ছোট বাচ্চা দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ।প্রায় সব মানুষই ছোট বাচ্চা দেখলে এমন ন্যাকামি করে যে আমার পিত্তি জ্বলে যায় ।কেউ কেউ আবার মা হতে না পারার দুঃখে নিজের জীবনকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দেয় ।বিরক্তকর ব্যাপার সব ।
আরে ,শুধু মা হবার মধ্যই কি জীবনের সার্থকতা ! আমার মতে বাচ্চা না হলেই ভালো ।হলে এই বাচ্চা পেটে আসা থেকে শুরু করে নিজের মৃত্যর আগ পর্যন্ত ওর কথা ভাবতে হয় ।আল্লাহ্র কাছে হাজার শুকরিয়া জানাই, আমার ১৮ বছর বয়সেই টিউমারের কারনে জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছে ।আমার জরায়ু ফেলে দেয়াতে আমি যে কতটা খুশী সেটা আমি আম্মা আর আমার অন্য আত্মীয়দের বুঝাতে পারিনা । উনাদের ধারনা আমি নিজের দুঃখ লুকানোর জন্য ছোট বাচ্চা দেখলেই বিরক্ত হবার ভান করি ।আসলে কিন্তু ব্যাপারটা একদমই সেটা না । আমার জরায়ু ফেলে দিবার আগ থেকেই বাচ্চাদের দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় । জরায়ু থাক্লেও আমি কখনো বাচ্চা নিতাম কিনা আমার সন্দেহ হয়।
বাচ্চাদের ন্যাপি পাল্টানো , রাত জেগে ওদের খাবার খাওয়ানো । ওহ্ আমি এইসব ভাবতেই পারিনা ।আম্মা দুই কাপ চা নিয়ে আমার রুমে আসলেন । আম্মা চায়ের কাপ নিয়ে আমার রুমে আসার মানে হল দীর্ঘ মেয়াদি কথোপকথন করার প্ল্যান নিয়ে আসা । সেই কথোপকথনের বেশিরভাগই থাকে আমার বিয়ে না হওয়া নিয়ে আম্মার চিন্তা ।সারাদিন অফিস করে রাতে বাসায় এসে এইসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগেনা।কিন্তু আম্মাকে বুঝাবে কে? আজকে আম্মার মুখ খুব খুশি খুশি লাগছে ।জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার আম্মা আজকে তোমার মন খুশি হবার কি কারন সেটা বলে ফেল তাড়াতাড়ি । আম্মা মুচকি হেসে আমার গা ঘেসে বসে বললেন – রিয়া তোর জন্য খুব ভালো একটি সম্বন্ধ এসেছে’রে ।
-আম্মা এর আগেও অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল । ওদের বল যে তোমার মেয়ের কোনদিন বাচ্চা হবেনা । এইকথা শুনলেই দেখবে আগের গুলোর মতোই এই বিয়েও ভেঙ্গে যাবে । আর মা আমি কতদিন তোমাকে বলেছি ।আমি বিয়ে টিয়ে করতে চাইনা । আমি লিখাপড়া করে চাকরি করছি ।বিয়ে না হলে কি অসুবিধা ? শুধু বিয়ে করলে আর গাদাখানেক বাচ্চা হলেই বুঝি নারীদের জীবনে পূর্ণতা আসে ?
– আহ্ রিয়া এতোকথা কেন বলিস ? মেয়ে বড় হলে সব বাবা-মাই চায় তারা সংসারী হোক । কিন্তু তোর জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তুই সারা জীবন বিয়ে না করেই থাকবি এটা কোন কথা ?এই ছেলে সব জেনেই তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে ।
– হ্যাঁ ! কি বলছ আম্মা বাচ্চা হবেনা জেনেও আমাদের দেশের ছেলে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো! আজব তো । আসলে কি ঘটনা আম্মা সত্যি করে বলতো ?
– আসলে কি এই ছেলের আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো ।একটা মেয়েও আছে জানিস ।কি সুন্দর চেহারা । ওর মেয়েটার তিন বছরের সময় বউটা মারা গেলো ।
-আচ্ছা আচ্ছা তো উনি এমন কোন মেয়ে খুঁজছে যাকে বিয়ে করলে উনার নিজের খায়েশ মিটবে । কিন্তু উনার মেয়ের সম্পত্তিতে আর কোন অংশীদার আসবেনা তাইতো ?
– ছিঃ রিয়া এভাবে কেন বলছিস ? দেখ আল্লাহ্ এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন । তুই একদম অমত করবিনা ।তোর আব্বাও রাজি ।আর শুন তোরতো কখনো বাচ্চা হবেনা । নিজের একটি বাচ্চাও পাবি ।ছেলেটি খুব ভালো । মেয়ে যতই চাকরি করুক মেয়েকে সংসারী দেখে না যেতে পারলে কোন বাবা-মা মরেও শান্তি পায়না রে । আমাদের কথা ভেবে হলেও তুই রাজি হয়ে যা ।
শেষ পর্যন্ত আম্মা আব্বার কান্নাকাটি সামলাতে না পেরে আমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলাম ।ভেবেছি বিয়ের রাতেই রায়হান সাহেব আমাকে বলবে – তোমাকে আমি আমার মেয়ের জন্য বিয়ে করেছি ।তুমি ওকে দেখে রেখ ।তারপরে মেয়ের কি পছন্দ অপছন্দ সব আমাকে বলে বলবে এইগুলো খেয়াল রাখবে । আমার মেয়ের যেন কোন অযত্ন না হয় । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রায়হান আমাকে এগুলো কিছুই বলল না । শুধু মেয়েটিকে কোলে করে এনে আমাকে দেখিয়ে বলল- রিয়া এই আমাদের মেয়ে তুরিন । তুরিন উনাকে সালাম দেও ।
আম্মা ঠিক বলেছেন মেয়েটি দেখতে সত্যি সুন্দর । বাবার কথায় তুরিন আমাকে সালাম দিয়ে বলল আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো ? রায়হান কিছু বলার আগেই আমি বললাম তুমি আমাকে খালামনি বলবে ।অন্যর বাচ্চার মুখে আমি মা ডাক শুনব ! কি দরকার এইসব আদিখ্যেতার । এইকথা বলার পর ভাবলাম রায়হান আপত্তি করবে ।কিন্তু ও কোন কথাই বলল না । তুরিন চলে গেলো । রায়হান আমাকে বলল রিয়া তুমি চাইলে পরশু থেকে অফিসে যেতে পারো ।কালকেই আমাদের সব মেহমান চলে যাবে । আর তুরিনকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা ।ওকে দেখা-শুনা করার জন্য একটি মেয়ে আছে ।মেয়েটি খুব ভালো ।তুরিনকে খুব ভালোবাসে ।
বিয়ের পরে আমার দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোন প্রভাব পড়লনা । আগের মতোই আমি অফিস করি ।শুধু রাতে মাঝে মাঝে রান্না করতে হয় । কারন রায়হান আমার রান্না খুব পছন্দ করে । তুরিন আমার কাছে তেমন একটা আসেনা । আসলেও আমি ওর সাথে তেমন কথা বলিনা ।কি বলবো এই ছোট মেয়ের সাথে । ওর সব কাজ কাজের মেয়েটি করে ।শুধু সকালে রায়হান ওকে নাস্তা করিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করে দেয় ।শুক্রুবারে বাসায় থাকলে তুরিন তার বাবাকে নিয়ে বেড়াতে যায় ।আমাকে রায়হান যেতে বললেও আমি যাইনা ।একদিন অফিস থেকে আমাদের বাসায় গেলাম । আম্মা বললেন কিরে তুই তুরিন কে নিয়ে আসিস নাই কেন ? আমি অবাক হয়ে বললাম সেকি! ওকে নিয়ে আসব কেন?
-ওমা, মা এক জায়গায় আর মেয়ে আরেক জায়গায় থাকবে কেন ?
– মা, বাজে বকোনাতো আমি তুরিনের মা হতে যাবো কেন? ও আমাকে খালামনি বলে ।
শুনেতো আম্মা আকাশ থেকে পড়লেন ।বারবার আমাকে বুঝাতে লাগলেন এইরকম মা হারা মেয়েকে আমি কেন আপন করে নিতে পারিনা ।আমার উচিত ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়া ।আমি ভেবেছিলাম রাতে থাকবো ।কিন্তু আম্মার এইসব কথাশুনে আবার নিজের বাসায় চলে আসলাম । পরেরদিন রাতে রায়হান আমাকে বলল রিয়া আগামিকাল তুরিনের স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং ।আমি খুব জরুরি একটি কাজে কালকেই ঢাকার বাইরে যেতে হবে । তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তুমি কি একটু যাবে?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম বাবা- মায়ের সাথে মিটিং করবে ।সেখানে আমি গিয়ে কি করব!আর তুরিনের লিখা- পড়ার ব্যাপারে আমিতো কিছুই জানিনা ।আমার এই কথায় রায়হান ব্যাথিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ।তারপরে বলল আচ্ছা যেতে হবেনা ।পরেরদিন রায়হান অফিসের কাজে রাজশাহী চলে গেলো তিন্ দিনের জন্য ।সেইদিন বিকালেই অফিস থেকে আসার সাথে সাথে কাজের মেয়েটি দৌড়ে এসে জানালো তুরিনের খুব জ্বর । আমি খুবই বিরক্ত হলাম ।
এই জন্যই এই বাচ্চা-কাচ্চা আমার ভাললাগেনা । সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে এখন আবার ডাক্তারের কাছে দৌড়াও । বললাম যা মাথায় পানি দে ।আমি আসছি ।জামা কাপড় ছেড়ে এসে দেখি জ্বরে মেয়েটির গা পুড়ে যাচ্ছে ।একটু চিন্তা হল । তুরিনের জন্য না ।রাতে ঘুমুতে পারবো কিনা সেই চিন্তা ভর করলো । নাপা দুই চামচ খাইয়ে দিয়ে কাজের মেয়েটিকে বললাম খেয়াল রাখিস । আমি উঠে চলে আসার সময় তুরিন আমার হাত ধরে বলল খালামনি আমার পাশে একটু বস ।
আমি কিছু না বলে রুমে চলে আসলাম । রায়হান থাকলে আমার কোন চিন্তা ছিলনা ।আমি না খেয়েই শুয়ে পড়লাম ।প্রায় একঘণ্টা শুয়ে থাকার পরেও কোন এক অজানা কারনে আমার ঘুম আসলোনা । বারবার শুধু তুরিনের কথা মনে হচ্ছিলো । আমি খুব অবাক হলাম কি ব্যাপার? আমার কি হল! আমি উঠে গিয়ে তুরিনের রুমে গিয়ে দেখি মেয়েটি ঘুমুচ্ছে আর তুরিন পানি খাবার জন্য কাঁদছে ।এই প্রথম আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল । আহ’ না জানি কখন থেকে বাচ্চাটি পানি খেতে চাইছে ।সারারাত আমি একটুও ঘুমালাম না ।সকালের দিকে তুরিনের জ্বর কমে গেলো ।
পরেরদিনই রায়হান তুরিনের জ্বরের কথা শুনে চলে আসলো । রায়হান আসার পরে আমি আর তুরিনের কাছে বেশি গেলাম না ।কিন্তু অফিস থেকে ফোন করে বেশ কয়েকবার তুরিনের খবর নিলাম । কেন নিলাম আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না । তুরিন ভালো হয়ে গেল । একদিন সকালে রায়হান তাড়াতাড়ি অফিসে চলে গেলো ।তুরিন কে কাজের মেয়েটি রেডি করে স্কুলে পাঠানোর কথা বলে গেলো ।কিন্তু আমার যে কি হল ! আমি নিজেই তুরিনকে ডেকে ওর চুল বেঁধে দিলাম । ওকে দুধ খাইয়ে দিলাম ।আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই কাজগুলো করার সময় আমার খুব ভালোলাগে । আরও একটি কাণ্ড করলাম সেদিন । বারোটায় তুরিনের স্কুল ছুটি হয় ।আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তুরিনের স্কুলে গিয়ে ওকে নিয়ে আমাদের বাসায় গেলাম ।আম্মা আব্বাতো ওকে দেখে মহাখুশী ।
উনারা এমনভাবে ওকে আদর করতে লাগলেন যেন তুরিন সত্যি সত্যি আমার মেয়ে!! আমার কাছেও কেন জানিনা খারাপ লাগলো না । ইদানিং বাচ্চা দেখলে আগের মতো আর খারাপ লাগেনা । মনে মনে ওদের সাথে তুরিনের তুলনা করি । আর সব দিক থেকে তুরিনকেই আমার বেস্ট মনে হয় । আমি পরেরদিনও তুরিনকে স্কুলের জন্য রেডি করতে গেলাম ।কিন্তু রায়হান বলল থাক রিয়া তোমাকে আর কষ্ট করতে হবেনা ।তুমি নিজে তৈ্রি হয়ে অফিসে যাও । আমার খুব রাগ হল । সেইদিনও আমি ঠিক বারোটায় তুরিনের স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম । কিন্তু ছুটি হয়ে সব বাচ্চা স্কুল থেকে বের হয়ে আসলেও তুরিন বের হলনা ।আমি এইবার খুব ভয় পেলাম ।দারোয়ানকে বলার পরে উনি উপরে গিয়ে দেখে এসে বলল ক্লাসে তো কোন বাচ্চা নেই । শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো ।
আমি এক দৌড়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে গেলাম । স্কুলের টিচাররা বলল সব বাচ্চাতো বের হয়ে গেছে ।তুরিন ও বের হয়েছে ক্লাস থেকে । আর আপনি কে ? আমি তখন রিতমত কান্না শুরু করেছি ।কারন আমি ছুটি হবার আগেই এসেছি ।আর এক মুহূর্তের জন্যও আমি স্কুলের গেট থেকে চোখ সরাইনি । আমি চিৎকার করে বললাম আপনারা আমার মেয়েকে খুঁজে দেন । আমি তুরিনের আম্মু ।আমার মেয়ে স্কুল থেকে কি ভাবে হারিয়ে যায়? আমি রায়হানকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললাম ।রায়হান আসার আগ পর্যন্ত আমি বারবার বললাম আপনারা স্কুলের ভিতরে ভালো করে দেখুন ।কিন্তু টিচারদের এক কথা উনারা তুরিনের ক্লাস দেখেছে সেই ক্লাসে তুরিন নেই ।
তুরিন ছুটির পরে স্কুল থেকে বের হয়ে গেছে । ততোক্ষণে আমার জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা ।রায়হান আসার পরে আমি দৌড়ে রায়হানের কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব বললাম ।রায়হানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো । আমি আম্মাকে ফোন করে বললাম ।আম্মা আমার মেয়েকে পাচ্ছিনা আম্মা । আল্লাহ্ আমাকে সন্তান পেটে ধরার ভাগ্য দেয়নি ।তারপরেও আমি সন্তান পেয়েছি ।সেই সন্তানকেও আমি হারিয়ে ফেলেছি আম্মা । আমার কান্না দেখে রায়হান একবার স্কুলের বাহিরে যায় আবার ভিতরে আসে । আমিতো জানি তুরিন স্কুল থেকে বাহির হয়নি ।ও স্কুলের ভিতরেই আছে ।আমি এবার নিজেই উপরে উঠে গেলাম ।রায়হানও আমার সাথে আসলো ।
একে একে সব ক্লাসরুম দেখে দেখি না আমার মেয়ে নেই ।হটাৎ মনে হল বাথরুম তো দেখলাম না । গিয়ে ওদের ক্লাসের ভিতরের ঢুকে ধাক্কা দিয়েই দেখি ভিতর থেকে বন্ধ ।আমি চিৎকার করে বললাম তুরিন মা তুমি কি ভিতরে ? আমার গলা শুনেই কান্না জড়ানো গলায় আমার মেয়ে বলে উঠলো খালামনি আমি দরজার লক খুলতে পারছিনা ।আমি দরজা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম মামনি তুমি ভয় পেওনা ।আম্মু চলে এসেছি ।এক্ষুনি তোমার বাবা তোমাকে ভিতর থেকে বের করে আনবে । আমি এতদিনে মাতৃত্তের স্বাদ পেলাম ।বুঝতে পারলাম আমরা মেয়েরা জরায়ু ছাড়াও মা হতে পারি ।