পার্কে ঢুকে নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলাম, আসলে নিরিবিলি নয়, আমি আসলে একজনের খোঁজে এখানে এসেছি। শুনেছি রোজ বিকেলে সে এই পার্কে এসে সময় কাটায়, তবে একা একা। আমি শুধু তার ছবিই দেখেছি আর নাম জেনেছি, বাকিটা আমাকে পরে জানানো হবে বলেছে।
যথারীতি আমার চোখ কাঙ্ক্ষিত মানুষকে খুঁজতে শুরু করে৷ কিছুসময় পর পেয়েও যায়, হালকা বাদামী টিশার্ট আর নীলচে জিন্স পড়া ছেলেটা, ওই যে একা একা বসে মাঠের বাচ্চাদের খেলা দেখছে, সেই আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি, যার জন্য আমাকে আজ এখানে আসতে হয়েছে, অনেকটা জোর করেই পাঠানো হয়েছে। ছেলেটা যে বেঞ্চে বসে আছে, সেটা অনেক বড় আর সে বসে আছে এক কোণায়। আমি গিয়ে বেঞ্চের আরেক কোণায় বসলাম, যদিও একেবারে কোণায় না, একটু এগিয়ে যাতে ছেলেটার সাথে কথা বলার সুযোগ থাকে। আমি পাশে গিয়ে বসেছি, এটা নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বোঝা যাচ্ছে সে মেয়েদের বিষয়ে অতটা কিউরিয়াস নয়, তা সে সুন্দরী হোক বা না হোক। ” ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, তাই না? ” একটু জোরেই বললাম, যাতে ছেলেটার কানে যায়। ” আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন? ” অনেকক্ষণ পরে উত্তর আসে।
– এখানে আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না, আর খেলা তো আপনিই দেখছেন।
– ওহ, হুম।
– আর তাছাড়া অনেকক্ষণ দুইজন মানুষ বসে আছে কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, ব্যাপারটা ঠিক বাঙালি জাতিকে অসম্মান করা হয়।
– (হালকা হাসি দিয়ে চুপ করে যায়।)
নিঃসন্দেহে হাসি সুন্দর, শুনেছি যার হাসি সুন্দর হয়, সে সুন্দর মনের মানুষ হয়। তবে আমি হাসির সাথে সাথে চোখের ভাষা পড়ায় বিশ্বাসী, কিন্তু চোখের দিক তাকাতে আমার দ্বিধাবোধ হচ্ছে। অনেকক্ষণ সে চুপ করে আছে, আমিও কথা বলি নি। কিছুক্ষণ পর বাদামওয়ালাকে দেখলাম, ডাক দিয়ে কিছু বাদাম বুট কিনলাম। খেতে খেতে খেলা দেখছিলাম, হঠাৎ করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম, সে কিছুটা অবাক হয়ে ইতস্তত ভাব নিয়ে তাকালো। স্বাভাবিক, কথায় আছে, রাস্তায় কারো দেয়া জিনিস খাবেন না, বিপদ হতে পারে। এটাকে আবার মজা করে বলা হয়েছে, বাসায় নিয়ে খাবেন, ঘুম ভাল হবে। মানুষ পারেও বটে, এসব ভেবে আবার বাদামের প্যাকেট নিজের দিকে নিলাম।
– কিছু মনে করবেন না, আমি আবার পাশে কেউ থাকলে তাকে না দিয়ে একা একা খেতে পারি না।
– নাহ ঠিকাছে।
– এখন মনে করতেই পারেন, অজ্ঞানপার্টির লোক, আপনাকে অজ্ঞান করে সব নিয়ে পালাবো।
– আমার কাছে নেয়ার মত কিছু নেই। (মৃদু হাসি)
– (আপনার হাসিই তো সবচেয়ে মূল্যবান) সে কি বলেন? আপনি নিজেই তো মূল্যবান।
– কিভাবে?
– (একটু কাছে এগিয়ে বসলাম, বাদামের প্যাকেট আবার এগিয়ে দিলাম) কিভাবে! জানেন না মনে হয়?
– (বাদাম নিলো সে এবার) আমার কাছে কম দামি মোবাইল, ঘড়ি আর মানিব্যাগে অল্প কিছু টাকা আছে।
– আপনি এখানে রোজ আসেন, তাই না?
– হুম, বিকেলে আমার এখানে বসে বসে খেলা দেখতে আর তারপর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বাসায় যেতে বেশ লাগে।
– এজন্যই বেশি মূল্যবান জিনিস সাথে রাখেন না, যদি অজ্ঞান পার্টি ধরে। হাহাহ!
– নাহ, তা নয়, আমার তেমন মূল্যবান কিছু নেই।
– তা কি করে হয়, আপনার হার্ট, লাঞ্চ, কিডনি, চোখ এগুলো কি মূল্যবান না?
– ওহ, এগুলো? হুম মূল্যবান।
– এগুলো তো চুরি হতে পারে।
– অত ভয় নেই।
– ও হ্যাঁ, আমি নীলাম্বরী। আপনি? এতক্ষণ কথা বললাম অথচ কেউ কারো নাম জানিনা।
– আমি শুভ্র, শুভ্র সরকার।
– ” শুভ্র গেছে তেঁতুল বনে ”
– মানে?
– আপনি কোনোদিন তেঁতুল বনে গেছেন?
– তেঁতুল বনে? কেন?
– হুমায়ুন আহমেদ এর একটা লেখা আছে ” শুভ্র গেছে তেঁতুল বনে “, ভাবলাম আপনি সেই শুভ্র কিনা?
– না না, আমি কখনো তেঁতুল বনে যাই নি, আর হুমায়ুন স্যারের সেই শুভ্র আমি না।
– তাইলেই হলো!
– কি হলো?
– আচ্ছা আপনার জিএফ আছে?
– আমি দেখতে কি রাজপুত্র নাকি যে জিএফ থাকবে? শুনেছি জিএফ থাকে বড়লোকদের ছেলেদের।
– তাইলে আপনার কি আছে? বউ?
– হাহাহা, আপনি খুব মজার তো। আপনার বিএফ আছে?
– হুমমম।
– আপনি সুন্দরী, বিএফ থাকাই স্বাভাবিক।
– কেন? যারা অসুন্দর তাদের বুঝি ভালবাসার অধিকার নেই, নাকি আপনি কোন অসুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবেন না।
– রাগ করলেন নাকি? তবে সুন্দরীদের রাগ করাটা একটা গুণ।
– (এ তো আমার উপর পল্টি নিচ্ছে, নাহ মাথা গরম করলে কাজ হবে না) নাহ, রাগের কি আছে!
– আসলে অধিকাংশ সুন্দরী মেয়েদের প্রেমিকা থাকে, এটা তাদের জিজ্ঞাসা করতে নেই।
– তার মানে আপনার বউ যদি সুন্দরী হয় তবে ভেবে নিবেন তার প্রেমিকা ছিল?
– অসম্ভব কিছু নয়, তবে এতে আমার আপত্তি নেই, শুধু বিয়ের পর পরকীয়া না করলেই হবে।
– ভাল।
– হুম আপনি এখানে নতুন?
– নতুন কেন হবো, এ শহর আমার চেনা।
– শহর না, আপনি এই পার্কে মনে হয় আগে তেমন আসেন নি, মানে আগে দেখি নি।
– ওহ, হুম, আজ নিয়ে দ্বিতীয় দিন হবে (এরপর আর নাও আসতে পারি)
– হুমম! (কিছু সময় নিরবতা)রবি মহারাজ পশ্চিমে গিয়ে রক্তিম দেবকে প্রদক্ষিণে পাঠিয়ে দিচ্ছে…..
– মানে?
– মানে সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত গিয়ে গোধুলী আলোয় ছেয়ে গেছে। ফেরার সময় হয়ে এলো।
– হুম, বাচ্চারাও তাদের খেলার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিচ্ছে।
– আজ তবে ওঠা যাক, স্রষ্টা চাইলে আবার দেখা হতেও পারে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে শুভ্র নিজের পথে হাঁটতে শুরু করে। শুভ্ররা কি এমনই হয়, কিছুটা আত্মভোলা আপন মনের উদাস, কিংবা নিজের মধ্যে অন্য জগৎ তৈরি করা ব্যক্তি। হুমায়ুন আহমেদ ঠিক এই কারণে শুভ্র নাম নিয়ে গল্প লিখে গেছেন। আসলেই অদ্ভুত, যদিও এর আগে শুভ্র নামের কারো সাথে এভাবে কথা বা আলাপ হয় নি। শুভ্র এতক্ষণে দৃষ্টির সীমানা পার করে গেছে আর আমি কেন জানি না তার পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর বাদাম বুট খাচ্ছি। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ে অবন্তিকার বজ্রের মত আগমণে, কোথা থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘাড়ে এসে পড়লো, আরেকটু অন্ধকার হলে হয়তো ভূত ভেবে দৌড়ে পালাতাম। যদিও ওকে দেখতে ভূতের মতো নয় আর আমিও ভূত তেমন ভয় পাই না।
– কিরে ছেলে কেমন দেখলি? (অবন্তী)
– ভালোই, চলবে (আমি)
– চলবে বললে হবে না, তুই যদি এমন বলিস তো আমি সাহস পাবো না।
– আরে খারাপ কই বললাম, চলবে মানে ভালই, বিয়ে করে নিতে পারিস।
– সব দিক দিয়ে কেমন লাগলো?
– দেখতে শুনতে ছবিতে যেমন ছিলো তার থেকে ভালো। আচরণ ভদ্র, ব্যবহার নম্র, আর তুই যে স্বার্থের জন্য এখানে আমাকে পাঠিয়েছিস, সেটাও পজিটিভ।
– মানে? আমি কি স্বার্থের জন্য পাঠাইছি তোকে?
– দেখ, আমি তোর থেকে বেশি সুন্দরী না, তাও তুই ভাবিস, আর আমাকে পাঠিয়েছিস ছেলে সুন্দরী দেখলে ফ্লার্ট করে কি না দেখার জন্য!
– আসলে তা না রে!
– দেখ অবন্তী, তোকে আমি চিনি ১৫ বছরেরও বেশি, আমাকে চেনাস না।
– আরে তুই ভুল ভাবছিস!
– তবে যাই হোক ছেলে কিন্তু হার্ড কোটেড,৷ বিয়ের পর উল্টাপাল্টা করলে টাইট দিতে জানে।
– তবে সব দিক দিয়ে পাকা, তাই তো, আমি এ সম্বন্ধে রাজি হতেই পারি?
– যেহেতু ছেলের গার্লফ্রেন্ড নাই, রাজি হয়ে যা, তোরও তো এ জন্মে কাউকে মনে ধরলো না, বিয়ের পর দেখ বরটাকে মনে ধারণ করতে পারিস কি না! (বলে বাদামের প্যাকেট অবন্তিকার হাতে দিয়ে দৌড়ের প্রস্তুতি নিলাম, কারণ এখনই সে আমার উপর চড়াও হবে আমি যা বলেছি তার জন্য)
– কি বললি? নীলু, দাঁড়া, দাঁড়া বলছি….
এবার আসা যাক আসল ঘটনায়, অবন্তিকাকে আমি চিনি ক্লাস ফোর থেকে, আমরা একই স্কুলে আর কলেজে পড়েছি। যদিও আমাদের ক্যাম্পাস আলাদা তাও আমাদের বন্ধুত্ব ভাঙে নি। আর যে ছেলেটার সাথে পার্কে দেখা করতে আসলাম, উনি শুভ্র, যার সাথে অবন্তীর বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অবন্তী তার পরিবার থেকে আমাকে বেশি ভরসা করে৷ এ নিয়ে এটা তার ছয় নম্বর সম্বন্ধ, আগের পাঁচটা সম্বন্ধে সে রাজি হয় নি কারণ আমার অমত ছিলো। প্রতিটা সম্বন্ধ এলে ছেলেপক্ষ মেয়েকে দেখার আগেই অবন্তী কোন না কোন ভাবে আমাকে দিয়ে ছেলেটাকে টেস্ট করতে পাঠায়, পরপর চারজনকে টেস্ট করার পর আমি বিরক্ত হয়ে পরে আর এমন করতে নারাজ হই, তাই পঞ্চম বার সে আমার বাড়িতে ছেলেকে পাঠায় ভুল ইনফরমেশন দিয়ে আর এই ষষ্ঠ বার পাঠায় আমাকে পার্কে, বলে কাজের জন্য দেখা করতে হবে। তবে আমার বান্ধবীকে তো আমি চিনি তাই ধরা সে খেয়ে গেছে। তবে শুভ্রকে আমার ভালই লেগেছে তাই আমি রাজি হয়েছি এ সম্বন্ধে।
এখন ছেলেপক্ষ দেখতে এলেই সব ফর্মালিটি করে হ্যাঁ বলে দিলে কাজ শেষ, আর অবন্তীকে দেখে তারা না বলতে পারবে না এটা নিশ্চিত। তবে আগের পাঁচজনের থেকে শুভ্রের সাথে হওয়া স্মৃতিটা বেশি মনে থাকবে, আর ভোলার উপায় কি? বিয়েতে বৌভাতে বা পরবর্তীতে বান্ধবীর সাথে দেখা হলেই সে বলবে, ” আরে আপনিই তো সে যার সাথে পার্কে দেখা হয়েছিলো “। একথা বলতে পারে নাও বলতে পারে আমার মনে হয়, কারণ সে আদৌও আমার দিকে তাকিয়ে চেহারা ভাল করে দেখেছে বলে আমার মনে হয় না। শুধু কণ্ঠস্বর মনে রাখতে পারলে সেটা ভিন্ন কথা। যাই হোক ঝামেলা গেছে এখন শুধু শুভ পরিণয়ের পালা।