কাজল চোখের পরিণীতা

কাজল চোখের পরিণীতা

সকালের স্নিগ্ধ রোদের আলোয় বাড়ির উঠোনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল আয়েশা। মেয়েটা দেখতে একটু শ্যাম বর্ণের হলেও চোখে হালকা কাজল, কপালে লাল টিপ কিংবা চুলে সামান্য পরিমাণ তেল মাখলে মেয়েটাকে দেখতে ভীষণ মায়াবী লাগে। এক কথায় মায়াবতী। ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন।

“বলছি, তোর চুল আঁচড়ানো হয়নি এখনও?”
“এইতো আম্মা হয়ে গেছে।”
আজকে শহর থেকে একদল মানুষ আসবে আয়েশাকে দেখতে। একদল মানুষ বলতে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আয়েশার মা মুখে সামান্য হাসি নিয়ে আয়েশার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি গো, মুখটা অত গম্ভীর কেন তোমার?”

আয়েশার মায়ের নাম আসমা বেগম, আর বাবার নাম আব্দুল বারেক। গ্রামে ছোটখাটো একটা মুদি দোকান আছে উনার। চাল, ডাল, তেল, লবণ ইত্যাদির। আসমা বেগমের কথা শুনে বারেক সাহেব কিছু বললেন না। চুপ করে আস্ত একটা পান মুখে দিয়ে চিবুতে শুরু করলেন।

“চুপ করেই থাকবে নাকি কিছু বলবে?”
“কি বলব?”
“ও মা, কিছুই বলার নেই বুঝি তোমার?”

বারেক সাহেবের মুখে একটা দ্বিধাদ্বন্দের ছাপ ভেসে উঠেছে সেটা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করলেন আসমা বেগম। কেন এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তা আসমা বেগম নিজেও বেশ ভালো করেই জানেন। “বলছি, আল্লাহর উপরে একটু ভরসা রাখ।”

বারেক সাহেব মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। মেয়েটা শ্যাম বর্ণের হওয়াতে তাকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় পড়ে থাকেন বারেক সাহেব। আসমা বেগমও ভীষণ চিন্তা করেন, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেন না। এর আগেও পাঁচবার পাত্রপক্ষ আয়েশাকে দেখতে এসেছিল, কিন্তু মেয়েটা একটু শ্যাম বর্ণের হওয়াতে সবাই-ই না করে দিয়েছে। একজন যদিও রাজী হয়েছিল কিন্তু সেই ছেলের পরিবার যৌতুক হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবী করেছিলেন। বারেক সাহেবের মতো মানুষের পক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। শেষ সম্বল বলতে বাপের দেয়া ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। “আয়েশার মা, কই গো?” আসমা বেগম রান্নাঘর থেকেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, “এইতো আমি, রান্নাঘরে।” শহর থেকে মানুষ আসবে বলে আজকে আসমা বেগম ভালোমন্দ রান্না করছেন। পোলাও, কোরমা, সেমাই সাথে আরও অনেক সুস্বাদু খাবার।

“ওরা কিন্তু প্রায় চলে এসেছে।” ওরা চলে এসেছে শুনে আসমা বেগম দৌড়ে আয়েশার রুমে চলে গেলেন।
“তুই রেডি তো মা?” আয়েশা মুচকি হাসি দিয়ে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ মা, আমি রেডি।”

মেয়েটাও ভীষণ চিন্তায় পড়ে থাকে সবসময়। চিন্তাটা তার নিজেকে নিয়ে না, বাবা-মাকে নিয়ে। বিয়ে হোক বা না হোক তা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই আয়েশার। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে তার বাবা-মাকে ঘিরে। তাদের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, উদাসীন ভাব সবকিছু আর সইতে করতে পারছে না আয়েশা। বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কান্না করছে আর উপরওয়ালাকে বলছে, কেন উপরওয়ালা তার গায়ের রঙ এমন কালো করে পৃথিবীতে পাঠালেন! কেন তাকে এত অবহেলা, এত যন্ত্রণা নির্দ্বিধায় সহ্য করে যেতে হচ্ছে! প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না আয়েশা। তাই চোখের জলেই মনের সব কষ্টগুলোকে মাটিতে ঝেড়ে ফেলে দেয় সে।

কিছুক্ষণ পরই পাত্রপক্ষ বাসায় চলে এলো। তারা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে খাওয়া-দাওয়া করে নিলো। তারপর মেয়ে নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলো। আয়েশা ঘোমটার আড়াল থেকে বারবার ছেলেটাকে দেখছে। ছেলেটা যে শহুরে পরিবেশের আধুনিক ধাঁচে বড় হয়েছে সেটা তার কথাবার্তা, চলাফেরা দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। ছেলেটা দেখতেও বেশ সুদর্শন। আয়েশা মনে মনে ভাবছে, নাহ এটাও হবে না। এত সুদর্শন ছেলে কখনও আমার মতো কালো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে না। “আমি মেয়ের সাথে আলাদাভাবে একটু কথা বলতে চাই।”

আলাদাভাবে কথা বলতে চায় শুনেই আয়েশার বুকটা ভয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। আয়েশা মনে মনে ভাবতে লাগল, ভিতরে গিয়ে কী তাহলে আমার গায়ের রঙের জন্য আমাকে কটু কথা শুনাবে ছেলেটা?? আয়েশা আল্লাহ আল্লাহ করছে যাতে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য কেউ অনুমতি না দেয়। “আচ্ছা বাবা যাও।” বারেক সাহেব মুখে একরাশ হাসি নিয়ে ছেলেকে কথাটা বললেন। আয়েশা ভয়ে কাঁপছে। আলাদা রুমে গিয়ে ছেলেটা এক দৃষ্টিতে আয়েশার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা আয়েশার মোটেও ভালো লাগছে না। ছেলেটা হয়তো তার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটা মেয়ে এতটা কালো কীভাবে হতে পারে?? আরও বহু চিন্তাভাবনা ঘুরছে আয়েশার মাথায়।

“আমি ফারাবী।”
“আমি আয়েশা।” ছেলেটার নামটা বেশ সুন্দর। ফারাবী।

“ফারাবী তো মেয়েদের নাম হয়।” ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে আয়েশার দিকে তাকালো। আয়েশা ভাবছে, বিয়েটা যেহেতু হবেই না সেহেতু একটু মজা করা যাক।
“আয়েশা, নামটা কে রেখেছে?”
“জন্মের পর আমি কি দেখেছি কে রেখেছে?”
“শুনেছেন তো নিশ্চয়ই যে কে রেখেছে।”
“আম্মা রেখেছেন।”
“এত্ত ক্ষেত টাইপের নাম কেউ রাখে এ যুগে?” আয়েশা ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমার বুলেট দিয়ে কিনা আমাকেই গুলি করা হচ্ছে!

“জীবনে প্রেম করেছেন কখনও?”
“কালো মেয়ের সাথে কে প্রেম করবে শুনি?”
“নিজেকে নিয়ে খুব ঘৃণা?”
“কিছুটা।”
ছেলেটা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল,
“ছেলে-মেয়ে সাদা হোক কিংবা কালো, বাবা-মার কাছে তারাই রাজপুত্র আর রাজকন্যা।”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“আপনার ছেলে যদি কালো হয় তাহলে কি তাকে ফেলে দিবেন?”
“অবশ্যই না।”
“তাহলে নিজেকে নিয়ে এত অবজ্ঞা কেন?”

আয়েশা কোনো কথা বলছে না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
“সবাই-ই জ্ঞান দিতে পারে।” “বুঝলাম না কী বললেন!” আয়েশা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি পারবেন আমার মতো কোনো একজন কালো মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করতে?” আয়েশা কথা শুনে ছেলেটা খানিকটা চুপসে গেলো। তা দেখে আয়েশা মুচকি হাসে।

“এই কথাটা বললেই সেইম আপনার মতোই সবার একইরকম চেহারা হয়ে যায়।” ছেলেটা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।
“আচ্ছা আপনি কি চোখে কাজল দিয়েছেন?”
“অল্প একটু দিয়েছি।”
“কাজলে কিন্তু আমার বেশ দুর্বলতা।”
“মানে?”
“মানে কাজল আমার খুব ভালো লাগে।”
“তারমানে কি, রাস্তায় যেসকল মেয়েরা কাজল দিয়ে বের হয় তাদের দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকেন?” আয়েশার কথা শুনে ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।

“ক্যারেক্টারে সমস্যা আছে নাকি বস?” ছেলেটা আয়েশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“আমার ক্যারেক্টারে সমস্যা মনে হচ্ছে আপনার?”
“না, তা অবশ্য হচ্ছে না। তবে একটা ঘাপলা তো অবশ্যই আছে।”
“কিসের ঘাপলা?”
“কাজল দেওয়া মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকেন।”
“আমি কি একবারও এ কথা বলেছি?”
“না তা বলেননি যদিও।”
“নিজের যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছেন।”
“হিহিহি অনেক আগের স্বভাব।”

আয়েশা ভাবছে, এত রাগাতে চাইছি তাও ছেলেটার রাগছে না। অন্যকেউ হলে এতক্ষণে দু’চার কথা শুনিয়ে চলে যেত।

“আচ্ছা চলুন, সবার সামনে যাই।”
“হ্যাঁ, চলুন।”
“ভালো থাকবেন। আর দোআ করি, ভালো একটা স্বামী পান।”
“কেন আমায় বিয়ে করবেন না?”
“উহু, আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না।”
“কেন সম্ভব নয়?”
“আপনি আমার থেকেও ভালো কাউকে আশা করেন।”

ছেলেটার কথা শুনে আয়েশা হাসছে। নিচে যাওয়ার পর সবাই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশা ঘোমটার আড়ালে চুপ করে হাসছে। “বাবা, মেয়ে পছন্দ হয়েছে আমার। এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করতে চাই।” “আলহামদুলিল্লাহ। সামনের শুক্রবারেই তাহলে কাবিন।”

ছেলে আর ছেলের বাবার কথা শুনে আয়েশা বড় বড় চোখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিমিষেই তার হাসি বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে গেলো। কথাগুলো তার বিশ্বাস হচ্ছে না একটুও। সাথে সাথে সে মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকাতেই আয়েশা দেখতে পেল তার আম্মা হাতে ঝাড়ু নিয়ে তার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। “ওরে হারামজাদী রে, প্রত্যেকদিন সকালে খোয়াব দেখবা আর ‘বিয়া করতাম না বিয়া করতাম না’ কইয়া চিল্লাইবা, হ্যাঁ? এইবার খালি ডাব্বা মারো পরিক্ষায়, উষ্টা দিয়া ছয়তলা ছাদেত্তে তোরে ফালায় দিমু।” “আম্মায়ায়ায়ায়া!”

“ঝাড়ুর বারি না খাইতে উঠ হারামজাদী। সকাল ১০ টা বাজে। তোর বাপে আজকা বাইত আহুক, সাতদিনের ভিতরে তোর বিয়া ঠিক করতাছি আমি খাড়া।” কথাটা বলেই আয়েশার আম্মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আয়েশা পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এটা কী তাহলে স্বপ্ন ছিল? তড়িঘড়ি করে আয়েশা বিছানা থেকে উঠে গেল। আর কিছুক্ষণ বিছানায় থাকলে নির্ঘাত ঝাড়ুর বারি খেতে হবে তাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত