সবসময় যাকে চাচা ডেকে আসছে, শেষ পর্যন্ত তার প্রেমেই পড়বে সেটা দিপা কখনই ভাবেনি।(আপন চাচা না) আসলে মানুষ সবসময় সবকিছু ভেবে করে না। দিপা দেখতে অনেক সুন্দরী কিন্তু তার চাচা মানে তাসফিক তিনি ছিলেন একদম কালো, কিন্তু তার মধ্যে অফুরান মায়া ছিলো, যার জন্যই দিপা তাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলো। তাই নিজের বাবা-মার অবাধ্য হয়ে বিয়ে করেন তাসফিককে। কিন্তু বিয়ের করলেই কি ছেলের বাড়িতেও তাদেরকে মেনে নিলো না।
এদিকে তারা এই বাড়ি,সেই বাড়িতে থেকে কয়েকদিন পার করেছিলো কিন্তু এভাবে তো হবে না, তাদের কিছু একটা করতে হবে, কেউ তো বেশিদিন আশ্রয়ও দিবে না। শেষ পর্যন্ত তাসফিক একটা দোকানে কাজ নিলো,নিজেও সবজি-ফল বিক্রি করতে শুরু করলো, একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে খুব ভালোই দিন কাটাতে লাগলো, এর দুই বছর পরে তাদের একটা ছেলে সন্তান হয়। তারা তার নাম রাখে রিমন।
এদিকে তাদের সন্তান হয়েছে শুনে তাসফিকের মা আর অভিমান করে থাকতে পারলো না ! ছুটে ছেলের কাছে চলে গেলো। তাদের এই সন্তানের জন্য তারা আবার নিজের মা-বাবার আশ্রয় তলে জায়গা করে নিতে পেরেছিলো সেদিন।
এরপর তাসফিক পরিবারের সিদ্ধান্তেই বিদেশে কাজ করতে যায়।সেখানে দিনরাত কাজ করে,টাকা উপার্জন করে। তাসফিক বছর পাচেঁক পরে পরে দেশে আসে। এর মধ্যে তাদের একটা মেয়ে হলো,তার নাম শিমুল। দিপা তার সংসারটা খুব যত্নেই আগলে রেখেছিলো, একটা বাড়িও করেছে। বাড়িটা করতে দিপার অক্লান্ত পরিশ্রম সবার নজর কাড়ানো ছিলো।
সবদিকেই তাদের এই সংসারটা সুন্দর ছিলো। বিয়ের পর তাদের সংসার এভাবেই কেটে গেলো অনেক বছর। তাদের ছেলে রিমন বড় হয়ে গেছে, আর তাদের মেয়ে শিমুলও এসএসসি দিয়ে ফেলেছে। সব ঠিক ছিলো, শুধুমাত্র শেষ পর্যন্ত ঠিক ছিলো না তাদের স্বামীর স্ত্রীর সম্পর্কটা। যেখানে ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে,সেখানে তাসফিক এই পর্যায়ে এসে অন্য রকম আচরণ শুরু করেছে,বাড়িতে টাকা পাঠায় না। ভালো করে কথা বলে না, টাকার কথা বললে তো তার মাথা একদম আউরে যেতো।
ফোন দিয়ে দিপা কথা বললে কথাই বলতো না, তাই শিমুলকে দিয়ে কথা বলাতো। কিন্তু তাতেও কাজ হতো না। পাচঁ ছয়মাস পরে বলতে বলতে কয়েক হাজার টাকা দিতো। দিপা কোনো উপায় দেখছিলো না,তার বাবার বাড়িতেও এসব বলে ঠাঁই পাবে না।কারণ বিয়ের সিদ্ধান্ত তার একান্ত ছিলো। এরপর মানুষজন থেকে অনেক টাকা ধার নিয়ে, নিজের গয়নাঘাটি ও ঘরের অর্ধেক জিনিসও বিক্রি করে, তিনি রিমনকে বিদেশে পাঠালেন। এরপর শুরু হলো উনার আরেকটা জীবন, সেখানে তাসফিকের প্রয়োজন ছিলো অতি নগণ্য। তার মেয়ে শিমুলকেও ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিলেন।
এক নাগাড়ে ৬ বছর পরে তাসফিক দেশে আসে একদম শূন্য হাতে। দেশে এসে দিপা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিলো না। কিন্তু দিপা তাসফিকের উপর এতোটাই ক্ষিপ্ত ছিলো যে ওর ধারে কাছে গেলেই তোলপাড় শুরু করতো। কিন্তু তাসফিক তখন খুব নরম আর সরল হয়ে গেছিলো কারণ তার যে আর উপায় নেই। দিপা শুধু একটা কথাই বলতো ৬ বছর যাবৎ সে যার পেছনে সব টাকা দিয়ে আসছে তার কাছেই যেন যায়।
এরপরও তাসফিক দিপার পিছে পিছে ঘুরতো।
কিন্তু দিপা এতটা কঠিন হয়ে গেছিলো যে তাসফিককে একদম সহ্য করতে পারছিলো না। দিপা বলতো খালি হাতে পিরিতি দেখালে মায়া লাগে না, সংসারে টাকার দরকার,এখানে বাজার লাগে, খাবার লাগে,পরন লাগে,সেখানে এতো বছর বিদেশ করে পেছনে পেছনে ঘুরলেই কি মাফ পেয়ে যাবে নাকি? এমনি এক সকাল বেলা কি নিয়ে যেন ঝগড়া করে দিপা রাগের মাথায় তাসফিকের মাথার মধ্যে স্টিলের বাটি দিয়ে ঢিল মেরেছিলো,অনেকটা অংশ কেটেও গেছিলো।
আর সেদিন দিপা সব গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো, নিজের সাজানো সংসার, কষ্টে বানানো বাড়ি সব রেখে এখান থেকে চলে গেলো। প্রায় এক বছর বেপাত্তা ছিল। পরে সবাই শুনেছিলো উনি ঢাকাতে বাসা করে থাকে,উনার ছেলে রিমন বিয়ে করেছে। বিয়ের পর রিমন বউ নিয়ে জার্মান চলে গেলে দিপা তার মেয়েকে বাসায় নিয়ে একসাথে থাকেন। কারণ তার মেয়ের জামাইও তখন বিদেশে ছিলো।
আর এদিকে তাসফিক তার ভাগের সম্পদ থেকে দুইটা জমি বিক্রয় করে দিব্বি দিন কাটাচ্ছে,কিছুদিনের ভেতর বিয়ে করারও পরিকল্পনা করে ফেলেছে । ৫০ বছর বয়সে বিয়ে!হাস্যকর একটা ব্যাপার হলেও সে কারো কথাতে কান দিলো না। বিয়ের আগেরদিন রাতে দিপা পুলিশ পর্যন্ত পাঠাইছে,কারণ তাসফিকের বিয়েতে বড় বউয়ের মানে দিপার তো মতামত নেই। শেষ পর্যন্ত তাসফিক তাকে ডিভোর্স পেপারও দিয়ে দিলো,সাথে কাবিনের টাকা। এরপর কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে করলো।
সেদিন দিপা খুব কান্না করেছিলো, প্রেম করে সবার অবাধ্য হয়ে এই মানুষটাকে বিশ্বাস করে সারাজীবনের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। সে যতটা খারাপ আচরণ করেছে শুধুমাত্র তাকে একটু শিক্ষা দিতে,কিন্তু তাসফিক যে এভাবে বুড়ো বয়সে বিয়ে করে ফেলবে সেটা দিপা ভাবতে পারে নি। দিপা ভেবেছে তাকে ছাড়া কিছুদিন থাকলেই তাসফিক ঠিক হয়ে যাবে, আর সংসারের জন্য কিছু একটা করবে।
তাসফিকের বিয়ের পর দিপা গ্রামে এসেছিলো। এসে নিজের হাতের গড়া বাড়ি,সাজানো সংসারে আরেকজনকে দেখে জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করেছিলো। আর বলছিলো,এই মানুষটা কিভাবে এমন করতে পারলো! তার সারা দুনিয়া জুড়ে তো আমি ছিলাম। কিভাবে সে এতো মধুর সংসারটা বুড়ো বয়সে নিজের হাতে ভেঙে দিলো?
তার কি একবারও বুক কাপঁলো না? একবারও মনে হলোনা তার সন্তানদেরও বিয়ে হয়ে গেছে সেখানে সে কিভাবে বিয়ে করবে? আমার মেয়ের শশুড় বাড়ির লোকেরা যে ছি! ছি! করছে সেটা আমি কিভাবে সহ্য করবো?
দিপার কান্নায় চারপাশে মানুষ ভীড় করেছিলো, আর দিপার কান্নাতে সবাইই চোখের জল নিয়ে নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আর বলাবলি করছিলো তাসফিকের জন্যই তো দিপা কিছুদিন খারাপ আচরণ করেছে, তার এই অল্প ভুলের জন্য তাসফিক তাকে এমন পরিণতি উপহার দিবে??