখে কিনে দিব।”
“বাটার জুতা বুঝছিস। ১,২০০ টাকা দাম।”
“হ্যাঁ, ১২০ টাকা দাম বুঝেছি আমি।” আয়শা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল।
“ওডিসি থেকে কিনেছ সেটাও জানি।”
“ওডিসি কী?”
“অপোজিট অব ঢাকা কলেজ।”
আমার কথা শুনে আয়শা তার নিজের গালে নিজেই খামচি দিয়ে বসল।
“এমা, তোমার ম্রিগি রোগ আছে নাকি? তোমার পায়ে না বাটার জুতা আছে? নাকে ধরব?” আয়শা বাচ্চাদের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল।
“আল্লাহ উঠায় নেও না ক্যারে আমারে? এই পোলার জ্বালাযন্ত্রণা তো আর সহ্য করতে পারি না।”
“তোমারে কই উঠায় নেবে?”
“জাহান্নামের চৌরাস্তায়।”
“আচ্ছা চলো, তোমায় নিয়ে জাহান্নামের চৌরাস্তায় যাই।”
আমি আয়শার হাতটা ধরে উঠে গেলাম। তারপর সামনের দিকে আগাতে যাব অমনি পেছন থেকে কে যেন আমার টি-শার্ট ধরে টান দিল।
“কিরে কই যাচ্ছিস?”
“আয়শার সাথে।”
“কোথায় আয়শা?”
“এইতো।” আমি বামপাশে আয়শার দিকে তাকালাম। কিন্তু সেখানে আয়শা ছিল না। আমি আয়শাকে চারপাশে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথায় পেলাম না।
“বাসায় চল।”
“হ্যাঁ, চল।”
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আয়শা আর আমার মাঝে নেই। দু’বছর আগে সে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমি পিছন ফিরে বেঞ্চের দিকে তাকালাম। এইটা সেই বেঞ্চ, যেখানে বসে আমি আর আয়শা গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম, খুনসুটি করতাম। এই বেঞ্চটার দিকে তাকালে আমার আয়শার কথা মনে পড়ে যায়। বেঞ্চটার দিকে তাকিয়ে আমি কাঁদছি, খুব জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে আমার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমার শরীরের সব পশম দাঁড়িয়ে গেছে। আমার টি-শার্ট, প্যান্ট সব ভিজে গেছে। আমি ভাবতে লাগলাম, কান্না করলে তো শার্ট, প্যান্ট ভেজার কথা না। তাহলে এগুলা ভিজে গেল কীভাবে??
পরক্ষণেই আমার ব্যাক সাইডে কে যেন ঠাস করে ঝাড়ু দিয়ে বাড়ি দিয়ে বসল। আমি “ওমা গো” বলে উঠে বসে পড়লাম।
“হারামজাদা, ১ টার সময় তোর পরিক্ষা আর তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস?” আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সামনে তাকালাম। দেখি আম্মু হাতে একটা বালতি আর একটা ঝাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো শরীর ভেজা। তারমানে আম্মাই বালতি ভর্তি পানি এনে আমার শরীরে ঢেলে দিয়েছেন। এই শীতের সকালে টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানি শরীরের এনে ঢেলে দেওয়া আর ৫০ তলা ছাদ থেকে লাত্থি মেরে ফেলে দেওয়া একই কথা। আমার পুরো শরীর ঠান্ডায় কাঁপছে। কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হচ্ছে আমি বুঝি স্বপ্নের ভিতরেই আছি। এটাও হয়তো কোনো একটা স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখছি ভেবে আমি আম্মাকে বললাম,
“আম্মা, ঝাড়ু দিয়া আর একটা বাড়ি দেও তো।”
কথাটা বলেই আমি উপুত হয়ে শুয়ে পড়লাম। ধুর, এটাও একটা স্বপ্ন। আর একটু ঘুমিয়ে নিই। মনে মনে কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আম্মা ঝাড়ু দিয়ে ঠাস করে আমার ব্যাক সাইডে আরও একটা বাড়ি বসিয়ে দিলেন। এবার এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব তা আর বুঝার অপেক্ষাই রাখেনা। আমি উঠে আম্মার দিকে একবার তাকালাম। আম্মা বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। “রিলেক্স আম্মা, কুল, বি কুল। এটা বাস্তব আমি বুঝেছি।” কথাটা বলেই আমি কোনোরকমে লুঙ্গিটা ঠিক করে বাইরে দৌড়। বালুর মাঠে যেতে হবে, রোদ পোহাতে হবে। নয়তো এখন ঠান্ডায় নির্ঘাত জমে যাব। পরিক্ষা জাহান্নামে যাক। আগে রোদ তারপর পরিক্ষা।