বোনের স্মৃতি

বোনের স্মৃতি

একটা ছেলে চলন্ত বাসে ঘুমিয়ে থাকা একটা মেয়ের উরুতে স্পর্শ করছে একটু পর পর। মেয়েটা ঘুমিয়ে থাকায় হয়তো টের পাচ্ছে না। স্পর্শের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।

বাসে সিট খালি নেই। আমি সহ আরো তিনজন দাঁড়িয়ে আছি। ওরা অবশ্যই এদিকে কেউ লক্ষ্য করছে না। যে ছেলেটা এই কাজটা করছে সেও ঘুমের ভান ধরে কাজটা করছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। কিছু একটা করা দরকার। একটু ভেবে একটা প্ল্যান করলাম। আমি ইচ্ছে করেই মেয়েটার পায়ে সজোরে আঘাত করে সামনে এগিয়ে গেলাম। যথারীতি মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেছে।

এই ঘুমের চেয়ে জাগ্রত থাকাটা এই মুহূর্তে বেশি শ্রেয় বলে আমার কাছে মনে হল। মেয়েটা জেগে উঠে ঘুম ভাঙ্গার কারণ খুঁজে পেল না হয়তো। তবে সে বেশ কিছুটা সরে বসল ওই ধান্দাবাজ ছেলেটার কাছ থেকে। আর ধান্দাবাজও বুঝতে পেরেছে মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেছে তাই সেও যথারীতি নিজের হাতগুলো সরিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ধান্দাবাজ ব্যক্তিটা নেমে গেলে আমি ওই সিটে বসি। আমি চট্টগ্রাম থেকে নেত্রকোনা যাচ্ছি। এরপর কেন্দুয়া যাবো। আমি সিটে বসার কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম মেয়েটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসের ঝাকুনিতে বার বার আমার দিকে হেলে পড়াতে আমি এক পাশে খুব বেশি সরে গিয়ে মেয়েটাকে জায়গা করে দিলাম।

মেয়েটা হয়তো কলেজে পড়ে। তানিয়ার সমবয়সী হবে। তানিয়া আমার বোন। এই মেয়েটার ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে মনে হবে তানিয়া বসে আছে এখানে। থাক হাজার হলেও আমি অপরিচিত। অনুমতি ছাড়া মেয়ে মানুষের মুখে তাকানো হয়তোবা পাপ। আমি আর সে দিকে তাকালাম না। ভৈরব এসে মেয়েটা নেমে পরল। আমি মনের অজান্তেই যেন মেয়েটাকে ডাক দিয়ে বসলাম, “আপু শোনো। ” “জ্বী বলুন।” “সাবধানে যেও। ” মেয়েটা একটা হাসি দিয়ে বলল “জ্বী আচ্ছা আপনাকে ধন্যবাদ। ”

কেমন যেন একটা শান্তি লাগলো মনের মধ্যে। এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই হয়ত আমাকে খুব ভালো মানুষ ভাবা শুরু করেছেন। সেটা ভাববেন না। আমি ভালো মানুষ নই। ভালো মানুষ হলে কি নিজের বোনটাকে এভাবে একা একা গ্রামে ফেলে রাখি। বছরে মাত্র একবার দেখতে যাই। জানেন আমার বোনটার আর কেউ নাই দুনিয়াতে। থাকার মধ্যে এই আমার মত অপদার্থ একটা ভাই। বাবা-মার চেহারা মনে করতে পারি না। তারা মারা যাওয়ার সময় অনেক ছোট ছিলাম। বাবা-মার আদর বুঝিনি কখনো তাই খুব একটা সে বিষয়ে কষ্ট নেই আমার। ছোট বোনটা আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিল। গ্রামের বাড়িতে থাকতাম আমরা। দুই ভাই বোনের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হত গ্রামের লোকজন। নন্দীর মা তার ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে এসে দেখাতেন ” দেখ দেখ তগো মতন না সারাদিন ঝগড়া করে না এরা। কত মিল এদের। দেখে শিখ। ”

বাবা-মা হারা এই দুই ভাই-বোনের মিল আর মায়া দেখে সবাই খুশি হতো। দুপুরবেলায় বুনো কলমি তুলতে বটতলার পাশের ডোবাটায় যেতাম দুই ভাইবোন মিলে। আর রাতে যখন আমাদের এই পরিশ্রমের আনা জিনিসটি ভাত দিয়ে খেতাম কতইনা তৃপ্তি আর স্বাদ লাগতো। এখনকার ৫ তারকা হোটেলেও আমি ওমন স্বাদ পাইনা। কেন্দুয়া চলে এসেছি। একটা রিকশা করে বাড়ি গেলাম। এখানে ফুফা আর ফুফু থাকেন। আমি থাকি মামা মামির সাথে চট্টগ্রামে। একাউন্টিং নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।

ধান নাড়া দিচ্ছিলেন ফুফু। আমায় দেখে কিছুটা দৌড়ে যেন আসলেন এসে বললেন “বাবা এত দেরি হলো আসতে? আসো আসো। এ মা আসরের আজান পড়েছে। আসো আসো ভেতরে আসো।” ফুফুকে সালাম করে ভেতরে গেলাম। ফুফা এখনো বাজারে হয়তো। ফুফু খাওয়ার আয়োজন করতে থাকলে আমি বললাম, “ফুপ্পি আমি আরো পরে খাবো। বোনকে দেখে আসি। ” “তাই হয় নাকি? এত দূর থেকে এলে খেয়ে নাও কটা। এরপরে না হয় গেলে। ” “ফুপ্পি আমার খিদা খুব একটা পায়নি। আমি এসে খাবো।” “আচ্ছা যাও বাবা। বোনের টান কখনো কমলো না পাগলটার।” দেখালাম ফুফুর চোখগুলো টলমল করে উঠলো।

বিকাল হয়ে এসেছে। আম বাগানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। পাশে ঘন কলাবাগানের উপর অনেকগুলো চিল উড়াউড়ি করছে। জায়গাটা খুব নীরব। কেমন একটা শীতল শীতল লাগছে। আম বাগান পেরিয়ে বাঁশবন। খুব একটা লোক আসে না এই সব জায়গাতে। আমার পায়ের নিচে শুকনো পাতার মর্মর শব্দ হচ্ছিল শুনে কয়েকটা শিয়াল মনে হলো সামনের ঝোপ থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল।

এই তো আমার বোনের কাছে চলে এসেছি। কিছুক্ষণ দোয়া পরে কবরের পাশে বসলাম। “তানিয়া কেমন আছিস রে? আমি জানি তুই ভালো থাকবি। আমরা তো এতিম। আর তুই তো সবে ১০ বছরে পরেছিলি। তুই তো অবুঝ মানুষ ছিলি। তোর কি মরার বয়স হয়েছিল রে? তাও খোদা তোকে নিয়ে নিলো। উনি তোকে শান্তিতেই রাখবেন। জ্বর তো আমারও হয়, কই আমি তো মরিনা? বোন খুব ভয় হয় এখানে থাকতে তোর তাই না? দুনিয়ার নিয়মটাই এমন। আমায় ক্ষমা করিস বোন।

তোকে একা এখানে রেখে আমি কত দূরে থাকি। আমারও কেউ নাইরে। আমারো কেউ নাই। বোন আমার চুপ করে আছে। বুকটা প্রচন্ড ব্যথা করছে আমার। চোখ ভিজে গেছে বলে অস্পষ্টভাবে দেখলাম গতবার লাগিয়ে দিয়ে যাওয়া গোলাপ গাছটা কবরের পাশে এখনও আছে। একটা মস্ত বড় ফুল ফুটে আছে। মনে হল ফুলটা আমার দিকে একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ফুলটাকে একটা চুমু দিলাম, ছিড়লাম না। তানিয়া বেঁচে থাকলে হয়তো তার কপাল বরাবরই চুমুটা পৌছাতো।

বিকেলের শেষ রোদ তখন বাঁশবনের মাথায় এসে পড়েছে। ঝাপসা ভাবে দেখতে পেলাম একঝাঁক পাখি উপর দিয়ে উড়ে গেল। পৃথিবীর অনেক ভাই-বোন হয়তো এখন ঝগড়া করছে, একে অপরের সম্পত্তি কেড়ে নেবার চিন্তা করছে। আর আমি তখন আমার অদৃশ্য বোনের কাল্পনিক দৃশ্যতা অঙ্কন করে শুধু কেঁদে যাচ্ছি এই জনহীন, লতাপাতার গন্ধ ভরা নিরব জায়গাটাতে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত