অপরিচিতা

অপরিচিতা

অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলাম আমার প্রেমিকা ঈশিতাকে। আর এজন্য বাবার হোটেলে আরাম করে আর বেশিদিন খেয়ে থাকতে পারিনি। আমি চাকরি করি একটা ছোটখাটো কোম্পানিতে। রোজ বউয়ের আদর ফেলে অফিসের দিকে ছুটতে হয়। সারাদিন অফিসে থাকার পরে রাতে বাসায় ফিরে আর প্রেম করার সময় থাকে না। তবে বাস্তবতা এটাই। এত আবেগ, এত প্রেম করবো বলে স্বপ্ন দেখার পর বাস্তবে সেসব আর হয়ে ওঠে না। কেননা অর্থের তাগিদে প্রচুর ছুটতে হয়। যেটা এখন আমি বুঝতে শুরু করেছি।

সেদিন অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই একটা জিনিস খেয়াল করলাম। অফিসের গেইটের দারোয়ানের সাথে একজন লোকের কথা কাটাকাটি চলছে। আমি এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে মামা, সমস্যা কি?” দারোয়ান মামা বললেন, “এই লোকটাকে কিছুতেই বুঝিয়ে আমি পারছি না, স্যার। বললাম ভেতরে যাওয়া যাবেনা, নিষেধ আছে। তারপরেও উনি ভেতরে যেতে চান। কি আজব মানুষরে বাবা।”

আমার কিছুটা কৌতুহল হলো। আমি লোকটির দিকে তাকালাম। লোকটি বেশ বয়স্ক কিন্তু চেহারার মধ্যে কেমন একটা শিক্ষিত শিক্ষিত ভাব আছে। পরনে ড্রেসগুলো পুরনো। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম “চাচা কী হয়েছে? আপনি আমাকে বলুন। আপনি ভেতরে গিয়ে কী করবেন চাচা? ”

লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ” বাবা, বাবা এইটা আমার ছেলের অফিস। আমার ছেলে আরমান, আরমানের সাথে আমি দেখা করতে আইছি। দেখেন বাবাজি আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি কতবার বলছি এটা আমার ছেলের অফিস, এটা আমার ছেলের অফিস। কিন্তু দিচ্ছেই না।” আমি অবাক হলাম। আমাদের এই কোম্পানির যিনি মালিক তার নাম আসলেই আরমান। উনি কি তার কথাই বলছেন? আমি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি ঢুকতে দিচ্ছে না কেন?”

দারোয়ান বলে,” আসলে স্যার, ঢুকতে দিচ্ছি না কারণ আরমান স্যার এখন মিটিংয়ে আছেন। উনার সাথে আমি কথা বলেছি উনি বলেছেন এনাকে যেন বাইরে বসিয়ে রাখা হয়। মিটিং শেষ হলে যাতে ঢুকে। আমি বললাম, “আপনি কি জানেন আরমান সাহেবের বাবা উনি?” দারোয়ান বলে ” আরমান স্যার কে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি।” আমি অবাক হয়ে বললাম, ” আশ্চর্য আপনি কি বলেন নি যে আপনার বাবা এসেছেন?” ” জি স্যার আমি বড় স্যারকে বলেছি কিন্তু উনি কিছু বলেননি। বলেছে অপেক্ষা করাতে।”

আমার এটা শোনার পর কেমন যেন একটা ভয়াবহ কষ্ট লাগলো। আমি চাচাকে নিয়ে অফিসের ভেতরে ঢুকলাম। একটা রুমে ওনাকে বসিয়ে কিছুটা নাস্তার ব্যবস্থা করলাম। উনি দেখলাম হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে তাড়াহুড়ো করে পুরোটা খেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ” চাচা কবে এসেছেন?” উনি বললেন “বাবা আজকেই। সকালের বাসে গ্রাম থেকে আইছি। আমার ছেলেটারে দেখিনা বহুদিন ধইরা। মাঝে মধ্যে টাকা পাঠায় কিন্তু কন দেহি আমার কি দেখতে ইচ্ছা হয় না। অবশেষে ঠিকানাটা জোগাড় কইরা নিজেই চইলা আইলাম। আমার আর কেউ নাই বাজান। এই একটা ছেলে আমার। ”

আমি চাচাকে আরো বিস্কিট আরো কেক এনে দিলাম, উনি যত্নসহকারে সব খেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আরমান সাহেবকে এদিকে আসতে দেখলাম। আমাকে এই বয়স্ক লোকটার সাথে দেখে আরমান সাহেব কিছুটা বিচলিত হলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম স্যার আপনার বাবা এসেছেন। আপনি উনাকে কিভাবে পারলেন গেইটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে? ” আরমান সাহেব আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “আচ্ছা তুমি এখন এখান থেকে যাও।”

আমি কিছু না বলে ওখান থেকে চলে আসলাম কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে হলো জানতে কি ব্যবহারটা করে উনার সাথে। আমি দরজার আড়াল থেকে দেখছিলাম। আরমান সাহেব লোকটার কাছাকাছি গিয়ে বললেন, ” আচ্ছা আপনাকে আমি টাকা পাঠাই না? আপনার যা লাগে সব দেই। তাহলে আপনার কেন এভাবে আসতে হয়? আপনি এখনই গ্রামে ফিরে যান। আমার এখানে আরো মিটিং আছে। আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারছি না। এই নেন টাকা। আপনি চলে যান। ” এসব বলে আরমান সাহেব চলে আসলো। আমি ততক্ষণে ওখান থেকে সরে পরলাম। লোকটার জন্য ভয়ঙ্কর কষ্ট হল। আমি আবার ওই বয়স্ক লোকটার সাথে দেখা করলাম। আমি বললাম ” বাজান কী করবেন এখন?”

তার চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু ঝরলো। বললেন, ” বাবা আমার আর ইচ্ছা নাই। আমার ছেলে সুখে আছে, আনন্দে আছে এইটাই আমার শান্তি। আমার ছেলে খুব সুখে আছে। খুব সুখে আছে।” লোকটাকে বাসে তুলে দিয়ে আমি ড্রাইভারকে বলে দিলাম ঠিকমত নামিয়ে দিতে। আমি জানতাম না কি করা উচিৎ ছিল আমার।

ঘটনাটা ছিল প্রায় তিনমাস আগের।সেদিনের পরে ওই কোম্পানিতে আমি আর চাকরি করি নি। অন্য একটা কোম্পানিতে আরেকটু কম বেতনে চাকরি করি তারপরেও আফসোস নেই। গতকাল রাতে বউয়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আবার আলোচনা করলাম। ঘটনাটা আমার বউয়ের জানা সেদিনই বলেছিলাম। আমার বউ আর আমি মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী রবিবার ওই লোকটাকে দেখতে যাব। উনার ঠিকানা আমার কাছে আছে। লোকটার জন্য কেন যেন খুব মায়া হয়, খুব মায়া, খুব।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত