টিভির রিমোটটা কোন ভাবেই শ্রাবণীর হাত থেকে নিতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ থেকে রাত ১০টা বাজে এখন পর্যন্ত সিরিয়াল দেখতে থাকলাম। শ্রাবণী একমনে টিভির স্কিনের দিকে তাকিয়ে আর আমি তাকিয়ে আছি শ্রাবণীর দিকে। প্রতিটা সিরিয়ালের একই কাহিনী, জামাই নিয়ে শুধু টানাটানি আর মেয়েরা সর্ব শক্তিমানের অধিকারী। আমি বুঝতে পারছি না শ্রাবণী এই অখাদ্য গুলো গিলছে কিভাবে টিভি দেখার সময় আমি কয়েকবার খেয়াল করলাম মা ড্রয়িংরুমে আসে তারপর একবার আমার দিকে তাকায় আরেকবার শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে চলে যায় খাবার টেবিলে বসে খেয়াল করলাম সবাই খেতে এসেছে কিন্তু বাবা খেতে আসি নি। আমি মাকে বললাম,
–মা, বাবা খেতে আসবে না? মা একবার শ্রাবণীর দিকে তাকালো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~তোর বাবার শরীরটা তেমন একটা ভালো না রে। ডাক্তার তোর বাবাকে যে ঔষধ গুলো দিয়েছিলো সেই ঔষধ গুলো তোর বাবার কোন কাজে দিচ্ছে না শ্রাবণী ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,
– এক সপ্তাহে কিভাবে বুঝলেন ঔষধ কাজে দিচ্ছে না। ঔষধ কাজ করারও জন্য হলেও তো একটু সময়ের দরকার। মা আমতা আমতা করে শ্রাবণীকে বললো,
~ আসলে মা এই ঔষধগুলো তোমার শ্বশুর খেলে শরীরটা আরো বেশি জ্বালাপোড়া করে। আমি মাকে বললাম,
— ঠিক আছে মা বাবাকে নিয়ে আমি কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাবো। আমার কথা শুনে শ্রাবণী খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে আমাকে রেগে গিয়ে বললো,
– আজ যে মাসের ২১ তারিখ সেই দিকে খেয়াল আছে? এখন ডাক্তারের কাছে গেলে নতুন করে আরো কত গুলো টেষ্ট দিবে। নতুন করে সব ঔষধ দিবে। মাস শেষ হতে আরো ৯দিন বাকি। সব টাকা যদি এখন ডাক্তার দেখানো আর ঔষধ কেনার মাঝেই চলে যায় তাহলে বাকি ৯দিন এই সংসারটা চলবে কিভাবে? এই কথা বলে শ্রাবণী রাগে রুমে চলে গেলো। আমি মা আর ছোট বোনকে বললাম, পাগল ছাগলের কথায় কান না দিয়ে চুপচাপ খাও তো সকালে বাবাকে নিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে যাবো তখন শ্রাবণীকে বললাম,
— তোমাকে কয়েকদিন আগে যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম মোবাইল কিনার জন্য সেই টাকাটা দাও তো। মোবাইলটা সামনের মাসে না হয় কিনো শ্রাবণী কিছু না বলে আলমারি থেকে টাকাটা বের করে আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
– বিয়ের আগে প্রেম করার সময় কত বড় বড় ডায়লগ, পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে ফেলবো আর এখন আমাকে এতটাই সুখ দিচ্ছে যে আমার এখন এই সুখ সহ্য হচ্ছে না তার কয়েকদিন পর খবর পাই শ্বাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি। আমার কাজ হলো হলো প্রতিদিন নিয়ম করে একবার শ্বাশুড়িকে দেখতে যাওয়া আর কি কি ঔষধ লাগবে সেই গুলো কিনে দিয়ে আসা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শ্রাবণী নেই। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম ছোট বোন তাড়াতাড়ি রুটি বানাচ্ছে আর মাঝে মধ্যে পাশে থাকা বইটা দেখছে। আমি বোনকে ধমক দিয়ে বললাম,
— তোর একটু পর পরীক্ষা তুই এখন রুটি বানাচ্ছিস? তোর ভাবী কোথায়? ছোট বোন বললো,
~ভাবী মনে হয় ছাদে গেছে । আর মার প্রেসারটা মনে হয় বেড়েছে তাই বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না। এজন্যই সকালের নাস্তার জন্য রুটি বানাচ্ছিলাম। আমি ছোট বোনকে বললাম,
— তুই যা, আমি দেখছি ছাদে গিয়ে দেখি শ্রাবণী হাটতে হাটতে দাঁতব্রাশ করছে আর ওর ছোট ভাইকে ফোনে বলছে,
– শুন, একদম তাড়াহুড়ো করবি না। ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবি। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তাই একটুও সময় নষ্ট করবি না | মাসখানেক পরের কথা। আমি দুপুরের দিকে অফিসে কাজ করছি এমন সময় রাহাত ( শ্রাবণীর ছোট ভাই) আমায় ফোন দিয়ে বললো, শ্রাবণী না কি ওয়াশরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। কথাটা শুনে আমি অফিস থেকে বের হয়ে কিভাবে যে শ্বশুর বাড়ি গেলাম আমি নিজেও জানি না। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু আল্লাহ বলছিলাম, আমার শ্রাবণীর যেন কিছু না হয়। শ্বশুর বাড়ি ঢুকতেই সবাই আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। আমি শ্বাশুড়িকে বললাম,
— মা, কি হয়েছে শ্রাবণীর? ও ঠিক আছে তো। শ্বাশুড়ি হাসতে হাসতে বললো,
~আরে তুমি চিন্তা করো না। আমার মেয়ে ঠিক আছে। আমি কিন্তু কয়েকদিন পর নানী হবো। কাথাটা শুনার পর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের মনের ভিতর একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিলো। আমি শ্বাশুড়ি মাকে বললাম,
— মা, শ্রাবণী কোথায়? এমন সময় শ্বশুর আমার পাশে এসে বসতে বসতে বললো,
~পিয়াস, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি বললাম,
— জ্বি বাবা বলেন উনি তখন বললো,
— দেখো আমার মেয়েটা প্রেগন্যান্ট এই অবস্থায় আমি চাই না ও তোমার এইখানে যাক। কয়েকদিন পর তোমার সন্তান হবে। এখন থেকেই তোমাকে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। তুমি বরং একটা আলাদা ফ্ল্যাট নাও। তোমার শ্বাশুড়ি তোমাদের সাথে থাকবে আর মেয়ের দেখাশুনা করবে। ভাড়ার কথা চিন্তা করো না আমিও না হয় তোমায় কিছু দিবো পাশে থেকে শ্বাশুড়ি বললো,
~ হ্যা বাবা, তোমার শ্বশুড় একদম ঠিক বলেছে। আমি চাই না আমার এই ছোট মেয়েটা এই অবস্থায় তোমাদের এই এত বড় সংসারে গিয়ে থাকুক। তুমি বরং আলাদা একটা ফ্ল্যাট নাও শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা শুনে আমি শ্রাবণীকে ডাকলাম। শ্রাবণী আমার সামনে আসতেই আমি মুচকি হেসে বললাম,
— তোমার বাবা মা চাইছে আমরা যেন নতুন ফ্ল্যাট নেই। তোমার কি মতামত? শ্রাবণী তখন বললো,
– আমিও বাবা মার কথায় একমত। পিয়াস আমি চাই আমার সংসারটা নিজ হাতে সাজাতে। কিন্তু তোমার বাবা মা বোনের জন্য এটা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া আমি চাই আমার সন্তান যেন কোন অভাবে বড় না হয় আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
— তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমার কথা শুনে শ্রাবণী হাসতে হাসতে বললো,
– নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাবে না কি? আমি মুচকি হেসে বললাম,
— না রে পাগলি, ডাক্তারের কাছে যাবো। বাচ্চাটা এবরশন করানোর জন্য। আমি চাই না আমাদের কোন সন্তান হোক। করণ আমাদের যদি মেয়ে হয় তাহলে মেয়েটা হবে তোমার মত। যে স্বামী সংসারে গিয়ে সংসারটাকে নষ্ট করে দিবে। আর যদি ছেলে হয় তাহলে ছেলেটা হবে আমার মত অপদার্থ যে কি না বউ যখন মা বাবাকে অপমান করবে সেটা যে মুখ বুঝে সহ্য করবে। তার থেকে বরং একে দুনিয়াতে না এনে পেটের ভেতরেই মেরে ফেলা ভালো।
আমার বাবাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে সংসার চালাতে সমস্যা হয়। আর তোমার মাকে যে আমি প্রতিদিন এত এত টাকার ঔষধ কিনে দিলাম কই একবার তো জানতে চাইলে না আমি এত টাকা কোথায় পাচ্ছি আর কোথা থেকে টাকা জোগাড় করছি? তোমার ভাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা তাই তুমি ওকে সময় নষ্ট করতে না করছো। অথচ আমার বোনেরও এইচএসসি পরীক্ষা ছিলো। একটা বার খোঁজ নিবে দূরের কথা বরং পরীক্ষার দিন আমার বোনের নাস্তা বানাতে হয়।
শ্রাবণী টাকার মাঝে সংসারের সুখ লুকিয়ে থাকে না। সংসারের সুখ লুকিয়ে থাকে সংসারের প্রতিটা সদস্যের ভিতর। সংসারের একটা সদস্যকেও বাদ দিয়ে তুমি সংসারে সুখ আনতে পারবে না। একটা বার যদি আমার পরিবারকে তোমার পরিবারের মত ভালোবাসতে বিশ্বাস করো পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে ফেলতাম শ্রাবণী চুপ করে আছে। আমি নিজের গালে নিজে একটা থাপ্পড় মেরে শ্রাবণীকে বললাম,
— ভেবো না থাপ্পড়টা আমি আমার গালে দিয়েছি। এটা আমি তোমাকে দিয়েছি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি উনাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
— নিজের মেয়ের জন্য একটা ছেলেকে তার পরিবার থেকে আলাদা থাকতে বলছেন। ভেবে দেখেছেন আপনাদেরও তো একটা ছেলে আছে….
শ্রাবণীদের বাসা থেকে বের হয়ে আমি রাস্তায় হাঁটছি। আগে কখনো রাস্তাটাকে এতটা দীর্ঘ মনে হয় নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে৷ খুব ক্লান্ত লাগছে। নিজে প্রথম বার বাবা হবো অথচ আমি খুশি হতে পারছি না। বরং বার বার মনে হচ্ছে, শেষ বয়সে আমার সন্তান আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারবে তো….