সাদা জবা

সাদা জবা

-সাদা জবা দেখছেন কখনো?
-জবা সাদা হয় নাকি?
-হয় তো!
-পাগল নাকি তুমি? জবা হয় লাল, রক্তের মত। বেলী ফুল হয় সাদা। পিউ এবার একটু বিরক্ত হলো আমার কথা শুনে।বলল,

-সাদাও হয়!
-তাই নাকি?দেখিনি তো।
-সেটা বলেন যে দেখেন নি।

আমি কিছু বললাম না কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম।রিকশায় চুপ চাপ বসে থাকা বেশ কষ্টের,অন্য কারো ক্ষেত্রে কি রকম হয় জানি না কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এটাতে বেশ কষ্ট হয়।এমনিতেই এই ঢাকা শহরে জ্যামের কারণে রিকশা চলে আস্তে আস্তে সেখানে কথা না বলে শুধু শুধু রিকশায় বসে থাকা টাফ,খুব টাফ! পিউ অবশ্য ব্যপার টা জানতো,তাই ও নিজে থেকে বলা শুরু করলো,

-আমার কি ইচ্ছা জানেন?
-কি?
-কেউ আমাকে সাদা জবা ফুল দিয়ে তার ভালবাসার কথা বলুক।
-এটা খুব কঠিন।
-কেন? জবা ফুল পাওয়া কঠিন নয় তো!
-ফুল পাওয়া না।সচারচর কেউ প্রপোজ করার ক্ষেত্রে লাল গোলাপ ইউজ করবে।আমিও এটাই করবো।সাদা জবার কথা মাথাতেও আসবেনা। পিউ এবার একটু হতাশ হয়ে বলল,

-হুম,এজন্যই ইচ্ছা।আর বেশির ভাগ ইচ্ছা আমাদের পূরণ হয়না।
-তবে তুমি যার কাছে চাও তাকে আগেই জানাতে পারো সাদা জবা তোমার পছন্দ তাহলে কিছু একটা হতে পারে।
-এটাতে মজা নাই।
-আচ্ছা,যে কেউ সাদা জবা দিলেই রাজী হবা?
-হুম,
-আমি দিলেও রাজী হবা!
-আপনি তো জেনে গেছেন আর তাছাড়া আপনি দিবেন ও না!
-তা দিবনা!

আবার কিছুক্ষন দুজন চুপ করে রইলাম! পিউকে আমিও ফুল দিতে পারি, এটাতে না দেওয়ার কি আছে? এত সুন্দর মেয়ে চান্স নেওয়াই যায়। মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে নাকি অপছন্দ করে এত বছরেও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে ভাল হতো, এটা অজানার কারণেই হয়ত আমিও ওকে তেমন পছিন্দ করিনা অথবা করি! এই ব্যপার টা আমাকে প্রতিবার কনফিউজ করেছে। একবার মনে হয়েছে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে আমিও করি৷ আবার অন্য সময় মনে হয়েছে কেউ কাওকে পছন্দ করিনা। সেখানে ভালবাসা দূরের ব্যপার।

আমরা কোথায় যাচ্ছি এখনো জানিনা। উদ্দেশ্য বিহীন যাত্রায় তেমন ফিল থাকেনা। আরেকবার পিউকে জিজ্ঞেস করবো কিনা বুঝতে পারছি না৷ আগেও দুবার জিজ্ঞেস করেছি উত্তর পাইনি।সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খাচ্ছিলাম,তখনি পিউ এর দেখা। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্য সম্পর্ক বেশ ভাল৷ যাতায়াত হার হামেশাই হয় এক বাসা থেকে আরেক বাসায়। সকাল সকাল পিউকে দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম।
পিউ এসে আমাকে বলল,

-নাহিদ ভাই আপনার কোন কাজ আছে আজ?
-না তেমন কিছু নেই।
-আমার একখানে একটু যেতে হবে,একা যেতে চাচ্ছি না।
-কোথায়?
-যেতে পারবেন?
-আচ্ছা,যাবো আমি।রেডি হয়ে এসো।

এটাই প্রথম বার নয়, পিউ এর প্রয়োজন হলে ওর সাথে সাথে মাঝে মাঝেই বের হতাম। তবে আগের সময় গুলোতে কোথায় যাচ্ছি এটা জানতাম। তবে শুধু যে ঘুরতেই বের হতাম এমন না, অনেক দিন ওকে ওর কলেজেও পৌছে দিয়েছি। এক্ষেত্রে ওর মা রিকুয়েস্ট করতো। ওনার সুন্দরী মেয়েকে একা ছাড়তে চাইতেন না।এক্ষেত্রে আমি বেশ বিশ্বাস যোগ্য ছিলাম। এসব চিন্তার মাঝে পিউ বলে উঠলো,

-আমার খুব দ্রুত বিয়ে হয়ে যাবে।
-তাই নাকি?
-হুম,
-কিভাবে বুঝলে?
-মনে হলো। আর এজন্যই আজ বেড়িয়েছি!
-মানে?
– এই শহর টা ঘুরতে বেড়িয়েছি। বিয়ের পর এভাবে ঘোরা হবেনা।
-কেন?
-হ্যাজবেন্ড এভাবে ঘুরতে দিবেনা।
-বিয়ে কি ঠিক হইছে?
-না, হতে কতক্ষন।আমাকে কোন ছেলেই অপছন্দ করবেনা।
-তা করবেনা!

আমাদের রিকশা গিয়ে থামলো নিলক্ষেত এর সামনে। পিউ সেখান থেকে কিছু বই কিনলো। তারপর আবার রিকশা করে গেলাম টিএসসিতে সেখান থেকে শহীদ মিনার পুরান ঢাকা এসব ঘুরে আমরা বাসায় ফিরলাম রাতে। হুট করে এত ঘোরাঘুরি কারণ আমি মোটেও বুঝতে পারলাম না।হয়ত পিউ এর মন খারাপ,হয়ত ছেলে দেখতে আসবে। বাট এটুকুতে এত মন খারাপের কি আছে। ও কাওকে পছন্দ করে কিনা? করলে হয়ত বলতো আমাকে! এত সুন্দরী মেয়ে,রিলেশন থাকলে থাকতেও পারে। কি ভেবে যেন একবার জিজ্ঞেস করলাম,

-পিউ তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে এজন্য মন খারাপ?
-না আসলে!
-মানে কোন পছন্দ আছে নাকি?
-জানিনা,
-এটা কেমন কথা।এসবের উত্তর হ্যাঁ বা না তে হয়।
-অনেক সময় অনেক কিছু পরে জানা যায়। পছন্দের ব্যপার টাও এমন। বিয়ের সময় জানবো হয়ত আমি অন্য কাওকে পছন্দ করি। তখন মন খারাপ হবে কিন্তু দেরী হতে যাবে।

-কঠিন ব্যপার তো।
-একটু কঠিন ই।

এর পর আমি আর এ ব্যপার নিয়ে কথা বাড়াইনি। সে রাতে একটা খুশির খবর ও এলো,একটা বেসরকারী কোম্পানিতে আমার জব হয়েছে৷ বেতন অল্প অবশ্য তবে আমি খুশি ছিলাম,জবের জন্য মোটামুটি প্রচুর ঘুরতে হয়েছে। পিউ এই খবর টা জানলো পরের দিন। অভিনন্দন জানিয়ে ট্রিট চাইলো আমার কাছে। আমিও রাজী হলাম বললাম দুই একদিনের মধ্যই দিবো। তবে দুই একদিন এর মধ্য আমার পিউ এর সাথে দেখাই হলোনা।ফোনেও কেন যেন কথা হলো না। সেবার প্রায় দুই সপ্তাহ পর পিউ এর সাথে দেখা আমার, এত দিন দেখা না হওয়ার কারণ আমি নতুন জব টা যেখানে পেয়েছি সেখানে রাত পর্যন্ত ডিউটি থাকে তাই দিনে যদি পিউ আসেও আমাদের বাসায় দেখা হওয়ার চান্স নেই। দেখা হওয়ার পর অনেক চমক ছিল আমার জন্য। পিউ মুখ খুলেই বলল,

-আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে!
-কংগ্রেটস!
-ধন্যবাদ, পিউ কছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, আপনার কি মন খারাপ হয়েছে?
-নাহ মন খারাপ কেন হবে! ভাল লাগছে!
-আচ্ছা,,

কিন্তু আমার মন খারাপ হলো রাত্রে ঘুমাতে গিয়ে,প্রেম ভালবাসার জন্য না একটা মায়া কাজ করতো। মনে হলো আশে পাশের যে কোন মেয়ের বিয়ে হলেও আমার এমনই খারাপ লাগতো।যে মেয়েটা ছোট থেকে আমার সামনে ছিল হুট করে চলে যাবে খারাপ লাগা স্বাভাবিক। আর মেয়েটা এত দেখে রেখেছি, ওর উচিত ছিল আমাকে বিয়ে করা। এসব প্রচুর উদ্ভট চিন্তা সারারাত ধরে করেছি৷ শেষ রাত্রে মাথা খালি করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে পিউ এর পছন্দের কিছু ওর বিয়েতে দিবো। অনেক ভেবে চিনতে জবা ফুলের কথা মনে পড়লো। সাদা জবা।

পিউ পরের দিনও আমাদের বাসায় এলো। সেদিন বাসাতেই ছিলাম। বিয়ের কথাই ও বলতে লাগলো। কেন যেন আমার বিরক্ত লাগলো। তবে মন খারাপ হলোনা, পিউ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো এসব শুনে আমার মন খারাপ কিনা। আমি হাসি মুখেই না বললাম। সাদা জবা খুঁযে পেতে আমার কষ্টই হলো। তবে শেষ মেস এক ফ্রেন্ড ম্যানেজ করে দিলো। তবে সেটা পেতে দেরী হলো। পিউ এর বিয়ের দিন সকালে অনেক গুলো সাদা জবা ফুল আমার হাতে আসলো। একটু মরা মরা ফুল গুলো নিয়ে হাজির হলাম পিউদের বাসাতে।ওদের বাসায় প্রায় উৎসব লেগে গেছে। এক মাত্র মেয়ের বিয়ে বলেই হয়ত বা। পিউ এর মা আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন,

-কই থাকিস তুই?এত কাজ একটু হেল্প করলেও তো পারিস!
-পিউ কোথায়?
-ওর রুমে!

পিউ এর রুমে আগেও অনেক বার গেছি, এবারো আগের মতই গেলাম! পিউ সাজগোজ করছিলো। আমার হাতে সাদা জবা দেখতে পেয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-ফুল গুলো আমার জন্য?
-হুম,
-দেরী হয়ে গেল না?
-মানে?
-মানে আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে আমার!
-কিসের আফসোস?
-এই যে আমার বিয়ে হয়ে গেলে কষ্ট পাবেন অনেক।
-আমি কেন কষ্ট পাবো?

-এমনিই পাবেন।কাল কেই যদি ফুল গুলো দিতেন তবে আমি রাজী হয়ে যেতাম।
-কিসে রাজী হতে?
-আপনার সাথে পালিয়ে যেতে।
-আজ বললে?
-ভেবে দেখবো।
-চলো যাই তাহলে?
-নাহ,বললাম না দেরী হয়ে গেছে।

হুট করে আমি কেন ওকে প্রস্তাব করে বসলাম নিজেও জানিনা। মনে হচ্ছিলো কোন স্বপ্নের মধ্য আছি। না শব্দটা কানে আসতেই স্বপ্ন টা ভেঙে গেলো। আমি ফুল গুলো টেবিলের উপর রেখে বের হলাম। পিউ আবার মেকআপ করা শুরু করলো। পিউ দের বাসা থেকে বের হয়ে বাসায় গেলাম না। বাসাতে কেউ নেই,সবাই পিউদের বাসায়। বাসার সামনের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। এবার আমার সত্যি আফসোস হওয়া শুরু হলো। এক মুহুর্তের জন্য মনেই হলো আমি পিউকে ভালবাসি। আগে থেকেই হয়ত বা৷ আমার আগে হয়ত ওই বুঝতে পেরেছিলো, হয়ত আমিও পেরেছিলাম, প্রকাশ করিনি। সব কিছু প্রকাশ করতে নেই এজন্যই৷ তবে ভাল লাগছে পিউ এর ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি শুধু ওই ওর কথা রাখেনি৷

হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো, চারদিকে লোকজন ছোটাছুটি শুরু করলো বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য! একবার মনে হলো কেউ যেন এদিকে দৌড়ে আসছে। লাল শাড়ি পড়ে, সেটা যেন রক্ত জবার মতো লাল।আমি বেশিক্ষন তাকালাম না সেদিকে। এটা বাস্তব না ভ্রম আমার জানার ইচ্ছা নেই! পিউ এর সাথে আমার বিয়ে হলে নিশ্চয় ওকে সাদা শাড়ি পড়তে বলতাম। সাদা শাড়িতে পিউকে একদম জবা ফুলের মতই লাগতো! বৃষ্টি বাড়ছে যেন,আমি আকাশের দিকে তাকালাম।দিনের আকাশ বেশ একা তবে আকাশের মত একা হওয়া খারাপ না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত