নতুন শার্টটা হাতে নিতেই দেখি বুক পকেটের নিচে বেশ কিছু ছোট ছোট ছিদ্র। বুঝতে বাকি রইলো না যে এই কাজটা রুশো ও তার দলের। আমার ঘরে একদল ইঁদুর আছে। তাদের মধ্যে একজন শারীরিক ভাবে মোটা তারা। সে-ই এই দলের প্রধান। আমি আমি তার নাম দিয়েছি রুশো। আর পুরো দলের নাম রুশো বাহিনী। আর এদের শায়েস্তা করার জন্য রেখেছি টাফিকে। আমার পোষা বিড়াল।
শার্টটা নিয়ে আমি টাফির কাছে আসলাম। ছিদ্র গুলো দেখিয়ে বললাম, “এইজন্যই বুঝি তোকে এতো আদর যত্ন করি?” টাফি তার ছোট্ট বিছানায় শুয়ে থেকে এক নজর শার্টের দিকে তাকালো। তারপর আবার আগেরমতো চুপচাপ শুয়ে রইলো যেন আমার কথাতে তার কিছুই যায় আসে না। এবার আমি চেঁচিয়ে বললাম, “আমার কথা কি তুই শুনতে পাচ্ছিস না?” সামনের বাম পা দিয়ে টাফি তার কানে কয়েকবার ঝাড়া মারলো তারপর একটা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। টাফির এমন ব্যবহারে আমার মাথায় রক্ত উঠতে লাগল। আমি কাগজটা হাতে নিলাম। তিন পায়ের ছাপ বসানো পুরো কাগজ জুড়ে। একটি রহস্যময় ব্যাপার হলো আমি সকল জীবজন্তুর মনের ভাষা ও সাংকেতিক চিহ্ন বুঝতে পারি। “প্রাক্তন প্রিয় মালিক।
আজ সকালে তুমি তোমার ব্যস্ততার কারণে আমাকে দুধ দিয়ে যাওনি। তারওপর সকালে ইলিশ মাছের কাটাও তুমি খেয়ে ফেলেছো। এই ঘটনা যে আজই হয়েছে এমনটা নয়। এমন ঘটনা এর আগেও বহুবার ঘটেছে। তবে আমি ব্যাপারে নজরে নেইনি। কিন্তু আর না। আমি চুপ থাকলে একটা সময় আমার অস্তিত্ব-ই বিলীন হয়ে যাবে। আমার অধিকার আমাকেই আদায় করে নিতে হবে। তাই আমি আবার সাত দফা দাবি তুলে ধরলাম। এক, আমাকে প্রতিদিন সকালে ও রাতে এক বাটি ভরপুর দুধ দিতে হবে। দুই, মাছ তোমার কাটা আমার। তিন, প্রতি শুক্রবার আমাকে নিয়ে ভ্রমণে যেতে হবে। সপ্তাহে একদিন একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। চার, পাশের বাসার জেসির সাথে দীর্ঘ ১০০ ঘণ্টা ধরে আমার প্রেম চলছে। অতি শীঘ্রই তার সাথে আমার বিবাহ করাতে হবে। পাঁচ, জেসির ভরণপোষণের সব দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। ছয়, আমার ও জেসির জন্য উন্নতমানের নতুন বাসা বানাতে হবে। সাত, দাবিগুলো অবশ্যই মানতে হবে। এই দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত আমি হরতাল ঘোষণা করলাম। কোনো কাজ আমি ঠিকমতো করবো না।
ইতি
তোমার একমাত্র টাফি।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম টাফির দিকে। একটা বিড়ালের এত বড় সাহস যে আমাকে সাত দফা দাবি মানার প্রস্তাব দেয়! আমি রেগেমেগে বললাম, “তোর কি মনে হয় আমি এগুলো মানবো?”
– না মানলে আমি কাজও করবো না।
– তোকে করতে হবে না। আমি আজই আরেকটা বিড়াল আনবো। তোকে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছি তো তাই এতো সাহস হয়েছে।
টাফি নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ভান ধরলো। আমি রেগেমেগে অন্য শার্ট পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কতবড় স্পর্ধা! আমার খেয়ে আমাকেই হুমকি দেয়। অফিসে এসে কাজকর্ম শেষে বিকালে পশুপাখির দোকানে এলাম। একটা ভালো দেখে বিড়াল কিনলাম। তারপর ঘরে এলাম। নতুন বিড়ালের নাম দিলাম সাফি। টাফি চুপচাপ শুয়ে আছে। আমি সাফিকে খুব সুন্দর করে গোসল করালাম। তারপর দুধ দিয়ে নিজে খেতে বসলাম। কিন্তু তরকারিতে হাত দিতেই রুশোর দলবলের ছুটাছুটি দেখে খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেল। আমি তাতক্ষণিক সাফিকে ডাক দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে ইঁদুর গুলো পালিয়েছে। অতঃপর না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে মিয়াও মিয়াও শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি উঠে পড়লাম।
শব্দ অনুসরণ করে সামনে গেলাম। দৃশ্যটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাফিকে ঘিরে ধরেছে রুশো ও তার দলবল। সাফি যেন তাদের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছে। কেউ সাফির লেজ টানছে তো কেউ কান। এতগুলো ইঁদুরের সামনে একটা বিড়াল অসহায়-ই হবে। তবে আমার ঘরে এতগুলো ইঁদুর থাকে না। রুশোর দলে দশটা ইঁদুর আছে। আমি একদিন দেখে গুনেছিলাম। তাহলে আজ এতগুলো কোত্থেকে এলো? নিশ্চয়ই আশপাশ থেকে ভাড়া করে এনেছে। “একতাই বল” এই প্রবাদটি এখন ইঁদুররাও বুঝতে শিখেছে। অসহায় সাফি কিছুক্ষণ পরপর মিয়াও মিয়াও করে ইঁদুরে গুলোর কাছে মাফ চাচ্ছে। বলছে সে তাদের কথামতো চলবে। বুঝলাম যে রুশোর দলকে দমিয়ে রাখতে হলে টাফিকেই লাগবে। আমি চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এই এলাকায় একজন দুধওয়ালা আছে। যে প্রতিদিন সকালে ক্রেতাদেরকে দুধ দিয়ে যায়। আমিও আগে তার একজন ক্রেতা ছিলাম। তবে আমি গত সপ্তাহে নিষেধ করে দিয়েছিলাম। কারণ দুধ আমার হজম হয় না। তবে এখন দুধ লাগবে। টাফির শর্ত আমাকে মানতেই হবে। নয়তো এই ঘরে থাকা যাবে না। ভাড়া কম, সারাক্ষণ পানি‚ নিরাপদ আবাসিক এলাকা, অফিসের সন্নিকটে, দূষণ মুক্ত পরিবেশ সব মিলিয়ে এত সুবিধা সম্পন্ন বাড়ি অত্র এলাকায় আর খুঁজে পাইনি। অতএব বাসা ছাড়া যাবে না। আমি আজ তাড়াতাড়ি উঠলাম। গেটের সামনে দাঁড়ালাম। দুধওয়ালা আসতেই তার থেকে দুধ নিয়ে জানিয়ে দিলাম আগামীকাল থেকে যেন প্রতিদিন দুধ দিয়ে যায়। আকি দুধ নিয়ে টাফির কাছে এলাম। আমার হাতে দুধের বাটি দেখে টাফি বিজয়ের হাসি দিলো। মনে মনে বেশ রাগ উঠলেও আমি নিজেকে সংযত করলাম।
– তোর সব দাবি আমি মেনে নিলাম। তবে আজই রুশোর দলকে আমার ঘর থেকে বিতাড়িত করবি। টাফি তার কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখানে দস্তখত করো।” আমার আর কত অবনতি হবে? শেষমেষ একটা বিড়ালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হচ্ছে। আমি সই করে দিলাম। তবে মনে মনে একটা নকশা আঁকলাম।
নীল নকশা। যার মাধ্যমে রুশোর দলবল সহ টাফির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো। দুধ খেয়েই টাফি তার বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ঘরের আনাচেকানাচে ঘুরতে লাগল আর মিয়াও মিয়াও করতে লাগল। চিতা বাঘ এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগের গর্জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তেমনই টাফির মিয়াও আর বাকি বিড়ালের মিয়াও শব্দের মাঝেও পার্থক্য আছে। আমি হালকা নাস্তা করে বের হচ্ছি এমন সময় টাফি বলল, “জেসির সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারটা মনে আছে তো?” আমি মাথা নাড়লাম। নামতে নামতে ভাবতে লাগলাম বিড়ালও প্রেম বুঝে? হ্যাঁ, বুঝতেই পারে। তাদেরও তো মন আছে। আর মন থাকলে অনুভূতিও আছে। আর যেখানে অনুভূতি সেখানে প্রেম থাকবেই। রাতে বাসায় এসে ঘরের দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঘরে কমপক্ষে দুইশত বিড়াল। এটা ঘর নয় যেন বিড়ালের আস্তানা।
– এসব কি টাফি?
– আমাদের মিটিং চলছে। তুমি একটু পরে এসো।
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিছু বলতেই যাব। কিন্তু এতগুলো বিড়ালের সামনে নিজেকে সাফির মতো অসহায় মনে হতে লাগল। অনেকগুলো ইঁদুরের সামনে যেমন ওকে অসহায় দেখেছিলাম। তেমনই অসহায়ত্ব ভাবটা নিজের মধ্যে কাজ করছে। বাম পাশে কিছু কালো বিড়াল দেখে তো মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়তে লাগলাম। বুঝলাম যে এখন বিড়ালদেরও দলবল আছে। আমিও কতবড় বোকা, যেখানে ইঁদুরদের দলবল থাকতে পারে সেখানে বিড়ালদের থাকবে না কেন? উপলব্ধি করলাম যে, আমি মনে মনে যে নীল নকশা এঁকেছি। তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমাকে টাফির সব প্রস্তাবই মেনে নিতে হবে। হায়রে জীবন!
অনেক কষ্টে জেসির মালিক নূরীর সাথে বন্ধুত্ব করলাম। মেয়েটা অত্যন্ত ভাবওয়ালী ও ন্যাকা। কিন্তু কিছু করার নেই। টাফির বিয়ে জেসির সাথে দিতে হলে নূরীর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হবে। বন্ধুত্বকে বাড়ানোর জন্য মাঝেমাঝে ছাদে বসে দুজনে আড্ডা দেই। তখন ছাদের এক পাশে জেসি ও টাফি খেলা করে। খেলা বললে ভুল হবে। মূলত তারা রোমান্স করে। এমনকি একে অপরকে চুমোও দেয়।
নূরী এসব দেখে হাসে আর বলে কি সুন্দর খেলে ওরা তাই না? অথচ এমনটা যদি মানুষ করতো তবে সমাজ থেকেই বহিঃস্কৃত করা হতো। মাঝেমাঝে আমি টাফিকে বলি, এভাবে সবার সামনে রোমান্স করার দরকার কি? জবাবে টাফি বলে, “যারা আমাদের অনুভূতি বুঝে না। তাদের কাছে এটা রোমান্স নয়। অতএব তুমি চুপ থাকো।” আমিও চুপ থাকি। আমার ঘরে ইঁদুরের উত্তাপ নেই বললেই চলে। সাফিকে আমি আবার সেই দোকানে ফেরত দিয়ে এসেছি। যদিও এতে আমার কিছু লোকসান হয়েছে। তবুও ভালো। টাফির সাত দফা দাবির সবই মানা হয়েছে। শুধু জেসির সাথে ওর বিয়ের ব্যাপারটা বাদে। আসলে তেমন কোনো সুযোগ পাচ্ছি না নূরীকে এই ব্যাপারে বলার। এক রাতে আমি পানি খেতে উঠলাম। তখন টাফি ও রুশোকে একত্রে বৈঠক করতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
– দেখেন বিড়াল সর্দার টাফি, আপনার কথায় আমরা আর কাপড়চোপড় কাটি না। কিন্তু আমাদের দাঁত তো কুট কুট করে। এভাবে আর কত?
– আমার বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর তোরা আবার তোদের কাজ শুরু করিস।
– বিয়ের দাওয়াত দিবেন কিন্তু। একশ গজ কাপড় কাটবো সেদিন।
– আচ্ছা কাটিস।
আমি চুপচাপ নিজ রুমে চলে এলাম। আমি সামান্য একটা বিড়ালের ফাঁদে আটকে আছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে। বিড়াল এত চালাক হলো কিভাবে? কিন্তু এর থেকে বের হওয়ার উপায় পাচ্ছি না। অন্য বিড়াল এনেও লাভ নেই। রুশোর সামনে টিকবে না। আর বাড়ি ছাড়লে নিজেরই ক্ষতি। কি যে করি!
টাফির ভাগ্য যেন সোনায় সোহাগা। একদিন নূরী নিজ থেকেই এসে তার জেসির সাথে আমার টাফির বিয়ের কথা বলল। আমি তো নেচে নেচে রাজি হয়ে গেলাম। ষষ্ঠ দাবি অনুযায়ী একটা টাফি-জেসির জন্য উন্নতমানের ঘর বানালাম। তারপর তাদের বিয়ে দিলাম। এই পৃথিবীতে বউ পাগলা শুধু মানুষই নয়‚ বিড়ালও। বিয়ের পর জেসির সাথে নূরীর বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাফি। কেননা জেসি তার মালিক নূরীকে ছাড়া থাকবে না। আর জেসিকে ছাড়া টাফি থাকবে না। মায়ার বাধনে সবাই জড়িয়ে গেল। আমি অবশ্য মনে মনে খুশিই হয়েছি। টাফির অত্যাচার থেকে তো বেঁচেছি। আমি রাতে বাসায় ফিরলাম। ঘরে প্রবেশ করে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ আকাশে। অজস্র ইঁদুর আমার সামনে উপস্থিত। আমাকে দেখে রুশো এগিয়ে এসে একটা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“প্রতিদিন আমরা কাপড় কাটবো। যদি বাধা দেন তাহলে খুঁজে খুঁজে টাকা কাটবো। সিদ্ধান্ত আপনার। কোনটা বাঁচাবেন, টাকা নাকি কাপড়?” আমি অসহায়ের মতো রুশো বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে? অতঃপর রুশো বাহিনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলাম। পরেরদিন সকালে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিছু পুরানো কাপড় কিনতে হবে। নয়তো ওরা টাকা ছিঁড়ে ফেলবে। নূরীর জানালার সামনে টাফি-জেসিকে দেখতে পেলাম। খুব রোমাঞ্চকর ভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গড়াগড়ি করছে। ঈর্ষায় আমার গা জ্বলে উঠলো। নিজের কাজ হতেই টাফিও বেঈমানী করলো। দুনিয়াটা স্বার্থপরের।