০২. ক্রাইসিসপূর্ণ জীবন
চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাই, চারদিকে সঙ্কট আর সঙ্কট। মানুষের জীবনে এর কি কোনও শেষ আছে? আসলে মানুষের জীবন মস্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র। আর এই যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের নানাবিধ সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতেই যেন মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। প্রতিদিন কত রকমের সমস্যা আমাদের জীবনকে ঘিরে থাকে। এই যে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা-নাশতা। খেতেই হবে। না খেলে পেটে ক্ষুধায় তীব্র যন্ত্রণা হবে। কিছু না খেলে এই যে চলে না, এই যুদ্ধ দিয়েই আমাদের দিনের শুরু। এরপর দিনের প্রহর যত গড়িয়ে যায় প্রহরের সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে সমস্যা আর সমস্যা।
প্রতিটি চলার মুহূর্তই মানুষের জীবনে, সমস্যার মুখোমুখি হওয়া। আর মোকাবিলা করতে করতে বেঁচে থাকা। যেমন ধরুন একজন ক্যান্সারের রোগী। সেও বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার কি তীব্র বাসনা তার! সেজন্যই কি সে কেমো-রেডিয়েশন নিচ্ছে না! কিন্তু ওদিকে মৃত্যু নিয়ত তাকে ছোবল দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। এই যে বেঁচে থাকার লড়াই জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে, একে কি বলবো? তবে অনেক সময় মানুষ তার সমস্যাগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে না ধরতে পারে, না পারে বুঝতে। তবুও মানুষ, বোঝা না বোঝার ভান করে করেই বেঁচে থাকে।
মানুষের চাওয়ার যেমন অন্ত নেই। ক্রাইসিসেরও তেমনই শেষ নেই। মানুষের চাওয়া-পাওয়া অফুরন্ত বলে ক্রাইসিসও ফুরোয় না। চেয়ে চেয়ে কাঙাল হয়ে বেঁচে থাকা। কত দুঃখ আর মৃত্যুর মতো সত্য প্রতিদিন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু এই অপরিমিত চাওয়ার ভারে মানুষ ক্লান্ত হয় না। যা পায় না, তারই জন্যে সীমাহীন লোভ। যা পেলো তার প্রতি অবহেলা। এই করে করে মানুষ অর্থহীন জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলার উন্মত্ত নেশায় মত্ত। কত কিছুইতো আমাদের চাই। না চাইলে লাগে না। পেলে আরো চাই। আরো পেলে, আরো আরো চাই। আমাদের পেটটা যেন ভগবানের অপরিমিত ক্ষুধার দান। একদিকে যেমন দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমন খেয়েই চলছে। খেয়ে খেয়ে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। এমনকি তার খাওয়ার ছুতো করে সেগুলো আবার আমরাই খাই। আসলে এই ক্ষুধাটা কার? আমাদের না ভগবানের? ভগবান তো একটা অজুহাত। তেমনি অজুহাত সন্তানের। অজুহাত সংসারের। অজুহাত নিজের। সবার জন্যেই কিছু না কিছু চাই। ভাত থাকলে সঙ্গে ডাল। ডাল থাকলে সবজি। সবজি থাকলে চাই মাছ, চাই মাংস। আর সব থাকলে চাই, যা নেই। ভিখিরিদের চাই শুধু ভাত। না পেলে ভিক্ষে। ভিক্ষে না মিললে, চুরি। শুধু এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন চাই। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের সময় সে চাওয়া আবার ফ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে পারে।
আমাদের চাওয়ার কোনও শেষ নেই। লাগাম নেই। কোনও লজ্জাবোধও নেই। দুঃখ থাকলে সুখ। সুখ হলে দুঃখ। ঘুম এলে যে-কোনও জায়গায় একটি বালিশ পেতে ঘুমোলেই চলে। কিন্তু ঘুমের জন্যে আমাদের চাই রুম। রুম হলে, বেডরুম। বেডরুম হলে, মাস্টার বেডরুম। মাস্টার বেডরুম হলে …। অথচ শোবার একটু জায়গা, একটু ঘুম, এইটুকু হলেই কিন্তু শোয়া যায়। যেমন রাস্তায় অসংখ্য ভাসমান মানুষেরা ঘুমোয়। যেমন মুটে-মজুর, কুলি-রিকশাওয়ালা-টোকাইরা ঘুমোয়। অথচ পাশেই কি বিশাল ইমারতে কেউ হয়তো মাথা খুঁড়ে মরবে সামান্য একটু ঘুমের আশায়! ওষুধ খেয়েও ঘুম আসছে না। তা সে দালান-কোঠা, ফুটপাত যেখানেই হোক না কেন ঘুম, দু’জনেরই কিন্তু এক। পাঁচ হাজার টাকা বেতনেও সংসার চলে। আবার পাঁচ লক্ষেও। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের পাঁচ কোটিতেও কুলোয় না। ক্রাইসিস লেগেই থাকে। কত। খাদ্য চাই! কত বিত্ত! ক’জোড়া জুতো! কটা গাড়ি, বাড়ি! ক’খানা কম্পিউটার সেলফোন! যখন সেসব ছিল না তখন দিন যায়নি! ব্রোঞ্জ-প্রস্তর-লৌহ যুগ, যায়নি! গ্যাছে, তখনও দিন গ্যাছে কিন্তু এখন যায় না। যায় না কারণ এখন যত আছে, আমাদের চাহিদাগুলো তার চেয়ে বেশি ক্ষমাহীন, সীমাহীন। “সীমাহীন লোভের কারণে সৃষ্ট চাহিদাগুলোই রূপ নেয় ক্রাইসিসে।” যেন বিপুল পরিমাণ বিত্ত, খাদ্য, পোশাক, প্রাসাদও আমাদের যথেষ্ট নয়। যদি হতো, তাহলে-পৃথিবীর সব পুঁজিবাদ বন্ধ হয়ে যেত। পুঁজিবাদ যা সৃষ্টি করে কৃত্রিম অভাব। অভাব নেই, তবুও। অভাব বাজারের। যেখানে ওরা বিক্রি করবে। মানুষ কিনছে একটার জায়গায় তিনটে। কিনে ফেলে রাখছে। পুরোনো হলে-গার্বেজে ফেলছে। কখনো কখনো আমরা পুঁজিবাদের এই কৃত্রিম ক্রাইসিসেরও শিকার। আমরা বলতে যারা গৃহী এবং গেরস্ত। যারা গৃহস্থ, তাদের ক্ষেত্র সংসার। সংসার হলো, সংসার চাহিদা এবং ক্রাইসিসের ভ্রূণ নিষিক্তের প্রসূতিকাগার।
এই যে বেঁচে আছি! বড়ই অবাক লাগে। বেঁচে আছি শোষণের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস, ক্ষুধা, যুদ্ধ, অসুখ-বিসুখ, স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিষ্ঠুরতা, চাহিদা, অস্থিরতা, ভগ্নহৃদয়, ব্যর্থ প্রেম …। প্রতিটি মুহূর্তেই সঙ্কট। যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। সামান্য কারণে মৃত্যু পর্যন্ত। একটু পা পিছলে পড়লেই মৃত্যু। একটা সংক্রামক ভাইরাস। একটা চলন্ত গাড়ির চাকা। রাস্তার হিংস্র কুকুর। সন্ত্রাসীর উড়ন্ত বুলেট। তবু বেঁচে থাকি দুর্ঘটনার মতো। মৃত্যুর কাছে আমাদের এই ক্ষুদ্রতা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু না বুঝলেও তাকেই অতিক্রম করার যুদ্ধ। তাকে অস্বীকার করি বলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারি। না হলে পারতাম না। ফলে শাসন-শোষণ, যুদ্ধের কারণে মানুষের এত যে অহেতুক মৃত্যু, এই অস্বীকারের ব্যাখ্যাও কিন্তু ঐ ক্রাইসিসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তবে মৃত্যু কাউকে ক্ষমা করে না। না শাসক, না শোষক কাউকে না। জীবনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য যাকে আমরা প্রতিনিয়তই ভুলে যাই তা হলো–”জীবনের কাছে মৃত্যুকে আমরা ঋণ করেছি।” যার অর্থ মৃত্যু দিয়েই একদিন, জীবনের কাছে আমাদের যাবতীয় দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে। করতেই হবে। কেবল সেখানেই কোনও ক্ষমা-ঘেন্নার অবকাশ নেই।
একটি শিশুর জন্ম। যম আর মানুষ। মা ও শিশুর বিপন্ন জীবন। মৃত্যুর আগাম শঙ্কা নিয়ে এভাবেই আমাদের জীবনের শুরু। এবং তারপর থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনে, প্রতিটি দিন মানুষ যেন বেঁচে থাকে তার জন্মের উত্তর দিতে দিতে, কেননা মানুষ জন্মই একটা বিশাল প্রশ্নমালা। কেন বেঁচে আছি! কি জন্যে! নশ্বর জীবন ঘিরে বড় বড় প্রশ্নমালা। মন্বন্তরের হা-ভাতেদের মতো হাত পেতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে! আর আমরা, তারই মধ্যে অপরিসীম আনন্দ ও যন্ত্রণায়-সরবে নীরবে, সুখে-দুঃখে জীবনযাপন করে যাই মাত্র কয়েক দশকের জন্যে মাপা যে জীবন, সেই জীবনকে, গোপনে গোপনে মৃত্যুর প্রস্তুতিতে।
আমরা ভাবতেই পারি, এত সব ক্রাইসিস এই বুঝি একটা সমাধানের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলছে। কত আশা আমাদের! অপেক্ষাই সার। একটি শেষ হচ্ছে আর একটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেয়ে বড় হয়েছে। ছেলে পাস করেছে। নিজের ব্লাডপ্রেসার। ওষুধ। ডাক্তার। চেষ্টা, একটার পর একটা। বিয়ে হয়, চাকরি হয়, ডাক্তার হয়। বিয়ে হলে বাচ্চা হবে। চাকরি হলে বাড়ি-গাড়ি হবে। ব্লাডপ্রেসার কমলে তাকে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্রাইসিসগুলো ভাইরাসের জীবাণুর মতো কেবলই বাড়তে থাকে শতক, সহস্র, অযুত-নিযুত আর কোটিতে।
সমস্ত জীবন ধরে এত এত জবাবদিহিতা। ব্যাংকের হিসেবের বইয়ে কোটি কোটি টাকা। বাড়ির গোটা বিশেক দলিল। বিশালাকারের সংসার। মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা ঋণ খেলাপির অর্থ। ”আমাদের ক্ষুদ্রতা” মৃত্যুর হাত ধরে আরও ক্ষুদ্রতর হওয়া। অবশেষে একদিন লক্ষ্মী ছেলের মতো শোষক এবং শাসক দু’জনকেই, মৃত্যুর হাত ধরে চলে যেতে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে। আর আমাদের ফেলে যাওয়া ক্রাইসিসগুলোকে ঘিরে। নতুন নতুন সব সমস্যার সৃষ্টি হয়। রেখে যাওয়া সম্পত্তি কে খাবে! কতটা খাবে! নির্ভর করে পেট কার কতটা বড়। কত বড় ক্ষুধা। ক্রাইসিস আমাদের চলে যাওয়ার পর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যায় নবায়ন হয়ে।
এই যে এতো বড় বড় ঝড় আমরা কাটিয়ে উঠি! ক্যান্সারের মতো অসুখ! সন্তানের অকাল মৃত্যু। নিজের অকাল বৈধব্য। মনে হয় এরপর কি আর অন্ন খাবো? ঘুমোবো? বাঁচবো? তখন মনে হয় জীবন কত তুচ্ছ। এরপর সব-সব ছেড়ে দেবো। দিয়ে শুধু পরকালের কথা ভাববো। কিন্তু ক্রাইসিস কমলে, আমরা কি ঠিক আগের মতো গল্প করি, খাই-দাই, ঘুমোই, সিনেমা দেখি, শরীর খেলি। আমরা কি সন্তানের মৃত্যু-শোক কুলিয়ে ওঠা শেষ হলে, সত্যিই বিত্তের ভাবনাগুলো ছেড়ে দিই? গাড়িতে চড়ি না? ঘুমোই না! খাই-না! ক্যান্সার সত্ত্বেও কি সত্যিই ব্যাংকের ঋণ করা টাকা মেরে দিয়ে স্বেচ্ছায় দেউলিয়া হওয়া থেকে বিরত থাকি? হজ শেষের সব প্রতিজ্ঞাই কি রাখি? রাখলে যে পরিমাণ হাজী এই বাংলাদেশে রয়েছে শুধু তারাও যদি অন্তত তাদের প্রতিজ্ঞা পালন করে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে পারতো তাহলে গোটা দেশের চেহারাটাই পাল্টে যেত। মনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিমপ্রধান দেশের অধিকাংশ শাসকই ধর্মপ্রাণ হাজী। অথচ সেসব দেশেইতো দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। সুতরাং আমার হিসেবে মেলে না কিছুই, কিছুতেই।
ক্রাইসিস কোথায় নেই। বেডরুম-লিভিংরুম, সেক্রেটারিয়েট, রমনা পার্ক, সংসদ, সংবিধান, গাঁজা স্ট্রিপ, শাঁখারিবাজার, পার্ক সার্কাস, কাবুল, ওয়াশিংটন, সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের উপকূল, প্রতারক প্রেমিক, নিষ্ঠুর স্বামী, গার্মেন্টসের বিষ, জনসংখ্যা, বাতাসে কার্বন, ভেজাল খাবার, নার্সিং হোম আর হাসপাতালের অপারেটিং রুম, ক্রাইসিস কোথায় নেই? যা খাচ্ছি, যা পরছি, যা দেখছি, যা অনুভব করছি। বেঁচে থাকাটাই দুর্ঘটনা। মৃত্যু, সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। পায়ের নিচে পড়লে সব পিঁপড়েই মরে না। কিন্তু ছ’তলা থেকে পা পিছলে পড়লে যে-কোনও মানুষের মৃত্যু সুনিশ্চিত। সুতরাং এত প্রতিকূল কিছুর মধ্যেও যে বেঁচে আছি এটাই মিরাকল। জীবন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো গগনচুম্বী। জীবন আবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো একটা খেলনা, একটা ঠুনকো হালকা চুড়িও। কয়েক সেকেন্ডেই ধসে যায়। কারণ যত শক্তিশালীই হোক, মৃত্যুর কাছে তা কাগজের চেয়েও-নরম।
লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাত, বয়স, সবাই সবকিছুর বিরুদ্ধে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে। ক্রাইসিস, সৃষ্টি করে রেখেছে তার কোটি কোটি পা। মানুষ ইচ্ছে করে একটার বিরুদ্ধে আরেকটা দাঁড় করিয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুদ্ধ তো আর কিছু নয়, শুধুই ক্লান্ত করবে। শুধুই শূন্যতায় ভরবে। অথচ সভ্যতা যখন ছিল না, তখন সমস্যাও ছিল পরিমিত। তাহলে দোষটা কার? সভ্যতার! আধুনিকতার! নাকি মূল্যবোধবিহীন মানুষের!
কটা টাকার জন্যে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়া শিশুকে টুকরো করে ফেরত দেয় সন্ত্রাসী। যুদ্ধে জয়ী হয় একপক্ষ, অপরপক্ষের কয়েক লক্ষ কফিনের বিনিময়ে। কৃষ্ণাঙ্গরা তাই ক্রীতদাস। অস্পৃশ্যরা তাই অমানুষ। দারিদ্র্য তাই ফকির-মিসকিন। নারী, পুরুষের চেয়ে নিচু। শুধু অন্যায় আর বৈষম্য। একজাতি আরেক জাতির বিরুদ্ধে। এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে। মানুষ, মানুষের বিরুদ্ধে। ক্যুনিজম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। মানুষ ক্রাইসিসের সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে যেহেতু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয়। নিষিদ্ধ ফলের ওপর আকর্ষণ বেশি। সমস্যা ভালো, সমাধান আমাদের পছন্দ নয়। ক্রাইসিস, একটা আনন্দ। একটা এন্টারটেইন্টমেন্ট। যেমন শাশুড়ি, বৌ পেটায়। বৌ শাশুড়িকে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। এগুলো হলো গৃহস্থ-আনন্দ। দেশে দেশে, মহাবিশ্ব জুড়েই সর্বত্র সবকিছু, সবকিছুর বিরুদ্ধে, পরাজয়ের বিনিময়ে বিজয়ের আনন্দ করে। উল্লাস করে। নৃশংসতার বিনিময়ে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতি জয়ী হয়। মানুষের বিরুদ্ধে শাসক, শোষক হয়। মৃত্যু, রক্ত, অন্যায়ভাবে মানুষের আনন্দ হয়। মানুষের কষ্ট দেখে মানুষ সুখী হয় এবং একমাত্র মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। কারণ আমরাই সবচেয়ে বড় অমানুষ!
তবে সব ক্রাইসিসকে ছাড়িয়ে আমার কাছে আজ যে ক্রাইসিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্রাইসিস। নিজের সঙ্গে দূরত্ব। নিজেকে বুঝতে না পারা। আমিত্ব থেকে বিচ্যুতি-বিচ্ছিন্নতা। মানুষের বিভ্রান্তির শুরু এখানে। জীবনের অপচয়ও এখানেই।
যৌবনের শুরুতে যা একরকম, মধ্য এবং বৃদ্ধ বয়সে তা অন্যরকম। মধ্য বয়স যা বয়সের সঙ্গে সময়ের বিষয়। প্রত্যেকের জীবনেই এই সত্য অমোঘ। না হলে মানুষ কেন একই চেহারায়, সৌন্দর্যে, গঠনে, আজীবন এক থাকে না! কৈশোরের রূপ কেন যৌবনে পাল্টে যায়। বার্ধক্যে কেন যৌবনের রূপ থাকে না! কেন মাথার চুল আজীবন কালো থাকে না। কেন মুখের চামড়া মুখ থেকে ঝুলে পড়ে! কেন বৃদ্ধ বয়সের দাঁতগুলো যৌবনের মুক্তো ঝরানো হাসি হাসে না!
স্বৈরাচারী শাসকের চেয়েও বড়, সময় বড় নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন। সময় হাত ধরে আমাদের নিয়ে যায় জন্ম মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর দিকে। শৈশব থেকে বার্ধক্যে। ওষুধ দিয়ে মৃত্যুকে দেরি করানো যেতে পারে। কিন্তু সময় তাকে ফেরানো যাবে না। কিছুতেই না। বার্ধক্য–ঠেকানো যাবে না। সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
সময়ের যাত্রাপথে মানুষের সব বয়সের সন্ধিক্ষণ মধ্য বয়স। মধ্য বয়স, প্রথম এবং শেষ জীবনের মধ্যিখানে। কি সুন্দর একটি মিলনক্ষেত্র! মিলনক্ষেত্র, যখন আমাদের যৌবনকে আমরা জানাচ্ছি বিদায় আর বার্ধক্যকে জানাই অভিবাদন। যা জানাতে আমরা বাধ্য। কোনও বিত্ত বা ক্ষমতা একে রোধ করতে পারে না। মধ্য বয়স, জীবন নামে একটি মহাসমুদ্রের একেবারে মাঝখানে, যেখানে এসে জোয়ার এবং ভাটা কিংবা বলা যেতে পারে যোগ আর বিয়োগ মিলে, (+ -) = বিয়োগ। এবং এই বিন্দুতে পৌঁছে জীবনের মহাসমুদ্র, একটা নিরঙ্কুশ শূন্যতা, অর্থাৎ সাব-জিরো, যেখানে পৌঁছে মানুষ প্রথম খুঁজে পায় বিচ্ছিন্নতা, যৌবনের সাথে। যোগাযোগ অনুভব করে বার্ধক্যের সাথে। এই মহাসমুদ্রে তখন সে একা তার একমাত্র সঙ্গী হতে পারে তার ‘আমিত্ব’। কিন্তু এই আমিত্বকে যে চিনতে ভুল করে সেখানেই তার সর্বনাশের শুরু। আর যে চিনতে পারে, ধরতে পারে তার জীবনের আরো বহু খোলা জানালা এখানেই খুলে যাবে।
মানুষের মিডলাইফ যেমন আছে। মিডলাইফের ক্রাইসিসও তেমন আছে। একদিকে বিচ্ছেদের বেদনা। অন্যদিকে প্রাপ্তির। এই বিচ্ছেদ এই প্রাপ্তি কোনওটাই আমাদের কাম্য নয়। এই মহাসমুদ্র, ভীষণ অচেনা। কৈশোর-যৌবনের সোনালি সময় ফেলে কে যেতে চায় বার্ধক্যে! কে চায় মৃত্যুর হাতছানি! এই যে সন্ধিক্ষণ, জীবনের সঙ্গে সময়ের, মন ও অনুভবের, গ্রন্থির সঙ্গে হরমোনের! এই সময়ে অনেক রকম জটিলতার সৃষ্টি হয় মানুষের মনের ভেতরে। মেয়েদের মেনোপজ বা ঋতুর শেষ কয়েক বছর আর পুরুষের শুক্রাণুতে ভাটার সময়। উভয়েরই দুটো মূল্যবান সম্পদ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসংবাদ। ফলে মেয়েদের শরীরের গোপন জায়গা হয়ে ওঠে শুষ্ক, আর ছেলেদের বেলায় শৈথিল্য। এই সময়ে পৌঁছে নারী ও পুরুষ উভয়েরই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, স্বাভাবিক ও সর্বজনীন। এর কারণ, সময়। সময়, যা একই সঙ্গে নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন।
যৌবনের অনেক নিষ্পাপ ভুল এখানে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফ ক্রাইসিস, অতীতের পুঞ্জীভূত মেঘ, মেঘ যা অতীত জীবনের আকাশে শুধু স্তরে স্তরে জমেই গ্যাছে একটার পর একটা বছরের পৃষ্ঠে বছর ধরে, কোনওরকম বর্ষণ ছাড়াই। মধ্য বয়স, সেখানে পৌঁছে জীবনের আকাশ প্রথম কেঁপে ওঠে ঝড় আর বিদ্যুতের চমকানিতে। তারপর আসে বর্ষণ আর উতল হাওয়া। শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। ঝড় একটু করে কমে, আকাশের মেঘ একটু একটু করে পরিষ্কার হয়। অতীত, পরিচ্ছন্ন আকাশে তাকিয়ে নতুন করে প্রথমবারের মতো ফিরে দেখা যায়। যেখানে দেখা যায় যৌবনের সব পুঞ্জীভূত নিষ্পাপ কিংবা ইচ্ছাকৃত ভুল। একটার পর একটা। ভুল যা মনে হয়, না হলেও পারতো। না চাইলেও, করা হয়ে গ্যাছে। হয়ে গ্যাছে যা, অতীতে। অতীত যা এখন মৃত। যা এখন মৃত বলে দূরে এবং দূর বলে দূর থেকে যা আরো স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় তাকে, যাকে ঘটনার এত কাছে বলে অতীতে কখনোই মনে হয়নি, যে এগুলো ভুল বা এগুলো অপচয়। মধ্য বয়স, সেই অনুভূতিগুলো উপলব্ধির প্রথম বয়স। মধ্য বয়স, জীবনের সবচেয়ে সত্য, বাস্তব ও সুন্দর সময়।
কৈশোর ও যৌবনের যাচিত ও অযাচিত সমস্যাগুলো মধ্য বয়সে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফের জটিল ক্রাইসিস মানুষের বাকি জীবনকে নড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে নারীর জীবন। অতীতে তার মাতৃত্বের কারণে সকল শারীরিক, প্রাকৃতিক জটিলতা এবং বর্তমানের হরমোন পরিবর্তন, মেনোপজ, জরায়ুর শুষ্কতার কারণে করুণ। যৌনজীবন। সংসারে নারীর জীবন যেন বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে একটি যন্ত্রের মতো। যৌবন গেছে। এবার মধ্য বয়সে এসে শুরু হয় সত্যিকারের ঝড় কাকে বলে। তার রুচি-অভ্যেস-ঘর-সংসার-হৃদয়-মন এবং মানসিকতা। নারী, এখানে পৌঁছে তার সবকিছু নিয়ে, নড়ে ওঠে।