আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। পাত্রের বায়োডাটা আর ছবি দেখেছি। পাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে, দেখতে বেশ ভালো।পাত্রের নাম আরাফাত নুর আকাশ।এর আগে কোনদিনও কোন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসেনি, খুব ভয় করছে বুকের ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আমাকে কোন পাত্রপক্ষ দেখতে না আসলেও বড়চাচির কল্যানে আমি দুই তিনবার পাত্রি দেখতে গিয়েছি।বড় চাচির মেয়ে নেই দুই ছেলে। চাচি আমাকে খুব ভালবাসেন। আমাদের বাড়ি আর বড় চাচার বাড়ি পাশাপাশি । বড় চাচির ছেলে সজিব ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে দূর্বল করে ফেলছে । তখন আমি ছিলাম পাত্রপক্ষ বুক ফুলিয়ে পাত্রীর অসহায় মুখ দেখেছি। বড়চাচি এবং আরও দুএকজন মুরব্বির প্রশ্নবাণে জর্জরিত পাত্রীর করুণ মুখ দেখে আর বড় চাচি যখন মেয়ের চুল বের করে দেখছে মেয়েকে হেঁটে দেখাতে বলছে সে সব দেখে তখন বেশ মজাই পেয়েছিলাম, একবার ও ভাবিনি এই দিন আমারও আসবে।
দুশ্চিন্তাই সারারাত ঘুমাতে পারিনি।সকাল সকাল বড়চাচি আমাদের বাড়ি চলে এসেছেন। পাত্রপক্ষ বিকেলে আসবে। বড়চাচি আমাকে খুব ভাল ভাবে ট্রেনিং দিচ্ছেন যেহেতু বড়চাচি অনেক বার নিজে পাত্রি দেখতে গিয়েছেন সেহেতু উনি খুব ভাল করে জানেন পাত্রপক্ষ আমাকে কি ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন উনি সেই মতো আমাকে ট্রনিং দিচ্ছেন। বুঝলি সুমি পাত্রপক্ষের সামনে খবরদার যেন হাসবি না।সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিবি। রান্না পারো কিনা জিগ্যেস করলে বলবি সব কিছু রান্না করতে পারি। কিন্তু চাচি আমি আলু ভর্তা ডাল আর ভাত ছাড়া কিছুই পারি না মিথ্যা কথা বলবো!
পাত্র পক্ষের সামনে একটু আধটু মিথ্যা কথা বলতে হয়। মনে কর, তুই তো কোন কাজ করিস না কিন্তু আমরা বলবো মেয়ে খুবই কাজের। সংসারের প্রায়ই কাজই ও করে। পাত্রপক্ষের সামনে এগুলো বলতে হয়।আচ্ছা তুই চার কলমা বলতো? হয়তো ওরা বলতে পারে চার কলমা পড়ো। চাচি শুধু একটা কলমা জানি ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ( সঃ) আর পারি না।
চাচি যেন আকাশ থেকে পড়লেন বলিস কি? এক্ষুণি কলমা মুখস্থ কর। এখানেই তো ধরা খেয়ে যাবি। পরবর্তী দু’ঘন্ট চাচি আমাকে কলমা মুখস্থ করিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বিকেল না হতেই চাচি আমাকে সাজুগুজু করার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। সুন্দর করে শাড়ি পরে, অবশ্যই মাথায় ঘোমটা দিবি। এসব কি বলছেন চাচি! এখন কি ঘোমটা দেওয়ার যুগ আছে? আমি সালোয়ার কামিজ পরবো।
খবরদার সুমি, আমার উপরে কথা বলবি না যেভাবে বলেছি সেই ভাবে করবি। ঘরে ঢুকেই সালাম দিবি আর মাথা নিচু করে রাখবি, মনে থাকে যেন। এগুলো হচ্ছে আদব লেহাজ বুঝেছিস। সাজুগুজু প্রায়ই শেষ, ছোট বোন রুমি এসে উত্তেজিত হয়ে বললো,আপু পাত্র পক্ষ এসে গেছে।কথাটা শোনা মাত্রই আমার হাত পা অবস হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে আস্তে করে সালাম দিলাম।
মহিলা কণ্ঠে সালামের উত্তরের সাথে সাথে আরও শুনলাম কেমন আছো সুমি? শাড়ি পরে এতবড় ঘোমটা দিয়েছো কেন? এখন কি শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আসার যুগ আছে? মাথা উঁচু করো সুমি, আমার তো মনে হচ্ছে তুমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। মহিলার কথায় আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম।ঘোমটা সরিয়ে আমি উনার দিকে তাকালাম।
মিষ্টি হেসে উনি বললেন, আমি আকাশের মা।তুমি বসো এতো নার্ভাস হচ্ছো কেন? ভেবে নাও আমরা তোমাকে দেখতে আসেনি। আমি তোমার আন্টি হই, এমনি তোমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি গল্প গুজব করে চলে যাবো। ভদ্র মহিলার সাথে আর একজন বয়স্কা মহিলা এসেছেন। আমার বুক কাঁপছে বসতে বসতে ভাবছি এখুনি মনে হয় প্রশ্ন পর্ব শুরু হবে কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখছি উনারা আমাকে কোন প্রশ্ন না করে মা আর চাচির সাথে গল্প শুরু করে দিলেন।
আন্টি, মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন বুঝলেন আপা আজকাল বায়োডাটার সিস্টেম হয়ে খুব সুবিধা হয়েছে, পাত্র পাত্রীর ছবি আর বায়োডাটা দেখেই তাদের সম্পর্কে অর্ধেকের বেশি জানা হয়ে যায়। আমাকে যখন আকাশের দাদিরা দেখতে গিয়েছিলেন তখন কতো প্রশ্ন! নাম কি? কয় ভাই বোন? বাপ চাচাদের নাম বলো। এটা পারো? সেটা পারো? নানান প্রশ্ন সেই সাথে হাত ধরে দেখছে চুল ধরে দেখছে আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির মতো অবস্থা। আমার ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার থেকে শিক্ষা নিয়েছি যদি কখনও আমার ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে যেতে হয় তাহলে এই ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করবো না। এখন যুগ পাল্টিয়েছে ঐভাবে কনে দেখা ঠিক না।এতে করে মেয়েদের মনের উপর চাপ পড়ে। তাই না আপা? আপনাদের কি মত? বলেই আন্টি বড় চাচির দিকে তাকালেন।
আমি আড় চোখে বড়চাচির দিকে তাকিয়ে দেখি চাচির মুখ কাল হয়ে গেছে।মা উৎসাহের সাথে বলল একদম ঠিক বলেছেন আপা। আন্টি এবার হাসিমুখে আমাকে জিগ্যেস করলেন, সুমি তুমি গল্পের বই পড়তে ভালবাসো? প্রিয় লেখক কে? পাত্র পক্ষ এমন প্রশ্ন করবে আমি তো আশাই করিনি । হাসি মুখে জবাব দিলাম, আমার বই পড়তে খুব ভাল লাগে আন্টি, হুমায়ুন আহমেদ আমার প্রিয় লেখক অন্য লেখকদের ও বই পড়ি।
জানো সুমি আমিও বই পড়তে অনেক পছন্দ করি আমার সংগ্রহে প্রায় দুইশোর মতো বই আছে। আমি এমন একটা মেয়ে খুঁজছি যার অন্যান্য গুণের পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস আছে।যে বই পড়তে ভালবাসে সে বই এর যত্ন নেয়, আমার অবর্তমানে আমার বৌমা বই গুলোর যত্ন করবে।
বড়চাচি বলে উঠলেন,আপা আমাদের সুমি খুব ভাল রান্না করতে পারে। তাই নাকি! এটা তো ভাল কথা তবে আপা সুমি রান্না না জানলেও কোন অসুবিধা নেই। যে মেয়ে সংসার আর পরিবারের সদস্যদের ভালবাসবে সে বিয়ের পর নিজের চেষ্টায় রান্না শিখে পরিবারের সদস্যদের রান্না করে খাওয়াবে। আর যে মেয়ে পরিবারের সদস্যদের ভালবাসবে না সে বাপের বাড়ি থেকে হাজার রান্না শিখে গেলেও একবেলা রান্না করে খাওয়াবে না।
জানেন আপা আমার খুব ইচ্ছা বৌমা আমার মেয়ের মতো হবে শ্রদ্ধার পাশাপাশি আমাকে ভালোবাসবে।আমাদের সময়ের শ্বাশুড়িরা আমাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করতেন। আমি উনাকে সম্মান করতাম ভয় পেতাম কিন্তু মন থেকে ভালবাসতে পারতাম না। আমার শ্বাশুড়িমা গল্প করতেন উনিও শ্বাশুড়ির কাছ থেকে খুব খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপা, আমি যে ব্যবহার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে পেয়ে কষ্ট পেয়েছি সেই ব্যবহার আমি আমার বৌমার সাথে করবো না।
সুমিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু আমার একার পছন্দ হলে তো হবে না। আপনাদের ও তো আমার ছেলেকে পছন্দ হতে হবে। চাইলে সুমি এবং আপনারা আকাশের সাথে দেখা করে কথা বলতে পারেন। আমার খুব ইচ্ছা বৌমা কে বুকের ভেতর রাখবো কিন্তু আমার ইচ্ছা তো সব না যাকে বৌমা করবো সে বুকের ভেতর আসবে কিনা সেটাও তো একটা কথা। আমি আগ্রহ করে বৌমা কে জড়িয়ে ধরতে গেলাম বৌমা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো, সে সংসারে তো শান্তি থাকবে না। দুইজন একই রকম হলে তবেই সংসারে শান্তি।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আন্টির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি দেখেছি আমার দাদি, মা আর বড়চাচির সাথে কেমন আচরণ করতেন! মা আর চাচি সবসময় দাদিকে ভয় পেতেন। বড়চাচি ও তার ছেলের বউয়ের সাথে কঠোর আচরণ করেন। বড়চাচির বক্তব্য, আমার শাশুড়ি আমার সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করেছেন সেই তুলনায় আমি তো কিচ্ছু করি না। দাদি আর বড় চাচি কে দেখে শাশুড়ি সম্পর্কে আমার মনের ভিতর ভয় তৈরি হয়েছিল, উনার কথা শুনে আমার সেই ভয় উবে গেল আমার মনে হচ্ছে আন্টির মতো মানুষ জগৎ সংসারে আর দ্বিতীয়টি হয় না।
আন্টি, মা আর বড়ো চাচি কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা যত তাড়াতাড়ি আকাশের সাথে দেখা করে কথা বলে আপনাদের মতামত জানাবেন তত তাড়াতাড়ি সুমিকে আমার মেয়ে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো।আন্টিরা বিদায় নেওয়ার সময় আমার হাত ধরে আন্টি বললেন,আসি সুমি ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।
আমার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো আমি আন্টি কে জড়িয়ে ধরলাম। আন্টি পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, নিজের ছেলে বলে বলছি না সুমি, আকাশ অসাধারণ একটা ছেলে। দেখবে, তোমাকে নিয়ে আমরা অনেক ভালো থাকবো।
আন্টিরা চলে যাবার পর আমার শুধু একটা কথাই মনে হলো, আন্টির মতো সব ছেলের মা’রা যদি এমন উপলব্ধি করতো তাহলে সংসারে শাশুড়ি বৌমার এমন আদায় কাচকলা সম্পর্ক থাকতো না সংসার জীবন অনেক সুখের হতো।