আমার কিছু কর্মকাণ্ডে আমি নিজেও অবাক হই মাঝে মাঝে৷ ইদানীং কী সব উদ্ভট কাজ করছি আমি। এইতো আজ ইরিনার শাড়ি পরা ছবি দেখে আমার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল৷ আমি সেখানে তাকে তোশামোদ করে দুর্দান্ত একটা কমেন্ট করলাম৷ যা আমি কখনোই করিনি। কোনো মেয়ের ছবিতেই করিনি৷ এমনকি আমার করার কথাও না৷ তাই ইরিনার ছবিতে আমার কমেন্ট দেখে বন্ধুবান্ধব বেশ অবাকই হলো৷ বলাবাহুল্য শেষ পর্যন্ত আমি নিজেও বেশ অবাক হলাম। আমার কমেন্টে হুড়মুড়িয়ে পড়লো আমার বন্ধু গুলো৷ তারা একে অপরে রিপ্লাই করতে থাকল।
তাদের ধারণা আমার আর ইরিনার মাঝে কিছু চলছে। তাদের আড়ালে আমরা হয়তো নিজেদের অবাধ্য কিছু অনুভূতির আদানপ্রদান করছি। আমি তেমন পাত্তা দিলাম না। আমার মনে হলো শাড়ি পরা ইরিনাকে দারুণ লাগছিল। মনে হচ্ছিল কোনো রূপবতী পরী ফেসবুকের দেয়ালে এসে লেপ্টে বসেছে। মন চাচ্ছিল কমেন্ট করতে। তাই করে ফেললাম। কে কী ভাবলা তা ভাববার বিষয় নয়। সেই কমেন্ট যে আমার প্রাক্তন প্রেমিকা দেখবে তাও আমার জানা ছিল। কিন্তু সে যে আমার কমেন্টে এংরি রিয়েক্ট দিবে তা সত্যিই আমি ভাবিনি। নিজেই এংরি রিয়েক্ট দিল আবার কিছুক্ষণ পর নিজেই সেটাকে রিমুভ করে দিল। যাক! সে যা ইচ্ছে তাই-ই করুক। আমার কী!
এমনিতেই জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে একদম। এই যে আমাদের মধ্যে এখন আর সম্পর্ক নেই, প্রেম চলছে না, এই যে আমি ব্যতিক্রমী স্বভাবের হয়ে উঠছি, নিয়মতান্ত্রিক থেকে অনিয়মন্ত্রিক হয়ে উঠছি, এসবের কারণ কী? এসবের কারণ হলো ওই মিহিন। আমার প্রাক্তন প্রেমিকা। সপ্তাহ হলো আমাদের ব্রেকাপ হয়েছে। সে ভেবেছে ব্রেকাপের পর, আমি একদম ভেঙ্গে পড়বো, ভার্সিটি যাবো না, কাঁদো কাঁদো হয়ে তার কাছে যাবো, ক্ষমা চাইবো, আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করতে চাইবো।
এসব নিতান্তই তার অগ্রিম ধারণা ছিল বলে আমি মনে করি। কিন্তু সে তো জানে না আমি কী! প্রথমদিন ঠিকই ভার্সিটি যাইনি৷ মন টন খারাপ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন হাসিমুখে ভার্সিটি গিয়ে উঠলাম। সবার সাথে বেশ হাসিখুশি দিন পার করতে থাকলাম। এমন একটা ভাব করলাম যেন কিছুই হয়নি। তেমন কিছুই ঘটেনি। কিংবা সদ্য ব্রেকাপে তেমন আঘাত পাইনি আমি। আমি জানি সে অবাক হবে আমাকে এভাবে দেখে। আমার হাসি মুখ সহ্য করতে পারবে না৷ ঘটলও তাই। আমাকে এমন প্রানবন্ত দেখে সে নিজ থেকেই আসল কথা বলতে। বলল,
-এই ভালোবাসিস তুই আমাকে? ব্রেকাপ হয়েছে অথচ চেহারায় তোর বিজয়ী হাসি। খুব সুখে আছিস মনে হয়!
আমি হাসি দিয়ে বললাম,
-শোন, ভালোবাসা মানে এই না যে প্রেমিকার সাথে ব্রেকাপ হলে দেবদাস হয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি করে চোখ ভাসাতে হবে। অন্তত আমি এসব মানি না। প্রেম আমার কাছে একটা অসাধারণ অনুভূতি কেবল। জীবনে কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পেরেছি এই-ই অনেক। আজকাল অনুভূতির প্রেম হয় কই! সর্বত্রই তো চামড়ায় চামড়ায় প্রেম হয়। ধন্যবাদ তোকে মিহিন। আজাদ করে দিয়েছিস আমায়। এখন নিজেকে ভীষণ স্বাধীন মনে হয়৷ মনে হয় এখন যা ইচ্ছে আমি তাই-ই করতে পারবো৷ বন্ধুদের সাথে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে সব পারবো। মেয়েদের সাথে নির্ভয়ে কথা বলতে পারবো। যেটা আমি রিলেশনে থাকাকালীন পারতাম না৷ এখন পারছি। আমার ভালো লাগছে এখন মিহিন।
মিহিন কেবল তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তার মুখ শক্ত হয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। হয়তো আমার কথায় হতভম্ব সে। আমি ফিরে এলাম সেখান থেকে। আড়াল হয়ে চোখের কোণাটা মুছে নিলাম কেবল। জল গুলো যেন অযথাই জমে যায় চোখের কোণে। অকারণে।
বন্ধুদের সাথে থাকলে মিহিনের কথা মনে পড়ে না। আড্ডায় সময় যায় কিছু। ভালো লাগে এই ভেবে যে কিছু সময় ওকে না ভেবে পার করছি। সময়টা ভালো যাচ্ছে৷ কিন্তু অবসর হলে? কে ঠেকায় তখন? কীভাবে আটকানো যায় চার বছরের ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি গুলো! কীভাবে সব ব্যাথা বুকের কোণে লুকিয়ে রাখা যায়! কীভাবে তার ভাবনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? মুখে মুখে না হয় মুক্তি হলো! কিন্তু অন্তরের মুক্তি? অনুভূতির মুক্তি? স্মৃতির মুক্তি? তা কীভাবে সম্ভব?
কীভাবে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে আমি হুট করেই ভুলে যেতে পারি? কিংবা কীভাবে পারব? যাকে আমি চারবছর যাবত মনে প্রাণে ভালোবেসেছি, যে আমার দুঃসময়ে ছিল, সুসময়ে ছিল। আমি ভেঙ্গে পড়লে যে মেয়েটা আমার হাত ধরে আমাকে ভরসা দিত। তাকে কি চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়? এতোই সহজ?
উপরে উপরে না হয় আমি হাসলাম। সবার সাথে বিনয়ী ব্যবহার করলাম। কিন্তু ভেতরের আমি? তাকে কী করে বুঝাবো? তার সামনে তো অভিনয় করা যায় না। তাকে তো বুঝানোই মুশকিল যে মিহিন ছিল একসময় আমার। এখন নেই। আমার নেই। তাকে কী করে বুঝাবো?
সবাই জানে, আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে। বিচ্ছেদের পরেও আমি কী দারুণ সময় পারছি। হাসছি, খেলছি, ভার্সিটিতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। এগুলোই কি আমার ভালো থাকার প্রমাণ? আমি ভালো আছি? তারা তো নিকশ কালো অন্ধকারে রুমে বন্ধি আমি’র কাঁথায় মুখ গুঁজে অব্যক্ত আর্তনাদ গুলো শুনে না। আড়ালে যে আমি কী ভীষণ কষ্টে আছি তারা তো বুঝতে পারে না। আর যে বুঝে সে আজকাল বুঝতেও তো চায় না।
কেবল সমান্য একটা কারণে, একটু ভুল বুঝাবুঝি, নিজের ইগোকে সর্ব প্রথম বলে গণ্য করা মিহিনই ছিল আমাদের ব্রেকাপের মূল কারণ। সে এটা মানতেই চায় না যে ভুল তার। নিজের ভুল সে স্বীকারই করে না৷ অথচ এতোদিন যে আমি তার ভুল গুলো নিজের কাঁধে নিয়ে এসেছি, তার ভুল নিজে স্বীকার করে তার কাছে বকা শুনেছি, সেই সব দিনের কথা, সেই সব ভুলের কথা কী তার মনে পড়ে না? আর কতো? এভাবে আর চলবে কতো? সে ভুল করবে। আর ঝাড়ি শুনতে হবে সব আমায়? এভাবে আর পারা যায়নি। বোঝাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। আর পারছিলাম না। তাই তো হঠাৎ সিদ্ধান্ত, এবং একটা অভাবনীয় বিচ্ছেদ৷
সবাই আমাদের বলতো সেরা জুটি৷ সেরা জুটি। ভার্সিটির সেরা জুটি। অথচ তারা তো জানে না কোনো রিলেশনের বয়স বৃদ্ধিই সেই রিলেশনকে সেরা করে না। সেরা তো হয় তখন, যখন একজন অন্যজনকে খুব বুঝবে। সুখে-অসুখে একে অপরের পাশে থাকবে৷ আজীবন থাকবে৷ সময় পার হয় বড় ধীর গতিতে। ধীরে ধীরে আজ আমি পর্যন্ত এলাম। বিচ্ছেদের এক সপ্তাহ পার করে ফেললাম। ভার্সিটি থেকে এসে মহা ক্লান্ত আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শরীর যেন অবশ হয়ে আসে। অভিনয়ের ক্লান্ত দু চোখ যেন আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়৷ ঘুম ভাঙ্গে সন্ধ্যার পর আবিদের ডাকে। আমি উঠতেই সে ভ্রু কুচকে বলল,
-কী হয়েছে তোর? দিনদিন অনিয়ম হয়ে যাচ্ছিস। আমি হাসলাম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
-জীবনের বিচিত্র কিছু স্বাদ গ্রহণ করছি রে বন্ধু। বেশ ভালো লাগছে৷ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কেবল। তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারল না যেন৷ কিছু সময় পার হতেই বলল,
-গোসল করবি? আমি হামি দিয়ে বললাম,
-কেমন জানি লাগছে। গোসলটা সেরে নেই।
-দাঁড়া। আমি পানি গরম করে দিচ্ছি৷ আমি হাসলাম। বললাম,
-লাগবে না৷
-বেশি কথা বলিস না৷ যা শীত ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে প্রব্লেম হবে৷
-আমার অভ্যাস আছে। এই বলে গোসলের প্রস্তুতি নিলাম। ও তখনও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ বলল,
-তাসফি? যা বলি শুন।
আমি ওর কথা শুনিনি। গোসলটা সেরে ফেললাম। তারপর থেকে মাথা ভারী হয়ে আসতে থাকল। ভারী মাথায় ইরিনার ছবি দেখে আবেগ প্রবন হলে কমেন্ট করলাম। সেই কমেন্ট নিয়ে চলল বন্ধু গ্রুপে বিস্তর আলোচনা। আবিদ বলল,
-বাব্বাহ! মিহিনের ছবিতে তো কখনোই এমন কমেন্ট দেখিনি। আমি হাসলাম। বললাম,
-আমিও ভাবছি এই করেন্ট করলাম কীভাবে! তবে মেয়েটা কিন্তু সুন্দর। তাই না? আবিদ বলল,
-সুন্দর তো বটেই। তবে তোর কি মনে ধরেছে? কথা বলব?
-এক মন আর ক’জনকে দিব রে বন্ধু।
-কেন? এক মন কী একের অধিককে দেওয়া যায় না?
-আমি তো এতোর মধ্যে একজনকে দিয়েছিলাম। সে তো সেটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলল। আবার কারো হাতের পুতুল হওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।
-খুব কথা বলা শিখেছিস।
-সময়, অবস্থান অনেক কিছু শেখায়৷ ইরিনাকে তোর পছন্দ না? আবিদ বিব্রত হলো। আমতাআমতা করে বলল,
-কই, না তো? কী বলছিস?
-তুইও দেখি আড়াল করতে শিখেছিস।
-তোর থেকেই তো শেখা৷ আমি অবাক হলাম। বললাম,
-আমার থেকে?
-হু?
-আমি আবার কী আড়াল করলাম? আবিদ কবিতার মতো কিছু একটা বলল। কণ্ঠে ছিল উদাসীনতা। বলল,
– প্রেমে পড়েছি তো কষ্ট পেয়েছি, ভালোবেসেছি তো আড়াল করতে শিখেছি। এই বলে আমি হাসল কেবল। উদাসীন হাসি। আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ফিকে হাসি দিলাম। সে বলল,
-সেই ছোট্ট বেলা থেকে তোকে চিনি৷ ভাবছিস কিছু বুঝি না! আমি কিছু বললাম না আর৷ ফেসবুকে মনোনিবেশ করলাম৷ রাতে খুব করে জ্বর এলো। শরীর ব্যাথা ব্যাথা লাগল ভীষণ৷ আবিদ মাথায় পানি দিল। জল পট্টি দিল। ঔষধ খাইয়ে দিল একটা। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সে বলল,
-আমি যদি পারতাম মিহিনের নামটা এই ঘরের প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে লিখতাম। আমি অবাক স্বরে বললাম,
-কেন?
-কী কেন? জানিস এটা কার কথা? এটা একজন বিশ্বপ্রেমিকের কথা। বিশ্বপ্রেমিক তাসফি জ্বরের ঘোরে কাল রাত অনেক কথা বলে ফেলেছে। ও দুষ্টামির হাসি দিল। আমি লজ্জা পেলাম। আর কী কী বলেছি কে জানে৷
ভার্সিটি যাওয়া হলো না আর। দশটার দিকে ইরিনা ফোন দিল। শরীর ভালো লাগলে যেন ভার্সিটির দিকে যাই। বারোটার দিকে মনে হলো বাইরে বের হওয়া উচিৎ। ঘরে একা একা বোর হচ্ছি। ভার্সিটির দিকে গেলাম। এখান থেকে ভার্সিটি কাছেই। আমাকে দেখতেই এগিয়ে এলো আবিদ৷ বলল,
-কেমন লাগছে এখন? আমি বললাম,
-বেশ স্বাভাবিক লাগছে। আচ্ছা শুন না, আর কী কী বলেছিলাম কাল রাতে। বল না? ও হাসল। বলল,
-নাহ। কিছু সিক্রেটও বলে ফেলেছিস তুই। সেগুলো বলা যাবে না৷ আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
-কী সিক্রেট বললাম আবার৷ আল্লাহ গো! আবিদ হাসতে থাকল। আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে হাসলাম। কোত্থেকে ইরিনা যেন এগিয়ে এল। আমার কাছে এসেই বলল,
-তাসফি, একটু গোপন কথা আছে৷ একটু এদিকে আসবে? আবিদ হাসি মুখে আমায় বিদায় জানালো। আমি ইরিনার সাথে গেলাম। কোনদিকে হাঁটছি জানি না৷ তবে হেঁটে অনেকটা পথ চলে এসেছি আমরা৷ ইরিনা বলল,
-কাল কমেন্ট টা কি নিজ থেকেই করেছো? আমি হাসলাম। বললাম,
-না৷ নিজ থেকে করিনি। পর থেকে করেছি। এই বলে আমি আবারও হাসলাম। ইরিনাও হাসলো বিপরীতে। সে বলল,
-জানো, আমার না ভীষণ ভালো লেগেছে।
-তাই? খুব ভালো লেগেছে?
-হু। তবে…
-তবে?
-দুজন মানুষ খুব জ্বলল।
-দু’জন?
-হ্যাঁ। আমি চিন্তা করতে থাকলাম কিছুক্ষন। দুইজন কে? কোন দু’জন? তখনই ইরিনা বলে উঠল,
-মিহিন কাল কী পাগলামি করলো জানো? আমার ভ্রু কুচকে এলো। বললাম,
-সে আবার কী পাগলামী করল?
-আমার পোষ্টে তোমার কমেন্ট দেখেই তার নাকি মেজাজ গরম হয়ে গেছে। সে দ্রুত আলমারি খুলে শাড়ি নামিয়ে সাজতে শুরু করলো। রাগে নাকি তার পুরো শরীর কাঁপছিল। শাড়ি পরে সে রাতেই ছবি আপ দিল, তা কি তুমি দেখোনি? আমি বললাম,
-না তো! শরীর খারাপ লাগছিল। তাই শুয়ে গিয়েছিলাম।
-এ জন্যেই হয়তো ওর রাগটা বেড়ে গিয়েছিল৷ তা তোমাকে এক্টিভ দেখাচ্ছিল কেন?
-পিসি অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই হয়তো এক্টিভ দেখাচ্ছিল।
-ও আচ্ছা। মিহিন কী করেছো জানো? আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ইরিনা কিছুদূর হেঁটে গেল। বললাম,
-কী করেছে? ইরিনা পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
-শাড়িটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিলো৷ এতো সুন্দর শাড়িটা! আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বললাম,
-এটার বাকি ছিল হয়তো। ইরিনা বলল,
-রাতে নাকি ও ওর বাবা মায়ের সাথে অনেক রাগারাগি করেছে৷ অনেক কিছু ভাঙচুর করেছে। আমি কিছু বললাম না। ইরিনা বলল,
-এই আরকি ঘটনা। আমি এগুলো তোমাকে কেন বলছি জানো?
-না তো! কেন বলছো?
-বলছি কারণ তুমি যেন বুঝতে পারো সে তোমাকে কেমন ভালোবাসে৷ আমি হাসলাম। বললাম,
-এগুলো ভালোবাসা নয়৷ তার ইগোতে লেগেছে৷ এটাই।
-আমার তা মনে হয় না৷ সে এখনও তোমায় ভালোবাসে। আমি কথাটা এড়িয়ে গেলাম। বললাম,
-দ্বিতীয় মানুষটা কে?
-আমার মনে হয় তুমি জানো তাকে?
-আবিদ? ইরিনা মুচকি হাসল। বলল,
-কাল তার ফেসবুক পোষ্ট দেখলেই টের পাইতা। আমি মৃদু হেসে বললাম,
-কাল রাত তো তাহলে অনেক কিছু ঘটে গেল। তা তোমার পছন্দ ওকে?
-পছন্দ দিয়ে কী হবে! হাদারাম তো কিছুই বুঝতে পারে না। গাধা একটা৷ খানিকটা রাগ দেখালো যেন ইরিনা। আমি হাসলাম। বললাম,
-বলবে বলবে। আমার সাথে যেহেতু আছে অবশ্যই বলবে৷
-এটার জন্যেই তো তোমাকে আসতে বললাম। গাধাটাকে একটু বুঝাও না৷
-দাঁড়াও কল দেই।
-এখন দিবা?
-হ্যাঁ এখনই। শুভ কাজে দেরি করতে নয়।
আবিদকে কল দিলাম। সে দ্রুতই উপস্থিত হলো। আমার কেন জানি মনে হলো ও আমাদের আশেপাশেই ছিল। আমাদের ফলো করছিল। আমি ইরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছো ইরিনা? ইরিনা মুচকি হাসি দিল। বলল,
-আমি তে সেই ব্যাপারে একদম নিশ্চিত। আমি আবিদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-ফলো করছিলি আমাদের? আবিদ মুখে কৃত্রিম রাগের ছাপ এনে বলল,
-ছিহ! তুই আমাকে এতো নিচু ভাবিস? আমি কেন তোদের ফলো করতে যাবো?
-সেটাই তো এখন বলবি। কেন ফলো করছিস?
-কী আশ্চর্য। কী শুরু করছিস এটা?
-আবিদ, এতো ঢং জানিস জানতাম না তো। আবিদ কেমন করে যেন তাকালো। আমি বললাম,
-বন্ধু, তোমার ডায়েরিতে কার নাম যেন দেখেছি একবার? আবির আমার হাত চেপে ধরল। মৃদু স্বরে বলল,
-প্লীজ ভাই? এসব এখন না বললেই কি নয়? আমি বললাম,
-আচ্ছা। যা। বাদ দিলাম। ওই টপিক বাদ। তুই তো কবিতা টবিতা লিখিস। দেখি আমাকে কাব্যিক ধরনের কিছু বলতো? ইরিনাকে প্রপোজ করবো। সঙ্গে সঙ্গে আবিদের চেহারা পাল্টে গেল। আমি বললাম,
-কার রাতে বলেছিস না ওকে মনে ধরেছে কি না! আসলেই ওকে মনে ধরেছে আমার৷ এখন ওকে প্রপোজ করবো ভাবছি৷ ইরিনা হাসি দিল। যেন সে চট করেই ব্যাপারটা বুঝে গেল। সে একদম আমার গায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। যেন সেও রাজি৷ আমি বললাম,
-ইরিনার ইচ্ছে তেমন কিছু বলে ওকে প্রপোজ করি। তা না হলে সে রাজি হবে না। বল না কিছু। ওকে রাজি করাতেই হবে। যে করেই হোক। আমি যে অভিনয় করছি বেচারা তা বুঝতেই পারল না৷ কেমন অসহায়, মলিন দৃষ্টিতে তাকালো। তার ভেতর কী চলছে তা আমি বেশ ভালোই জানি। যথেষ্ট ভালো জানি। তার অনুভূতি আমি বুঝতে পারি৷ আবিদ কেমন ধরে আসা গলায় বলল,
-কী বলব আমি৷ তেমন কিছু তো মাথায় আসছে না এখন৷ তুই তো জানিস! সব সময় সব কিছু হয় না৷
আমি বললাম,
-আজ হবে। আজ সব হবে৷ এখানে আয়৷ হাঁটু ভেঙ্গে বোস এখানে। এই বলে আমি ওকে জোর করে বসালাম। ও অবাক হয়ে বলল,
-আমাকে কেন?
-তুই এখন আমার হয়ে প্রপোজ করবি। তোর পর আমি ওকে প্রপোজ করবো৷ তুই যা যা বলবি সে সব ওকে বলব। আগে তুই একবার করে দেখাবি। আমি মাথা নেড়ে বলল,
-আমি পারবো না রে! ওর এই অবস্থা দেখে বেশ মজা পেলাম। কঠিন স্বরে বললাম,
-বেশি কথা বলিস না৷ যা বলছি কর। তুই না আমার প্রাণের বন্ধু৷ আমার জন্যে বুঝি এতোটুকুও করতে পারবি না?
ও কিছু বলল না আর৷ হাঁটু ভেঙ্গে বসলো ইরিনার সামনে। ইরিনা তার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি আবিদের পেছনে৷ সে তাকিয়ে আছে ইরিনার চোখ বরাবর। চোখে চোখে যেন কথা হচ্ছে তাদের৷ আমি দু পাঁ পিছিয়ে এলাম। আবিদ বলল,
-ইরিনা, কখনও কি তোমার এমন মনে হয় যে তোমার বুকে বাঁ পাশটা অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে। ধপ ধপ শব্দটা কি নিজের কানে শুনতে পাও? কখনো কী এমন মনে হয়েছে যে একটা মানুষকে দেখার পর, কেবল দেখার পর তোমার ভেতর ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। গায়ে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে? কিংবা কাউকে দেখে তোমার মনে হয়েছে আজকের দিনটা অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর, এই কড়া রোদটাও যেন বেশ মায়া বয়ে বেড়ায়…
আমি আরো দু পা পিছিয়ে এলাম। ধীরে ধীরে আবিদের কণ্ঠ দূরে যেতে থাকল। আমি অনেকটা পেছনে চলে এলাম নিশ্চুপে। কিছু সময় একান্ত নিজেদের হয়৷ নিজেদের হওয়া উচিৎ। তৃতীয় পক্ষ যত আপনই হোক, তার অবস্থান সেখানে না হলেই যেন ভালো। ওরা থাকুক ওখানে। আবিদ বোকাটা গোপন কথা গুলো বলুন আমার হয়ে। কিন্তু যখন দেখবে সবই একটা প্ল্যান ছিল, তাকে দিয়ে প্রপোজ করানোর প্ল্যান, যখন খুশিতে ইরিনা সত্যিই ওকে জড়িয়ে ধরবে তখন ওই বোকাটার চেহারা কেমন হবে? চোখে কি জল জমবে? গায়ের পশম কি দাঁড়িয়ে যাবে অনুভূতির চরম শিহরণে? হয়তো তাই! আমি চাই আবিদ বোকাটা চালাক হোক। ইরিনার মতো কেউ একজনের খুব প্রয়োজন তার৷ খুব প্রয়োজন৷ ওদের পেছন ফেলে আমি চলে এলাম অনেকটা পথ৷
হঠাৎই দেখলাম মিহিন দৌড়ে দৌড়ে আসছে। আমি খানিকটা অবাক হলাম। আমাকে দেখতেই ওর দৌড়ানোটা বন্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার মনে হলো চারপাশটা যেন ভীষণ স্তব্ধ হয়ে আছে। কেবল বুকের ধপ ধপ শব্দটা ছাড়া যেন আর কোনো শব্দই হচ্ছে না। দেহের ভেতর কী অদ্ভুত এক আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। আমি ঘোর ভেঙ্গে এগিয়ে গেলাম। মিহিন দ্রুত হেঁটে এলো। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। সোজা হাঁটতে থাকলাম। মিহিন পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি আড় চোখে তাকালাম তার দিকে। সে ভেজা অথচ কঠিন স্বরে বলল,
-তুই নাকি ইরিনাকে প্রপোজ করতে যাচ্ছিস? আমার ভ্রু কুচকে এলো। বললাম,
-তোকে বলল কে?
-যে-ই বলুক আগে বল কথাটা সত্য কী না।
-তোকে উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি। মিহিন আমাকে মৃদু জোরে ধাক্কা দিলো একটা। বলল,
-তুই উত্তর দিবি৷ অবশ্যই উত্তর দিবি৷ তোকে উত্তর দিতেই হবে৷
-চিল্লাবি না৷ আমি যাকে ইচ্ছে তাকে প্রপোজ করবো তাতে তোর কী? মিহিন এগিয়ে এলো আমার দিকে। বলল,
-আমার অনেক কিছু। তুই অন্য কাউকে প্রপোজ করতে পারবি না৷ কোনো মতেই না৷
-কেন পারবো না?
-কারণ তুই শুধু আমার। শুধু আমার।
-মানে? কী বলছিস মাথা ঠিক আছে তোর?
-তোর মাথা ঠিক নেই। তাই ইরিনাকে প্রপোজ করতে যাচ্ছিস।
-হ্যাঁ। আমার মাথা ঠিক নেই৷ আমি ইরিনাকে প্রপোজ করবো৷
তাতে তোর কী? বল তোর কী? আমি এখনই ইরিনাকে প্রপোজ করবো৷ মিহিন আমার শার্টের কলার চেপে ধরল। নিজের মুখটা আমার মুখের একদম কাছে নিয়ে এলো সে। তার চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে। নাকের ডগায় অল্প অল্প রাগ জমা হয়ে আছে৷ রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। এইযে আমার কলার চেপে ধরে আছে সে, তার সেই হাতটাও কাঁপছে৷ সে ভারী স্বরে বলল,
-খুন করবো তোকে আমি। আমি কেবল ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকলাম। কিছু বলতে পারলাম না৷ আমার গা যেন কেঁপে উঠল। এই মেয়েটার মাঝে ভিন্ন কিছু আছে৷ যা প্রতিবারই আমায় ভীষণ রকম দূর্বল করে দেয়৷ তার উপর রাগ যেন ধরে রাখতেই পারি না৷ মিহিন বলল,
-তুই যদি কাউকে প্রপোজ করিস তবে সেটা আমার মৃত্যুর পর করতে পারবি৷ এর আগে কোনো ভাবেই তুই এই কাজটা করতে পারবি না৷ না! মৃত্যুর পরও পারবি না৷ তুই কারো হবি না কখনও। শুধু আর হয়ে থাকবি আজীবন।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল৷ কী মায়া সেই চোখ দুটোতে৷ আমি আজো যেন হারিয়ে যাই। স্রষ্টা কেন এই মেয়ের চোখে এতো মায়া দিলেন। এতো প্রেম দিলেন। আমি বললাম,
-এমন ভাবে বলছিস যেন আমাকে তুই আগ থেকেই কিনে রেখেছিস৷ তুই যা বলবি আমাকে তাই করতে হবে!
-তাই করতে হবে। তুই শুধু আমারই। শুধু আমার। তুই জানিস না কতোটা ভালোবাসি তোকে আমি।
-তাহলে এমন করিস কেন? কেন এমন ভুল বুঝিস বারবার ? আমাকে বুঝতে চাস না কেন? সে গাল ফুলিয়ে বলল,
-আর হবে না রে। আর কখনই এমন করবো না। তোর উপর খুব প্রেশার দিয়ে ফেললাম তাই না!
আমি মাথা নাড়লাম কেবল। চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে আমার চোখের জল গুলো মুছে দিল। তারপর চট করেই আমার ঠোঁটে চুমু খেল। কী গভীর সেই চুম্বন। অসাধারণ সেই শিরশিরে অনুভূতি। যেন কতো বছর পর তা অনুভব করলাম। চুমু খেয়ে চট করেই সে আমায় জড়িয়ে ধরল। বলল,
-এই কদিন তোর ঠোঁট দুটো ভীষণ মিস করেছি রে।
আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাসলাম কেবল। চোখে জল রেখে হাসা যাকে বলে। অদ্ভুত এক আনন্দ যেন আমাদের ঘিরে ফেলল। চারদিকে যেন ভালোবাসার গন্ধে ভরে গেল। প্রেম প্রেম একটা অনুভূতি হতে থাকল আমার। আচ্ছা ভালোবাসার কি কোনো ঘ্রাণ হয়? হয়? নাকি আমার মনে হচ্ছে কেবল?