মায়াবতীর নিমন্ত্রনে

মায়াবতীর নিমন্ত্রনে

তোদের বাবা মনে হয় আরেকটা বিয়ে করেছে মা কথাটা বলেই আমাদের দিকে তাকালো প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। আমি কিছু না বলে আগের মতো পা দুলাতে লাগলাম বিছানায় বসে। আর আপা হাই তুলতে তুলতে বলল, “এটা তো খুশির সংবাদ। কয়জন পারে নিজের বাবা মায়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে, বলো? আমরা তো সৌভাগ্যবতী।” আপার কথা শুনে মায়ের প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মতো।

তিনি চোখজোড়া এত বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি কিছুক্ষণের মধ্যই মূর্ছা যাবেন। আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মা যে ভীষন আশাহত হয়েছেন সেটা উনার মুখেই ফুঁটে উঠেছে। মা হরহামেশাই বাবাকে নিয়ে এরকম অমূলক সন্দেহ প্রকাশ করেন। এজন্য আমরা কেউ এসবে কান দেই না। মায়ের এসব কথায় পাত্তা না দেওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। মা পূর্বেও এরকম অনেক কথা বলেছেন, যেগুলো পরে ভুল প্রমানিত হয়েছিল।

বাবা চোখ মুখ কুঁচকে খাবার টেবিলে বসে আছে। বাবার ব্যাপারটা একটু বলি.. বাবা বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর। কিন্তু উনার মধ্যে রসকষের ছিটাফোঁটাও নাই। বাবা যদি হাসেও, সেটা দেখায় ভেংচি কাটার মতো। উনি সবসময়ই সবকিছুতেই বিরক্তি দেখায়। বাবা মনে হয় এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেও মহা বিরক্ত। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি বাবাকে অন্য কোনো গ্রহে ট্রান্সফার করে দিতাম। এ মুহূর্তে বাবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা উনার কাছে খুবই বিরক্তিকর কাজ।

বাবা গম্ভীর মুখে আপাকে বললেন, “মিলু, তোমার কি খবর?” আপা তার অভ্যাস মতো হাই তুলতে তুলতে বলল, “খবর তো অনেকই আছে, আপনি কি খবর চান?” আপার কথা শুনে বাবা কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে থাকলেন। তারপর চোখমুখ শক্ত করে কি যেন বললেন বিরবির করে। আমি যদিও শুনিনি তবুও মনে হলো “অশিক্ষিত মেয়েলোক” জাতীয় কিছু একটা বললেন। বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর সুন্দর শব্দ থাকলেও বাবার পছন্দের শব্দ হলো ‘অশিক্ষিত’! বাবা নিজেকে বাদে আর সবাইকে ‘অশিক্ষিত’ ভাবেন।

বাবার চোখমুখ দেখে মা খুবই ভয়ের মধ্য আছেন। আড়ালে যত কথাই বলুক না কেন, বাবার সামনে মা কিছুই বলতে পারেন না। মা কারো উপরই রাগ দেখাতে পারে না। এমনকি কারিনা বুয়া রান্না রেখে সিরিয়াল দেখলেও কিছু বলতে পারে না। আমাদের কারিনা বুয়া আবার ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর মহা ভক্ত। আমাদের বুয়া মনে হয় সিরিয়ালগুলোর পরিচালকদের থেকেও বেশি টেনশনে থাকে ওগুলি নিয়ে। বুয়ার দূর্ভাগ্য যে, পরিচালকরা এখনো এ ব্যাপারে জানে না। জানলে মনে হয় খুশি হয়ে বুয়াকেও একটা পার্ট দিতো।

এ মুহূর্তে মিলু আপা আরাম করে বসে কলা খাচ্ছে। কিন্তু মা আর কারিনা বুয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপার হাতে কলার বদলে সাপ বা এরকম জাতীয় ভয়ংকর কোনো প্রানী আছে। কারিনা বুয়া ফিসফিস করে মাকে বলল, “আফার মতিগতি ভালা লাগতিচে না। জোড়-কলা খাওন তো ঠিক না।” মা যদিও জানে এটা, তবুও বুয়ার কথা শুনে ভয়ে কুঁকরে গেল। এখন যদি মায়ের সামনে কেউ একটা মুরগি এনেও ধরে, তাহলেও মা মনে হয় সেটাকে ঈগল ভেবে মূর্ছা যাবে।

মিলু আপার কাজকর্ম সবসময়ই অদ্ভূত। আপার প্রিয় কাজ হলো ‘হাই তোলা’। অনার্স শেষ করে এখন মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। মাঝে মাঝে পাত্রপক্ষ আসে আপাকে দেখতে, কিন্তু প্রতিবারই আপা কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে ব্যাপারটা দেখাদেখিতেই আটকে রাখে। সমাজে যত কুসংস্কার আছে, আপা সবগুলোর বিরুদ্ধে। বেগম রোকেয়া যদি না জন্মাতো, তাহলে মনে হয় আপা-ই উনার ভূমিকা পালন করত। আপার একটা গোপন ব্যাপার আছে, সেটা হয়তো কোনো এক মুহূর্তে প্রকাশিত হবে।

মোটামুটি সবারই পরিচিতি দেওয়া শেষ। এ গল্পে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অবহেলিত চরিত্র আমি। আমি নীলু। পড়ি দ্বাদশ শ্রেনীতে। কারো সাথেও নেই পাঁচেও নেই। চিরায়িত নিয়মে আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। এরই মধ্য এন্ট্রি নিলো আরো একজন নতুন চরিত্র কলেজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরোতেই চোখে পরল এক রূপবান কিন্তু অদ্ভূত যুবককে। অদ্ভূত বলার কারনটা ব্যাখ্যা করছি..

উনার চোখে ছিলো মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা। পরনে পান্জাবী, পান্জাবীর রং নীল। পান্জাবীতে কোনো পকেট ছিলো না (কাছে যাওয়ার পর দেখেছিলাম)। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, উনি খালি পায়ে দাড়িয়ে ছিলেন (পরে জেনেছি মাঝরাস্তায় জুতা ছিড়ে গিয়েছিল) উনাকে দেখে আমার মনে পরল হুমায়ূন স্যারের উপন্যাসের দুই চরিত্র ‘হিমু’ আর ‘শুভ্র’-র কথা। উনি না ‘হিমু’, না ‘শুভ্র’ ;দুই চরিত্রের সংমিশ্রন। অপরিচিত হওয়ায় কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলাম। পরে বাসায় ফিরে দেখি উনি বসে আছে আমাদের ড্রয়িংরুমে। আপার ঘরে এক জরুরী মিটিং বসেছে। মিটিং এর বিষয়বস্তু হলো সেই যুবক। মায়ের থেকে জানলাম উনার নাম শুভ্র; পেশায় লেকচারার। বাবা উনাকে বলেছে এখানে আসতে। কিছুদিন পর উনার বাবা মা আসবে।

কারিনা বুয়া গম্ভীর মুখে মাকে বলল, “বাড়িতে তিনডা জোয়ান সুন্দর মাইয়ার মদ্দে এই জোয়ান বেটারে আনাডা কি ঠিক অইলো আপা হাই তুলে চুপ করে রইল। আর মা কপাল কুঁচকে বলল, “মেয়ে তো দুইটা, মিলু আর নীলু।” কারিনা বুয়া অভিমানী কন্ঠে বলল, “আমারে কারো চোক্কেই পরে না।” [দুইদিন যাওয়ার পর দেখা গেল, কারিনা বুয়া নিজেই ঠোটে লাল লিপস্টিক মেখে ওই ‘জোয়ান বেটার’ আশেপাশে ঘুরাঘুরি শুরু করল।] এর মধ্যে বেশ কয়েকবার শুভ্রর সাথে কথা হয়েছে। প্রতিবারই উনি আমাকে অবাক করেছেন। শেষ যে বার কথা হলো উনি আমাকে বললেন, “নীলু, তুমি কি জানো আমি এখানে কেনো এসেছি?”

আমি বললাম, “না।” তখন উনি বললেন, “আমার এখানে আসার কারন হলো মিলুকে বিয়ে করা। যদিও আমি জানি বিয়েটা হবে না।” উনার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম “কেনো?” উনি শান্ত ভাবে আমাকে বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, “তোমার আপু মারাত্মক সুন্দরী। ওর নিশ্চয়ই পছন্দের কেউ আছে। আর তার সাথেই মিলু পালিয়ে যাবে উনার কথা শুনে আমি বজ্রাহতের মতো দাড়িয়ে ছিলাম। কারন উনার আশংকা সত্যি।

আপা সত্যিই খুব সুন্দরী, সে তুলনায় আমি মোটামুটি সুন্দরী। আপার পছন্দের কেউ একজন আছে। কিন্তু তিনি বেকার হওয়ায় আপা কিছু বলতেও পারছে না বাসায়। এরপর ঘটে গেল একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আপা পালিয়ে গেল বাসা থেকে। রাতেই ব্যাপারটা টের পেয়েছিলাম আমি আপাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে। আমি আর আপা তো এক রুমেই থাকি। আপার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে মা শয্যা নিয়েছে। আর বাবা দাঁত কিরমির করে বিরবির করছে। মা যতটা না কষ্ট পেয়েছে আপা চলে যাওয়ায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে বাবার চোখমুখ দেখে। কারিনা বুয়া মার মাথায় পানি ঢালছে। এরমধ্যেই বাবা ঘোষনা দিলো দুদিন পর আমার বিয়ে শুভ্রর সাথে। শুভ্রর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম না উনি খুশি হয়েছেন কি না।

আমার আর শুভ্রর বিয়ের পক্ষে বিপক্ষে অনেক তর্কাতর্কি হওয়ার পর বিয়েটা হলো। বাসর রাতে ও যখন আমার হাত ধরল আমি তখন ভয়ে কাঁপছিলাম। কাজল পরা চোখে লজ্জামাখা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই বলে উঠেছিল, “মায়াবতীর কাজল মাখা চোখের প্রেমে পরে গেলাম।” আমি ভয়টাকে একপাশে সরিয়ে রেখে মৃদু কন্ঠে বললাম, “মায়া কাটানোর ইচ্ছা আছে কি?” ও মাথা নেড়ে বলল, “না।” আমি ওকে সেদিন বলেছিলাম, “তুমি নাকি বুঝেছিলে আপার সাথে তোমার বিয়ে হবে না, তবুও কেন এসেছিলে বাসায়??” শুভ্র বলেছিল, “আমি এসেছি মায়াবতীর নিমন্ত্রনে”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত