সাদাসিধে ছেলেটার গল্প

সাদাসিধে ছেলেটার গল্প

নূরী চুলার ওপর ভাত বসিয়ে তরকারি কুটতে গিয়ে দেখলো ঘরে আলু নেই। তরকারিতে আলু আকবরের খুব প্রিয়। অনেক সময় সে শুধু আলু দিয়েই খেয়ে নেয়। নূরী ফোনটা বের করে আকবরকে কল দিলো।

– হ্যালো।
– কোথায় তুমি?
– এই তো ঘরের সামনে চায়ের দোকানে।
– বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত আছো?
– হ্যাঁ, সবাই মিলে খা খাচ্ছি।
– এই শুনো না, তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।

কষ্ট শব্দটা শুনে মায়া মায়া স্বরে আকবর বলল, “তুমি আমাকে কষ্ট দিতে চাও?” নূরী কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বলল, “আরে সেই কষ্ট না, একটা কাজ করতে হবে।”

– ও আচ্ছা। তাই বলো। কি কাজ?
– ঘরে আলু নাই। গতকাল বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি দুটো আলু নিয়ে আসো।
– আচ্ছা আমি চা শেষ করে তারপর আসছি।
– ঠিক আছে।

নূরী ফোনটা কেটে দিলো। কিছুক্ষণ পর আকবর আলু নিয়ে হাজির হলো। ঠিক দুটোই আলু এনেছে। যা দেখে নূরীর মেজাজ অত্যন্ত বিগড়ে গেল।

– তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি কখনোই হবে না?
– কেন? আমি আবার কি করলাম? কোমড়ে হাত দিয়ে কটমট দৃষ্টিতে নূরী বলল, “দুটো আলু কেন এনেছ?”
– তুমিই তো বলেছিলে দুটো আলু আনতে।

নূরী রাগন্বিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর হনহনিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আর বিড়বিড় করে নানান কথা বলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আকবর রান্নাঘরের সামনে এলো। শান্ত স্বরে বলল, “আচ্ছা শুনো, রাগ করো না। বলো কয়টা আলু আনবো। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসবো।” রাগন্বিত স্বরে নূরী জবাব দিলো, “এখান থেকে যাও। আমাকে একটু শান্তিতে কাজ করতে দাও।” আকবর চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে এলো। সোফায় বসে ভাবতে লাগল তার দোষটা কোথায়? মা বলেছে নূরীকে সবসময় হাসিখুশি রাখতে। কিন্তু এখন নূরী রেগে আছে। যার কারণটা আকবর বুঝতে পারছে না। তাই সে তার বড় বোন নিশিকে ফোন করলো। সব শুনার পর নিশি হাসি দিয়ে বলল, “আরে বোকা। দুটা মানে কমপক্ষে এক কেজি তো আনবি।” আকবর নিচে গিয়ে এক কেজি আলু নিয়ে নূরীর কাছে এলো।

– আমি কি বলেছি আলু আনতে?
– রাগ করো না। এই দেখো পুরো এক কেজি এনেছি। কিছুটা শান্ত স্বরে নূরী বলল, “ঠিক আছে। রাখো ওখানে।”

আকবর- নূরী; মাসখানেক হলো পারিবারিক তাদের বিয়ে হয়েছে। আকবর যে কতটা সহজ সরল তা তো বুঝালেনই। যদিও আকবরের ব্যাপারে নিশি সবই বলেছিল নূরীকে। কিন্তু নূরী তখন ভেবেছিল ভাই বিধায় এমন বলেছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝলো আকবর সত্যিই খুব সাদাসিধে মানুষ। যা বর্তমানে হয় না। বিয়ের পর থেকে আকবর তাদের বাড়ির তিন তলায় থাকে। আর তার বাবা-মা নিচ তলায় ও নিশি থাকে তার শ্বশুরবাড়ি। আকবর তার মনের সব কথা মা ও বোনকে বলে। সমাধানও তাদের থেকে পায়। তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার মা-বোন। তবে এই অংশে এখন নূরীও যোগ হয়েছে। তবে বোঝাপড়াটা এখনো ঠিকমতো হয়ে উঠেনি।

আজ নূরীর বাল্যকালের বান্ধবীর বিয়ে। নূরী তার স্বামীকে নিয়ে দেখানে উপস্থিত হয়েছে। তার অনেক বন্ধুবান্ধবও এসেছে। আকবরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বান্ধবীরা মিলে বেশ গল্প গুজব করছে। আকবর সহ অন্যান্য বান্ধবীদেরও স্বামী আছে। আড্ডা বেশ জমেই উঠেছে। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলা শেষে সবাই মিলে খেতে বসলো। খাওয়া শেষে একটু বসলো। তখন হঠাৎ নূরীর মাথা ব্যাথা শুরু করলো।

– এই শুনো না, মাথাটা খুব ব্যাথা করছে। দুটা প্যারাসিটামল নিয়ে আসো না!
– আচ্ছা তুমি বোসো। আমি আনছি।

আকবর ফার্মেসির দোকান খুঁজতে বের হলো। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলেও আকবর এলো না। নূরীর ফোনও রিসিভ করছে না। নূরী তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে প্যারাসিটামল পেয়ে খেয়ে নিলো। ঘণ্টাখানেক পর আকবর হাজির হলো। হাতে এক ব্যাগ প্যারাসিটামল। যা দেখে নূরী ও আশেপাশের সবাই বিস্মিত হয়ে আছে। নূরী বুঝলো যে আকবর তার নিত্যদিনের মতো কোনো বোকামি করেছে। নূরী কিছু বলার আগেই তার এক বান্ধবী আকবরকে প্রশ্ন করলো এতগুলো ঔষধ আনলো কেন। জবাবে আকবর বলল যে নূরী দুটো আনতে বলেছে। তাই এক এক কেজি এনেছে। কেননা গতবার দুটো আলু আনাতে নূরী রাগ করেছিল। তাই এবার এক কেজি এনেছে। এই কথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। নূরী বেশ লজ্জা পেল। রাগ করে হনহনিয়ে হেঁটে গেল। আকবরও পিছু পিছু গেল।

আকবরের নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে নূরীর জীবন কাটতে লাগল। একদিন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে নূরীর বাবা মাও এলো। নূরী তার বাবা মায়ের সাথে খুব একটা কথা বলছে না। অথচ আজ প্রায় মাসখানেক পর দেখা। নূরীর মা মোরশেদা বেগম বুঝলেন যে, মেয়ে কোনো ব্যাপারে রাগ করেছে। তাই সুযোগ পেয়ে একান্তে ধরলেন।

– কিরে মা! তুই কি কোনো ব্যাপারে আমাদের ওপর রাগ করেছিস?
– না, আমার কোনো রাগ নেই। আমাকে বিদায় করে তোমরাও বেঁচেছ। আমিও বেঁচেছি।
– এভাবে বলছিস কেন? মেয়ে বড় হলে বিয়ে তো দিতেই হবে। এটাই তো জগৎ সংসারের নিয়ম।
– তাই বলে এমন একটা কান্ডজ্ঞানহীন মানুষের সাথে? অর্থ সম্পদ-ই কি সব? ধনী বাবা একমাত্র ছেলে দেখে মেয়েটা দিয়ে দিলে। ছেলের ব্যাপারে কি একবারও যাচাই করেছ?

– কি বলছিস এসব? তোর বাবা তো সবকিছুই যাচাই করেছে। ছেলে শিক্ষিত, বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে, কোনো নেশা করে না, কোনো খারাপ অভ্যাস নেই।। আর কি চাই?
– কিছু না। কিছু না। আমি খুব ভালো আছি।

নূরী চলে গেল। মোরশেদা বেগম আর থামাতে পারলেন না। তবে এটা বুঝলেন যে মেয়ে শান্তিতে নেই। এতে তার মনটাও অশান্ত হয়ে উঠলো। ব্যাপারটা স্বামীকে বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শুরুতে এমন হয় বলে তিনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন।

দিনদিন আকবরের প্রতি নূরীর মেজাজ খিটখিটে হতে লাগল। আকবরের প্রতিটি কাজে নূরী অত্যন্ত রাগারাগি করে। ঘরের প্রতিটি কাজে নূরীকে সাহায্য করে আকবর। কেননা তার মা বলেছে নূরীকে সব কাজে সাহায্য করতে। কিন্তু যখনই আকবর কোনো কাজ করতে যায় তখনই তা উল্টো হয়ে যায়। এতে নূরী আরও রেগে যায়।
ডিনার শেষে নূরী থালাবাসন রাখতে রান্নাঘরে গেল। এসে দেখল মেঝেতে পানি। আকবর তা মুছার জন্য কাপড় খুঁজতেছে।

– পানি পড়লো কিভাবে?
– টেবিল গুছাতে গিয়ে জগে হাত লেগে পানি পড়ে গেছে।
– আমি কি তোমাকে বলেছি টেবিল গুছাতে?
– সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।
– এই বুঝি সাহায্য? কেন তুমি প্রতিনিয়ত আমাকে জ্বালাচ্ছ?

আকবর চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো। নূরী কাপড় এনে পানি মুছতে লাগল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কেন যে বাবা মা আমাকে এমন একটা আহাম্মকের সাথে বিয়ে দিলো! আমার জীবনটা শেষ!” চাঁদের আলো ঝিকিমিকি করছে। চারিদিকে এক মিষ্টি স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর পর মৃদু হাওয়া বইছে। এমন মনোরম এক পরিবেশেও নূরীর মন ভালো নেই। এতদিনের সংসারে নূরী এটা ভালোভাবেই বুঝেছে যে আকবরের সাথে তার বনিবনা হবে না। এভাবে জীবন কাটানো হবে একরোখা। যেখানে সে সুখ পাবে না। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই পথ খোলা আছে। তবে সেই পথে পা বাড়াতে গেলে বাবার সম্মানে আঘাত পড়বে। কিন্তু জীবনটা তো তার।

তাহলে কেন সে এই জীবন কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে রাখবে? তার বাবা মা একটা ভুল করেছে। তাই বলে আজীবন সেই তাকেই কেন ভুল বহন করতে হবে? অনেক ভেবেচিন্তে নূরী সিদ্ধান্ত নিলো সে এই বাধন ছেড়ে মুক্ত হবে। এভাবে চলা সম্ভব নয়। পরেরদিন সকালে আকবর অফিসে যাওয়ার পর নূরী তার পরিচিত এক উকিলের উদ্দেশ্যে বের হলো। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে এক পাশে বসে পড়লো। পথযাত্রীরা তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে এলো। হাসপাতালে আকবর-নূরী উভয়ের পরিবারই এসেছে। সবার মুখে হাসি। নূরী যে মা হতে চলেছে। নূরীর কেবিনে বসে আছে আকবর। টিপটিপ করে চোখ খুলে আকবরকে দেখতে পেল নূরী। কিছুটা বিরক্তিসূচক ভাব নিয়ে বলল, “ডাক্তার কোথায়?”

– ডাক্তার বলেছে তোমাকে বিশ্রামে থাকতে।
– কেন? কি হয়েছে আমার?

আকবর মুখমণ্ডলে লজ্জার আভা দেখা গেল। যা দেখে নূরীর বিরক্তি ভাব আরও বেড়ে গেল। কি অসহ্য এই লোকটা! এমন ভাবে লজ্জা পাচ্ছে যেন নববধূ! আকবর ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে যা বলল তাতে নূরীর সব চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। যে বাধন থেকে সে মুক্তি পেতে চেয়েছিল, সেই বাধন তাকে আরও আঁকড়ে ধরলো। একে একে সবাই নূরীকে অভিনন্দন দিয়ে চলে গেল। তবে নূরীর মা থেকে গেলেন।

– দেখ মা, আকবর খুব ভালো ছেলে। একটু মানিয়ে নে। সন্তানটার কথা তো ভাব। ঘুরন্ত পাখার দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে থেকে উদাস মনে নূরী বলল, “আচ্ছা মা, আমাদের জন্ম হয় কি আজীবন মানিয়ে চলার জন্য?” একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মোরশেদ বেগম বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহ-ই নারীকে সবচেয়ে বেশি ধৈর্য্য-সহ্য দিয়েছেন। কারণ নারীকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলতে হবে। তুইও এবার এটা বুঝে নে।”

সময় গড়াতে লাগল। নূরীর মাঝে নতুন অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল। নূরী তার সব চিন্তাভাবনাকে বাদ দিয়ে নতুন অতিথির অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগল। বারান্দায় বসে আছে নূরী। ঘরের ভেতরে আকবর মুখে হাত দিয়ে মোবাইলে দিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে। নূরী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেন যেন আজ আকবরকে দেখে খুব মায়া লাগছে। সহজ-সরল ছেলেটা যেকোনো কাজ করার আগে হাজারবার ভাবে। তবুও কোনো না কোনো ভাবে ভুল হয়েই যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নূরী অন্যদিকে ফিরে তাকালো।

হাসপাতালে শুয়ে আছে নূরী। ডেলিভারীর সময় খুব সন্নিকটে। নূরী যতবারই চোখ খুলেছে ততবারই আকবরকে দেখেছে। কিন্তু তার সম্পূর্ণ হুঁশ ছিল না। যখন নূরী সম্পূর্ণ হুঁশ ফিরলো। তখন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হচ্ছে। তখনও আকবরকে পাশে দেখেছে। তার হাত ধরে আকবর একটা কথাই বলছে, “তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার পাশে আছি।” নূরী কিছু বলতে পারেকি। শুধু তাকিয়ে ছিল। অবশেষে একটা ফুটফুটে ছেলে জন্ম দিলো নূরী। সবাই ব্যস্ত নবজাতককে নিয়ে। ভীড় শেষে নূরীর কাছে এলো আকবর। নূরীর গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “কেমন আছ তুমি?” নূরীর মনে হঠাৎই ভালো লাগার বাতাস বইয়ে গেল। তার বাবা মা আত্মীয়স্বজন কেউই তার কথা জিজ্ঞেস করেনি। সবাই শুধু অভিনন্দন জানিয়েছে। বাকি সময় নবজাতককে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। নূরীর অজান্তেই তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

– আমার ছোঁয়াতে তুমি কি ব্যাথা পেয়েছ?
– উঁহু। না।
– তবে কাঁদছো কেন?
– ওসব কিছু না। তুমি সারারাত ঘুমাওনি বুঝি? চোখ লাল হয়ে আছে কেন?
– ঘুম আসেনি।
– কেন? আকবর চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নূরী হঠাৎই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
– এই তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার!
– এই চুপ।
– কষ্ট হচ্ছে তোমার?
– না।

তবে আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি, তাই না? যখন তখন রাগারাগি করেছি। তোমাকে অবহেলা করেছি।
আকবর বিস্মিত হয়ে বলল, “কি বলো এসব? তুমি আবার কখন আমাকে কষ্ট দিলে?” আকবর বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে যেন নূরীর সব কথাই বানোয়াট। অথচ নূরী এসবই করেছি। অন্যকেউ হলে হাজারো অভিযোগ করতো। কিন্তু অভিযোগ তো দূর, আকবর স্বীকারই করছে। নূরী নিজের বিবেকের কাছে নিজেই লজ্জিত হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরী বলল, “তুমি খুশি তো?”

– তুমি সুস্থ এটা দেখেই আমি খুশি।
– ছেলে হয়েছে তা দেখে খুশি তো?
– হ্যাঁ, অখুশি কেন হবো? আমিও তো ছেলে।
– যদি মেয়ে হতো?
– তাতে কি? তুমিও তো মেয়ে। নূরী হেসে দিলো।
– তুমি এত বোকা কেন? কিছুই কি বুঝ না?
– আমি তো সব বুঝি। তুমি বোকা বলছো কেন? নূরী হাসি দিয়ে আকবরের হাতটা ধরে বলল, “এভাবে বোকা হয়ে সারাজীবন আমার পাশেই থেকো।”
– হ্যাঁ, আম্মু বলেছে তোমার পাশে থাকতে।

নূরী আবার হেসে উঠলো। কষ্ট, শান্তি ও আনন্দের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ঠিক তখনই নিশি প্রবেশ করলো। “এই যা! তোমাদেরকে বিরক্ত করলাম। কিন্তু ভাতিজার সাথে দেখার করার জন্য অস্থির হয়ে আছি। কোথায় আমার বাবাটা!” নিশি এগিয়ে এলো নবজাতকের দিকে। কোলে নিলো। নানান কথা বললো। তারপর আকবরের কাছে এসে বলল‚ “তুই কোলে নিয়েছিস?” আকবর যেন আঁতকে উঠলো। সাথেসাথে মাথা নাড়াতে নাড়াতে জবাব দিলো, “না, না, না আমি নিবো না। বড় হোক তারপর নিবো।” আকবরের অবস্থা দেখে নিশি-নূরী দুজনই হেসে উঠলো। আকবর তাড়াতাড়ি প্রস্থান করলো।

সময়ের স্রোতে কেটে গেল দিন। নূরী এখন এই সাদাসিধে আকবরের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এখন আর আকবরের বোকা বোকা কর্মকাণ্ড দেখে বিরক্ত হয় না। শুধু হাসে। তাদের ছেলে ফয়সাল বেশ দুষ্টু। পুরো ঘর একাই মাতিয়ে রাখে। বয়স মাত্র চারের কোঠায় পড়েছে। কিন্তু মাঝেমাঝে তার বুদ্ধির সামনে নূরীও হেরে যায়। মাঝেমাঝে নূরী ভাবে সেদিন যদি সে উকিলের কাছে চলে যেতো তবে এই সুখ-শান্তি, আনন্দ উল্লাস থেকে বঞ্চিত হতো।

ফয়সালের আগমনে সে তার সুখের ঠিকানায় টিকে আছে। হয়তো আকবর রোমান্টিক নয়, কিন্তু সে খুব ভালোবাসতে জানে। একজন যুবতী মেয়ে হিসেবে নূরীর মনের অনেক স্বপ্নই পূরণ হয়নি। যেমন নদীর পাড়ে আকবরের হাতে হাত রেখে রোমাঞ্চকর সময় কাটানোর নূরীর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সকালে চায়ের কাপ মুখে নিয়ে আকবরের গল্প করার স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। আকবরের সাথে রাতে জোসনা বিলাস করার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এমন হাজারো স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে তার। কিন্তু নূরীর প্রতি যত্নে আকবর কোনো অবহেলা করেনি। পরিবারের প্রতি দায়িত্বে তার কোনো ত্রুটি দেখেনি নূরী।

সকল বিপদে আপদে আকবরকে পাশে পেয়েছে। ফয়সাল আসার পর নূরী একটা জিনিস বুঝেছে যে, কারও দিকে যদি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকানো হয় তবে ভালোলাগা কাজ করবে। আর যদি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকান তবে সেটাই কাজ করবে। তাই তো যে আকবরকে দেখলে আগে বিরক্ত লাগতো। এখন সেই আকবরকে দেখলে তার মনের মধ্যে ভালোবাসা দোলা দেয়, আনন্দের বাতাস প্রবাহিত হয়, মনে প্রশান্তি কাজ করে। এত বছরের সংসারে নূরী এটা বুঝেছে যে, আকবর যেমন সাদাসিধে তার মনটাও সাদাসিধে। এমন মানুষ শুধু ভালোবাসতেই জানে। এই ভালোবাসায় নূরী কাটিয়ে দিচ্ছে তার জীবন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত