৭. চমক
আব্বাকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনাটা খানিকটার রদবদল করা হল। ঠিক করা হল বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠানোর বদলে সেখানে গাব্বকে ব্যবহার করা হবে। তার কয়েকটা কারণ প্রথম কারণ হচ্ছে ব্যাপারটা রাত্রে না করে উপায় নেই। দিনের বেলায় কারও কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তুললে সেটা যে কেউ বুঝে ফেলবে। রাত্রিবেলা বুবুনকে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তোলার জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া খুব সহজ হবে না–বুবুনকে কিছুক্ষণ না দেখলেই আব্বা বেশ অস্থির হয়ে যান। গাব্বকে ব্যবহার করা হলে সেই সমস্যা নেই। শুধু তাই নয়, যখন গাকে আকাশে টেনে তোলার সময় হবে তখন বুবুন আব্বাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসতে পারবে। জানালার কাছেই একটা বড় নিমগাছ রয়েছে, সেই নিমগাছে একটা কপিকল বাঁধা হয়েছে। বাজার থেকে নাইলনের দড়ি কেনা হয়েছে, গাব্বর বেল্টের সাথে সেই দড়ি বেঁধে তাকে টেনে উপরে তোলাও বেশ কয়েকবার প্যাকটিস করা হয়ে গেছে।
যেদিন ঘটনাটা ঘটানো হবে সেদিন সবার ভিতরেই খানিকটা উত্তেজনা টের পাওয়া গেল। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়ার জন্যে আগে থেকে বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করে রাখা হয়েছে। সুমি বলল তাকে বকুলের বাসায় যেতে হবে। টেলিভিশনে একটা গানের প্রোগ্রাম দুজন একসাথে না দেখলেই নয়। গাব্বু বলল বুবুন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। পিয়ালের বাসায় কঠিন শাসন, সে বলল স্কুলে পরের দিন জ্যামিতির টেস্ট পরীক্ষা হবে, একটা বিশেষ উপপাদ্য গার বাসা থেকে বুঝে আসতে হবে।
ঠিক সময়ে সবাই গুটিগুটি হাজির হয়েছে, গাব্বকে গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে কোমরের বেল্টে দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাবে না বলে গাব্বু হাতে একটা বড় টর্চলাইট নিয়েছে। সময় হলে নিজেই নিজের দিকে জ্বালিয়ে ধরবে।
নিমগাছের নিচে সব প্রস্তুতি শেষ করে সেখান থেকে ছোট এক টুকরা ঢিল জানালায় ছুঁড়ে মারা হল। শব্দ শুনে বুবুন জানালা খুলে তার আব্বাকে ডাকাল, “আব্বা দেখে যাও।”
আব্বা খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ঘাসফড়িংকে পরীক্ষা করছিলেন। কীভাবে সেটা জানি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেছে। বুবুনের কথা শুনে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কী দেখব?”
কী প্রশ্ন করলে কী বলা হবে আগে ঠিক করে রাখা ছিল, বুবুন বলল, “গাব্বু দেখা করতে এসেছে।”
গাব্বু তখন টর্চলাইট জ্বালিয়ে নিজেকে দেখিয়ে দিল। গাব্বু কেন সামনের দরজা দিয়ে না এসে বাসার পিছনে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেটারও উত্তর ঠিক করা ছিল কিন্তু আব্বা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ‘ও!”
ঠিক এই সময়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সুমি আর পিয়াল গাবুকে টেনে ওপরে তুলতে শুরু করল। একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই সে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে বাঁকা হয়ে ঝুলতে লাগল। আব্বা বললেন, “গাব্বুর কী হয়েছে?”
বুবুন বলল, “বাতাসে ভাসছে আব্বা।”
আব্বা বললেন, “ও!”
আব্বা যে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন বুবুন মোটেও সেটা আশা করেনি। সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে আবার কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তখন আবার হ্যাঁচকা টানে গাবুকে আরও খানিকটা উপরে তোলা হল। সুপারম্যান এর কমিকে সুপারম্যান যে-ভঙ্গিতে আকাশে ওড়ে গাব্বু সেরকম ভঙ্গি করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু সে বাঁকা হয়ে ঝুলেছিল বলে ভঙ্গি দেখাতে লাগল বিচিত্র। ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে দেওয়ার জন্যে গাব্বু দড়িতে বাধা
অবস্থায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। আব্বা বললেন, “গাব্বু ঘুরছে।”
দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক খাওয়ার অংশটুকু পরিকল্পনার মাঝে ছিল না, গাব্বু নিজেকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারল না। হাত-পা নাড়া অবস্থায় তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে থাকে, দেখে আব্বা পর্যন্ত খুকখুক করে হেসে ফেললেন।
পরিকল্পনাটি এমনিতেই মাঠে মারা যাচ্ছিল কিন্তু এর পর যা ঘটল তাতে পরিকল্পনাটি শুধু মাঠে মারা গেল না, মরে একেবারে ভূত হয়ে গেল। হঠাৎ পটাং শব্দ করে গাব্বর বেল্ট খুলে গিয়ে সে উপর থেকে ধড়াম করে নিচে এসে পড়ল এবং শূন্যে শুধু তার বেল্ট ঝুলতে লাগল। গাব্বর যে ইচ্ছে করে বেল্ট খুলে গিয়েছে সেটা সে বুঝতে পারল না, মনে করল তাকে বুঝি আর পিয়াল নিচে ফেলে দিয়েছে। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে চিৎকার দিয়ে বলল, “গাধার বাচ্চারা আমাকে ফেরে দিলি যে?”
পিয়াল এবং সুমি লুকিয়ে থেকে যতটুকু সম্ভব পরিকল্পনাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল কিন্তু গাব্বু তার সুযোগ দিল না। দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “ঐ ছাগলের বাচ্চারা, কথা বলিস না কেন? কই গেলি তোরা? পিয়াল? সুমি?”
আব্বা বললেন, “গাব্বু রাগ করেছে। অনেক রাগ করেছে।”
কোনো উপায় না দেখে পিয়াল আর সুমি আড়াল থেকে বের হয়ে এল, গাব্বু তখন প্রায় খ্যাপা মোষের মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটাকে আরও গুরুতর করার জন্য ঠিক সেই সময় আম্মা ঘরে এসে হাজির হলেন, বুবুন আর আব্বাকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছ?”
এই কয়েকদিনে আব্বা আম্মার সাথে খানিকটা সহজ হয়েছেন, আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গাব্বু উড়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ করে পড়ে গেছে।”
আম্মা জানালার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “কী বললে? উড়ার চেষ্টা করছিল?”
নিমগাছের নিচে তখন প্রচণ্ড মারামারি চলছে। গাব্বু ধরেই নিয়েছে তাকে হেনস্থা করার জন্যে ইচ্ছে করে উপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আব্বা আম্মাকে বললে, “ঐ যে দ্যাখো। গাব্বর বেল্টটা এখনও উড়ছে।”
আম্মা বেল্টটা নিয়ে ব্যস্ত হলেন না, উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “ওরা কারা? ঝগড়া করছে কেন?”
আম্মার গলার স্বর শুনে নিচে মারামারি বন্ধ হয়ে গেল। সুমি বলল, “চাচি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ মা ভালো আছি। তোমরা কী করছ এখানে?”
“না মানে ইয়ে এই তো–“
পিয়াল বলল, “ইয়ে, গাব্বর বেল্ট–”
“ও হা গাঙ্কুর বেল্ট। বেল্টটা নিতে এসেছে। তাই ভাবলাম–” সুমি গলার স্বর পালটে বলল, “চাচা ভালো আছেন?”
আব্বা বললেন, “বেশি ভালো নেই।” ডান হাতটা উপরে তুলে আঙ্গুলটা দেখিয়ে বললেন, “এই যে নখ কাটার সময় বেশি কেটে ফেলেছি, এখন ব্যথা করছে।
সুমি বলল, “ভালো হয়ে যাবে চাচা।”
আব্বা বললেন, “গাল্লুকে বলো যাদের পাখা নেই তাদের ওড়া ঠিক না। পড়ে ব্যথা পাবে।”
গাবু, সুমি এবং পিয়াল কথাটা না শোনার ভান করে চলে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হচ্ছে ওখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
বুবুন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে এরকম সময়ে সরাসরি সবকিছু স্বীকার করে ফেলে আধাঘণ্টার একটা লেকচার শুনে ফেলাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। সে গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি বলছি আম্মা।”
আব্বা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ তুই বল।” তারপর জানালা দিয়ে মাথা বের করে অন্যদেরকে বললেন, “তোমরা ভিতরে চলে আসো। বাইরে মশা কামড়াবে।”
সুমি বলল, “না চাচা। আজকে যাই” বলে আর কাউকে কিছু বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনজনই অদৃশ্য হয়ে গেল।
আব্বা সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “গাল্লুকে ভালো করে বোঝাতে হবে। মানুষ তো ফড়িং না যে আকাশে উড়বে।
আম্মা চোখ পাকিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলতে চাস বলে ফেল। কপালে দুঃখ আছে নাহলে জানিস তো?”
বুবুন মনে-মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, পৃথিবীর কত মহৎ পরিকল্পনা না জানি এইভাবে মাঠে মারা গেছে।
.
গাবুকে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা নিয়ে যত বড় ঝামেলা হবে সন্দেহ করেছিল দেখা গেল সেরকম কিছু হল না। আব্বাকে কোনোভাবে চমকে দিয়ে তাঁকে সবকিছু মনে করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মনে হর আম্মা একটু বিশ্বাসও করে ফেললেন। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো ধরনের পাগলামো করা না হয় এরকম একটা কথা দেওয়ার পর আম্মা হালকাভাবে বুবুনের কান মলে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন।
পরের দুইদিন হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল, বাসার আশেপাশে নিচু জায়গায় পানি জমে পুরো এলাকাটাকে একটা সমুদ্রের মতো দেখাতে লাগল। ব্যাঙদের আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি, গলা ফুলিয়ে ঘা ঘো ঘা ঘো করে ডেকে ডেকে এলাকার সবার কান ঝালাপালা করে দিল। মেয়েদের স্কুলের কী একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খুব ব্যস্ত ছিলেন, আশেপাশে গ্রামে-গ্রামে বৃষ্টির মাঝে ঘোরাঘুরি করে করে তাঁর বাসায় ফিরতে দেরি হতে লাগল।
বৃষ্টির প্রথম দিনেই গাব্বু একটা প্রস্তাব নিয়ে এল, টিলার কাছে নিচু জায়গা আছে সেখানে পানি জমে ছোটখাটো একটা সমুদ্রের মতো হয়ে গেছে সেখানে একটা ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া। আগেও এক-দুইবার চেষ্টা করা হয়েছিল খুব একটা সুবিধে করা যায়নি। ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ জোগার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এবারে অবিশ্যি অন্য ব্যাপার, আব্বাকে নিয়ে গ্রামে হাজির হয়ে কয়েকটা কলা গাছ চাইলেই গ্রামের লোকেরা খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। আব্বা যে ডক্টর রওশানের স্বামী, নিজেও ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছেন এই সব কথা শুধু একটু গলা বাড়িয়ে বলে দিতে হবে।
আব্বাকে ভেলা তৈরি করার প্রস্তাবটা দেওয়ামাত্রই খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল ছোট একটা দল আব্বার পিছুপিছু গ্রামের দিকে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে সুমি সবসময় আগে থাকে কিন্তু কোনো-একটা বিচিত্র কারণে এবার সুমি আসতে চাইছিল না। বুবুন বলল, “মাঠে তো পানি একেবারেই বেশি না, এই হাঁটুপানি, ভয়ের কী আছে?”
সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি ভয় পেয়েছি তোকে কে বলল?”
“তা হলে আসতে চাইছ না কেন?”
গাব্বু বলল, “ছিপ নিয়ে যাব, কেঁচো দিয়ে টোপ দিলেই কপাকপ করে মাছ ধরবে।”
সুমি বলল, “কেঁচো? ছি!”
“দেখবি ভেলায় উঠতে কী মজা লাগে। নিচে পরিষ্কার কাঁচের মতো পানি। তার মাঝে মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
সুমি কিছু বলল না। বুবুন বলল, “দেখবে লগি দিয়ে ধাক্কা দিতেই ভেলা ভাসতে থাকবে। কী মজা হবে!”
শেষ পর্যন্ত সুমি রাজি হল। কাদা এবং পানির মাঝে ছপছপ করে সবাই যাচ্ছে এবং হঠাৎ করে একজন পানিতে একটা জোক আবিষ্কার করে ফেলল, সাপের বাচ্চার মতো সেটা কিলবিল করে যাচ্ছে। জোকটা দেখেই সুমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে একেবারে লাফ দিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ল। আব্বা প্রথমে খুব অবাক হলেন, একটু পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুকখুক করে হাসতে লাগলেন। বললেন, “জোককে এত ভয় পাওয়া ঠিক না।”
“কেন না চাচা? যদি ধরে?”
“ধরলে একটু লবণ দিলেই ছেড়ে দেবে।”
“লবণ? লবণ কোথায় পাব?”
“ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে নেব।”
আব্বার কথা শুনে সুমি ভয়ে ভয়ে আব্বার ঘাড় ছেড়ে দিয়ে নেমে এল। সুমির মতো এরকম হৈহৈ করা মেয়ে কেন ভেলার মাঝে ভেসে বেড়ানোর মতো একটা মজার ব্যাপারে আসতে চাচ্ছিল না সেটা হঠাৎ করে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সে জোঁককে অসম্ভব ভয় পায়। ব্যাপারটা অন্যেরা জেনে ফেলার পর সবাই মিলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলল। একটু পরেপরে মিছিমিছি তাকে ভয় দেখাতে লাগল। সুমি এমনিতে জাঁদরেল ধরনের মেয়ে তার, সাথে ফাজলেমি করলে সে সহজে কাউকে ছেড়ে দেয় না, কিন্তু জোঁকের বেলায় সে একেবারে ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা যাই হোক জোঁক কথাটা উচ্চারণ করলেই সে একেবারে ছুটে গিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়তে লাগল, সেটা দেখে সবাই যা মজা পেল সেটা আর বলার মতো নয়।
টিলার নিচে পানি জমে সমুদ্র হয়ে থাকা অংশের অন্য মাথায় যেখানে গ্রামের মানুষেরা বাসা তৈরি করে রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে অনেকক্ষণ লেগে গেল। তারা ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ নিতে এসেছে শুনে সবাই বেশ মজা পেল। আব্বাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই বেশ কয়েকটা কলাগাছ কেটে ফেলা হল। পিয়াল যখন আব্বার পরিচয় দিল তখন গ্রামের মানুষেরা দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর বসার জন্য হাতলওয়ালা নকশাকাটা একটা চেয়ার নিয়ে এল। আব্বা অবশ্য সেই চেয়ারে বসলেন না, অন্য সবার সাথে ভেলা তৈরি করার কাজে যোগ দিলেন। প্রথমে কাটা কলাগাছগুলো ঠেলে পানিতে নেওয়া হল। পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে দুই টুকরো বাঁশ কয়েক জায়গায় আড়াআড়িভাবে লাগিয়ে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল। ভেলাকে ঠেলাঠেলি করার জন্যে একটা বাঁশের লগি দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল আব্বাকে নিয়ে বাচ্চাদের এই ছোট দলটা পানিতে ভাসতে শুরু করেছে। পানি নিয়ে গার বেশি ভয়ডর নেই, সে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই পানিতে ভিজে এবং কাদা মেখে সে ভূতের মতো হয়ে গেল। আব্বা বসেছেন মাঝখানে, তার ওজন বেশি বলে একট নড়াচড়া করলেই ভেলা টলমল করে ওঠে। জোঁকের ভয়ে সুমি আব্বার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে শক্ত করে ধরে রাখা কাগজে প্যাচানো খানিকটা লবণ। পিয়াল এবং বুবুন পালা করে লগি দিয়ে ঠেলা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। নিচে পানি একেবারেই কম, বৃষ্টির পরিষ্কার পানিতে সবকিছু দেখা যায়। মাছ ভেসে বেড়াবে বলে যেরকম আশা করেছিল সেরকম অবিশ্যি দেখা গেল না, মাছেরা সম্ভবত ভেলা দেখেই সতর্ক হয়ে গেছে।
বুবুনদের দেখাদেখি গ্রামের বাচ্চারাও নিজেদের ভেলা তৈরি করে পানিতে নামিয়ে এনেছে–তারা বুবুনদের থেকে অনেক বেশি দুর্দান্ত–ভেলার উপর থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে লাগল। যারা পানিতে নামতে চাইছিল না ভেলা উলটিয়ে তাদের সবাইকে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হল।
ভেলায় করে সমুদ্রের মতো জমে থাকা পানির মাঝে আব্বাকে নিয়ে সবাই ভেসে বেড়াল। আকাশে আবার মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে ভেবে তারা একসময় ফিরে আসতে শুরু করে। মাঝপথেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, তখন আব্বার আনন্দ দেখে কে! তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল বৃষ্টিতে ভেজার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতেই নেই। আনন্দ জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্যেরাও সেই আনন্দের ভাগ পেয়ে গেল। চুপচাপ বসে আনন্দ করা যায়
বলে ভেলার ওপরেই নাচানাচি শুরু হয়ে গেল এবং হঠাৎ কিছু বোঝার আগে দেখা গেল গাব্বু ঝপাং করে পানির মাঝে পড়েছে। আব্বা ভয় পেয়ে যেই গাকে ভোলার জন্যে ভেলার পাশে এগিয়ে গেলেন ভেলা কাত হয়ে পিয়াল। এবং বুবুনও পানিতে পড়ে গেল, তখন যা একটা মজা হল সে বলার মতো নয়। সবাইকে টেনে আবার ভেলার মাঝে তোলা হল এবং হঠাৎ করে দেখা গেল পিয়ালের শার্টের মাঝে ছোট একটা চকচকে মাছ লেগে আছে। পানির বাইরে এসে নির্জীবের মতো মাছটা তিরতির করে নড়ছে, আব্বা বললেন, “আহা বেচারা, কষ্ট পাচ্ছে। পানিতে ছেড়ে দাও আবার।”
কারোই মাছটাকে ছেড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বার কথা শুনে মাছটাকে পানিতে ছেড়ে দিতেই সেটা মুহূর্তে যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে চোখের পলকে সারা শরীর দুলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আকাশে মেঘ তখন আরও ঘন হয়ে এসেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা আরও চেপে এসেছে, হঠাৎ করে একটু বাতাসও দিতে শুরু করেছে।
পানিতে ভিজে একেকজনের যা চেহারা হয়েছে সেটা বলার মতো না। গাব্বু দাঁত বের করে হেসে পিয়ালকে বলল, “তোকে আজ তোর বাবা যা বানানো বানাবে!”
পিয়াল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বানালে বানাবে। তুই হাসছিস কেন?”
গাঙ্কু তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল, “কে বলল, আমি হাসছি? হি হি হি।”
আগের পর্ব :
০১. নতুন জায়গা
০২. খবিরউদ্দিন ও মোষের দই
০৩. শেয়ালের গর্ত
০৪. খবর
০৫. বাবা
০৬. শেয়াল দেখা
পরের পর্ব :
০৮. ভূত
০৯. কিডন্যাপ
১০. পরিকল্পনা
১১. অ্যাডভেঞ্চার
১২. পথ-কুক্কুর
১৩. শেষ কথা